কামরুল হাসান, ঢাকা
আজ একটি খুনের গল্প বলব। রোজ ঢাকায় যেভাবে মানুষ খুন হয়, সে রকম। পুলিশের একটি কেতাবি হিসাব আছে, রাজধানীতে দিনে গড়ে একজন খুন হন, মাসে ৩০ জন। আজকের গল্পের খুনের ঘটনাটিও তেমন, জমা-খরচের খাতায় বৃদ্ধি পাওয়া সংখ্যার মতো।
২০০১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার। অনেক রাতে মালিবাগ মোড়ে আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎ খবর এল, উত্তরায় খুন হয়েছে। ব্রাশফায়ারে একজনকে খুন করা হয়েছে, আর দুজন আহত হয়েছে। অত রাতে পত্রিকায় নিউজ ধরানো যাবে না। পরদিন শুক্রবার সকাল সকাল গেলাম ঘটনাস্থলে। দেখি, উত্তরায় নয়, খুন হয়েছে দক্ষিণখান এলাকায়।
যিনি খুন হয়েছেন, তাঁর নাম তারাজ উদ্দিন। আর আহত হয়েছেন নজরুল ইসলাম ও লিটন। তারাজ উদ্দিন এলাকায় বেশ প্রভাবশালী ও ধনী। তাঁর জমিজমার কারবার। এলাকার নবজাগরণ বহুমুখী সমবায় সমিতির প্রধান তিনি। পিতার নাম আবদুল গফুর। বসবাস করতেন দক্ষিণখানের দক্ষিণ পাড়ায়। আমি এলাকায় পৌঁছে শুনি, রাতের মধ্যে আসামির নাম উল্লেখ করে মামলাও হয়ে গেছে। মামলা করেছেন তারাজের ভাই নুরুল ইসলাম।
এলাকার লোকজন আমাকে বললেন, দক্ষিণপাড়ায় ৪৭ কাঠা জমি নিয়ে বিরোধেই তারাজ খুন হয়েছেন। কার সঙ্গে বিরোধ? সবাই বললেন, বিরোধ তাঁর আপন চাচাতো বোন আলেয়া বেগমের সঙ্গে। দুজনই মহামূল্যবান এই জমির মালিকানা দাবি করেন। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এ জন্য দুজনে নাকি আলাদা করে সন্ত্রাসীও ভাড়া করেন।
এলাকাবাসী বললেন, জমির দখল নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারাজ উদ্দিন নবজাগরণ বহুমুখী সমবায় সমিতি বানিয়েছেন। সেই সমিতির অফিসও জমির ওপর। দিনরাত একদল যুবক সেখানে অস্ত্র নিয়ে অবস্থান করে আর তাস খেলে সময় কাটায়। তারা সেখানে অবস্থান করে জমি পাহারা দিচ্ছে, যাতে আলেয়ার লোকজন আসতে না পারে।
সেই সমিতির অফিসে বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে তারাজ উদ্দিন বসে ছিলেন। তখন পাহারাদারের সংখ্যা কমে গেছে। হঠাৎ হলুদ রঙের তিনটি ট্যাক্সি ক্যাব সেখানে এসে থামে। ট্যাক্সি থেকে ৮-১০ জন যুবক অস্ত্র হাতে নেমে শুরু করেন ব্রাশফায়ার। এতে তারাজ নিহত এবং দুজন আহত হন।
গুলির শব্দে লোকজন ছুটে আসে। তারা ট্যাক্সি ক্যাবকে ধাওয়া দেয়। তারাজের লোকজন চালকসহ একটি ট্যাক্সি ক্যাব ধরে ফেলে। সেই ক্যাবের ভেতরে পাওয়া যায় বোরহান নামের এক সন্ত্রাসীকে, যার হাতে অস্ত্র ছিল। ক্যাবের চালক আমিনুলকেও আটক করা হয়। পরে দুজনকেই পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
ঘটনাস্থল থেকে উত্তরা থানায় গিয়ে দেখি, এই মামলা নিয়ে একটি লম্বা এজাহার হয়েছে। তাতে ২১ জনের নাম, পিতার নাম ও পূর্ণ ঠিকানা রয়েছে। থানার ডিউটি অফিসার এজাহারের একটি কপি আমার সামনে ধরে বললেন, কপি দেওয়া বারণ, পড়ে নোট করে নেন। আমার চোখ আটকে যায় আসামির তালিকা দেখে। তিন নম্বর আসামির নাম দীপু চৌধুরী।
পিতার নাম মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তিনি তখন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী। মন্ত্রিপুত্রের নাম মামলার এজাহারে। স্বাভাবিকভাবেই বড় খবর। এতক্ষণ যেটি ছিল সাধারণ খুনের মামলা, মন্ত্রিপুত্রের বদৌলতে সেটা হয়ে গেল গুরুত্বপূর্ণ মামলা। পরদিন সব কাগজে লিড নিউজ।
জমি নিয়ে বিরোধ তো আর দীপু চৌধুরীর সঙ্গে হয়নি। তাহলে খুনের মামলায় কেন তাঁর নাম এল? ধীরে ধীরে সবই পরিষ্কার হয়ে গেল। তার আগে আরেকজন সন্ত্রাসীর কথা বলি। তাঁর নাম মুকুল। বাড্ডার বাসিন্দা মুকুল অনেক দিন ধরে ভারতে আত্মগোপন করে আছেন। সেই মুকুল একসময় ছিলেন বিমানবন্দর এলাকার নিয়ন্ত্রক ও শীর্ষ সন্ত্রাসী টোকাই সাগরের ঘনিষ্ঠ। টোকাই সাগর আমেরিকায় পাড়ি জমানোর পর বিমানবন্দর এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন মুকুল। এর মধ্যে মায়ার পুত্র দীপু চৌধুরী তখনকার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কনকর্স হল ও গাড়ি পার্কিং এলাকা ইজারা নেন। সেই ইজারা পাওয়ার পর তিনি বিমানবন্দর থেকে মুকুলকে সরিয়ে দিয়ে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এতে মুকুলের সঙ্গে তাঁর বিরোধ চরমে পৌঁছায়। এর মধ্যে বাড্ডা ক্লাবে ছাত্রলীগ নেতা আঁখি খুন হন। সেই খুনের মামলার পুলিশ মুকুলকে গ্রেপ্তার করে। কিছুদিন পর মুকুল জামিনে বেরিয়ে আসেন। এরপর পরিস্থিতি এমন হয় যে দীপু ও মুকুল রীতিমতো ৮-১০ জন করে দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা করতে শুরু করেন। সেই বিরোধে ঘি ঢালেন আলেয়া বেগম ও তারাজ উদ্দিন।
৪৭ কাঠা জমি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারাজ একদিন দীপু চৌধুরীর প্রতিপক্ষ মুকুলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁদের কথা হয়, জমির দখল রাখতে পারলে তাঁদেরও জমি দেওয়া হবে। এটা শুনে আলেয়া বেগম বাদ যাবেন কেন, তিনি যোগাযোগ করেন দীপু চৌধুরীর লোকজনের সঙ্গে। খুনের ঘটনা নিয়ে উত্তরা থানায় যে মামলা হয়, তাতে বলা হয়, আলেয়া বেগমের ভাড়াটে হয়ে দীপু চৌধুরী ও তাঁর দলবল এই খুন করে। খুনের সময় হলুদ ট্যাক্সি ক্যাবে দীপু চৌধুরী বসে ছিলেন বলেও উল্লেখ করা হয়। অভিযোগ ওঠে, জমিটি দখল করতে দীপুর বন্ধু রানাকে জমির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেওয়া হয়েছে। দীপুর সঙ্গে ছিল তাঁর বন্ধু শিহাব, সৌরভ ও সাগর।
এই খুনের চার দিন পর ১২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ আলেয়া বেগম ও তাঁর স্বামী জহির উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এর আগে গ্রেপ্তার হওয়া বোরহান ও আমিনুলকেও রিমান্ডে নেওয়া হয়। পুলিশ আরও আটজনকে গ্রেপ্তার করে। শুরু হয় ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ।
তারাজ খুনের কয়েক দিন পর প্রতিমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও তাঁর স্ত্রী নিহত তারাজের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে তাঁদের বাসায় যান। তাঁরা ফিরে আসার পর খবর রটে যায়, নিহতের পরিবারকে তাঁরা ভয় দেখাতে গিয়েছিলেন। তারাজের পরিবারের পক্ষ থেকেও বিষয়টি দাবি করা হয়। এমনকি এ নিয়ে থানায় জিডিও করা হয়। খুন নিয়ে শুরু হয় রাজনীতি। তবে মায়া তাঁর ছেলের পক্ষ নিয়ে কোনো দিন একটি কথা বলেননি। তিনি সব সময় নীরব থেকেছেন। গণমাধ্যমে বড় বড় করে খবর প্রকাশিত হয়, মন্ত্রীর খুনি ছেলেকে পুলিশ ধরছে না। চারদিকে হইচই পড়ে যায়। আওয়ামী লীগ সরকার ও দলকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম কুমিল্লায় টেলিফোন এক্সচেঞ্জের উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেন, ‘খুনে জড়িত মন্ত্রিপুত্রকে সারেন্ডার করতে বলেছি।’
অবশেষে ১৮ ফেব্রুয়ারি দীপু চৌধুরী, তাঁর বন্ধু রানা ও সৌরভ ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। মহানগর হাকিম শৈলেন্দ্র কুমার অধিকারী তাঁদের জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। দীপুর পক্ষে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সৈয়দ রেজাউর রহমান দাঁড়িয়েছিলেন।
দীপু চৌধুরী গ্রেপ্তারের পর এই আলোচনা থেমে যায়। আরও নতুন ঘটনার ভিড়ে আমরাও ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিছুদিন পর দীপুও জামিনে বেরিয়ে আসেন। একদিন তিনি সাংবাদিকদের ডেকে বলেন, ওই খুনের ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না।
এভাবে মাস দুয়েক যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন শুনি, তারাজ খুনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসামি বোরহান রহস্যজনকভাবে মারা গেছেন। তাঁর মৃত্যু নিয়ে সবাই সন্দেহ করেন। বোরহানকে ঘটনার সময় হাতেনাতে ধরা হয়েছিল। তারাজ খুনের সবকিছুই ছিল তাঁর নখদর্পণে। সেই বোরহানের মৃত্যুর পর তদন্তকারীরাও বিপাকে পড়েন।
তখন অভিযোগ ওঠে, বোরহানকে মেরে ফেলা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ উঠলেই তো আর হলো না, সেটা প্রমাণ করতে হবে। প্রমাণ করা আর সম্ভব হয়নি। যেভাবে প্রমাণ করা যায়নি দীপু চৌধুরীর খুনে জড়িত থাকার বিষয়টি। একপর্যায়ে এটাও প্রমাণিত হয়, তারাজকে আসলে কেউই খুন করেনি।
এই গল্পের শুরুতেই বলেছিলাম, রাজধানীতে খুন একটি সংখ্যামাত্র। একদিন সেই তালিকায় যোগ হলো আরেকটি নাম—তারাজ উদ্দিন।
আরও পড়ুন:
আজ একটি খুনের গল্প বলব। রোজ ঢাকায় যেভাবে মানুষ খুন হয়, সে রকম। পুলিশের একটি কেতাবি হিসাব আছে, রাজধানীতে দিনে গড়ে একজন খুন হন, মাসে ৩০ জন। আজকের গল্পের খুনের ঘটনাটিও তেমন, জমা-খরচের খাতায় বৃদ্ধি পাওয়া সংখ্যার মতো।
২০০১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার। অনেক রাতে মালিবাগ মোড়ে আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎ খবর এল, উত্তরায় খুন হয়েছে। ব্রাশফায়ারে একজনকে খুন করা হয়েছে, আর দুজন আহত হয়েছে। অত রাতে পত্রিকায় নিউজ ধরানো যাবে না। পরদিন শুক্রবার সকাল সকাল গেলাম ঘটনাস্থলে। দেখি, উত্তরায় নয়, খুন হয়েছে দক্ষিণখান এলাকায়।
যিনি খুন হয়েছেন, তাঁর নাম তারাজ উদ্দিন। আর আহত হয়েছেন নজরুল ইসলাম ও লিটন। তারাজ উদ্দিন এলাকায় বেশ প্রভাবশালী ও ধনী। তাঁর জমিজমার কারবার। এলাকার নবজাগরণ বহুমুখী সমবায় সমিতির প্রধান তিনি। পিতার নাম আবদুল গফুর। বসবাস করতেন দক্ষিণখানের দক্ষিণ পাড়ায়। আমি এলাকায় পৌঁছে শুনি, রাতের মধ্যে আসামির নাম উল্লেখ করে মামলাও হয়ে গেছে। মামলা করেছেন তারাজের ভাই নুরুল ইসলাম।
এলাকার লোকজন আমাকে বললেন, দক্ষিণপাড়ায় ৪৭ কাঠা জমি নিয়ে বিরোধেই তারাজ খুন হয়েছেন। কার সঙ্গে বিরোধ? সবাই বললেন, বিরোধ তাঁর আপন চাচাতো বোন আলেয়া বেগমের সঙ্গে। দুজনই মহামূল্যবান এই জমির মালিকানা দাবি করেন। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এ জন্য দুজনে নাকি আলাদা করে সন্ত্রাসীও ভাড়া করেন।
এলাকাবাসী বললেন, জমির দখল নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারাজ উদ্দিন নবজাগরণ বহুমুখী সমবায় সমিতি বানিয়েছেন। সেই সমিতির অফিসও জমির ওপর। দিনরাত একদল যুবক সেখানে অস্ত্র নিয়ে অবস্থান করে আর তাস খেলে সময় কাটায়। তারা সেখানে অবস্থান করে জমি পাহারা দিচ্ছে, যাতে আলেয়ার লোকজন আসতে না পারে।
সেই সমিতির অফিসে বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে তারাজ উদ্দিন বসে ছিলেন। তখন পাহারাদারের সংখ্যা কমে গেছে। হঠাৎ হলুদ রঙের তিনটি ট্যাক্সি ক্যাব সেখানে এসে থামে। ট্যাক্সি থেকে ৮-১০ জন যুবক অস্ত্র হাতে নেমে শুরু করেন ব্রাশফায়ার। এতে তারাজ নিহত এবং দুজন আহত হন।
গুলির শব্দে লোকজন ছুটে আসে। তারা ট্যাক্সি ক্যাবকে ধাওয়া দেয়। তারাজের লোকজন চালকসহ একটি ট্যাক্সি ক্যাব ধরে ফেলে। সেই ক্যাবের ভেতরে পাওয়া যায় বোরহান নামের এক সন্ত্রাসীকে, যার হাতে অস্ত্র ছিল। ক্যাবের চালক আমিনুলকেও আটক করা হয়। পরে দুজনকেই পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
ঘটনাস্থল থেকে উত্তরা থানায় গিয়ে দেখি, এই মামলা নিয়ে একটি লম্বা এজাহার হয়েছে। তাতে ২১ জনের নাম, পিতার নাম ও পূর্ণ ঠিকানা রয়েছে। থানার ডিউটি অফিসার এজাহারের একটি কপি আমার সামনে ধরে বললেন, কপি দেওয়া বারণ, পড়ে নোট করে নেন। আমার চোখ আটকে যায় আসামির তালিকা দেখে। তিন নম্বর আসামির নাম দীপু চৌধুরী।
পিতার নাম মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তিনি তখন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী। মন্ত্রিপুত্রের নাম মামলার এজাহারে। স্বাভাবিকভাবেই বড় খবর। এতক্ষণ যেটি ছিল সাধারণ খুনের মামলা, মন্ত্রিপুত্রের বদৌলতে সেটা হয়ে গেল গুরুত্বপূর্ণ মামলা। পরদিন সব কাগজে লিড নিউজ।
জমি নিয়ে বিরোধ তো আর দীপু চৌধুরীর সঙ্গে হয়নি। তাহলে খুনের মামলায় কেন তাঁর নাম এল? ধীরে ধীরে সবই পরিষ্কার হয়ে গেল। তার আগে আরেকজন সন্ত্রাসীর কথা বলি। তাঁর নাম মুকুল। বাড্ডার বাসিন্দা মুকুল অনেক দিন ধরে ভারতে আত্মগোপন করে আছেন। সেই মুকুল একসময় ছিলেন বিমানবন্দর এলাকার নিয়ন্ত্রক ও শীর্ষ সন্ত্রাসী টোকাই সাগরের ঘনিষ্ঠ। টোকাই সাগর আমেরিকায় পাড়ি জমানোর পর বিমানবন্দর এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন মুকুল। এর মধ্যে মায়ার পুত্র দীপু চৌধুরী তখনকার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কনকর্স হল ও গাড়ি পার্কিং এলাকা ইজারা নেন। সেই ইজারা পাওয়ার পর তিনি বিমানবন্দর থেকে মুকুলকে সরিয়ে দিয়ে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এতে মুকুলের সঙ্গে তাঁর বিরোধ চরমে পৌঁছায়। এর মধ্যে বাড্ডা ক্লাবে ছাত্রলীগ নেতা আঁখি খুন হন। সেই খুনের মামলার পুলিশ মুকুলকে গ্রেপ্তার করে। কিছুদিন পর মুকুল জামিনে বেরিয়ে আসেন। এরপর পরিস্থিতি এমন হয় যে দীপু ও মুকুল রীতিমতো ৮-১০ জন করে দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা করতে শুরু করেন। সেই বিরোধে ঘি ঢালেন আলেয়া বেগম ও তারাজ উদ্দিন।
৪৭ কাঠা জমি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারাজ একদিন দীপু চৌধুরীর প্রতিপক্ষ মুকুলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁদের কথা হয়, জমির দখল রাখতে পারলে তাঁদেরও জমি দেওয়া হবে। এটা শুনে আলেয়া বেগম বাদ যাবেন কেন, তিনি যোগাযোগ করেন দীপু চৌধুরীর লোকজনের সঙ্গে। খুনের ঘটনা নিয়ে উত্তরা থানায় যে মামলা হয়, তাতে বলা হয়, আলেয়া বেগমের ভাড়াটে হয়ে দীপু চৌধুরী ও তাঁর দলবল এই খুন করে। খুনের সময় হলুদ ট্যাক্সি ক্যাবে দীপু চৌধুরী বসে ছিলেন বলেও উল্লেখ করা হয়। অভিযোগ ওঠে, জমিটি দখল করতে দীপুর বন্ধু রানাকে জমির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেওয়া হয়েছে। দীপুর সঙ্গে ছিল তাঁর বন্ধু শিহাব, সৌরভ ও সাগর।
এই খুনের চার দিন পর ১২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ আলেয়া বেগম ও তাঁর স্বামী জহির উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এর আগে গ্রেপ্তার হওয়া বোরহান ও আমিনুলকেও রিমান্ডে নেওয়া হয়। পুলিশ আরও আটজনকে গ্রেপ্তার করে। শুরু হয় ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ।
তারাজ খুনের কয়েক দিন পর প্রতিমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও তাঁর স্ত্রী নিহত তারাজের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে তাঁদের বাসায় যান। তাঁরা ফিরে আসার পর খবর রটে যায়, নিহতের পরিবারকে তাঁরা ভয় দেখাতে গিয়েছিলেন। তারাজের পরিবারের পক্ষ থেকেও বিষয়টি দাবি করা হয়। এমনকি এ নিয়ে থানায় জিডিও করা হয়। খুন নিয়ে শুরু হয় রাজনীতি। তবে মায়া তাঁর ছেলের পক্ষ নিয়ে কোনো দিন একটি কথা বলেননি। তিনি সব সময় নীরব থেকেছেন। গণমাধ্যমে বড় বড় করে খবর প্রকাশিত হয়, মন্ত্রীর খুনি ছেলেকে পুলিশ ধরছে না। চারদিকে হইচই পড়ে যায়। আওয়ামী লীগ সরকার ও দলকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম কুমিল্লায় টেলিফোন এক্সচেঞ্জের উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেন, ‘খুনে জড়িত মন্ত্রিপুত্রকে সারেন্ডার করতে বলেছি।’
অবশেষে ১৮ ফেব্রুয়ারি দীপু চৌধুরী, তাঁর বন্ধু রানা ও সৌরভ ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। মহানগর হাকিম শৈলেন্দ্র কুমার অধিকারী তাঁদের জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। দীপুর পক্ষে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সৈয়দ রেজাউর রহমান দাঁড়িয়েছিলেন।
দীপু চৌধুরী গ্রেপ্তারের পর এই আলোচনা থেমে যায়। আরও নতুন ঘটনার ভিড়ে আমরাও ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিছুদিন পর দীপুও জামিনে বেরিয়ে আসেন। একদিন তিনি সাংবাদিকদের ডেকে বলেন, ওই খুনের ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না।
এভাবে মাস দুয়েক যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন শুনি, তারাজ খুনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসামি বোরহান রহস্যজনকভাবে মারা গেছেন। তাঁর মৃত্যু নিয়ে সবাই সন্দেহ করেন। বোরহানকে ঘটনার সময় হাতেনাতে ধরা হয়েছিল। তারাজ খুনের সবকিছুই ছিল তাঁর নখদর্পণে। সেই বোরহানের মৃত্যুর পর তদন্তকারীরাও বিপাকে পড়েন।
তখন অভিযোগ ওঠে, বোরহানকে মেরে ফেলা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ উঠলেই তো আর হলো না, সেটা প্রমাণ করতে হবে। প্রমাণ করা আর সম্ভব হয়নি। যেভাবে প্রমাণ করা যায়নি দীপু চৌধুরীর খুনে জড়িত থাকার বিষয়টি। একপর্যায়ে এটাও প্রমাণিত হয়, তারাজকে আসলে কেউই খুন করেনি।
এই গল্পের শুরুতেই বলেছিলাম, রাজধানীতে খুন একটি সংখ্যামাত্র। একদিন সেই তালিকায় যোগ হলো আরেকটি নাম—তারাজ উদ্দিন।
আরও পড়ুন:
দেশে বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা সাড়ে ১৫ লাখের মতো। তাদের সবাইকে আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দিতে হবে। তবে এরপর প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তা জমা দিতে হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে গত ১ সেপ্টেম্বর এমনটাই জানানো হয়েছে।
৯ ঘণ্টা আগেফরিদপুরের মল্লিকপুরে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে খাগড়াছড়ি পরিবহন ও গ্রিন এক্সপ্রেস বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষের দুর্ঘটনাস্থলকে ‘ব্ল্যাক স্পট’ বা বারংবার দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছে জাতীয় তদন্ত কমিটি। মৃতুফাঁদে পরিণত ওই সড়কটির কাঠামোগত ত্রুটি সারানোসহ একগুচ্ছ সুপারিশ করে জরুরি ভিত্তিতে তা বাস্তবায়নের
১০ ঘণ্টা আগেদেশের সব টিভি চ্যানেল ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দিনে কমপক্ষে দুবার প্রচার করতে হবে ‘জুলাই অনির্বাণ’ ভিডিওচিত্র। আজ শুক্রবার (২২ নভেম্বর) এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ কথা জানায় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের আত্মত্যাগ জনগণকে অবহিত করার লক্ষ্যে তথ্য..
১২ ঘণ্টা আগেনতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন ও অপর চার নির্বাচন কমিশনারের শপথ আগামী রোববার অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ রোববার বেলা দেড়টায় সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে তাঁদের শপথ পাঠ করাবেন। সুপ্রিম কোর্টের জনসংযোগ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে এ কথা জানান।
১২ ঘণ্টা আগে