Ajker Patrika

টেকসই সংস্কার না হলে হাসিনা আমলের ব্যবস্থা ফিরে আসার ঝুঁকি: এইচআরডব্লিউ

অনলাইন ডেস্ক
Thumbnail image

বাংলাদেশে চলমান পরিস্থিতিতে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবাধিকার লঙ্ঘনের সেই পুরোনো রীতি ফিরে আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন পর্যবেক্ষণ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংস্থাটি জানিয়েছে, দৃঢ় ও টেকসই সংস্কার ছাড়া বাংলাদেশ এই ঝুঁকি এড়াতে পারবে না।

সোমবার (২৭ জানুয়ারি) প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে সংস্থাটি সতর্ক করেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি প্রশাসনিক ও আইনগত সংস্কার বাস্তবায়ন না করে, তবে শেখ হাসিনার পতনের মাধ্যমে অর্জিত কষ্টার্জিত ‘অগ্রগতি’ ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ৫০ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনটির শিরোনাম ‘আফটার দ্য মনসুন রেভল্যুশন: অ্যা রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’।

প্রতিবেদনে উল্লেখ বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জন্য এটিই একমাত্র সুযোগ, যেখানে তারা আইনি নির্যাতনের অবসান ঘটাতে পারে।’ সংস্থাটি দ্রুত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে বলেছে, ‘আদালত, পুলিশ, সামরিক বাহিনী এবং সিভিল সার্ভিসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে।’

প্রতিবেদনে দেশের আইনগত প্রক্রিয়ার পুনর্বিন্যাস ও বিরোধী মত বা সমালোচকদের দমন করতে ব্যবহৃত বিতর্কিত কিছু আইন বাতিলেরও সুপারিশ করা হয়েছে।

শেখ হাসিনা, ১৫ বছরের শাসনের পর গত বছরের আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগে বাধ্য হন। পরবর্তীতে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন খাত সংস্কারে ৬টি কমিশন গঠন করেছে এবং সংস্কারের পরে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

প্রতিবেদনে হাসিনার শাসনামলে নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যবহার করে কীভাবে সমালোচক ও বিরোধীদের ওপর নিপীড়ন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বিচার গ্রেপ্তার ও নজরদারি করা হয় তা তুলে ধরা হয়েছে। এ ব্যাপারে এইচআরডব্লিউ-এর প্রতিবেদনে একজন পুলিশ কর্মকর্তার কথা তুলে ধরা হয়। তিনি এইচআরডব্লিউ-কে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্যকে অনেক সময় মেধার চেয়েও বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। ফলে দলের নেতা-কর্মীদের মতো আচরণ করত পুলিশ।’

শেখ হাসিনার শাসনামলে ৩ হাজার ৫০০ টিরও বেশি গুমের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে এইচআরডব্লিউ। এ সংক্রান্ত একটি কমিশনের তদন্তের উদ্ধৃতি দিয়ে এইচআরডব্লিউ জানিয়েছে, সে সময়কার কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এবং শেখ হাসিনা নিজেও এসব ঘটনার বিষয়ে জানতেন।

এক ভুক্তভোগী এইচআরডব্লিউকে জানান, ‘গুমের বিষয়টি এমনভাবে পরিকল্পিত ছিল, বন্দীদের মৃত্যুর চেয়েও ভয়ানক অভিজ্ঞতা হতো।’

প্রতিবেদনে, গুমের ঘটনার সঙ্গে জড়িত বিশেষ সরকারি বাহিনী র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

এইচআরডব্লিউ তাদের প্রতিবেদন তৈরির সময় র‍্যাব প্রধান এ কে এম শহিদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ কে এম শহিদুর রহমান গোপন আটক কেন্দ্রের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন এবং তিনি জানান, এই বাহিনী বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিলে সরকারকে তারা সহযোগিতা করবেন।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, ড. ইউনূসের সরকার হাসিনার আমলে ধ্বংসপ্রায় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার শুরু করেছে, যে প্রতিষ্ঠানগুলো একসময় আওয়ামী লীগ ও হাসিনা বিরোধীদের নিপীড়নের জন্য ব্যবহৃত হতো। তবে তারা এও জানিয়েছে, শেখ হাসিনার সমর্থকদের বিরুদ্ধে নেওয়া আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু পদক্ষেপ ‘পূর্ববর্তী সরকারের নির্যাতনমূলক নীতির পুনরাবৃত্তি’ ঘটাচ্ছে।

এইচআরডব্লিউ–এর প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, জুলাই–আগস্টের আন্দোলনে নিহত কিছু পরিবারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে মামলা করতে বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ এসব পরিবারের অনেকেই মামলার আসামিকে পর্যন্ত চেনেন না।

এ ছাড়া হাসিনার সমর্থক কিছু সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দমনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলেও উঠে অভিযোগ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে এইচআরডব্লিউ। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১৪০ জন সাংবাদিককে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

এইচআরডব্লিউ–এর এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ইলেন পিয়ারসন বলেন, ‘গণতন্ত্রের জন্য প্রায় ১ হাজার বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের জন্য গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সমুন্নত হয় এমন ভবিষ্যৎ গড়তে এটি একটি ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি করেছে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি দ্রুত কাঠামোগত সংস্কার করতে না পারে তাহলে এই অর্জন হারিয়ে যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো, ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের উত্তরাধিকার থেকে বেরিয়ে আসা এবং ভবিষ্যতে এসব নিপীড়নের পুনরাবৃত্তি রোধে জাতিসংঘের সহায়তা নিয়ে কাঠামোগত সংস্কার নিশ্চিত করা উচিত।’

প্রতিবেদনে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এই পরামর্শগুলো দুই দশক ধরে বাংলাদেশে এইচআরডব্লিউ–এর গবেষণা এবং সাম্প্রতিক সময়ে মানবাধিকারকর্মী, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।

গত বছরের ৮ আগস্ট ৮৪ বছর বয়সী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর বলেন, তিনি ‘সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়া’ একটি প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থা পেয়েছেন, যার ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন।

শপথ অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি পরিবার। আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এই দেশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘শেখ হাসিনার শাসনামলে যারা অন্যায় করেছেন, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত