Ajker Patrika

অমরত্বের যাত্রায় সন্‌জীদা খাতুন

খান মুহাম্মদ রুমেল
আপডেট : ২৫ মার্চ ২০২৫, ২০: ৩৮
অমরত্বের যাত্রায় সন্‌জীদা খাতুন

জীবন-মৃত্যুর ভেদরেখা মুছে অসীম আকাশের তারা হয়ে গেলেন সন্‌জীদা খাতুন। মঙ্গলবার বেলা ৩টার কিছু পরে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান আজন্ম এই রবীন্দ্রসাধক। আর মাত্র কদিন পেরোলেই এই এপ্রিলে ছুঁতেন ৯৩ বর্ষ। কিন্তু তার আগেই নিভে গেল আলোকপ্রাপ্ত এক প্রাণ।

সন্‌জীদা খাতুন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সংগীতজ্ঞ ও শিক্ষক। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। আমৃত্যু ছিলেন ছায়ানটের সভাপতি। এ ছাড়া তিনি জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। প্রচলিত ধারার বাইরে শিশুদের জন্য ভিন্নধর্মী এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নালন্দারও সভাপতি ছিলেন তিনি।

ষাটের দশকের শুরু থেকে ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যে সাহসী গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলন এবং সাংস্কৃতিক জাগরণের সূচনা ঘটেছিল, সেটাই পরে ষাটের দশকজুড়ে বহু বিস্তৃত হয়ে দেশে অবিশ্বাস্য এক গণজাগরণ তৈরি করেছিল।

সেই ছাত্র ও রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি আরেকটি গভীর স্রোতোধারাও বহমান ছিল—বাঙালির আত্মানুসন্ধান এবং বাঙালির সংস্কৃতির জন্য অব্যাহত সংগ্রাম। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেই আন্দোলনে শুরুর দিকের নাম সন্‌জীদা খাতুন।

রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন করার পরপরই সংগঠক ও শিল্পীরা একমত হলেন একটি সংগঠন তৈরির বিষয়ে। নতুন সংগঠনের প্রস্তাব গৃহীত হলো। সুফিয়া কামাল সভাপতি ও ফরিদা হাসান সাধারণ সম্পাদক। কমিটিতে আরও ছিলেন মোখলেসুর রহমান, সায়েদুল হাসান, শামসুন্নাহার রহমান, ওয়াহিদুল হক, আহমেদুর রহমান, দেবদাস চক্রবর্তী, সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিকসহ অনেকে। কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সন্‌জীদা খাতুনের নাম প্রস্তাব করা হলেও তিনি কমিটিতে থাকেননি। তিনি তখন সরকারি কলেজে চাকরি করতেন। নবগঠিত কমিটির দ্বিতীয় বৈঠকেই সংগঠনের নাম ঠিক করা হয়েছিল ‘ছায়ানট’।

সন্‌জীদা খাতুনকে জীবনের প্রায় শুরু থেকে দেখা গেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকায়। যখন তিনি কলেজের শিক্ষার্থী, তখন থেকেই পড়াশোনা, আবৃত্তি ও অভিনয়ের পাশাপাশি গানের চর্চা করেছেন। পাশাপাশি কিছু সাংগঠনিক কাজেও যুক্ত হয়েছেন।

শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে ব্রতচারী আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। মুকুল ফৌজে কাজ করেছেন, আবার ছেড়েও দিয়েছেন। তাঁর প্রথম গানের গুরু ছিলেন সোহরাব হোসেন। তাঁর কাছে তিনি শিখেছিলেন নজরুলসংগীত, আধুনিক বাংলা গান ও পল্লিগীতি। পরে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন হুসনা বানু খানমের কাছে। এরপর আরও অনেকের কাছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার, আবদুল আহাদ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেনসহ কয়েকজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই সন্‌জীদা খাতুন সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারির দুপুরে বাসায় ফিরে ছাত্রহত্যার খবর পেয়েছিলেন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি সবকিছু বন্ধ, সকালে বাসা থেকে বের হয়ে নানা খোঁজখবর নিয়ে বিকেলে মাকে নিয়ে রওনা দিলেন অভয় দাস লেনের এক বাসার উদ্দেশে মহিলাদের প্রতিবাদ সভায় যোগ দিতে। সেই ভয়ের পরিবেশে দূরের পথ হেঁটে গেলেন সেই বাসার চত্বরে। সেখানে গিয়ে দেখেন, বেগম সুফিয়া কামাল, বেগম দৌলতুন্নেসা, নূরজাহান মুরশিদ প্রমুখ উপস্থিত। কিন্তু সেদিন সে পরিস্থিতিতে কেউ সভার সভাপতি হতে চাননি। শেষ পর্যন্ত সন্‌জীদা খাতুনের মা সাজেদা খাতুনকে সভাপতির আসনে বসিয়ে দেওয়া হলো। সেদিন সন্‌জীদা খাতুন প্রথম বক্তৃতা দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তাঁর রবীন্দ্রসাহিত্য ও সংগীতের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, অনার্সের পর শান্তিনিকেতনে যাবেন, বিশ্বভারতীতে এমএ পড়বেন। হয়েছিল তা-ই।

বাংলাদেশের এক অনন্য সংগঠন ছায়ানট। শুরুর দিন থেকে ছায়ানটের একেবারে সামনের সারির মানুষ ছিলেন সন্‌জীদা খাতুন। প্রায় ৬০ বছর ছায়ানট বাংলাদেশে একটি মানবিক বাঙালি সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করে চলেছে।

১৯৬৩ সালে শুরু হলো ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন। ওয়াহিদুল হক ছিলেন এর পেছনের মূল উদ্যোক্তা। এরপর ছায়ানট আর থেমে থাকেনি। দশকের পর দশক ছায়ানট নানা সময়ে শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু এড়িয়ে, সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে তার সাহসী পথচলা অব্যাহত রেখেছে।

সেই ষাটের দশকের ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ), সে সময়ের ছাত্র ইউনিয়ন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা আন্দোলনের প্রায় সব উদ্যোগে সব সময় সন্‌জীদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হককে ঘনিষ্ঠভাবে পাওয়া গেছে।

সন্‌জীদা খাতুন রাজনীতিক ছিলেন। তবে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। পরে সন্‌জীদা খাতুন লিখেছেন, দলভুক্ত হওয়া মানে নিজেকে বিকিয়ে দেওয়া। তাঁর আত্মজীবনী ‘সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দে’তে তিনি লিখেছেন, ‘রাজনীতি আমার ক্ষেত্র নয়, সাংস্কৃতিক আন্দোলনই আমার আসল কাজের ক্ষেত্র। বিশেষ করে, বাংলাদেশ বা বাঙালি সাংস্কৃতিক স্বাধিকার সংরক্ষণ আমার উপযুক্ত কাজের ক্ষেত্র।’ আজীবন তিনি বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামে মাঠে স্থির হয়ে ছিলেন। ছায়ানট শুধু নয়, তাঁর সুদীর্ঘ জীবনের বাঁকে বাঁকে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, ব্রতচারী সমিতি, নালন্দা বিদ্যালয় বা কণ্ঠশীলনের মতো সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

সেই ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরের বাংলাদেশে নানা উত্থান-পতনের মধ্যে সব প্রগতিশীল ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সামনে ছিলেন তিনি। ১৯৬৭ সালের ১৫ এপ্রিল, বাংলা সনের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ। রমনার বটমূলে ছায়ানট প্রথম আয়োজন করেছিল নববর্ষের প্রথম অনুষ্ঠানের। এরপর থেকে শুধু একাত্তর সাল বাদে ছায়ানট রমনার বটমূলে নববর্ষের অনুষ্ঠান সফলভাবে করে চলেছে। এ এক বিস্ময়কর ঘটনা। ২০০১ সালে নববর্ষের প্রভাতের এই অনুষ্ঠানে বড় রকমের জঙ্গি হামলা হলেও ছায়ানট বা সন্‌জীদা খাতুন এই অনুষ্ঠান থেকে সরে আসেননি।

৬৭ বছর ধরে সন্‌জীদা খাতুন বাংলাদেশ বা বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাধিকার সংরক্ষণের কাজ করে গেছেন পরম নিষ্ঠায়। আকুল মমতায়। কিছু মানুষের জীবন থাকে এমন—চলে যাওয়া মানে শেষ নয়, বরং নতুন করে প্রাসঙ্গিক হওয়া। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সন্‌জীদা খাতুন তেমন এক চির অম্লান নাম।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দিয়াবাড়ীতে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জিএমের রক্তাক্ত মরদেহ

ফেসবুকের রাজনীতি আর মাঠের রাজনীতি এক নয়: জারাকে সারজিসের জবাব

কিছুদিন আগে মানিব্যাগও ছিল না, এখন বিশাল শোডাউন কীভাবে—সারজিসকে ডা. তাসনিম

‘সারজিস নাগরিক পার্টি করতে পারলে আমরা কেন ছাত্রদল করতে পারব না’

অক্টোবরে সংসদ নির্বাচনের তফসিল, আগস্টের মধ্যেই ‘পূর্ণ প্রস্তুতি’

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত