কামরুল হাসান, ঢাকা
থাইএয়ারের উড়োজাহাজে আসা দুই বিদেশিকে নিয়ে গাড়িটা সোজা চলে গেল ঢাকা বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনালের ভেতরে। দুই যাত্রীর একজন অ্যান্থনি সকার, আরেকজন বার্নার্ড রুডিগার। একজন ব্রিটিশ, অন্যজন জার্মান। দুজনই বিজনেস ক্লাসের যাত্রী, তাঁদের হাতে চামড়ার তৈরি চোখধাঁধানো স্যুটকেস।
ভিআইপি যাত্রীরা যেভাবে বিমানবন্দর অতিক্রম করেন, তাঁরাও সেভাবে কোনো কিছু ডিক্লারেশন না দিয়েই চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দুজনের গতিবিধি দেখে সন্দেহ করে কাস্টমস। তল্লাশির পর দুজনের স্যুটকেস থেকে পাওয়া যায় ৩৮ কেজি সোনার বার।
শুরু হয় হইচই। গণমাধ্যমকর্মীরা খবর পেয়ে পৌঁছে যান বিমানবন্দরে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম ধরা পড়া সবচেয়ে বড় সোনার চালান।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তখন ক্ষমতায়। সবকিছু এমনভাবে রটতে শুরু করে যে সবাই ধরে নেয়, এই সোনা পাচারের সঙ্গে এরশাদ ও তাঁর স্ত্রী রওশনের হাত আছে। কম করে হলেও ১০ বছর ধরে সংবাদপত্রে এ খবরের ফলোআপ ছাপা হয়। তবে মূল ঘটনা কাভার করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমি সাংবাদিকতায় এসে ফলোআপ করতে শুরু করি। কারণ, এ ঘটনার শুরুটা ছিল ১৯৯০ সালের ২৪ জুলাই।
এটুকু পর্যন্ত পড়ে মনে প্রশ্ন উঠতে পারে, এত পুরোনা ঘটনার কথা শুনে লাভ কী? লাভ একটা আছে। সেটা হলো, সোনা চোরাচালানের মতো একটি ঘটনার সঙ্গে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী এবং রাজনীতি কীভাবে জড়িয়ে যায়, এ ঘটনা তার অন্যতম বড় প্রমাণ। আবার একটি ঘটনা থেকে রাজনীতিকেরা কীভাবে ফায়দা লুটে নেন, এ ঘটনা তারও বড় উদাহরণ। তবে এটাও বলে রাখি, এই গল্পের অনেক উপাদান বিভিন্ন নথিপত্র আর সাবেক পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা সফিক উল্লাহর বই ‘এক পুলিশের ডায়েরি’ থেকে নেওয়া।
গণমাধ্যমের পাঠক-দর্শকমাত্রই জানেন, বিমানবন্দর দিয়ে সোনা পাচারের ঘটনা নতুন নয়। পাচারের সময় ধরাও পড়ছে হরহামেশা। মাদক পাচার নিয়ে ইউএনওডিসির একটি ‘মেথড’ আছে, যত পাচার হয়, ধরা পড়ে তার মাত্র ১০ শতাংশ। অর্থাৎ মোট হিসাবের ৯০ শতাংশই পাচার হয়ে যায়। সোনার ক্ষেত্রে যদি সেই হিসাব কষা হয়, তাহলে মাথা ভনভন করে ঘুরবে।
যাক এসব, এবার আসল গল্পে ফিরি।
তো সেই দুই বিদেশিকে গ্রেপ্তার করে তুলে দেওয়া হয় ডিবির হাতে। মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে এনে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করতেই বেরিয়ে পড়ে বিষধর সাপ। দুজনেই স্বীকার করেন, ঢাকা বিমানবন্দরের সিকিউরিটি অফিসার তাহের নিজের গাড়িতে করে তাঁদের উড়োজাহাজ থেকে ভিআইপি লাউঞ্জে নিয়ে আসেন। তাহেরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এরপর তাহের স্বীকার করেন, এয়ারপোর্ট ম্যানেজার মেজর সেকান্দার তাঁকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বলা হয়েছিল, দুই বিদেশিকে তিনি ভিআইপি লাউঞ্জ দিয়ে পার করে দেবেন। ঢাকা কাস্টমসে তখন কমিশনার ছিলেন মঞ্জুর মান্নান।
পানি নিচের দিকে না গড়িয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকে। আটক করা হয় এয়ারপোর্ট ম্যানেজার মেজর সেকান্দারকে। তিনি স্বীকার করেন, সিভিল এভিয়েশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান এয়ার কমোডর মইনুল ইসলাম তাঁকে এ কাজে লাগিয়েছিলেন। চেয়ারম্যানের নির্দেশ তিনি তাহেরকে বলেন। কালে কালে ঘটনা বড় হতে থাকে।
ডিবি হেফাজতে দুই বিদেশি জানান, সিঙ্গাপুরের ব্যবসায়ী হাজি ইয়াকুব এই সোনার মালিক। ইয়াকুবের প্রতিনিধি হয়ে তাঁরা বিভিন্ন দেশে সোনা পাচার করেন। তবে তাঁরা জানেন না, এই সোনার আসল মালিক কে। হাজি ইয়াকুব সময়মতো টেলিফোনে তাঁদের সংকেত দেন। সেই সংকেত অনুসারে তাঁরা কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির কাছে সোনা পৌঁছে দেন। এবার কথা ছিল, কালো রঙের একটি মার্সিডিজ বিমানবন্দর থেকে তাঁদের সোনারগাঁও হোটেলে নিয়ে যাবে।
মামলটির প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন এসি আবদুল বাতেন। এদিকে মার্সিডিজের কথা শুনেই পুলিশের দল সেই গাড়ির খোঁজে নেমে পড়ে। তারা ধরে নিয়েছিল, এ গাড়িতেই মামলার ক্লু আছে। সে সময় কালো মার্সিডিজ ছিল শিল্পপতি আজিজ মোহাম্মদ ভাই এবং চিত্রনায়িকা রোজিনার স্বামী ফজলুর রশীদ ঢালির। আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের গাড়িটি ডিবিতে আনা হয়। পরীক্ষা করে দেখা যায়, সেটা মাত্র দেড় মাস আগে কুয়েত দূতাবাস থেকে কেনা। সন্দেহ এবার চলে যায় আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বন্ধু ভিডিও কানেকশনের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলামের দিকে। তিনি ছিলেন সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান কমোডর মইনুলের ঘনিষ্ঠ। বান্টির বনানীর বাড়ি তল্লাশি হয়। গাড়ি না মিললেও সেখানে পাওয়া যায় সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং তাঁদের স্ত্রী ও বান্ধবীদের আপত্তিকর ছবি।
বান্টির বাড়িতে একটি আনরেজিস্টার্ড ফোর্ড গাড়ি ছিল। বান্টির বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ মামলায় প্রথম জেলে গেলেন বান্টি ইসলাম।
এদিকে সোনা চোরাচালানের ঘটনা নিয়ে পত্রপত্রিকা গরম হয়ে ওঠে। তখনকার উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তিনি এই ঘটনায় জড়িত বলে খবর প্রকাশিত হয়। কেউ কেউ লেখেন, ফার্স্ট লেডি রওশন এরশাদও জড়িত। কেউ আরও একধাপ এগিয়ে এরশাদকেও দুষতে থাকেন। দিন দিন এ প্রচার বাড়তেই থাকে। এরশাদ এতে খুবই বিব্রত হন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসানকে ডেকে দ্রুত তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দিতে বলেন।
তখন সিআইডির ডিআইজি ছিলেন এ এস এম শাহজাহান (পরে তিনি আইজিপি হন)। তিনি ডিবির তদন্ত প্রতিবেদন পরীক্ষা করে চার্জশিট দিতে বলেন।
কিন্তু ডিবি দাবি করে, সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান মইনুলকে গ্রেপ্তার করা না গেলে তদন্ত শেষ করা যাবে না। এ সময় স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন আজিম উদ্দিন, তিনি সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ। তিনি এ গ্রেপ্তারের বিপক্ষে মত দেন। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলেন। তখন পত্রিকায় রিপোর্ট হতে থাকে, তদন্ত ধামাচাপা দিচ্ছেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতি এরশাদ। অবস্থা বেগতিক দেখে এরশাদ সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তারের অনুমতি দেন।
সিদ্ধান্ত হয়, মইনুল ইসলামকে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে ওএসডি করে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করার পরই গ্রেপ্তার করা হবে। মইনুল ইসলামের কাছে সে খবর আগেই চলে যায়। ওএসডি হওয়ার পরপরই তিনি পালিয়ে যান। ডিবি মামলাটি তদন্ত করে বার্নার্ড রুডিগার্ড, অ্যান্থনি সকার, সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার কমোডর মইনুল ইসলাম, তাঁর পিএস, এয়ারপোর্ট ম্যানেজার মেজর সেকান্দার ও সিকিউরিটি অফিসার আবু তাহেরকে আসামি করে চার্জশিট দেয়।
এই চার্জশিটের কিছুদিন পর এরশাদ সরকারের পতন হয়। দেশে তখন বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সোনা নিয়ে আবার লেখালেখি শুরু হয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ একদিন তদন্তকারী দলকে ডেকে পাঠান। তখনকার আইজিপি তৈয়ব উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে পুলিশের দলটি তাঁকে ব্রিফ করেন। এবার তিনি দ্রুত বিচার শেষ করতে বলেন।
ক্ষমতার আবার পালাবদল হয়। এবার আসে বিএনপি। বিএনপির এমপিরা প্রথম অধিবেশনেই সোনা চোরাচালান মামলার প্রসঙ্গ তোলেন। সংসদে তাঁরা বলেন, সোনা চোরাচালানের সঙ্গে এরশাদ, রওশন ও মওদুদ জড়িত। বলা হয়, এয়ার কমোডর মইনুল ইসলামকে রাজসাক্ষী করা হলে সব বেরিয়ে আসবে। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বর্ধিত তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন। আবার তদন্ত শুরু হয়। মইনুল শেষ পর্যন্ত আর রাজসাক্ষী হননি। কারণ, রাজসাক্ষী হতে হলে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করতে হয়। মইনুল বুদ্ধিমান, তিনি সেটা করতে চাননি।
সিআইডিতে আসার পর গোলাম মোস্তফা মামলাটি তদন্ত করেন। তিনি এরশাদ ও রওশনের নাম যুক্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন। পরে নিম্ন আদালত রওশন এরশাদকে খালাস দিয়ে এরশাদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করেন। এরশাদ হাইকোর্টে গেলে মামলার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। তখনই শোনা যাচ্ছিল, কমোডর মইনুল ছিলেন তৎকালীন বিএনপি সরকারের কৃষিমন্ত্রী মাজেদুল হকের আত্মীয়। তাঁদের আরেক আত্মীয় ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমান।
তাঁরাই সোনা চোরাচালানের মামলায় এরশাদকে ফাঁসানোর চেষ্টায় উৎসাহী ছিলেন। তবে অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে বিচারকাজ চলতে থাকে। বিচারে শুধু দুই বিদেশির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। তা ছাড়া সেকেন্দারের ১০ বছর এবং তাহেরের ৭ বছরের কারাদণ্ড হয়।
কথায় আছে, রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। ২০০০ সালে এরশাদের বিরুদ্ধে আবার এ মামলা চালু হয়। শেষ পর্যন্ত এবারেও এরশাদ খালাস পান।
এবার ভাবুন, একটি ঘটনার জাল কত দূর বিস্তৃত হতে পারে। দেশে এখনো সোনা পাচার হচ্ছে, ধরাও পড়ছে বটে। কিন্তু তদন্ত আগের মতোই, তল আর পায় না।
কোথায় গিয়ে সবকিছু যেন আটকে যায়। কেন আটকে যায়, প্রিয় পাঠক, তা কি আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর দরকার আছে?
আষাঢ়ে নয় সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
থাইএয়ারের উড়োজাহাজে আসা দুই বিদেশিকে নিয়ে গাড়িটা সোজা চলে গেল ঢাকা বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনালের ভেতরে। দুই যাত্রীর একজন অ্যান্থনি সকার, আরেকজন বার্নার্ড রুডিগার। একজন ব্রিটিশ, অন্যজন জার্মান। দুজনই বিজনেস ক্লাসের যাত্রী, তাঁদের হাতে চামড়ার তৈরি চোখধাঁধানো স্যুটকেস।
ভিআইপি যাত্রীরা যেভাবে বিমানবন্দর অতিক্রম করেন, তাঁরাও সেভাবে কোনো কিছু ডিক্লারেশন না দিয়েই চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দুজনের গতিবিধি দেখে সন্দেহ করে কাস্টমস। তল্লাশির পর দুজনের স্যুটকেস থেকে পাওয়া যায় ৩৮ কেজি সোনার বার।
শুরু হয় হইচই। গণমাধ্যমকর্মীরা খবর পেয়ে পৌঁছে যান বিমানবন্দরে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম ধরা পড়া সবচেয়ে বড় সোনার চালান।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তখন ক্ষমতায়। সবকিছু এমনভাবে রটতে শুরু করে যে সবাই ধরে নেয়, এই সোনা পাচারের সঙ্গে এরশাদ ও তাঁর স্ত্রী রওশনের হাত আছে। কম করে হলেও ১০ বছর ধরে সংবাদপত্রে এ খবরের ফলোআপ ছাপা হয়। তবে মূল ঘটনা কাভার করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমি সাংবাদিকতায় এসে ফলোআপ করতে শুরু করি। কারণ, এ ঘটনার শুরুটা ছিল ১৯৯০ সালের ২৪ জুলাই।
এটুকু পর্যন্ত পড়ে মনে প্রশ্ন উঠতে পারে, এত পুরোনা ঘটনার কথা শুনে লাভ কী? লাভ একটা আছে। সেটা হলো, সোনা চোরাচালানের মতো একটি ঘটনার সঙ্গে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী এবং রাজনীতি কীভাবে জড়িয়ে যায়, এ ঘটনা তার অন্যতম বড় প্রমাণ। আবার একটি ঘটনা থেকে রাজনীতিকেরা কীভাবে ফায়দা লুটে নেন, এ ঘটনা তারও বড় উদাহরণ। তবে এটাও বলে রাখি, এই গল্পের অনেক উপাদান বিভিন্ন নথিপত্র আর সাবেক পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা সফিক উল্লাহর বই ‘এক পুলিশের ডায়েরি’ থেকে নেওয়া।
গণমাধ্যমের পাঠক-দর্শকমাত্রই জানেন, বিমানবন্দর দিয়ে সোনা পাচারের ঘটনা নতুন নয়। পাচারের সময় ধরাও পড়ছে হরহামেশা। মাদক পাচার নিয়ে ইউএনওডিসির একটি ‘মেথড’ আছে, যত পাচার হয়, ধরা পড়ে তার মাত্র ১০ শতাংশ। অর্থাৎ মোট হিসাবের ৯০ শতাংশই পাচার হয়ে যায়। সোনার ক্ষেত্রে যদি সেই হিসাব কষা হয়, তাহলে মাথা ভনভন করে ঘুরবে।
যাক এসব, এবার আসল গল্পে ফিরি।
তো সেই দুই বিদেশিকে গ্রেপ্তার করে তুলে দেওয়া হয় ডিবির হাতে। মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে এনে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করতেই বেরিয়ে পড়ে বিষধর সাপ। দুজনেই স্বীকার করেন, ঢাকা বিমানবন্দরের সিকিউরিটি অফিসার তাহের নিজের গাড়িতে করে তাঁদের উড়োজাহাজ থেকে ভিআইপি লাউঞ্জে নিয়ে আসেন। তাহেরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এরপর তাহের স্বীকার করেন, এয়ারপোর্ট ম্যানেজার মেজর সেকান্দার তাঁকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বলা হয়েছিল, দুই বিদেশিকে তিনি ভিআইপি লাউঞ্জ দিয়ে পার করে দেবেন। ঢাকা কাস্টমসে তখন কমিশনার ছিলেন মঞ্জুর মান্নান।
পানি নিচের দিকে না গড়িয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকে। আটক করা হয় এয়ারপোর্ট ম্যানেজার মেজর সেকান্দারকে। তিনি স্বীকার করেন, সিভিল এভিয়েশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান এয়ার কমোডর মইনুল ইসলাম তাঁকে এ কাজে লাগিয়েছিলেন। চেয়ারম্যানের নির্দেশ তিনি তাহেরকে বলেন। কালে কালে ঘটনা বড় হতে থাকে।
ডিবি হেফাজতে দুই বিদেশি জানান, সিঙ্গাপুরের ব্যবসায়ী হাজি ইয়াকুব এই সোনার মালিক। ইয়াকুবের প্রতিনিধি হয়ে তাঁরা বিভিন্ন দেশে সোনা পাচার করেন। তবে তাঁরা জানেন না, এই সোনার আসল মালিক কে। হাজি ইয়াকুব সময়মতো টেলিফোনে তাঁদের সংকেত দেন। সেই সংকেত অনুসারে তাঁরা কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির কাছে সোনা পৌঁছে দেন। এবার কথা ছিল, কালো রঙের একটি মার্সিডিজ বিমানবন্দর থেকে তাঁদের সোনারগাঁও হোটেলে নিয়ে যাবে।
মামলটির প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন এসি আবদুল বাতেন। এদিকে মার্সিডিজের কথা শুনেই পুলিশের দল সেই গাড়ির খোঁজে নেমে পড়ে। তারা ধরে নিয়েছিল, এ গাড়িতেই মামলার ক্লু আছে। সে সময় কালো মার্সিডিজ ছিল শিল্পপতি আজিজ মোহাম্মদ ভাই এবং চিত্রনায়িকা রোজিনার স্বামী ফজলুর রশীদ ঢালির। আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের গাড়িটি ডিবিতে আনা হয়। পরীক্ষা করে দেখা যায়, সেটা মাত্র দেড় মাস আগে কুয়েত দূতাবাস থেকে কেনা। সন্দেহ এবার চলে যায় আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বন্ধু ভিডিও কানেকশনের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলামের দিকে। তিনি ছিলেন সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান কমোডর মইনুলের ঘনিষ্ঠ। বান্টির বনানীর বাড়ি তল্লাশি হয়। গাড়ি না মিললেও সেখানে পাওয়া যায় সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং তাঁদের স্ত্রী ও বান্ধবীদের আপত্তিকর ছবি।
বান্টির বাড়িতে একটি আনরেজিস্টার্ড ফোর্ড গাড়ি ছিল। বান্টির বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ মামলায় প্রথম জেলে গেলেন বান্টি ইসলাম।
এদিকে সোনা চোরাচালানের ঘটনা নিয়ে পত্রপত্রিকা গরম হয়ে ওঠে। তখনকার উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তিনি এই ঘটনায় জড়িত বলে খবর প্রকাশিত হয়। কেউ কেউ লেখেন, ফার্স্ট লেডি রওশন এরশাদও জড়িত। কেউ আরও একধাপ এগিয়ে এরশাদকেও দুষতে থাকেন। দিন দিন এ প্রচার বাড়তেই থাকে। এরশাদ এতে খুবই বিব্রত হন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসানকে ডেকে দ্রুত তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দিতে বলেন।
তখন সিআইডির ডিআইজি ছিলেন এ এস এম শাহজাহান (পরে তিনি আইজিপি হন)। তিনি ডিবির তদন্ত প্রতিবেদন পরীক্ষা করে চার্জশিট দিতে বলেন।
কিন্তু ডিবি দাবি করে, সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান মইনুলকে গ্রেপ্তার করা না গেলে তদন্ত শেষ করা যাবে না। এ সময় স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন আজিম উদ্দিন, তিনি সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ। তিনি এ গ্রেপ্তারের বিপক্ষে মত দেন। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলেন। তখন পত্রিকায় রিপোর্ট হতে থাকে, তদন্ত ধামাচাপা দিচ্ছেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতি এরশাদ। অবস্থা বেগতিক দেখে এরশাদ সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তারের অনুমতি দেন।
সিদ্ধান্ত হয়, মইনুল ইসলামকে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে ওএসডি করে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করার পরই গ্রেপ্তার করা হবে। মইনুল ইসলামের কাছে সে খবর আগেই চলে যায়। ওএসডি হওয়ার পরপরই তিনি পালিয়ে যান। ডিবি মামলাটি তদন্ত করে বার্নার্ড রুডিগার্ড, অ্যান্থনি সকার, সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার কমোডর মইনুল ইসলাম, তাঁর পিএস, এয়ারপোর্ট ম্যানেজার মেজর সেকান্দার ও সিকিউরিটি অফিসার আবু তাহেরকে আসামি করে চার্জশিট দেয়।
এই চার্জশিটের কিছুদিন পর এরশাদ সরকারের পতন হয়। দেশে তখন বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সোনা নিয়ে আবার লেখালেখি শুরু হয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ একদিন তদন্তকারী দলকে ডেকে পাঠান। তখনকার আইজিপি তৈয়ব উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে পুলিশের দলটি তাঁকে ব্রিফ করেন। এবার তিনি দ্রুত বিচার শেষ করতে বলেন।
ক্ষমতার আবার পালাবদল হয়। এবার আসে বিএনপি। বিএনপির এমপিরা প্রথম অধিবেশনেই সোনা চোরাচালান মামলার প্রসঙ্গ তোলেন। সংসদে তাঁরা বলেন, সোনা চোরাচালানের সঙ্গে এরশাদ, রওশন ও মওদুদ জড়িত। বলা হয়, এয়ার কমোডর মইনুল ইসলামকে রাজসাক্ষী করা হলে সব বেরিয়ে আসবে। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বর্ধিত তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন। আবার তদন্ত শুরু হয়। মইনুল শেষ পর্যন্ত আর রাজসাক্ষী হননি। কারণ, রাজসাক্ষী হতে হলে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করতে হয়। মইনুল বুদ্ধিমান, তিনি সেটা করতে চাননি।
সিআইডিতে আসার পর গোলাম মোস্তফা মামলাটি তদন্ত করেন। তিনি এরশাদ ও রওশনের নাম যুক্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন। পরে নিম্ন আদালত রওশন এরশাদকে খালাস দিয়ে এরশাদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করেন। এরশাদ হাইকোর্টে গেলে মামলার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। তখনই শোনা যাচ্ছিল, কমোডর মইনুল ছিলেন তৎকালীন বিএনপি সরকারের কৃষিমন্ত্রী মাজেদুল হকের আত্মীয়। তাঁদের আরেক আত্মীয় ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমান।
তাঁরাই সোনা চোরাচালানের মামলায় এরশাদকে ফাঁসানোর চেষ্টায় উৎসাহী ছিলেন। তবে অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে বিচারকাজ চলতে থাকে। বিচারে শুধু দুই বিদেশির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। তা ছাড়া সেকেন্দারের ১০ বছর এবং তাহেরের ৭ বছরের কারাদণ্ড হয়।
কথায় আছে, রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। ২০০০ সালে এরশাদের বিরুদ্ধে আবার এ মামলা চালু হয়। শেষ পর্যন্ত এবারেও এরশাদ খালাস পান।
এবার ভাবুন, একটি ঘটনার জাল কত দূর বিস্তৃত হতে পারে। দেশে এখনো সোনা পাচার হচ্ছে, ধরাও পড়ছে বটে। কিন্তু তদন্ত আগের মতোই, তল আর পায় না।
কোথায় গিয়ে সবকিছু যেন আটকে যায়। কেন আটকে যায়, প্রিয় পাঠক, তা কি আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর দরকার আছে?
আষাঢ়ে নয় সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘দেশের চলমান অর্থনৈতিক ভঙ্গুর অবস্থা ও সংকটের মূলে আছে স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি ও অনাচারী অর্থনীতি। বিগত সরকারের সময়ে অনাচারী অর্থনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার
২ ঘণ্টা আগেসারা দেশের বিভিন্ন জেলায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবুর রহমানের নামে থাকা ৬টি মেডিকেল কলেজের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। ব্যক্তির নাম বাদ দিয়ে মেডিকেল কলেজগুলোর নামকরণ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর নামে
৩ ঘণ্টা আগেনির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ দিতে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি করেছে সরকার। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীকে সভাপতি করে আজ বৃহস্পতিবার সার্চ কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
৪ ঘণ্টা আগেরাষ্ট্র সংস্কারে অগ্রাধিকার দেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর নির্বাচনের জন্য চাপ বাড়ছে। বিএনপি শুরুতে সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বললেও এখন দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ চাইছে।
৫ ঘণ্টা আগে