৭ দিনের ব্যবধানে মৃত্যু বেড়েছে ৩৯ শতাংশ

গোলাম ওয়াদুদ
প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২১, ২৩: ৫২

ঢাকা: দ্বিতীয় ধাপে দেশে করোনা প্রকট আকার ধারণ করেছিল। রোজার ঈদের কয়েক দিন আগে থেকে কমতে থাকে করোনায় আক্রান্ত ও শনাক্তের সংখ্যা। তবে গত এক সপ্তাহে করোনায় মৃত্যু ও শনাক্ত ঊর্ধ্বগামী। বিশেষজ্ঞরা ঈদের আগে থেকে বলে আসছিলেন, ঈদ যাত্রার পর করোনা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। এখন সেই চিত্রই দেখা যাচ্ছে।

আজ বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আগের দিন এ সংখ্যা ছিল ৫০।

শুধু এ দুদিনে নয়, গত সাত দিন ধরেই ধারাবাহিকভাবে করোনায় মৃত্যু বাড়ছে। গত ১০ জুন করোনায় দেশে ৩৬ জনের মৃত্যু হয়। সে হিসেবে এক সপ্তাহের ব্যবধানে আজ ১৬ জুন করোনায় একদিনে মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ৩৯ শতাংশ।

স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে যেভাবে ঈদ যাত্রা করেছিল মানুষ, তাতে সে সময়ই এমন শঙ্কার কথা শুনিয়েছিলেন মহামারি বিশেষজ্ঞরা। শুধু এই সীমিত সময়ের জন্যই নয়, এ দেশের মানুষ সে অর্থে কখনোই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেনি। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্যরা এ নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলছেন, বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত নানা সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু সেসব আমলে নেওয়া হয়নি। প্রশাসনিকভাবে তেমন তৎপরতা দেখানো হয়নি। যে মাত্রার স্বাস্থ্য সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার ছিল, তা করা হয়নি। যতটুকু করা হয়েছে, প্রশাসনিক তৎপরতার অভাবে তাও মানেনি মানুষ।

এর ফল এখন ভোগ করতে হচ্ছে। গত সাত দিনের করোনা পরিস্থিতির দিকে তাকালেই বিষয়টি বোঝা যাবে। গত ১০ জুন দেশে একদিনে করোনায় মৃত্যু হয়েছিল ৩৬ জনের। পরদিন এই সংখ্যা বেড়ে ৪৩ জনে দাঁড়ায়। ১২ জুনে মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কমে ৩৯ হলেও পরদিন তা আবার বেড়ে ৪৭ জনে পৌঁছায়। ১৪ জুন মৃত্যু বেড়ে ৫৪ জনে দাঁড়ায়। আর গতকাল এ সংখ্যা আবার কিছুটা কমে ৫০–এ আসে, যার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু মৃত্যুর সংখ্যার দিকে তাকালে পরিস্থিতির ভয়াবহতা হয়তো বোঝা যাবে না। এই একই সময়ে দেশে করোনা শনাক্তের সংখ্যা বেড়েছে বলা যায় ধারাবাহিকভাবেই। দৈনিক সংক্রমণ সংখ্যা দু হাজারের কোটা পেরিয়েছিল আগেই। এখন এ সংখ্যা তিন হাজার পার হচ্ছে প্রতিদিনই। সাত দিন আগে দৈনিক শনাক্ত সংখ্যা আড়াই হাজার হলেও আজ বুধবার শনাক্ত সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ হাজার জন। এমন চলতে থাকলে সামনে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে প্রথম দিকে কঠোর লকডাউন (সরকারি ভাষায় চলাচলে বিধিনিষেধ) দিলেও ধীরে ধীরে তা শিথিল করা হয়। এখন দেশে চলছে ঢিলেঢালা বিধিনিষেধ। এ দফায় বিধিনিষেধ বাড়ানো হয়েছে এক মাস। নতুন ঘোষণায় বলা হয়েছে, সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করে খোলা থাকবে। সব পর্যটনকেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ থাকবে। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সেই গত বছর থেকেই চলছে সাধারণ ছুটি। নিত্যপণ্যের দোকান ও বাজার খোলা রয়েছে। এ ছাড়া বিয়ে, জন্মদিন, পিকনিকের মতো জনসমাগম হয়—এমন সামাজিক অনুষ্ঠান এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে। আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকানগুলো সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খাবার বিক্রি ও সরবরাহ করতে পারবে এবং আসনসংখ্যার অর্ধেক সেবাগ্রহীতাকে সেবা দিতে পারবে। গণপরিবহন স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচলের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।

স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে নাএই বিধিনিষেধের মধ্যেও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো কেন? কারণ, অসতর্কতা এবং অবহেলা। এই ঢিলেঢালা বিধিনিষেধ খাতায় থাকলেও আসলে বাস্তবে দেখা যায় না। স্বাস্থ্যবিধির কথা জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্নভাবে প্রচার করা হলেও তা যথাযথভাবে মেনে চলা হচ্ছে কিনা, তা দেখার কেউ নেই। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন হাটবাজার বা জনসমাগম স্থলে গিয়ে মাস্ক না পরার দায়ে বিভিন্ন মানুষকে জরিমানা করা হচ্ছে বটে। কিন্তু এটি বৃহত্তর পরিসরে তেমন প্রভাব ফেলতে পারছে না। সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে প্রায় দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু শপিংমলসহ বিভিন্ন জনসমাগমস্থল ঠিকই খোলা রাখা হয়েছে। যদিও করোনা নিয়ন্ত্রণে সফল অন্য দেশগুলো ঠিক বিপরীত কাজটি করেছে। নিত্যপণ্য ব্যতীত মার্কেট ও শপিংমলগুলো খোলার আগে তারা চেষ্টা করেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিতে। এর সুফলও তারা পেয়েছে। পেয়েছে কারণ, লকডাউন তুলে দেওয়ার লক্ষ্যে তারা কয়েকটি ধাপে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিল। আর তা কাগুজে ছিল না, ছিল কার্যক্ষেত্রে।

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তবে কী করা হচ্ছে? রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস এম আলমগীর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দেশের যে এলাকায় ১০ শতাংশের বেশি সংক্রমণ দেখা দেবে, সেখানেই লকডাউনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনকে। সরকার থেকে স্পষ্টভাবে এ কথা জানানো হয়েছে।’

স্থানীয় প্রশাসনের ওপর এমন নির্দেশনা থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। উচ্চ মহলের নির্দেশনা ছাড়া লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না তারা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হলেও কঠোর লকডাউনে যাচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন। কিছু কিছু সীমান্ত এলাকায় কঠোর লকডাউন আরোপ করা হলেও, তার অকার্যকারিতা করোনার নতুন এই ধরনের অন্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়া থেকেই বোঝা যায়। সীমান্ত এলাকা নয়—এমন কিছু এলাকায়ও এখন ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হচ্ছে। ফলে বিদ্যমান লকডাউন বা বিধিনিষেধের কার্যকারিতা নিয়ে স্বাভাবিক প্রশ্ন উঠছে।

করোনায় মৃতদের জন্য প্রতিনিয়তই এভাবে কবর খোড়া হচ্ছেএকই সঙ্গে বাড়ছে উদ্বেগ। রাজধানী ঢাকায় করোনাভাইরাসের আরেকটি ঢেউ আঘাত হানার আশঙ্কা এরই মধ্যে প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে গেলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সেটি কতটা সামাল দিতে পারবে, তা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট উদ্বেগ। এক মাস আগেও পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৭ শতাংশ ছিল। এখন এ হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের উত্তর এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলায় করোনাভাইরাসে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা এখনো ৪০ শতাংশের বেশি। মৃতের সংখ্যাও বাড়ছে সেসব জেলায়। গত ১৫ দিনে শুধু রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে প্রায় দেড় শ রোগী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। খুলনার অবস্থাও দিন দিন খারাপ হচ্ছে। আজ বুধবার জেলাটিতে নয়জন মারা গেছে। ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে সংক্রমণ বাড়ছে হু হু করে। এই পরিস্থিতিতেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া না গেলে ভয়াবহ সংকট দেখা দেবে। অর্থনীতিকে সচল রেখে স্বাস্থ্য সতর্কতা মেনে চলার মাধ্যমে কী করে করোনা মোকাবিলা করা যায়, তা বের করাই এখন সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত