কামরুল হাসান, ঢাকা
অপেক্ষা নাকি মৃত্যুর চেয়েও কঠিন। কোন মনীষী কথাটা বলেছিলেন, সেটা আর মনে নেই। কিন্তু কথা যে সত্যি, তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আড়াই ঘণ্টা ধরে পাঁচ তারকা হোটেলের লবিতে বসে আছি, ভদ্রলোকের দেখা নেই। অবশ্য এর মধ্যে তাঁর সঙ্গে এক দফা কথা হয়েছে ইন্টারকমে। তিনি এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, আমার সঙ্গে দেখা করবেন কি না। আমিও নাছোড়, কথা আমাকে বলতেই হবে। চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন বলতেন, খবর জোগাড়ের সময় মান-অপমান কোনো ব্যাপার নয়। সঠিক খবর হাতে পাওয়াটাই আসল কাজ। সেই মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছি, যা আছে কুলকপালে।
পাঁচ তারকা হোটেল লবির সুবিধা হলো, এসব জায়গায় যতক্ষণ খুশি বসে থাকতে কোনো বারণ নেই। আসনগুলোও বেশ আরামদায়ক। কিন্তু সমস্যা হলো, কিছুক্ষণ পরপর ওয়েটার এসে জানতে চান, কিছু লাগবে কি না। আমার কোনো ক্রেডিট কার্ড নেই, পকেটের অবস্থাও ভালো নয়। এক কাপ চায়ের দাম দেড় শ টাকা শুনে চায়ের তেষ্টা উবে গেল। বলছি ২০০২ সালের কথা। এটা ছিল সেই বছরের ২৬ আগস্টের সকাল।
যে লোকটার জন্য এত অপেক্ষা, তাঁর নাম-পরিচয় জানার আগে শানে-নজুলটা শুনুন। এর আগের দিন, অর্থাৎ ২৫ আগস্ট রোববার সকালে খবরের খোঁজে গিয়েছিলাম মালিবাগের এসবি অফিসে। তখন এসবির প্রধান ছিলেন আনোয়ারুল ইকবাল। পরে তিনি পুলিশের আইজি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাও হয়েছিলেন। আনোয়ারুল ইকবাল একসময় সিআইডির ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুলের কমান্ড্যান্ট ছিলেন, তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক। তো সেদিন তাঁর রুমে বসে আছি, এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে দুজন কর্মকর্তা এলেন। আমার উপস্থিতি দেখে ইশারা-ইঙ্গিতে তাঁদের কথা সারলেন। সেই ইশারার মধ্যে বুঝতে পারলাম, কোনো একটি বিশেষ ঘটনার তদন্তে এফবিআইয়ের একজন কর্মকর্তা আসছেন। তাঁর সঙ্গে এসবির প্রধানের বৈঠক হবে।
অতিরিক্ত আইজিপি আনোয়ারুল ইকবাল খুব শক্ত মানুষ। তাঁকে এ কথা জিজ্ঞাসা করা ঠিক হবে না। আর আমি জানতে চাইলেও তিনি উত্তর দেবেন না। এসবিতে আমার অনেক পরিচিত কর্মকর্তা। তাঁদের কারও কাছ থেকে এটা জানা যাবে। রুম থেকে বেরিয়ে পরিচিত একজন কর্মকর্তার কাছে গেলাম। তাঁর কাছে বিষয়টি তুলতেই মনে হলো, তিনি ঘটনা জানেন। তবে পুরোটা আমাকে বললেন না। যেটুকু বললেন সেটা হলো, কোকা-কোলার কান্ট্রি ডিরেক্টর অজয় মিত্র গুলশান থানায় একটি অভিযোগ দিয়েছেন। এ নিয়ে সরকারের ওপরমহলে হইচই শুরু হয়েছে। এক শীর্ষ সন্ত্রাসী ফোন করে তাঁর কাছে চাঁদা দাবি করেছে। সেই চাঁদার পরিমাণ অবিশ্বাস্য। তিনি অভিযোগে উল্লেখ করেছেন, প্রথম টেলিফোনকে অতটা গুরুত্ব দেননি। কিন্তু যত সময় গড়িয়েছে, বিষয়টা তত বড় হয়ে যাচ্ছিল। একপর্যায়ে সেই সন্ত্রাসী তাঁকে আলটিমেটাম দিয়ে বলেছে, এই মাসের মধ্যে বিষয়টির মীমাংসা না হলে বউ-বাচ্চার সামনে গুলি করে মেরে ফেলবে। এই হুমকিতে কান্ট্রি ডিরেক্টর খুবই ভয় পেয়েছেন। তিনি নিজের বারিধারার বাসা ছেড়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পাঁচ তারকা হোটেলে উঠেছেন। এখন সেখানেই আছেন। কোকা-কোলা যেহেতু আমেরিকান কোম্পানি, সে কারণে মার্কিন প্রশাসন বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছে।
সেই পুলিশ কর্মকর্তা এর চেয়ে বিস্তারিত আর কিছু বললেন না। এমনকি কোন হোটেলে উঠেছেন, তা-ও বললেন না। ঢাকায় তখন দুটি পাঁচ তারকা হোটেল। একটি হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও, অন্যটি স্টারউডের শেরাটন হোটেল।
আমার মাথায় সবকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে, আরও বিস্তারিত তথ্য লাগবে। একটু খোঁজখবর করতে গিয়ে জানলাম, ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মেরি অ্যান পিটার্স এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরীর সঙ্গে দেখাও করেছেন। মনে হলো, পুলিশ ছাড়াও সব গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে খোঁজখবর করছে; কিন্তু সন্ত্রাসীকে কেউ ধরতে পারছে না।
এসবি অফিস থেকে বেরিয়ে ইস্কাটনের দিকে যাব। মৌচাক মোড়ে এসে দেখি, ইউএনবির সাইফুল হুদা (আমেরিকাপ্রবাসী) দাঁড়িয়ে। তিনি তখন প্রধানমন্ত্রীর বিট করতেন। তাঁর কাছে কোকা-কোলার প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, তাঁর বাল্যবন্ধু খালিদ রাজা কোকা-কোলায় বড় পদে চাকরি করেন। সেখানে গেলে সব সমস্যার সমাধান হবে। সাইফুল হুদাকে মোটরসাইকেলের পেছনে তুলে ছুটলাম বিজয় সরণির দিকে, কোকা-কোলার ঢাকা অফিসে। সাইফুল হুদা কোকা-কোলায় এসে খালিদ রাজাকে বাইরে ডেকে এনে ফিসফাস করে সব বললেন। কিন্তু খালিদ রাজা এমন ভান করলেন, যেন কিছুই জানেন না। শুধু বললেন, কিছু জানার থাকলে তাঁকে লিখে দিতে হবে। আমরা তা-ই করলাম। সাদা কাগজে কয়েকটি প্রশ্ন লিখে সেটা খালিদ রাজার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম।
সেখান থেকে বেরিয়ে আমার মনে হচ্ছিল, ঢাকায় দুটি পাঁচ তারকা হোটেলের একটিতে অজয় মিত্র উঠেছেন। হোটেলের অভ্যর্থনায় গিয়ে খোঁজ করলেই কিছু না কিছু জানা যাবে। প্রথমে এলাম সোনারগাঁওয়ে। সেখানকার অভ্যর্থনা থেকে বলা হলো, এই নামে কেউ নেই। এবার গেলাম শেরাটনে। অজয় মিত্রের নাম বলতেই অভ্যর্থনায় থাকা এক নারী আমাকে ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন, এই অতিথি সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারবেন না। অভ্যর্থনার কর্মীর কাছে জানতে চাইলাম, তাঁর রুম নম্বর কত, তিনি সেটাও বললেন না।
সব পাঁচ তারকা হোটেলের লবিতে একাধিক ইন্টারকম সংযোগ থাকে। সেখান থেকে অতিথিদের সঙ্গে কথাও বলা যায়। কিছুক্ষণ লবিতে বসে অপেক্ষা করলাম। এরপর একটি ইন্টারকমের কাছে গিয়ে তাতে শূন্য ডায়াল করতেই মনে হলো, ইনফরমেশনের কেউ ধরেছেন। তাঁর কাছে অজয় মিত্রের নাম বলতেই তিনি সেই রুমের পিএবিএক্স নম্বর বললেন। মনে হলো জাদুর কাঠি পেয়ে গেলাম। কল দিলাম সেই নম্বরে। এক নারী ফোন ধরে জানতে চাইলেন, কাকে চাই। আমি অজয় মিত্রের নাম বলতেই তিনি পরিচয় জানতে চাইলেন। এরপর সাংবাদিক শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। আমাকে লাইনে রেখে নারী-পুরুষ হিন্দিতে কথা বললেন। এরপর আমার সঙ্গে কোনো কথা বলবেন না বলে ফোনটা রেখে দিলেন।
আমি হোটেল না ছেড়ে অভ্যর্থনায় বসেই থাকলাম। ঘণ্টাখানেক পর আবার ফোন দিলাম। এবার অজয় মিত্র নিজেই ফোন ধরলেন। খাঁটি বাংলায় বললেন, আমি কেন তাঁর জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছি। তাঁকে বললাম, আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই। আপনার ওপর হুমকির বিষয়টি কাগজে এলে আপনি নিরাপদ হবেন। মনে হলো, এ কথায় কাজ হয়েছে। তিনি আমাকে বললেন, ভাবার জন্য একটু সময় দিন। আমি বললাম, অভ্যর্থনায় আছি।
আমার অপেক্ষার পালা শেষ হলো। আড়াই ঘণ্টা পর অজয় মিত্র নিচে নামলেন, সঙ্গে তাঁর স্ত্রী। কথায় মনে হলো, তিনি খুবই ভয় পেয়েছেন। আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন আর চারদিকে তাকাচ্ছিলেন। প্রথমে কিছু বলতে না চাইলেও পরে সবই বললেন। শর্ত ছিল, তাঁর নাম প্রকাশ করা যাবে না। কোকা-কোলার নিয়ম অনুযায়ী কেউ গণমাধ্যমের সামনে কথা বলতে পারেন না।
অজয় মিত্র বললেন, তাঁকে প্রথম ফোন করা হয় ১৪ আগস্ট (২০০২), এরপর ১৯ আগস্ট। ফোন করে বলা হয়, বাংলাদেশে কোকা-কোলা বিক্রির বিপরীতে প্রতি বোতলের জন্য তাকে ১০ পয়সা দিতে হবে। এই হিসাবে মাসে ৫০ লাখ টাকা তাকে দিতে হবে। সেটা না দিলে তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে এবং কোকা-কোলার বিপণনব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হবে।
আমি জানতে চাইলাম, যিনি ফোন করেছিলেন, তাঁর কণ্ঠস্বর কেমন? তিনি বললেন, কম বয়স, কিন্তু গলাটা বেশ ভরাট। কী নাম বলেছেন? বললেন, জাহাঙ্গীর ফেরদৌস বা কালা জাহাঙ্গীর। অজয় মিত্র বললেন, তাঁকে ফোন করার আগে লোকটি তাঁর গতিবিধির সব তথ্য অনেক দিন ধরে জোগাড় করেছেন। শুধু তিনি নন, তাঁর স্ত্রী-সন্তান কোন গাড়িতে চলেন, কখন বাসা থেকে বের হন—সব তিনি জানেন। অজয় মিত্র আমাকে বললেন, এ ঘটনা নিয়ে তিনি গুলশান থানায় ২০ আগস্ট জিডি করেছেন।
অজয় মিত্র আরও বললেন, জিডি করার পর পুলিশ কমিশনার আবদুল কাইয়ুম ও আইজিপি মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী তাঁকে ফোন করেন। তাঁর বারিধারার বাসায় পাহারাও বসানো হয়। কিন্তু তার পরও কেউ তাঁকে ফলো করছিল। হোটেলে আসার পরও ফোন এসেছে। বলা হয়েছে, কত দিন হোটেলে থাকবি?
পরে জানতে পারি, চাঁদা দেওয়ার টোপ দিয়ে ফার্মগেট থেকে এক যুবককে পুলিশ আটক করেছিল। এফবিআই কর্মকর্তা তাঁকে জেরাও করেছিলেন। এটা ছিল ডামি চাঁদাবাজ। কালা জাহাঙ্গীর এ ঘটনার পর খুবই ক্ষুব্ধ হন।
অজয় মিত্রকে নিয়ে আমার তৈরি করা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল ২৭ আগস্ট ২০০২। সেখানে অজয় মিত্রের কোনো বক্তব্য ছাপা হয়নি। তবে কোকা-কোলার মূল প্রতিষ্ঠান কোকা-কোলা ফার ইস্টের একটি বক্তব্য ছাপা হয়। তাতে বলা হয়, কোকা-কোলা স্থানীয় প্রশাসনের ওপর আস্থাশীল।
সেই খবর প্রকাশের পর কালা জাহাঙ্গীর ফোন করে প্রতিবাদ জানান। অজ্ঞাত স্থান থেকে একটি লিখিত প্রতিবাদও পাঠান। কিন্তু তখনকার পুলিশ কমিশনার আবদুল কাইয়ুম আমাকে বলেছিলেন, এই হুমকিদাতা যে কালা জাহাঙ্গীর, সে ব্যাপারে তাঁরা মোটামুটি নিশ্চিত। কয়েক দিন পর শুনলাম, অজয় মিত্র বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছেন। কোকা-কোলার অফিস বিজয় সরণি থেকে গুলশানে সরিয়ে নেওয়া হয়।
অজয় মিত্র চলে যাওয়ার কিছুদিন পর জাহাঙ্গীরের স্ত্রী সোনিয়া পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। ডিবি অফিসে আমি তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সোনিয়া আমাকে বলেছিলেন, কালা জাহাঙ্গীরের মাসে খরচ ৭০ লাখ টাকার বেশি। সেই টাকার জন্য সে মরিয়া হয়ে ওঠে। কোকা-কোলার কর্তাকেও সে ছেড়ে দিত না।
সেদিন সোনিয়ার এই কথা শুনে মনে হয়েছিল, বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ায় প্রাণে বেঁচে গেলেন অজয় মিত্র!
আষাঢ়ে নয় সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
অপেক্ষা নাকি মৃত্যুর চেয়েও কঠিন। কোন মনীষী কথাটা বলেছিলেন, সেটা আর মনে নেই। কিন্তু কথা যে সত্যি, তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আড়াই ঘণ্টা ধরে পাঁচ তারকা হোটেলের লবিতে বসে আছি, ভদ্রলোকের দেখা নেই। অবশ্য এর মধ্যে তাঁর সঙ্গে এক দফা কথা হয়েছে ইন্টারকমে। তিনি এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, আমার সঙ্গে দেখা করবেন কি না। আমিও নাছোড়, কথা আমাকে বলতেই হবে। চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন বলতেন, খবর জোগাড়ের সময় মান-অপমান কোনো ব্যাপার নয়। সঠিক খবর হাতে পাওয়াটাই আসল কাজ। সেই মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছি, যা আছে কুলকপালে।
পাঁচ তারকা হোটেল লবির সুবিধা হলো, এসব জায়গায় যতক্ষণ খুশি বসে থাকতে কোনো বারণ নেই। আসনগুলোও বেশ আরামদায়ক। কিন্তু সমস্যা হলো, কিছুক্ষণ পরপর ওয়েটার এসে জানতে চান, কিছু লাগবে কি না। আমার কোনো ক্রেডিট কার্ড নেই, পকেটের অবস্থাও ভালো নয়। এক কাপ চায়ের দাম দেড় শ টাকা শুনে চায়ের তেষ্টা উবে গেল। বলছি ২০০২ সালের কথা। এটা ছিল সেই বছরের ২৬ আগস্টের সকাল।
যে লোকটার জন্য এত অপেক্ষা, তাঁর নাম-পরিচয় জানার আগে শানে-নজুলটা শুনুন। এর আগের দিন, অর্থাৎ ২৫ আগস্ট রোববার সকালে খবরের খোঁজে গিয়েছিলাম মালিবাগের এসবি অফিসে। তখন এসবির প্রধান ছিলেন আনোয়ারুল ইকবাল। পরে তিনি পুলিশের আইজি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাও হয়েছিলেন। আনোয়ারুল ইকবাল একসময় সিআইডির ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুলের কমান্ড্যান্ট ছিলেন, তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক। তো সেদিন তাঁর রুমে বসে আছি, এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে দুজন কর্মকর্তা এলেন। আমার উপস্থিতি দেখে ইশারা-ইঙ্গিতে তাঁদের কথা সারলেন। সেই ইশারার মধ্যে বুঝতে পারলাম, কোনো একটি বিশেষ ঘটনার তদন্তে এফবিআইয়ের একজন কর্মকর্তা আসছেন। তাঁর সঙ্গে এসবির প্রধানের বৈঠক হবে।
অতিরিক্ত আইজিপি আনোয়ারুল ইকবাল খুব শক্ত মানুষ। তাঁকে এ কথা জিজ্ঞাসা করা ঠিক হবে না। আর আমি জানতে চাইলেও তিনি উত্তর দেবেন না। এসবিতে আমার অনেক পরিচিত কর্মকর্তা। তাঁদের কারও কাছ থেকে এটা জানা যাবে। রুম থেকে বেরিয়ে পরিচিত একজন কর্মকর্তার কাছে গেলাম। তাঁর কাছে বিষয়টি তুলতেই মনে হলো, তিনি ঘটনা জানেন। তবে পুরোটা আমাকে বললেন না। যেটুকু বললেন সেটা হলো, কোকা-কোলার কান্ট্রি ডিরেক্টর অজয় মিত্র গুলশান থানায় একটি অভিযোগ দিয়েছেন। এ নিয়ে সরকারের ওপরমহলে হইচই শুরু হয়েছে। এক শীর্ষ সন্ত্রাসী ফোন করে তাঁর কাছে চাঁদা দাবি করেছে। সেই চাঁদার পরিমাণ অবিশ্বাস্য। তিনি অভিযোগে উল্লেখ করেছেন, প্রথম টেলিফোনকে অতটা গুরুত্ব দেননি। কিন্তু যত সময় গড়িয়েছে, বিষয়টা তত বড় হয়ে যাচ্ছিল। একপর্যায়ে সেই সন্ত্রাসী তাঁকে আলটিমেটাম দিয়ে বলেছে, এই মাসের মধ্যে বিষয়টির মীমাংসা না হলে বউ-বাচ্চার সামনে গুলি করে মেরে ফেলবে। এই হুমকিতে কান্ট্রি ডিরেক্টর খুবই ভয় পেয়েছেন। তিনি নিজের বারিধারার বাসা ছেড়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পাঁচ তারকা হোটেলে উঠেছেন। এখন সেখানেই আছেন। কোকা-কোলা যেহেতু আমেরিকান কোম্পানি, সে কারণে মার্কিন প্রশাসন বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছে।
সেই পুলিশ কর্মকর্তা এর চেয়ে বিস্তারিত আর কিছু বললেন না। এমনকি কোন হোটেলে উঠেছেন, তা-ও বললেন না। ঢাকায় তখন দুটি পাঁচ তারকা হোটেল। একটি হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও, অন্যটি স্টারউডের শেরাটন হোটেল।
আমার মাথায় সবকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে, আরও বিস্তারিত তথ্য লাগবে। একটু খোঁজখবর করতে গিয়ে জানলাম, ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মেরি অ্যান পিটার্স এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরীর সঙ্গে দেখাও করেছেন। মনে হলো, পুলিশ ছাড়াও সব গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে খোঁজখবর করছে; কিন্তু সন্ত্রাসীকে কেউ ধরতে পারছে না।
এসবি অফিস থেকে বেরিয়ে ইস্কাটনের দিকে যাব। মৌচাক মোড়ে এসে দেখি, ইউএনবির সাইফুল হুদা (আমেরিকাপ্রবাসী) দাঁড়িয়ে। তিনি তখন প্রধানমন্ত্রীর বিট করতেন। তাঁর কাছে কোকা-কোলার প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, তাঁর বাল্যবন্ধু খালিদ রাজা কোকা-কোলায় বড় পদে চাকরি করেন। সেখানে গেলে সব সমস্যার সমাধান হবে। সাইফুল হুদাকে মোটরসাইকেলের পেছনে তুলে ছুটলাম বিজয় সরণির দিকে, কোকা-কোলার ঢাকা অফিসে। সাইফুল হুদা কোকা-কোলায় এসে খালিদ রাজাকে বাইরে ডেকে এনে ফিসফাস করে সব বললেন। কিন্তু খালিদ রাজা এমন ভান করলেন, যেন কিছুই জানেন না। শুধু বললেন, কিছু জানার থাকলে তাঁকে লিখে দিতে হবে। আমরা তা-ই করলাম। সাদা কাগজে কয়েকটি প্রশ্ন লিখে সেটা খালিদ রাজার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম।
সেখান থেকে বেরিয়ে আমার মনে হচ্ছিল, ঢাকায় দুটি পাঁচ তারকা হোটেলের একটিতে অজয় মিত্র উঠেছেন। হোটেলের অভ্যর্থনায় গিয়ে খোঁজ করলেই কিছু না কিছু জানা যাবে। প্রথমে এলাম সোনারগাঁওয়ে। সেখানকার অভ্যর্থনা থেকে বলা হলো, এই নামে কেউ নেই। এবার গেলাম শেরাটনে। অজয় মিত্রের নাম বলতেই অভ্যর্থনায় থাকা এক নারী আমাকে ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন, এই অতিথি সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারবেন না। অভ্যর্থনার কর্মীর কাছে জানতে চাইলাম, তাঁর রুম নম্বর কত, তিনি সেটাও বললেন না।
সব পাঁচ তারকা হোটেলের লবিতে একাধিক ইন্টারকম সংযোগ থাকে। সেখান থেকে অতিথিদের সঙ্গে কথাও বলা যায়। কিছুক্ষণ লবিতে বসে অপেক্ষা করলাম। এরপর একটি ইন্টারকমের কাছে গিয়ে তাতে শূন্য ডায়াল করতেই মনে হলো, ইনফরমেশনের কেউ ধরেছেন। তাঁর কাছে অজয় মিত্রের নাম বলতেই তিনি সেই রুমের পিএবিএক্স নম্বর বললেন। মনে হলো জাদুর কাঠি পেয়ে গেলাম। কল দিলাম সেই নম্বরে। এক নারী ফোন ধরে জানতে চাইলেন, কাকে চাই। আমি অজয় মিত্রের নাম বলতেই তিনি পরিচয় জানতে চাইলেন। এরপর সাংবাদিক শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। আমাকে লাইনে রেখে নারী-পুরুষ হিন্দিতে কথা বললেন। এরপর আমার সঙ্গে কোনো কথা বলবেন না বলে ফোনটা রেখে দিলেন।
আমি হোটেল না ছেড়ে অভ্যর্থনায় বসেই থাকলাম। ঘণ্টাখানেক পর আবার ফোন দিলাম। এবার অজয় মিত্র নিজেই ফোন ধরলেন। খাঁটি বাংলায় বললেন, আমি কেন তাঁর জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছি। তাঁকে বললাম, আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই। আপনার ওপর হুমকির বিষয়টি কাগজে এলে আপনি নিরাপদ হবেন। মনে হলো, এ কথায় কাজ হয়েছে। তিনি আমাকে বললেন, ভাবার জন্য একটু সময় দিন। আমি বললাম, অভ্যর্থনায় আছি।
আমার অপেক্ষার পালা শেষ হলো। আড়াই ঘণ্টা পর অজয় মিত্র নিচে নামলেন, সঙ্গে তাঁর স্ত্রী। কথায় মনে হলো, তিনি খুবই ভয় পেয়েছেন। আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন আর চারদিকে তাকাচ্ছিলেন। প্রথমে কিছু বলতে না চাইলেও পরে সবই বললেন। শর্ত ছিল, তাঁর নাম প্রকাশ করা যাবে না। কোকা-কোলার নিয়ম অনুযায়ী কেউ গণমাধ্যমের সামনে কথা বলতে পারেন না।
অজয় মিত্র বললেন, তাঁকে প্রথম ফোন করা হয় ১৪ আগস্ট (২০০২), এরপর ১৯ আগস্ট। ফোন করে বলা হয়, বাংলাদেশে কোকা-কোলা বিক্রির বিপরীতে প্রতি বোতলের জন্য তাকে ১০ পয়সা দিতে হবে। এই হিসাবে মাসে ৫০ লাখ টাকা তাকে দিতে হবে। সেটা না দিলে তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে এবং কোকা-কোলার বিপণনব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হবে।
আমি জানতে চাইলাম, যিনি ফোন করেছিলেন, তাঁর কণ্ঠস্বর কেমন? তিনি বললেন, কম বয়স, কিন্তু গলাটা বেশ ভরাট। কী নাম বলেছেন? বললেন, জাহাঙ্গীর ফেরদৌস বা কালা জাহাঙ্গীর। অজয় মিত্র বললেন, তাঁকে ফোন করার আগে লোকটি তাঁর গতিবিধির সব তথ্য অনেক দিন ধরে জোগাড় করেছেন। শুধু তিনি নন, তাঁর স্ত্রী-সন্তান কোন গাড়িতে চলেন, কখন বাসা থেকে বের হন—সব তিনি জানেন। অজয় মিত্র আমাকে বললেন, এ ঘটনা নিয়ে তিনি গুলশান থানায় ২০ আগস্ট জিডি করেছেন।
অজয় মিত্র আরও বললেন, জিডি করার পর পুলিশ কমিশনার আবদুল কাইয়ুম ও আইজিপি মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী তাঁকে ফোন করেন। তাঁর বারিধারার বাসায় পাহারাও বসানো হয়। কিন্তু তার পরও কেউ তাঁকে ফলো করছিল। হোটেলে আসার পরও ফোন এসেছে। বলা হয়েছে, কত দিন হোটেলে থাকবি?
পরে জানতে পারি, চাঁদা দেওয়ার টোপ দিয়ে ফার্মগেট থেকে এক যুবককে পুলিশ আটক করেছিল। এফবিআই কর্মকর্তা তাঁকে জেরাও করেছিলেন। এটা ছিল ডামি চাঁদাবাজ। কালা জাহাঙ্গীর এ ঘটনার পর খুবই ক্ষুব্ধ হন।
অজয় মিত্রকে নিয়ে আমার তৈরি করা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল ২৭ আগস্ট ২০০২। সেখানে অজয় মিত্রের কোনো বক্তব্য ছাপা হয়নি। তবে কোকা-কোলার মূল প্রতিষ্ঠান কোকা-কোলা ফার ইস্টের একটি বক্তব্য ছাপা হয়। তাতে বলা হয়, কোকা-কোলা স্থানীয় প্রশাসনের ওপর আস্থাশীল।
সেই খবর প্রকাশের পর কালা জাহাঙ্গীর ফোন করে প্রতিবাদ জানান। অজ্ঞাত স্থান থেকে একটি লিখিত প্রতিবাদও পাঠান। কিন্তু তখনকার পুলিশ কমিশনার আবদুল কাইয়ুম আমাকে বলেছিলেন, এই হুমকিদাতা যে কালা জাহাঙ্গীর, সে ব্যাপারে তাঁরা মোটামুটি নিশ্চিত। কয়েক দিন পর শুনলাম, অজয় মিত্র বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছেন। কোকা-কোলার অফিস বিজয় সরণি থেকে গুলশানে সরিয়ে নেওয়া হয়।
অজয় মিত্র চলে যাওয়ার কিছুদিন পর জাহাঙ্গীরের স্ত্রী সোনিয়া পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। ডিবি অফিসে আমি তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সোনিয়া আমাকে বলেছিলেন, কালা জাহাঙ্গীরের মাসে খরচ ৭০ লাখ টাকার বেশি। সেই টাকার জন্য সে মরিয়া হয়ে ওঠে। কোকা-কোলার কর্তাকেও সে ছেড়ে দিত না।
সেদিন সোনিয়ার এই কথা শুনে মনে হয়েছিল, বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ায় প্রাণে বেঁচে গেলেন অজয় মিত্র!
আষাঢ়ে নয় সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘দেশের চলমান অর্থনৈতিক ভঙ্গুর অবস্থা ও সংকটের মূলে আছে স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি ও অনাচারী অর্থনীতি। বিগত সরকারের সময়ে অনাচারী অর্থনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার
২ ঘণ্টা আগেসারা দেশের বিভিন্ন জেলায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবুর রহমানের নামে থাকা ৬টি মেডিকেল কলেজের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। ব্যক্তির নাম বাদ দিয়ে মেডিকেল কলেজগুলোর নামকরণ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর নামে
৩ ঘণ্টা আগেনির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ দিতে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি করেছে সরকার। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীকে সভাপতি করে আজ বৃহস্পতিবার সার্চ কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
৪ ঘণ্টা আগেরাষ্ট্র সংস্কারে অগ্রাধিকার দেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর নির্বাচনের জন্য চাপ বাড়ছে। বিএনপি শুরুতে সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বললেও এখন দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ চাইছে।
৫ ঘণ্টা আগে