নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
সংবিধান সংস্কার
বর্তমান বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। সেটি পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ রাখার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। সেই সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে কমিশন।
গতকাল বুধবার দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এতে সাতটি প্রধান বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে একগুচ্ছ সুপারিশ করা হয়েছে। বিষয়গুলো হলো: ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস, অন্তর্বর্তী সরকারকাঠামোর সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সুনিশ্চিতকরণ এবং মৌলিক অধিকারের আওতা সম্প্রসারণ, সাংবিধানিক সুরক্ষা ও বলবৎযোগ্যতা নিশ্চিতকরণ।
সংবিধান সংস্কারের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল সুস্পষ্ট। কার্যকর গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার সুনিশ্চিতকরণ এবং জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা। সেদিক থেকে বিবেচনা করে সংবিধানে যে ধারা ও বিষয়গুলোর সংস্কার করা দরকার, তা বলেছি। আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের যে জন-আকাঙ্ক্ষা, তার প্রতিফলন হিসেবে রাষ্ট্রের পাঁচটি মূলনীতির সুপারিশ করেছি। সেগুলো হচ্ছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র।’
কমিশন রাষ্ট্র পরিচালনার বিদ্যমান মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এবং এ সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদগুলো বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া সংবিধানের প্রযোজ্য সব ক্ষেত্রে ‘প্রজাতন্ত্র’-এর পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলো ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। তবে ইংরেজি সংস্করণে ‘Republic’ এবং ‘Peoples Republic of Bangladesh’ শব্দগুলো থাকবে। ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি...’ কমিশন এই বিধান বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে। সংবিধানের বর্তমান অনুচ্ছেদ ৬(২) সংশোধন করে ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ “বাংলাদেশি” বলে পরিচিত হবেন’ হিসেবে প্রতিস্থাপনের সুপারিশ করেছে কমিশন।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা মনে করি, বাংলাদেশকে যেভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বলা হয়, তার মধ্যে প্রজাতন্ত্রের কথার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছি। আমরা বলেছি, বাংলাদেশ পরিচিত হওয়া উচিত জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে।’
সংস্কার কমিশন একটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে নিম্নকক্ষ জাতীয় সংসদ এবং উচ্চকক্ষ সিনেট নামে পরিচিত হবে। উভয় কক্ষের মেয়াদ হবে চার বছর। নিম্নকক্ষ গঠিত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সরাসরি নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে। ৪০০ আসন নিয়ে নিম্নকক্ষ গঠিত হবে। এর মধ্যে ১০০টি থাকবে নারী আসন। অন্যদিকে উচ্চকক্ষ মোট ১০৫ জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হবে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন রাষ্ট্রীয় কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনয়ন এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করার জন্য একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের সুপারিশ করেছে। এই কাউন্সিল হবে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। আর এই কাউন্সিলের সদস্য হবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্নকক্ষের স্পিকার, উচ্চকক্ষের স্পিকার, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দল মনোনীত নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দল মনোনীত উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতার প্রতিনিধিত্বকারী সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের উভয় কক্ষের সদস্যরা ব্যতীত, আইনসভার উভয় কক্ষের বাকি সকল সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে তাঁদের মধ্য থেকে মনোনীত ১ জন সদস্য।
সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে ইলেকটোরাল কলেজের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সুপারিশ করেছে। রাষ্ট্রপতির মেয়াদ হবে চার বছর। রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ দুবারের বেশি অধিষ্ঠিত থাকবেন না। রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করা যাবে। নিম্নকক্ষ থেকে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হবে।
একই ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হওয়ার বিধানের সুপারিশ করে সংবিধান সংস্কার কমিশন। সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না।
সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদনের পর গণভোটের মাধ্যমে করার সুপারিশ করা হয়। আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের পুনরুদ্ধার বা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলেছি।
বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশ করা হয়েছে জানিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ বলেন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারকে সুগম ও মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হলে বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার। সুপ্রিম কোর্টের একক চরিত্র অক্ষুণ্ন রেখে দেশের সকল বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বিভাগের মর্যাদাসম্পন্ন একটি স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছি।
অংশীজনদের প্রায় সবাই শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় জোর দিয়েছেন উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, স্থানীয় সরকার কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছি। জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে সমন্বয় কাউন্সিল গঠনের কথা বলেছি। মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণের কথা বলেছি। সেটা সাংবিধানিক সুরক্ষা ও বলবৎ হয়, তা নিশ্চিতের জন্য সমন্বিত একক সনদের কথা বলেছি।
এ ছাড়া সাংবিধানিকভাবে চার বছর মেয়াদি মানবাধিকার, নির্বাচন, সরকারি কর্ম কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেয় কমিশন। জরুরি অবস্থা জারির জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের সুপারিশে রাষ্ট্রপতিকে ঘোষণার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবে যাতে নাগরিক অধিকার রদ বা স্থগিত এবং আদালতের যাওয়ার অধিকার বন্ধ বা স্থগিত করা যাবে না বলে প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন। এই ক্ষেত্রে বর্তমান সংবিধানের ১৪১খ ও গ অনুচ্ছেদ বাতিলের সুপারিশ করেছে কমিশন।
সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, এইগুলো একটা খসড়া প্রস্তাবনা হয়েছে। তাঁরা যেটা মনে করছেন যে সংবিধানের এই জায়গায় পরিবর্তন আসা দরকার। এখন এটা নিয়ে আলোচনা হবে, চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এগুলো গ্রহণ করবে কি না।
দ্বিকক্ষ সংসদের প্রস্তাবটি নতুন উল্লেখ করে শাহদীন মালিক বলেন, এগুলো অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ঠিক আছে, তারা আলোচনা সূত্রপাতের জন্য একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এখন এটা নিয়ে আন্দোলনে যারা জড়িত, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে আলোচনা শুরু হলে তারপর এটার সুরাহা হবে।
নির্বাচন সংস্কার: ৪০ শতাংশের কম ভোট পড়লে পুনরায় নির্বাচন
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে ১৫০টির মতো সুপারিশ করেছে কমিশন। এর মধ্যে আছে ৪০ শতাংশের কম ভোট পড়লে পুনরায় নির্বাচন হবে। ‘না ভোট’-এর ব্যবস্থা রাখা এবং না ভোট বিজয়ী হলে নির্বাচন বাতিল। এই ভোটের প্রার্থীরা পরের ধাপে প্রার্থী হতে পারবেন না।
এমন সব সুপারিশ করে গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে গেছে। সেটিকে ঠিক করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। নির্বাচনব্যবস্থায় স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায় যা করা দরকার, সেটাই করার চেষ্টা করেছি। একই সঙ্গে সব অংশীজনের দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা এবং নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ভোটারদের ভোট দেওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার প্রস্তাব দিয়েছি।’
বদিউল আলম আরও বলেন, ‘গত তিনটি নির্বাচনে যারা নির্বাচনব্যবস্থাকে নির্বাসনে নিয়েছে, শুধু কর্মকর্তা নয়, আমাদের কমিশনের সদস্যের বিষয়ে তদন্ত করা দরকার। বিশেষত ২০১৮ সালে মধ্যরাতে যে অভূতপূর্ব কাণ্ড ঘটেছে, সে ব্যাপারে একটি তদন্ত করে তাদের বিচারের আওতায় আনা গুরুত্বপূর্ণ।’
কমিশনের সুপারিশের মধ্যে বড়দাগে আছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা ও দুবারের বেশি কেউ যেন প্রধানমন্ত্রী না হতে পারেন, সেই প্রস্তাব। তবে দুবার প্রধানমন্ত্রী হলে পরে তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন। এ ছাড়া একই ব্যক্তি একই সঙ্গে দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা যাতে না হতে পারেন, সেই প্রস্তাবও দিয়েছে কমিশন।
সরাসরি নির্বাচনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত যেসব বিষয়ে সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেছে কমিশন, তার মধ্যে আছে—অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা। প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতায় ঋণ-বিলখেলাপিদের প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখা। প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে তিন বছর আগে অবসর গ্রহণ-সংক্রান্ত আরপিওর বিধান বাতিল করা। গুরুতর মানবাধিকার (বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, অমানবিক নির্যাতন, সাংবাদিক/মানবাধিকারকর্মীর ওপর হামলা) এবং গুরুতর দুর্নীতি, অর্থ পাচারের অভিযোগে গুম কমিশন বা দুর্নীতি দমন কমিশন বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক অভিযুক্ত হলে তাঁদের সংবিধানের ৬৬(২)(ছ) অনুচ্ছেদের অধীনে একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করে সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য করা।
এ ছাড়া নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিধান বাতিল করা; নির্বাচনের সময়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করা।
সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ১০০ আসন নিয়ে সংসদের উচ্চকক্ষ সৃষ্টির সুপারিশ করেছে কমিশন। সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের হারের ভিত্তিতে (সংখ্যানুপাতিকভাবে) আসন বণ্টন করার কথা বলেছে কমিশন।
উচ্চকক্ষের নির্বাচনের বিষয়ে কমিশনের মত, নিম্নকক্ষে দলগুলোর প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে তাদের জন্য উচ্চকক্ষে ৫০ শতাংশ আসন বরাদ্দ। অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ আসন নির্দলীয় ভিত্তিতে নাগরিক সমাজ, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, মানবসেবা প্রদানকারী, শ্রমজীবীদের প্রতিনিধি, নারী উন্নয়নকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে সংখ্যানুপাতিক হারে পূরণ করা। তবে উচ্চকক্ষে সব মিলিয়ে নারীদের জন্য কমপক্ষে ৩০ শতাংশ আসন নিশ্চিত করতে হবে। উচ্চকক্ষের সদস্যদের বয়স কমপক্ষে ৩৫ বছর এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা কমপক্ষে স্নাতক নির্ধারণ করার কথা বলেছে কমিশন।
সংসদের নিম্নকক্ষের আসন ১০০ বাড়িয়ে ৪০০ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে নারীর জন্য নির্ধারিত রাখতে হবে ১০০ আসন। এই ১০০ আসন নির্ধারণ করা যেতে পারে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে।
এ ছাড়া একটি স্থায়ী ‘স্থানীয় সরকার কমিশন’ গঠন করা, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা, স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় করার জন্য আইন সংশোধন করা এবং জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন, ২০২৩ জরুরি ভিত্তিতে বাতিল করার সুপারিশ করেছে কমিশন।
পুলিশ সংস্কার: প্রাণহানি কমাতে পুলিশ বল প্রয়োগ করবে ৫ স্তরে
বেআইনি সমাবেশ ও শোভাযাত্রা ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশকে পাঁচ ধাপে বলপ্রয়োগের সুপারিশ করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে কমিশন উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে। কমিশন একটি নিরপেক্ষ পুলিশ কমিশন গঠনের পক্ষে মত দিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গতকাল বুধবার জমা দেওয়া পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে পুলিশ বাহিনী নিয়ে এসব সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদন জমা দেন পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন। প্রতিবেদনে থানায় নারী আসামির জন্য ২৪ ঘণ্টা নারী পুলিশ ডেস্ক রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের জন্য ২২টি আইনের সংশোধন ও পরিমার্জনের প্রস্তাব করেছে কমিশন।
প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় সফর রাজ হোসেন বলেন, ২ লাখ ২০ হাজারের বেশি পুলিশকে তিন হাজারের বেশি আইন নিয়ে কাজ করতে হয়। সব আইন খুঁটিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। তবে এ ২২টি আইনের সংশোধন, পরিমার্জন বা কোনো ক্ষেত্রে পরিবর্তন করতে হবে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ভিড় বা জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কিছু নিয়মকানুন আছে। এ ক্ষেত্রে ইউরোপের মডেল অনুসরণ করার সুপারিশ করা হয়েছে। বেআইনি সমাবেশ ও শোভাযাত্রা ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশকে পাঁচ স্তরে বলপ্রয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে ন্যূনতম ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির ঝুঁকি এড়িয়ে চলা সম্ভব হবে।
গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলন দমাতে ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান, নির্বাচনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের মতো পুলিশ সংস্কার কমিশনও গঠন করে। গতকাল ছিল কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার দিন।
কমিশনের প্রতিবেদনে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার এবং রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সফর রাজ হোসেন বলেন, দুটি ক্ষেত্রেই হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের কিছু নির্দেশনা আছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে হয়তো জনসাধারণের কষ্ট লাঘব হতো। সরকারের রিভিউ আবেদনের কারণে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তাঁরা এই আবেদন প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছেন।
প্রতিটি থানায় নারী আসামির জন্য পুলিশের নারী উপপরিদর্শক, সহকারী উপপরিদর্শক ও কনস্টেবলকে দিয়ে ২৪ ঘণ্টার জন্য ডেস্ক করার সুপারিশ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। দীর্ঘ সময় লাগলেও এই সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য বলে মনে করে কমিশন।
চাকরির জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন। তবে চাকরিপ্রার্থী দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব-সংক্রান্ত কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে তা ভেরিফিকেশন প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হতে হবে। এটিও হতে হবে এক মাসের মধ্যে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের তদন্তভার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে দিতে জোরালো সুপারিশ করেছে কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি নিরপেক্ষ, প্রভাবমুক্ত পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে সংস্কার কমিশন নীতিগতভাবে ঐকমত্য পোষণ করেছে। পুলিশে নিয়োগ-পদোন্নতির ক্ষেত্রে যোগ্য কর্মকর্তাদের তালিকা করা, পুলিশে আলাদা মেডিকেল কোর ও টেকনিক্যাল কোর করারও সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে থানায় জিডি নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে বলা হয়েছে। কোনোভাবেই জিডি প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। প্রতিবেদনে ফৌজদারি মামলার তদন্তে একটি বিশেষায়িত দল গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।
দুদক সংস্কার: দুদককে ‘স্বাধীন ও কার্যকর’ করতে ৪৭ সুপারিশ
ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থে সুবিধা আদায়ে ব্যবহৃত আইন বাতিল এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) ‘স্বাধীন’ ও ‘সাংবিধানিক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়াসহ সংস্থাটির সংস্কারে মোট ৪৭টি সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন। গতকাল বুধবার দুপুরে সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি দল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তাদের সুপারিশ-সংবলিত প্রতিবেদন হস্তান্তর করে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে দুই দফায় দুদকসহ ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। দুদক-সংক্রান্ত কমিশনটি গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের একটি। দীর্ঘদিন দুর্নীতির ওপর নজরদারি করা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের দায়িত্বে থাকা ড. ইফতেখারুজ্জামানকে এর প্রধান করা হয়।
কমিশন দুদককে একটি কার্যকর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে এবং প্রতিষ্ঠানটির আমূল সংস্কারে সুপারিশগুলো করেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার, আইন পরিবর্তনসহ ১০টি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন। সংস্কার কমিশনের বক্তব্য হচ্ছে, দুর্নীতি প্রতিরোধ দুদকের একার কাজ নয়; দুর্নীতি নির্মূলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ জরুরি।
সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও আইনি সংস্কার, দুর্নীতি কমিশনের মর্যাদা ও গঠন; অভিযোগ ব্যবস্থাপনা, অনুসন্ধান, তদন্ত ও বিচার; দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম এই কয়েকটি উপশিরোনামের অধীনে ৪৭টি সুপারিশ তুলে ধরেছে।
প্রতিবেদনে দুদকের ওপর থেকে রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক প্রভাব ও সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, অনিয়মসহ অনাচারগুলো দূর করতে টাস্কফোর্স গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রভাবের কারণে দুদকে সৃষ্ট পেশাগত বৈষম্য দূর করতে সুনির্দিষ্ট কিছু সুপারিশ রয়েছে এতে।
শুরুতেই ‘রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও আইনি সংস্কার’ উপশিরোনামের আওতায় রয়েছে ১০টি সুপারিশ। এর প্রথমটিতে বলা হয়েছে, সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করে লিখতে হবে: কোনো ব্যক্তি যাতে ব্যক্তিগত স্বার্থে সাংবিধানিক ও আইনগত ক্ষমতার অপব্যবহার করতে বা অনুপার্জিত আয় ভোগ করতে না পারে। অনুপার্জিত আয় বৈধ করার রাষ্ট্রীয় চর্চা স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে।
জাতীয় দুর্নীতিবিরোধী কৌশলপত্র প্রণয়ন করে তা প্রতিপালিত হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণের জন্য সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিরসন নিয়ে কোনো আইন না থাকার কারণে রাষ্ট্রীয় বা সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার হয়ে থাকে। এ ধরনের সমস্যা সমাধানে ‘স্বার্থের দ্বন্দ্ব’ বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে হবে। বেনামি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ পাচার প্রতিহত করতে আন্তর্জাতিক চর্চার অনুরূপ সব ধরনের কোম্পানি, ট্রাস্ট বা ফাউন্ডেশন-জাতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত মালিকানা জনস্বার্থে প্রকাশ করার জন্য আইন করা।
দুদকের সংস্কার বিষয়ে
সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে দুদককে ‘সাংবিধানিক’ প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি দিতে বলা হয়েছে। তিন সদস্যের পরিবর্তে ‘পরিসর’ বাড়িয়ে পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশন গঠনে সার্চ কমিটির পরিবর্তে ‘বাছাই ও পর্যবেক্ষণ’ কমিটি করা; দুদকের বিতর্কিত চাকরিবিধি ৫৪-এর ২ ধারা বাতিল; সচিব, মহাপরিচালক ও পরিচালক পদে নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ৬০ ও ৭৫ শতাংশ পদায়ন ইত্যাদি সুপারিশ করা হয়।
দুদকের কর্মকাণ্ডকে স্বচ্ছ করতে জনগণের কাছে জবাবদিহি করা এবং দুদকের কর্মীদের দুর্নীতির বিষয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করা, দোষীদের অপসারণ ও যথাযথ জবাবদিহির আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে। দুদকের কর্মীদের প্রণোদনার হার সরকারি স্কেলের চেয়ে দ্বিগুণ করতে বলা হয়েছে।
সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দুদক একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আছে। এটাকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা চাই দুদক যেন স্বাধীন ও কার্যকর হয়। আমরা একটি পরিপূর্ণ সংস্কারের সুপারিশ তৈরি করেছি।’
সংস্কার কমিশন বলেছে, তাদের সুপারিশগুলো তিনভাবে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এসব সুপারিশের মধ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। স্বল্পমেয়াদিগুলো ছয় মাসে, মধ্য মেয়াদিগুলো ১৮ মাসে এবং দীর্ঘমেয়াদিগুলো ৪৮ মাসে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
সংবিধান সংস্কার
বর্তমান বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। সেটি পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ রাখার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। সেই সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে কমিশন।
গতকাল বুধবার দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এতে সাতটি প্রধান বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে একগুচ্ছ সুপারিশ করা হয়েছে। বিষয়গুলো হলো: ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস, অন্তর্বর্তী সরকারকাঠামোর সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সুনিশ্চিতকরণ এবং মৌলিক অধিকারের আওতা সম্প্রসারণ, সাংবিধানিক সুরক্ষা ও বলবৎযোগ্যতা নিশ্চিতকরণ।
সংবিধান সংস্কারের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল সুস্পষ্ট। কার্যকর গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার সুনিশ্চিতকরণ এবং জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা। সেদিক থেকে বিবেচনা করে সংবিধানে যে ধারা ও বিষয়গুলোর সংস্কার করা দরকার, তা বলেছি। আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের যে জন-আকাঙ্ক্ষা, তার প্রতিফলন হিসেবে রাষ্ট্রের পাঁচটি মূলনীতির সুপারিশ করেছি। সেগুলো হচ্ছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র।’
কমিশন রাষ্ট্র পরিচালনার বিদ্যমান মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এবং এ সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদগুলো বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া সংবিধানের প্রযোজ্য সব ক্ষেত্রে ‘প্রজাতন্ত্র’-এর পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলো ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। তবে ইংরেজি সংস্করণে ‘Republic’ এবং ‘Peoples Republic of Bangladesh’ শব্দগুলো থাকবে। ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি...’ কমিশন এই বিধান বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে। সংবিধানের বর্তমান অনুচ্ছেদ ৬(২) সংশোধন করে ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ “বাংলাদেশি” বলে পরিচিত হবেন’ হিসেবে প্রতিস্থাপনের সুপারিশ করেছে কমিশন।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা মনে করি, বাংলাদেশকে যেভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বলা হয়, তার মধ্যে প্রজাতন্ত্রের কথার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছি। আমরা বলেছি, বাংলাদেশ পরিচিত হওয়া উচিত জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে।’
সংস্কার কমিশন একটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে নিম্নকক্ষ জাতীয় সংসদ এবং উচ্চকক্ষ সিনেট নামে পরিচিত হবে। উভয় কক্ষের মেয়াদ হবে চার বছর। নিম্নকক্ষ গঠিত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সরাসরি নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে। ৪০০ আসন নিয়ে নিম্নকক্ষ গঠিত হবে। এর মধ্যে ১০০টি থাকবে নারী আসন। অন্যদিকে উচ্চকক্ষ মোট ১০৫ জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হবে।
সংবিধান সংস্কার কমিশন রাষ্ট্রীয় কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনয়ন এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করার জন্য একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের সুপারিশ করেছে। এই কাউন্সিল হবে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। আর এই কাউন্সিলের সদস্য হবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্নকক্ষের স্পিকার, উচ্চকক্ষের স্পিকার, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দল মনোনীত নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দল মনোনীত উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতার প্রতিনিধিত্বকারী সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের উভয় কক্ষের সদস্যরা ব্যতীত, আইনসভার উভয় কক্ষের বাকি সকল সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে তাঁদের মধ্য থেকে মনোনীত ১ জন সদস্য।
সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে ইলেকটোরাল কলেজের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সুপারিশ করেছে। রাষ্ট্রপতির মেয়াদ হবে চার বছর। রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ দুবারের বেশি অধিষ্ঠিত থাকবেন না। রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করা যাবে। নিম্নকক্ষ থেকে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হবে।
একই ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হওয়ার বিধানের সুপারিশ করে সংবিধান সংস্কার কমিশন। সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না।
সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদনের পর গণভোটের মাধ্যমে করার সুপারিশ করা হয়। আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের পুনরুদ্ধার বা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলেছি।
বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশ করা হয়েছে জানিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ বলেন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারকে সুগম ও মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হলে বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার। সুপ্রিম কোর্টের একক চরিত্র অক্ষুণ্ন রেখে দেশের সকল বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বিভাগের মর্যাদাসম্পন্ন একটি স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছি।
অংশীজনদের প্রায় সবাই শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় জোর দিয়েছেন উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, স্থানীয় সরকার কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছি। জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে সমন্বয় কাউন্সিল গঠনের কথা বলেছি। মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণের কথা বলেছি। সেটা সাংবিধানিক সুরক্ষা ও বলবৎ হয়, তা নিশ্চিতের জন্য সমন্বিত একক সনদের কথা বলেছি।
এ ছাড়া সাংবিধানিকভাবে চার বছর মেয়াদি মানবাধিকার, নির্বাচন, সরকারি কর্ম কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেয় কমিশন। জরুরি অবস্থা জারির জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের সুপারিশে রাষ্ট্রপতিকে ঘোষণার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবে যাতে নাগরিক অধিকার রদ বা স্থগিত এবং আদালতের যাওয়ার অধিকার বন্ধ বা স্থগিত করা যাবে না বলে প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন। এই ক্ষেত্রে বর্তমান সংবিধানের ১৪১খ ও গ অনুচ্ছেদ বাতিলের সুপারিশ করেছে কমিশন।
সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, এইগুলো একটা খসড়া প্রস্তাবনা হয়েছে। তাঁরা যেটা মনে করছেন যে সংবিধানের এই জায়গায় পরিবর্তন আসা দরকার। এখন এটা নিয়ে আলোচনা হবে, চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এগুলো গ্রহণ করবে কি না।
দ্বিকক্ষ সংসদের প্রস্তাবটি নতুন উল্লেখ করে শাহদীন মালিক বলেন, এগুলো অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ঠিক আছে, তারা আলোচনা সূত্রপাতের জন্য একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এখন এটা নিয়ে আন্দোলনে যারা জড়িত, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে আলোচনা শুরু হলে তারপর এটার সুরাহা হবে।
নির্বাচন সংস্কার: ৪০ শতাংশের কম ভোট পড়লে পুনরায় নির্বাচন
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে ১৫০টির মতো সুপারিশ করেছে কমিশন। এর মধ্যে আছে ৪০ শতাংশের কম ভোট পড়লে পুনরায় নির্বাচন হবে। ‘না ভোট’-এর ব্যবস্থা রাখা এবং না ভোট বিজয়ী হলে নির্বাচন বাতিল। এই ভোটের প্রার্থীরা পরের ধাপে প্রার্থী হতে পারবেন না।
এমন সব সুপারিশ করে গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে গেছে। সেটিকে ঠিক করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। নির্বাচনব্যবস্থায় স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায় যা করা দরকার, সেটাই করার চেষ্টা করেছি। একই সঙ্গে সব অংশীজনের দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা এবং নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ভোটারদের ভোট দেওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার প্রস্তাব দিয়েছি।’
বদিউল আলম আরও বলেন, ‘গত তিনটি নির্বাচনে যারা নির্বাচনব্যবস্থাকে নির্বাসনে নিয়েছে, শুধু কর্মকর্তা নয়, আমাদের কমিশনের সদস্যের বিষয়ে তদন্ত করা দরকার। বিশেষত ২০১৮ সালে মধ্যরাতে যে অভূতপূর্ব কাণ্ড ঘটেছে, সে ব্যাপারে একটি তদন্ত করে তাদের বিচারের আওতায় আনা গুরুত্বপূর্ণ।’
কমিশনের সুপারিশের মধ্যে বড়দাগে আছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা ও দুবারের বেশি কেউ যেন প্রধানমন্ত্রী না হতে পারেন, সেই প্রস্তাব। তবে দুবার প্রধানমন্ত্রী হলে পরে তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন। এ ছাড়া একই ব্যক্তি একই সঙ্গে দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা যাতে না হতে পারেন, সেই প্রস্তাবও দিয়েছে কমিশন।
সরাসরি নির্বাচনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত যেসব বিষয়ে সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেছে কমিশন, তার মধ্যে আছে—অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা। প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতায় ঋণ-বিলখেলাপিদের প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখা। প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে তিন বছর আগে অবসর গ্রহণ-সংক্রান্ত আরপিওর বিধান বাতিল করা। গুরুতর মানবাধিকার (বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, অমানবিক নির্যাতন, সাংবাদিক/মানবাধিকারকর্মীর ওপর হামলা) এবং গুরুতর দুর্নীতি, অর্থ পাচারের অভিযোগে গুম কমিশন বা দুর্নীতি দমন কমিশন বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কর্তৃক অভিযুক্ত হলে তাঁদের সংবিধানের ৬৬(২)(ছ) অনুচ্ছেদের অধীনে একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করে সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য করা।
এ ছাড়া নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিধান বাতিল করা; নির্বাচনের সময়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করা।
সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ১০০ আসন নিয়ে সংসদের উচ্চকক্ষ সৃষ্টির সুপারিশ করেছে কমিশন। সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের হারের ভিত্তিতে (সংখ্যানুপাতিকভাবে) আসন বণ্টন করার কথা বলেছে কমিশন।
উচ্চকক্ষের নির্বাচনের বিষয়ে কমিশনের মত, নিম্নকক্ষে দলগুলোর প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে তাদের জন্য উচ্চকক্ষে ৫০ শতাংশ আসন বরাদ্দ। অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ আসন নির্দলীয় ভিত্তিতে নাগরিক সমাজ, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, মানবসেবা প্রদানকারী, শ্রমজীবীদের প্রতিনিধি, নারী উন্নয়নকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে সংখ্যানুপাতিক হারে পূরণ করা। তবে উচ্চকক্ষে সব মিলিয়ে নারীদের জন্য কমপক্ষে ৩০ শতাংশ আসন নিশ্চিত করতে হবে। উচ্চকক্ষের সদস্যদের বয়স কমপক্ষে ৩৫ বছর এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা কমপক্ষে স্নাতক নির্ধারণ করার কথা বলেছে কমিশন।
সংসদের নিম্নকক্ষের আসন ১০০ বাড়িয়ে ৪০০ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে নারীর জন্য নির্ধারিত রাখতে হবে ১০০ আসন। এই ১০০ আসন নির্ধারণ করা যেতে পারে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে।
এ ছাড়া একটি স্থায়ী ‘স্থানীয় সরকার কমিশন’ গঠন করা, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা, স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় করার জন্য আইন সংশোধন করা এবং জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন, ২০২৩ জরুরি ভিত্তিতে বাতিল করার সুপারিশ করেছে কমিশন।
পুলিশ সংস্কার: প্রাণহানি কমাতে পুলিশ বল প্রয়োগ করবে ৫ স্তরে
বেআইনি সমাবেশ ও শোভাযাত্রা ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশকে পাঁচ ধাপে বলপ্রয়োগের সুপারিশ করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে কমিশন উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে। কমিশন একটি নিরপেক্ষ পুলিশ কমিশন গঠনের পক্ষে মত দিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গতকাল বুধবার জমা দেওয়া পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে পুলিশ বাহিনী নিয়ে এসব সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদন জমা দেন পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন। প্রতিবেদনে থানায় নারী আসামির জন্য ২৪ ঘণ্টা নারী পুলিশ ডেস্ক রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের জন্য ২২টি আইনের সংশোধন ও পরিমার্জনের প্রস্তাব করেছে কমিশন।
প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় সফর রাজ হোসেন বলেন, ২ লাখ ২০ হাজারের বেশি পুলিশকে তিন হাজারের বেশি আইন নিয়ে কাজ করতে হয়। সব আইন খুঁটিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। তবে এ ২২টি আইনের সংশোধন, পরিমার্জন বা কোনো ক্ষেত্রে পরিবর্তন করতে হবে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ভিড় বা জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কিছু নিয়মকানুন আছে। এ ক্ষেত্রে ইউরোপের মডেল অনুসরণ করার সুপারিশ করা হয়েছে। বেআইনি সমাবেশ ও শোভাযাত্রা ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশকে পাঁচ স্তরে বলপ্রয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে ন্যূনতম ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির ঝুঁকি এড়িয়ে চলা সম্ভব হবে।
গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলন দমাতে ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান, নির্বাচনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের মতো পুলিশ সংস্কার কমিশনও গঠন করে। গতকাল ছিল কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার দিন।
কমিশনের প্রতিবেদনে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার এবং রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সফর রাজ হোসেন বলেন, দুটি ক্ষেত্রেই হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের কিছু নির্দেশনা আছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে হয়তো জনসাধারণের কষ্ট লাঘব হতো। সরকারের রিভিউ আবেদনের কারণে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তাঁরা এই আবেদন প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছেন।
প্রতিটি থানায় নারী আসামির জন্য পুলিশের নারী উপপরিদর্শক, সহকারী উপপরিদর্শক ও কনস্টেবলকে দিয়ে ২৪ ঘণ্টার জন্য ডেস্ক করার সুপারিশ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। দীর্ঘ সময় লাগলেও এই সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য বলে মনে করে কমিশন।
চাকরির জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন। তবে চাকরিপ্রার্থী দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব-সংক্রান্ত কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে তা ভেরিফিকেশন প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হতে হবে। এটিও হতে হবে এক মাসের মধ্যে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের তদন্তভার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে দিতে জোরালো সুপারিশ করেছে কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি নিরপেক্ষ, প্রভাবমুক্ত পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে সংস্কার কমিশন নীতিগতভাবে ঐকমত্য পোষণ করেছে। পুলিশে নিয়োগ-পদোন্নতির ক্ষেত্রে যোগ্য কর্মকর্তাদের তালিকা করা, পুলিশে আলাদা মেডিকেল কোর ও টেকনিক্যাল কোর করারও সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে থানায় জিডি নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে বলা হয়েছে। কোনোভাবেই জিডি প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। প্রতিবেদনে ফৌজদারি মামলার তদন্তে একটি বিশেষায়িত দল গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।
দুদক সংস্কার: দুদককে ‘স্বাধীন ও কার্যকর’ করতে ৪৭ সুপারিশ
ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থে সুবিধা আদায়ে ব্যবহৃত আইন বাতিল এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) ‘স্বাধীন’ ও ‘সাংবিধানিক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়াসহ সংস্থাটির সংস্কারে মোট ৪৭টি সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন। গতকাল বুধবার দুপুরে সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি দল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তাদের সুপারিশ-সংবলিত প্রতিবেদন হস্তান্তর করে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে দুই দফায় দুদকসহ ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। দুদক-সংক্রান্ত কমিশনটি গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের একটি। দীর্ঘদিন দুর্নীতির ওপর নজরদারি করা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের দায়িত্বে থাকা ড. ইফতেখারুজ্জামানকে এর প্রধান করা হয়।
কমিশন দুদককে একটি কার্যকর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে এবং প্রতিষ্ঠানটির আমূল সংস্কারে সুপারিশগুলো করেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার, আইন পরিবর্তনসহ ১০টি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন। সংস্কার কমিশনের বক্তব্য হচ্ছে, দুর্নীতি প্রতিরোধ দুদকের একার কাজ নয়; দুর্নীতি নির্মূলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ জরুরি।
সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও আইনি সংস্কার, দুর্নীতি কমিশনের মর্যাদা ও গঠন; অভিযোগ ব্যবস্থাপনা, অনুসন্ধান, তদন্ত ও বিচার; দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম এই কয়েকটি উপশিরোনামের অধীনে ৪৭টি সুপারিশ তুলে ধরেছে।
প্রতিবেদনে দুদকের ওপর থেকে রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক প্রভাব ও সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, অনিয়মসহ অনাচারগুলো দূর করতে টাস্কফোর্স গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রভাবের কারণে দুদকে সৃষ্ট পেশাগত বৈষম্য দূর করতে সুনির্দিষ্ট কিছু সুপারিশ রয়েছে এতে।
শুরুতেই ‘রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও আইনি সংস্কার’ উপশিরোনামের আওতায় রয়েছে ১০টি সুপারিশ। এর প্রথমটিতে বলা হয়েছে, সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করে লিখতে হবে: কোনো ব্যক্তি যাতে ব্যক্তিগত স্বার্থে সাংবিধানিক ও আইনগত ক্ষমতার অপব্যবহার করতে বা অনুপার্জিত আয় ভোগ করতে না পারে। অনুপার্জিত আয় বৈধ করার রাষ্ট্রীয় চর্চা স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে।
জাতীয় দুর্নীতিবিরোধী কৌশলপত্র প্রণয়ন করে তা প্রতিপালিত হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণের জন্য সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিরসন নিয়ে কোনো আইন না থাকার কারণে রাষ্ট্রীয় বা সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার হয়ে থাকে। এ ধরনের সমস্যা সমাধানে ‘স্বার্থের দ্বন্দ্ব’ বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে হবে। বেনামি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ পাচার প্রতিহত করতে আন্তর্জাতিক চর্চার অনুরূপ সব ধরনের কোম্পানি, ট্রাস্ট বা ফাউন্ডেশন-জাতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত মালিকানা জনস্বার্থে প্রকাশ করার জন্য আইন করা।
দুদকের সংস্কার বিষয়ে
সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে দুদককে ‘সাংবিধানিক’ প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি দিতে বলা হয়েছে। তিন সদস্যের পরিবর্তে ‘পরিসর’ বাড়িয়ে পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশন গঠনে সার্চ কমিটির পরিবর্তে ‘বাছাই ও পর্যবেক্ষণ’ কমিটি করা; দুদকের বিতর্কিত চাকরিবিধি ৫৪-এর ২ ধারা বাতিল; সচিব, মহাপরিচালক ও পরিচালক পদে নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ৬০ ও ৭৫ শতাংশ পদায়ন ইত্যাদি সুপারিশ করা হয়।
দুদকের কর্মকাণ্ডকে স্বচ্ছ করতে জনগণের কাছে জবাবদিহি করা এবং দুদকের কর্মীদের দুর্নীতির বিষয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করা, দোষীদের অপসারণ ও যথাযথ জবাবদিহির আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে। দুদকের কর্মীদের প্রণোদনার হার সরকারি স্কেলের চেয়ে দ্বিগুণ করতে বলা হয়েছে।
সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দুদক একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আছে। এটাকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা চাই দুদক যেন স্বাধীন ও কার্যকর হয়। আমরা একটি পরিপূর্ণ সংস্কারের সুপারিশ তৈরি করেছি।’
সংস্কার কমিশন বলেছে, তাদের সুপারিশগুলো তিনভাবে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এসব সুপারিশের মধ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। স্বল্পমেয়াদিগুলো ছয় মাসে, মধ্য মেয়াদিগুলো ১৮ মাসে এবং দীর্ঘমেয়াদিগুলো ৪৮ মাসে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগে নেওয়ার আইন বাতিল চেয়েছে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আজ বুধবার ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ স্বাক্ষরিত চিঠি সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
৭ ঘণ্টা আগেসরকারি কর্মকর্তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে বিশেষ দায়িত্বশীল হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে বিশেষ দায়িত্বশীল...
৮ ঘণ্টা আগেপ্রায় ৫০০ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের পরিবারের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
৮ ঘণ্টা আগেপ্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের বিচ ভ্যালি, কিংশুক এবং সায়রি ইকো রিসোর্টে অগ্নিনির্বাপণে বাংলাদেশ নৌবাহিনী সহযোগিতা করেছে। পরে নৌসদস্যদের সঙ্গে যুক্ত হন কোস্ট গার্ড, বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরা। নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, বিজিবি...
৯ ঘণ্টা আগে