সেক্টর কর্মসূচি না থাকায় গতিহীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা

  • এখনো অনুমোদন পায়নি পঞ্চম স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচি।
  • ব্যাহত টিকা, পুষ্টিসহ ৩০টির বেশি কর্মসূচি।
  • কমিউনিটি ক্লিনিক কর্মীদের বেতন বন্ধ ছয় মাস।
  • গর্ভবতীদের ফলিক অ্যাসিড, আয়রন ট্যাবলেটও বন্ধ।
  • জরুরি সেবা চালু রাখতে রাজস্ব বরাদ্দের আবেদন।
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০: ৫৪
ছবি: সংগৃহীত

দেশের স্বাস্থ্য খাতের সিংহভাগ অবকাঠামো, রোগ প্রতিরোধ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয় পাঁচ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা বা অপারেশনাল প্ল্যানের (ওপি) মাধ্যমে। বর্তমানে ওপি চলমান না থাকায় পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় একরকম স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। গত জুলাইয়ে ‘পঞ্চম স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচি (এইচপিএনএসপি)’ শিরোনামের ওপির কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা অনুমোদন পায়নি। ফলে ব্যাহত হচ্ছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, হাসপাতালের সেবা ব্যবস্থাপনা, সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, টিকা ও পুষ্টি কার্যক্রমসহ ৩০টির বেশি বড় কর্মসূচি।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পঞ্চম এইচপিএনএসপির বাস্তবায়ন চলতি বছরের জুলাইতে শুরু হয়ে ২০২৯ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এর ব্যয়ের আকার ১ লাখ ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা। চতুর্থ এইচপিএনএসপি চলতি বছরের জুনে শেষ হয়ে গেছে। ফলে দেশে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, নিয়মিত ব্যবস্থাপনা ও সেবা কার্যক্রমের জন্য কোনো কর্মসূচি দাপ্তরিকভাবে চালু নেই।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, চতুর্থ কর্মসূচি চলার সময় পরবর্তী কর্মসূচির আগাম পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল। সেক্টর কর্মসূচির পদ্ধতিগত বিনিয়োগ পরিকল্পনা (এসআইপি) কার্যক্রমে যুক্ত থাকা একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আজকের পত্রিকাকে বলেছেন, ২০১৭ সালের জুলাইতে শুরু হওয়া চতুর্থ সেক্টর কর্মসূচির মেয়াদ আসলে ছিল ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। পরে আর্থিক বরাদ্দ ও মেয়াদ বৃদ্ধি করায় ২০২৪ সালের জুনে শেষ হয় ওই কর্মসূচি। চলতি বছর সাধারণ নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠন করা হয়। নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী কোথায় কী হচ্ছে, বুঝে নিচ্ছিলেন। এভাবেই জুন চলে আসে। বিভিন্ন ধাপে পঞ্চম সেক্টর কর্মসূচির পরিকল্পনার (পিআইপি) খসড়া প্রণয়নে দেরি হয়।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা সেক্টর কর্মসূচিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। তাঁরা বলেন, একই কাজ দুবার করা এড়াতে এ উন্নয়ন কর্মসূচির সূচনা করা হয়। আগে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ৩০ থেকে ৩৫টি অপারেশনাল প্ল্যান নিয়ে কাজ করত। এক কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম অন্য কর্তৃপক্ষ জানত না। এখন এক ওপির অধীনে সব কর্মসূচি একসঙ্গে শুরু এবং একসঙ্গে শেষ হয়।

সেক্টর কর্মসূচি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হলেও এর প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন-সম্পর্কিত সার্বিক সমন্বয় করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। কর্মসূচির খসড়া পরিকল্পনা কমিশনের যাচাই কমিটিতে পাঠানো হয়। এরপর অনুমোদনপ্রক্রিয়ার জন্য পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেশ কয়েকটি সংশোধনী দিয়ে সেক্টর কর্মসূচি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ফেরত পাঠায় পরিকল্পনা কমিশন। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আওতাধীন ২৩টি এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের আওতাধীন ১৫টি অপারেশনাল প্ল্যানের (ওপি) মাধ্যমে চতুর্থ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। পঞ্চমটিতে কয়েকটি কর্মসূচি বাড়ানোর প্রস্তাব ওঠায় তা যাচাই করা হচ্ছে।

সেক্টর কর্মসূচির প্রধান কাজগুলো হচ্ছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি), সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (সিডিসি), অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (এনসিডিসি), স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থাপনা ও ই-হেলথ, হাসপাতাল সেবা ব্যবস্থাপনা, জীবনধারা এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা ও প্রচার, মাতৃ, শিশু ও কৈশোর স্বাস্থ্যসেবা, চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন, সম্প্রসারিত টিকা কার্যক্রম (ইপিআই), জাতীয় চক্ষুসেবা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, প্রজননস্বাস্থ্য, পুষ্টি, সচেতনতামূলক কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ বা উচ্চশিক্ষা, ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কর্মশালা বা সেমিনার, তথ্য ব্যবস্থাপনা বা মানবসম্পদ উন্নয়ন, মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন, গবেষণা, ক্রয়, মজুত ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনা, যক্ষ্মা-কুষ্ঠ ও এইডস এবং নার্সিং ও মিডওয়াইফারি শিক্ষাসেবা।

চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য অনুযায়ী, দেশের স্বাস্থ্য খাতের সিংহভাগ কাজই ওপির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে সরকার। দীর্ঘদিন ধরে ওপির আওতায় কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়ে আসায় এর ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। এখন এটি না থাকায় সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্ট শাখা বলছে, ওপির মাধ্যমেই দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা করা হয়। এর ওপর সব জেলা হাসপাতালের চিকিৎসা যন্ত্রাংশ, অস্ত্রোপচারের সরঞ্জাম ও অন্যান্য উপকরণের শতভাগ অর্থায়ন নির্ভরশীল। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোর অর্ধেকের বেশি যন্ত্রাংশ দেওয়া হয় ওপির মাধ্যমে। বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল, রিএজেন্ট এবং ওষুধের এক-তৃতীয়াংশ দেওয়া হয়। সরকারি হাসপাতালে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তাকর্মীদের বেতনও এভাবে দেওয়া হয়। ওপি না থাকায় বন্ধ রয়েছে এসব কার্যক্রম।

হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্টের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক ডা. সুপ্রিয় সরকার আজকের পত্রিকাকে বলেন, হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্ট কর্মসূচির অতি জরুরি বিষয়গুলো অব্যাহত রাখতে রাজস্ব খাত থেকে বরাদ্দ দিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় দাপ্তরিক কার্যক্রম ও যানবাহনের জ্বালানির খরচও রাজস্ব থেকে অনুমোদনের আবেদন করা হয়েছে।

সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) কার্যক্রম ওপিতে হওয়ায় এতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এ কারণে ওপি বাস্তবায়ন শুরু না হওয়া পর্যন্ত রাজস্ব খাত থেকে টিকা কেনার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।

সারা দেশে তৃণমূলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সাড়ে ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিচি) নামে কর্মীদের বেতন বন্ধ রয়েছে ছয় মাস ধরে। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আখড়াখোলা ইউনিয়নের একটি কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি বলেছেন, তাঁরা পরিবার নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন। ওষুধের সরবরাহ না থাকায় তাঁরা সংকটের আশঙ্কা করছেন।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ারের লাইন ডিরেক্টর ডা. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কমিউনিটি ক্লিনিকের ওষুধ কেনা, বেতন দেওয়া এবং সব সেবা চলে ওপির অর্থে। ক্লিনিকগুলোতে মজুত থাকা ওষুধে চলবে জানুয়ারি পর্যন্ত। জরুরি মজুত দিয়ে মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলতে পারে।’ ওপি না থাকায় বন্ধ রয়েছে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ, এইডস, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মতো কার্যক্রম। জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের (আইপিএইচএন) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গর্ভবতী নারী ও কিশোরীদের জন্য জরুরি ফলিক অ্যাডিস ও আয়রনের ট্যাবলেটও দেওয়া হচ্ছে না।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কিছু সংশোধনীসহ পঞ্চম ওপি ফেরত এসেছে। আশা করছি সংশোধনীর কাজ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ হবে। টিকা কার্যক্রম চালু রাখতে রাজস্ব খাত থেকে টিকা কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত কমিটি প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি টাকার টিকা ক্রয়ের অনুমোদন দিয়েছে। হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্টের অত্যাবশ্যকীয় কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। তবে অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ। ওপির যেসব প্রকল্পে ফলাফল আসার সম্ভাবনা কম, সেগুলো বাদ দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে।’

জনস্বাস্থ্যবিদদের সংগঠন পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট (ইলেক্ট) অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যথাসময়ে যেন নতুন সেক্টর শুরু করা যায়, তার জন্য আগের কর্মসূচি চলমান থাকা অবস্থায় অন্তত দেড় বছর আগে থেকে কাজ শুরু করার প্রয়োজন ছিল। এখন দ্রুত একটা গ্রুপ করা উচিত, যারা দ্রুততার সঙ্গে অনুমোদনের জন্য জরুরি বিষয়গুলো চিহ্নিত করবে। ওপির বিষয়ে গুরুত্ব না দিলে স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিনে অর্জিত অগ্রগতি ভেঙে পড়বে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত