ভরা মৌসুমেও নদীতে ইলিশের আকাল

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০২১, ১০: ৪২

লকডাউনের প্রভাব পড়েছে সর্বত্র। কলকারখানায় ধোয়া নেই, দূষণও নেই। নদী এখন স্বচ্ছতোয়া। এমন পরিবেশে বুকভরে নিশ্বাস নিতে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ আসার কথা নদীতে। কিন্তু কোথাও ইলিশের দেখা নেই। বাজারে তাই ইলিশের আকাল। ইলিশ কম পাওয়ায় হতাশ ব্যবসায়ী ও আড়তদারেরা।

‘ইলিশের বাড়ি’খ্যাত চাঁদপুর। জেলার পদ্মা-মেঘনা নদীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জাল ফেলেও ইলিশ উঠছে না। খরচ পোষাতে পারছেন না জেলেরা। নদীতেই নামা বন্ধ করে দিয়েছেন। অন্য বছরগুলোতে এই সময়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ ইলিশ পাওয়া যেত চাঁদপুরে।

শুধু চাঁদপুর নয়, ইলিশের বড় মোকামের একই অবস্থা। আজকের পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধিরা ইলিশের হাহাকার নিয়ে যেসব তথ্য পাঠিয়েছেন, তা সত্যিই উদ্বেগের।

বরগুনার কথাই বলি। নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসছেন বরগুনার জেলেরা। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় জেলে, ট্রলারমালিক, মৎস্য ব্যবসায়ী ও মৎস্যজীবী শ্রমিকেরা।  

বরিশালের জেলেদের কপালেও চিন্তার ভাঁজ। ভরা মৌসুমেও ইলিশের দাম আকাশছোঁয়া। গোটা দক্ষিণাঞ্চলেই ইলিশ এখন সোনার হরিণ। ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে এখনো ইলিশের দেখা নেই। গত রোববার ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের মেঘনা নদীর পাড়ের মাছঘাটে সরেজমিনে দেখা গেছে, নদীর পাড়ে জাল ও নৌকা রেখে হতাশায় সময় কাটছে জেলেদের।

ইলিশ গবেষক ও সমুদ্রবিজ্ঞানীরা বলছেন, ইলিশ না পাওয়ার বড় কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। সেই সঙ্গে মানবসৃষ্ট বাধা, অসময়ে বৃষ্টি, পানির লবণাক্ততায় পরিবর্তন, ইকোসিস্টেম ধ্বংসসহ বিভিন্ন দূষণের কারণে ইলিশ মাছ বঙ্গোপসাগর থেকে নদীতে আসতে পারছে না। এসব উল্লেখ করে তাঁরা বলছেন, ইলিশ যাতায়াতের রুট পরিবর্তন করেছে।

দেশে এ বছরও নদী ও সাগরে মোট ১৫০ দিন জেলেরা মাছ ধরা থেকে বিরত ছিল ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে। পরিসংখ্যানও বলছে, এই সময় বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের প্রবেশমুখের নদীগুলোতে ইলিশের কমতি থাকার কথা নয়।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গত বছর অক্টোবর-নভেম্বরের সব শেষ তথ্য বলছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ৩৭ হাজার ৮০০ কোটি ইলিশের জাটকা তৈরি হয়েছে। সেগুলো সাগরে গেছে। যা এ বছর বড় ইলিশ হয়ে আবারও বাংলাদেশের নদনদীতে ফিরে আসার কথা। কিন্তু সেই জাটকা ইলিশ গেল কোথায়, কেন তারা ফিরছে না বাংলাদেশের নদীগুলোতে–বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে ইলিশ বিশেষজ্ঞদের।

ভারতের কেন্দ্রীয় মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে গত বছর ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর দুই দিনব্যাপী একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশের ইকোফিশ প্রকল্পের দলনেতা অধ্যাপক আবদুল ওহাব। তিনি বলেন, মা-ইলিশ যে নদীতে ডিম পাড়ে ও বাচ্চা ইলিশ যেখানে বড় হয়, পরিণত বয়সে তারা সমুদ্র থেকে সেই নদীতেই ফিরে আসে।  

মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ডফিশের ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের তথ্য বলছে, বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। চার বছর আগে বিশ্বের মোট উৎপাদিত ইলিশের ৬৫ শতাংশ আসত বাংলাদেশ থেকে। গত ৫ বছরে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে ইলিশের উৎপাদন। প্রতিবেশী ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে ইলিশের উৎপাদন উল্টো কমেছে।  

২০২০ সালের নভেম্বরে মৎস্য অধিদপ্তর ও ওয়ার্ল্ডফিশের গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে ৬ লাখ ৭০ হাজার টন ইলিশের সর্বোচ্চ টেকসই উৎপাদন সম্ভব।
বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হাসান আহমেদ বলেন, ইলিশ তাদের যাতায়াতের রুট পরিবর্তন করে থাকতে পারে। সাগর থেকে যে পথ দিয়ে ইলিশ বাংলাদেশের নদীগুলোতে আসে, সেখানে কোনোভাবে বাধা পেয়ে থাকতে পারে। নদীতে আসতে বাধা পেলে ইলিশ কম ধরা পড়বে এটাই স্বাভাবিক।  

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ও ইউনেসকোর আন্তসরকারি সামুদ্রিক সংস্থার ভারত মহাসাগরবিষয়ক কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ড. মোসলেম উদ্দিন বলেন, বৃষ্টিও হচ্ছে অসময়ে। নদীর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণে পরিবর্তনে এসেছে। জোয়ার-ভাটারও পরিবর্তন এসেছে। ইকোসিস্টেম বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। তাই শুধু মৎস্য গবেষকদের দিয়ে ইলিশের উৎপাদন ধরে রাখা যাবে না। এ জন্য ইলিশ ম্যানেজমেন্ট কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।

বিষয়:

লকডাউন

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত