বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

সীমান্তের দুই পারে উত্তেজনা

  • আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলা; কলকাতা, মুম্বাই ও গুয়াহাটিতে বিক্ষোভ।
  • দুই দেশের বসা উচিত: কূটনৈতিক বিশ্লেষক
  • পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে বৈঠক নিশ্চিত করেনি দিল্লি।
সাহিদুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা 
প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২: ১২
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বিক্ষোভের সময় পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়ে বিক্ষোভকারীরা। গতকাল ভারতের ত্রিপুরার আগরতলায়। ছবি: সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অস্থিরতা চলছে দেশে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ঘটনায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে প্রতিবেশী ভারত। এ নিয়ে দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কেও চাপা অস্থিরতা চলছে। আর এই অস্থিরতা ও সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাকে পুঁজি করে সীমান্তের ওপারে সক্রিয় হয়েছে ভারতের উগ্রপন্থী বিভিন্ন রাজনৈতিক চক্র। প্রায় প্রতিদিনই কলকাতা, আগরতলা, গুয়াহাটি, মুম্বাইসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোর সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে এসব সংগঠন। ঘটনা কেবল বিক্ষোভেই সীমিত থাকছে না; আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলাও হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের অযাচিত জড়িয়ে পড়ার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষও। ঢাকায় রাস্তায় ভারতীয় পতাকা এঁকে তাতে পদাঘাত করে পতাকার অবমাননা করা হয়েছে, এমন অভিযোগ দেশটির কূটনীতিকদের।

সরকার মনে করছে, সাম্প্রদায়িক বিষয়সহ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট উত্তেজনা দুই দেশের সীমানার ভেতরেই সীমিত রাখা হয়েছে এমন নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তার বিস্তার ঘটছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গতকাল সোমবার বলেন, বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে নিয়ে বৈশ্বিক একটি প্রচারণা চালানো হচ্ছে। একটি বিশেষ গোষ্ঠীর দ্বারা এই প্রচারণা চলছে। তবে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ও স্বাভাবিক সম্পর্ক দেখতে চায়। রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বিদেশি কূটনীতিকদের জন্য আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন তিনি।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণে দুই দেশে উত্তেজনা বাড়ানো হচ্ছে। এমন উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই দুই দেশের সরকারের মধ্যে যোগাযোগ হওয়া দরকার। নিয়মিত বসা দরকার।

ভারতে বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার আহমেদ তারিক করিম মনে করেন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কে ওঠানামা থাকে। তার অর্থ এটা নয়, সেটা মিশনে হামলা পর্যন্ত গড়াবে। জাতীয় পতাকার অবমাননা করতে হবে।

তারিক করিম ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দিল্লিতে হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। আজকের পত্রিকাকে গতকাল তিনি বলেন, ‘উত্তেজনা বাড়লে সেটা ওদের জন্য ভালো নয়; আমাদের জন্যও নয়। দুই সরকারের পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো দরকার। কথা বলা দরকার।’

গতকাল আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলা এবং জাতীয় পতাকার অবমাননাই প্রথম নয়; এর আগে গত ২৮ নভেম্বর কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের সামনে জাতীয় পতাকা পুড়িয়েছে বিক্ষোভকারীরা। বাংলাদেশ সরকার মনে করছে, মিশনগুলোর সামনে বিক্ষোভের সময় ভারতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অনেকটা নিষ্ক্রিয় থাকছেন।

কূটনৈতিক চ্যানেলে আগরতলা থেকে পাওয়া তথ্যের সূত্রে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, পূর্বপরিকল্পিত উপায়ে সেখানে হিন্দু সংঘর্ষ সমিতির বিক্ষোভকারীদের মিশন চত্বরে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে। তারা মিশনের প্রধান ফটক ভেঙে ঢুকে যায়। পতাকাদণ্ড ভেঙে ফেলে। পতাকা ছিঁড়ে ফেলে। কলকাতা ও আগরতলার ঘটনা কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ে ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন, এমনটা মনে করে বাংলাদেশ সরকার।

অন্য এক কূটনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করে গত ৫ আগস্ট ভারতে যাওয়ার পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে আসা অস্থিরতা গত ১৫ বছর ভারত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে নীতি অনুসরণ করেছে, তার ফল। দুই দেশের জনগণের মধ্যকার সম্পর্ককে গুরুত্ব না দিয়ে ভারত আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার সঙ্গে সম্পর্ককেই জোরালো করায় এমনটা ঘটেছে। এ ছাড়া ভারতের শাসক দল বিজেপি, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিএমসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিজেদের রাজনৈতিক কারণে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়কে ব্যবহার করছে।

তৃণমূল প্রধান ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েনের ব্যবস্থা করতে কেন্দ্রের কাছে আবদার করেছেন। বাংলাদেশের এক কূটনীতিক মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন প্রদেশে বিজেপির পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ ইস্যুতে যে বিক্ষোভ হচ্ছে, তাতে নিজের দল যাতে জনমত না হারায়, সে কারণে মমতা এমন মন্তব্য করেছেন।

সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশে সনাতন ধর্মের একাংশের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে একটি মামলায় গ্রেপ্তারের পর মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে ভারত সরকার। ভারতীয় গণমাধ্যমকেও ব্যবহার করে তারা।

বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পরস্পর নির্ভরশীলতার, এমনটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সুইজারল্যান্ডে দায়িত্ব পালন করা এই কূটনীতিক বলেন, দুই দেশের সরকারসহ সকলের উচিত উগ্র দেশপ্রেমে (জিংগোইজম) না ভেসে গিয়ে উত্তেজনা কমিয়ে আনা। মানুষের ইস্যুগুলোর ওপর জোর দেওয়া।

বিশ্লেষকেরা দুই সরকারকে বসার তাগিদ দিলেও ঢাকা থেকে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বৈঠক করার জন্য যে ডাক দেওয়া হয়েছে, গতকাল পর্যন্ত তাতে সাড়া দেয়নি দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশের একজন কূটনীতিক জানান, ভারত অনেক সময় এমন বৈঠকে আসার কথা শেষ মুহূর্তে জানায়।

আরও পড়ুন—

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত