Ajker Patrika

চলে গেলেন সন্‌জীদা খাতুন

ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা 
আপডেট : ২৫ মার্চ ২০২৫, ২৩: ২২
সন্‌জীদা খাতুন (জন্ম: ৪ এপ্রিল ১৯৩৩; মৃত্যু: ২৫ মার্চ ২০২৫)। ছবি: সংগৃহীত
সন্‌জীদা খাতুন (জন্ম: ৪ এপ্রিল ১৯৩৩; মৃত্যু: ২৫ মার্চ ২০২৫)। ছবি: সংগৃহীত

আজ মঙ্গলবার, বেলা তিনটা কুড়ির দিকে একটা ফোন এল। কালের কণ্ঠের অলকানন্দার ফোন। ও বলল, ‘সন্‌জীদা খাতুনও চলে গেলেন!’ মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। কিছু একটা বলে ওকে নিরস্ত করে হোয়াটসঅ্যাপে ‘হাসপাতাল ২৫’ নামের থ্রেডটির দিকে ভয়ে ভয়ে চোখ রাখি। হাসপাতালে তিনি কেমন আছেন, তা কাছের মানুষের জানানোর জন্য এই থ্রেড তৈরি করা হয়েছিল। নাহ্‌! সেখানে এ রকম কোনো দুঃসংবাদ নেই। একটু স্বস্তি পাই।

‘হাসপাতাল ২৫’ থ্রেড শঙ্কা দূর করলেও খচখচ করছিল মন। ফোন করি সন্‌জীদা আপার ঘনিষ্ঠ একজন, ফওজিয়া মান্নানকে। তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের ঘরে। তিনিও এ ব্যাপারে কিছু জানেন না। এরপর খুব বেশিক্ষণ যায়নি, বিকেল প্রায় ৪টার দিকে ‘হাসপাতাল ২৫’ থ্রেডে ভেসে ওঠে পুত্রবধূ শিল্পী লাইসা আহমদ লিসার একটি বাক্য: ‘মা দুপুর ৩টা ১০-এ চলে গেছেন।’ পাথরের চেয়ে ভারী হয়ে ওঠা বলে বোধ হয় এ রকম বাক্যকেই! চারদিক হঠাৎ করে শূন্য মনে হয়। আরমা দত্ত, শাহীন সামাদ, তানিয়া মান্নান, খায়রুল আনাম শাকিল, বুলবুল ইসলাম, মোমিনুল হক দুলু, শোয়েব আহমেদসহ হৃদয়ের পড়শিরা লিখতে থাকেন হোয়াটসঅ্যাপের সেই থ্রেডে। সন্‌জীদা খাতুনের ছেলে সাংবাদিক পার্থ তানভীর নভেদ লেখেন, ‘আপা মুক্তি নিয়েছেন, কাল বুধবার বেলা সাড়ে বারোটায় ছায়ানটে শেষ দেখা মিলবে।’

গানের মানুষ, প্রাণের মানুষ সন্‌জীদা খাতুন ছিলেন সেই প্রজন্মের শেষতম মহিরুহ, যে প্রজন্ম ভাষা ও সংস্কৃতিকে মহীয়ান করে তুলেছিল। সেই প্রজন্মের কথা বলা হচ্ছে, ‘যারা জীর্ণ জাতির বুকে জাগালো আশা, মৌন মলিন মুখে জাগালো ভাষা’। অনেকখানি বদলে যাওয়া এই সময়ে তাদের ত্যাগ ও সংগ্রামের কথা অনুভব করাও হয়তো কঠিন। সন্‌জীদা খাতুনরাই তো ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মানবতার জয়গান করেছিলেন। অখণ্ড পাকিস্তানের রাজনীতিতে তখনো উর্দুকে মহিমান্বিত করার পাঁয়তারা চলছে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রবীন্দ্রনাথকে অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের পরই অবশ্য ফয়সালা হয়ে গিয়েছিল, বাঙালি এগোবে ভাষা ও সংস্কৃতির পথ ধরে। ধর্ম যার যার, দেশ সবার—এই জায়গায় পৌঁছাতে পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ পথ। সেই পথের শুরুতে, সেই বায়ান্ন সালেই সন্‌জীদা খাতুনকে দেখা যায় আপন সংস্কৃতির পথে দৃপ্ত পদক্ষেপে হাঁটতে। বাবা কাজী মোতাহার হোসেনের সুযোগ্য কন্যা তিনি। নজরুলপ্রীতির সঙ্গে তখন যোগ হয়েছে রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীর সেই দ্রোহের কাল কাটিয়ে তাঁরা কয়েকজন মিলে তৈরি করলেন ছায়ানট। ‘বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন’কে এক করার কাজটি তাঁরা করেছেন।

সেই যে শুরু, এর পর থেকে এ ভূখণ্ডের সব আন্দোলনেই তাঁকে পাওয়া গিয়েছে। সেই ষাটের দশকেই এক সভায় বঙ্গবন্ধু তাঁকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাইতে বলেছিলেন। সেটাই পরে হয়ে ওঠে এই দেশের জাতীয় সংগীত।

রাজনীতি এগিয়েছে, সেই সঙ্গে এগিয়েছেন সন্‌জীদা খাতুন। তবে রাজনীতির পথে নয়, বরাবর ওই সংস্কৃতিতেই আস্থা তাঁর। মোখলেসুর রহমান সিধু ভাই, রোজ বু, ওয়াহিদুল হকসহ সবার কথাই লিখেছেন তিনি। খেয়াল করে দেখেছি, তাঁর লেখালেখিতে রয়েছে সমসাময়িক সবার প্রতি শ্রদ্ধার নিবেদন।

ছায়ানট, কণ্ঠশীলন, নালন্দা, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদসহ কত প্রতিষ্ঠানকে যে ছায়া দিয়েছেন তিনি, তার যেন ইয়ত্তা নেই।

খুব কাছে থেকে দেখেছি তাঁকে। আমাকে সযত্ন প্রশ্রয় দিয়েছেন। সবার সঙ্গে সহজে মিশতেন না। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমাকে ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’-এ নামিয়ে এনেছিলেন। একটা সময় প্রায় প্রতিদিন ফোন করে কথা বলতেন, সেটা শুধু এ কারণে নয় যে তিনি ছিলেন আবৃত্তিচর্চার সংগঠন কণ্ঠশীলনের সভাপতি আর আমি সাধারণ সম্পাদক। মূল কারণটা ছিল, যে জায়গাগুলোয় আঘাত পেতেন, তা নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলে হালকা হওয়া। এমন অনেক কথাই তিনি আমাকে বলেছেন, যেগুলো নিয়ে কোনো দিন কারও সঙ্গে কথা বলা হবে না। সন্‌জীদা খাতুন আক্ষেপ করে বলতেন, ‘সংস্কৃতিকে যেখানে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলাম, সেখানে পৌঁছে দিতে পারিনি। এখন সাধনা নেই বললেই চলে। ছায়ানটের আদর্শকে সবাই অন্তরে নেয় না।’ আর বলতেন, ‘আমরা হয়ে পড়লাম শহরকেন্দ্রিক। গ্রামে গিয়ে পৌঁছতে পারিনি।’

বাংলাদেশকে ছুঁতে হলে যে গ্রামে যেতে হবে, সে কথা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করতেন সন্‌জীদা খাতুন।

এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন ঘটল ২৫ মার্চ। তবে আমরা বলব, তিনি চলে গেলেও তো থেকে যাবেন এই নশ্বর পৃথিবীতে। থেকে যাবেন দেশের প্রতি তাঁর প্রবল ভালোবাসা দিয়ে। ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত