সীমান্ত পেরিয়ে আসা অস্ত্র ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে

শাহরিয়ার হাসান, ঢাকা
প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯: ০০

দেশে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের বড় অংশই সীমান্ত দিয়ে আসে। সীমান্ত পার করে আনা অত্যাধুনিক এসব ছোট আগ্নেয়াস্ত্র টাকার বিনিময়ে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সারা দেশে। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, গুপ্ত খুনি এমনকি কতিপয় রাজনীতিবিদদের হাতেও পৌঁছে গেছে এই অস্ত্র। যা দিয়ে করা হচ্ছে নানা ধরনের অপরাধ। সম্প্রতি যশোর সীমান্ত এলাকায় এক তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, এই তরুণ একাই বিক্রি করেছেন দুই শতাধিক অস্ত্র। তাঁর মত এমন আরও ডজনখানেক অস্ত্র কারবারি খোঁজ মিলেছে।

প্রশ্ন উঠছে, সীমান্তে কঠোর নজরদারির ফাঁকি দিয়ে এত অস্ত্র আসছে কীভাবে? এর জবাবও মিলেছে  সীমান্তে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে থেকে। তাঁরা বলেছেন, অবৈধ অস্ত্রের পেছনে আন্তর্জাতিক চোরাচালানিদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। তাঁরাই সীমান্ত পার করে দেশে অস্ত্র চোরাচালান করছেন। আন্তদেশীয় এই অস্ত্র কারবারিদের নেটওয়ার্ক ভাঙা অসম্ভব না হলেও বেশ কঠিন।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন,  প্রতি মুহূর্তে সীমান্তে বিজিবির ৬ হাজার টহল থাকে। এর মধ্যেও অস্ত্র আসছে। আমরা অস্ত্র কারবারিদের নেটওয়ার্ক ভাঙার চেষ্টা করছি। এ নিয়ে সীমন্তবর্তী দেশগুলো সঙ্গে আলোচনা চলছে।

গোয়েন্দারা বলছেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডেও অবৈধ অস্ত্র তৈরির কারখানা চালু করেছেন। এসব কারখানায় তৈরি হওয়া অস্ত্রের একটি অংশ বাংলাদেশে পাচার হয়ে আসছে। তদন্তে উঠে এসেছে, দেশে অবৈধভাবে আসা ৮০ ভাগ বিদেশি অস্ত্র সীমান্ত দিয়ে আসছে। বাকি বিদেশি অস্ত্রগুলো অসাধু ব্যবসায়ীরা বৈধপথে দেশে এনে অবৈধভাবে বিক্রি করে দিচ্ছে।

 গত বুধবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ভারত থেকে আনা অস্ত্র বিক্রির একটি নেটওয়ার্কের মূল হোতা আকুল হোসেনসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর পরিচয় মিলেছে, আকুল যশোরের শার্শা উপজেলার ছাত্রলীগ নেতা। ২০১৪ সাল থেকে তিনি অস্ত্র ব্যবসা করেন। গত ছয় বছরে ২০০ টির বেশি অস্ত্র বিক্রি করেছেন তিনি। পুলিশ বলছে, রাজধানী ঢাকা, সীমান্তবর্তী যশোর, সাতক্ষীরা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় সক্রিয় রয়েছেন এই চক্রের অর্ধশতাধিক সদস্য। 

সীমান্ত দিয়ে পার হওয়া ২০০ অস্ত্রে তদন্ত নেমে শুরুতেই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, গত এপ্রিলে রাজধানীর ভাষানটেকে মুছা ওরফে চিকনা জামাল নামের এক ঠিকাদারকে গুলি করার হয়। ওই ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র আকুলের দেওয়া। এমন আরও কয়েকটি ঘটনার বিষয়ে তারা তথ্য গেছেন।

অস্ত্র নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্ট পদস্থ এক কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেছেন, আকুলের এই অস্ত্র রাজধানীসহ জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। সহজে হাতে পাওয়ায় তাঁর অনেক পরিচিতরা অস্ত্র কিনেছেন। অস্ত্র গেছে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডেও। সেই অস্ত্র পেয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সদস্যরা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চলতি বছরেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে একে প্রায় একশ’ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

ভাষানটেক থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মুন্সি সাব্বির আহমেদ বলেন, ৫০ হাজার টাকা চাঁদার জন্য গুলি করা চিকনা জামালকে। জামাল নিজেও চিহ্নিত একজন সন্ত্রাসী। তাঁর নামে এক ডজন মামলা আছে। এলাকায় অবৈধ অস্ত্রে ঝনঝনি রয়েছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ এর প্রেসিডেন্ট, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল (অব) এএনএম মুনীরুজ্জামান বলেন, ক্ষুদ্রাস্ত্র এবং হালকা অস্ত্র চালান করার জন্য বাংলাদেশের ভূমি ক্রমশ অনেক বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। যারা চোরাচালানি বা ছিনতাই এর সঙ্গে জড়িত, তারাও এ ধরনের ক্ষুদ্রাস্ত্র কিনছেন। এটা বন্ধের একমাত্র উপায় বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় করা। গোয়েন্দা তথ্য সীমান্তে যাবে আবার সীমান্তের তথ্য গোয়েন্দাদের কাছে আসবে। তাহলে সবাইকে ধরা যাবে।

পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরে নিয়মিত অভিযানে র‍্যাব পুলিশে সদস্যরা সারা দেশ থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ টির মত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করেছে। এগুলোর বেশির ভাগই ভারতীয় সীমান্ত পথে দেশে ঢুকছে। বাহিনীর কর্মকর্তারাই বলছেন, বছরে উদ্ধার হওয়া এই সংখ্যার চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি অস্ত্র ঢুকেছে।

অভিযোগের তীর যখন দুর্বল সীমান্ত নজরদারির দিকে, তখন সীমান্তে দায়িত্বে থাকা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবির) সদর দপ্তর তা অস্বীকার করছেন না। সংস্থাটির গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তের ৩২৮ কিলোমিটার স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সীমান্তের মধ্যে যশোরের শার্শা–বেনাপোল, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, হিলি, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান অন্যতম। তথ্য বলছে এই সীমানারই অনন্ত ৩২টি পয়েন্ট দিয়ে অবৈধ অস্ত্র দেশে ঢুকে।

বিজিবি বলছে, এসব ঘটনায় অস্ত্র উদ্ধার ও কারবারিদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। ২০২০ সালে ৩২টি পিস্তল, ১ টি রিভলবারসহ ৭৬টি সর্টগান ছাড়াও চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ২৭টি পিস্তল ৪টি রিভলবার উদ্ধার করা হয়েছে।

জানতে চাইলে যশোর ৪৭ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল সেলিম রেজা আজকের পত্রিকাকে বলেন, অস্ত্র চোরাকারবারের সঙ্গে যদি শুধু দেশিরা জড়িত থাকত তাহলে বন্ধ করা সহজ হতো। দুই দেশে কারবারি একত্রিত হয়েছে। সীমান্তে বিজিবি সব সময় চোখ কান খোলা আছে। নিয়মিত অস্ত্র উদ্ধার ও কারবারিদের আটক চলছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন বলেছেন, অস্ত্র চোরাচালান বন্ধ করতে সীমান্তের দুই পাশে থাকা বাহিনীদের কার্যকরী ভূমিকা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে সমস্যাটা কোন এক দেশের না। দুই দেশেই এর দায় নিতে হবে। এর জন্য ইউনাইটেড ট্রান্স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ক্রাইমের যে আর্মস প্রটোকল রয়েছে। সে অনুযায়ী দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।

সীমান্তে ৩০ হাজার, ঢাকায় ৯০ হাজার: ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেছেন, সীমান্তের ওপার থেকে একটি রিভলবার ৩০ হাজার টাকায় আনা হয়। ঢাকায় এনে এসব অস্ত্র বিক্রি করা হচ্ছে ৯০ হাজার টাকায়। আবার অপরাধের ধরন ও সময় ওপরেরও এই দাম কমবেশি হয়। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত