চাকরি পেয়েও বেতন-ভাতা ছাড়া ঈদ

অর্চি হক, ঢাকা
প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০২২, ০৯: ২১
আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২২, ১২: ৪৩

সিরাজগঞ্জের জামিরুল ইসলাম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করেছিলেন ২০১২ সালে। ১০ বছর অপেক্ষার পর গত ৩০ জানুয়ারিতে তিনি চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। শিক্ষকতা করছেন সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার একটি স্কুলে।

চাকরি পাওয়ার পর এটাই জামিরুলের প্রথম ঈদ। কিন্তু এখনো কোনো বেতন-ভাতা পাননি তিনি। মা-বাবা এবং স্ত্রী- সন্তানদের নতুন জামাকাপড় দেওয়ার পরিবর্তে উল্টো তাঁদের কাছ থেকে টাকা- পয়সা চেয়ে দিন কাটছে জামিরুলের। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘চাকরি পেতে ১০ বছর গেল। আর এখন চাকরি হলেও বেতন-ভাতার খোঁজ নেই।’
জামিরুল একা নন। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির পর বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যোগ দেওয়া এমন কয়েক হাজার শিক্ষক এখনো বেতন-ভাতা পাননি।

এনটিআরসিএর সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, বেতন-ভাতা না পাওয়া শিক্ষকদের মধ্যে নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানে আছেন প্রায় তিন হাজার। এ ছাড়া বিভিন্ন জটিলতায় এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার শিক্ষকও এখনো বেতন পাননি বলে জানা গেছে। তবে তাঁদের কোনো সুনির্দিষ্ট সংখ্যা কারও কাছে নেই বলে জানান সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষক ফোরামের সভাপতি শান্ত আহাদ।

শান্ত আহাদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নন-এমপিও কলেজগুলোতে নিয়োগপ্রাপ্তদের প্রায় কেউই বেতন পাচ্ছেন না। আর এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেকের নানা অজুহাতে বেতন আটকে আছে। এ ছাড়া অনেক মাদ্রাসায় বিষয় জটিলতার কারণেও অনেকের বেতন আটকে আছে। এসব শিক্ষক ধারদেনা করে চলছেন। এমনকি এই ঈদে সামান্যতম সম্মানীও দেওয়া হচ্ছে না। এর তো একটা সমাধান হওয়া দরকার।’

এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী, স্কুল পর্যায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত নতুন শিক্ষকদের বিএড করা থাকলে ১৬ হাজার টাকা মাসিক বেতন পাওয়ার কথা। বিএড করা না থাকলে বেতন পাওয়ার কথা মাসে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। আর কলেজে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বেতন ২২ হাজার টাকা। নীতিমালায় যোগদানের দিন থেকেই এই বেতন কাঠামো কার্যকর করতে বলা হয়েছে।
নন-এমপিও স্কুল-কলেজের প্রধানরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানের ফান্ড না থাকায় তাঁরা বেতন দিতে পারছেন না।

তবে ভুক্তভোগী শিক্ষকদের প্রশ্ন, বেতন দেওয়ার নিশ্চয়তা না থাকলে নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে এনটিআরসিএ কেন সুপারিশ করল?এ প্রশ্নের জবাবে এনটিআরসিএ সচিব ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘বেতনসংক্রান্ত বিষয় দেখার কাজ অধিদপ্তরের। আমাদের না।’

জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘৩৫ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা ছিল। (শিক্ষা) মন্ত্রণালয় থেকে সেটার সমাধান হয়েছে। আর ডিগ্রি পর্যায়ের কলেজশিক্ষকদের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।’

এই কর্মকর্তা জানান, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির কাগজপত্র পাঠানোর ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হচ্ছে। সঠিকভাবে কাগজপত্র পাঠালে বেতন নিয়ে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। যোগদানের দিন থেকেই তাঁরা বেতন পেয়ে যাবেন। তবে ঈদের আগে এর সমাধান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানান তিনি। 

শিক্ষক নিয়োগের জন্য ২০০৫ সাল থেকে নিবন্ধন পরীক্ষার আয়োজন করছে এনটিআরসিএ। এ পর্যন্ত ১৬টি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা হয়েছে। এই পরীক্ষা এনটিআরসিএ আয়োজন করলেও প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ চূড়ান্ত করে আসছিল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদের নিয়োগে অনিয়ম, দুর্নীতি ও প্রভাব খাটানোর অভিযোগ ওঠায় ২০১৫ সাল থেকে এনটিআরসিএকে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর থেকে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের শিক্ষক চাহিদা এনটিআরসিএতে পাঠায়। এর ভিত্তিতে এনটিআরসিএ নিয়োগের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। নিবন্ধনধারী শিক্ষকেরা এতে আবেদন করে নিয়োগের সুপারিশ পান। এ পর্যন্ত তিনটি গণবিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে তিন দফায় শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করেছে এনটিআরসিএ। কিন্তু এই নিয়োগ নিয়েও আছে জটিলতা। নিজের এলাকা থেকে অনেক দূরের কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেলে অনেকেই সেখানে থাকতে চান না।

পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার আতরখালি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, ‘এনটিআরসিএর সুপারিশে আমরা ভালো শিক্ষক পাচ্ছি, এটা ঠিক। কিন্তু দূর-দূরান্ত থেকে আসা অনেক শিক্ষকই থাকতে চান না। আমার স্কুলে নীলফামারী থেকে একজনকে সুপারিশ করেছে। তিনি যোগদান করবেন না বলে জানিয়েছেন। এতে স্কুলের এই পদ শূন্যই থাকবে। ছাত্রদের দুর্ভোগ পোহাতে হবে।’

২০২১ সালে সারা দেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে থাকা ৫৪ হাজার পদে শিক্ষক নিয়োগের তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি দেয় এনটিআরসিএ। কিন্তু এর মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার পদে কোনো আবেদনই পড়েনি। এরপর মোট ৩৮ হাজার ২৮৩ পদে নিয়োগে সুপারিশ করে এনটিআরসিএ৷ তাঁদের মধ্যে অনেকেই ভেরিফিকেশন ফরম পূরণ করে জমা না দেওয়ায় চূড়ান্ত সুপারিশপ্রাপ্ত হন ৩৪ হাজার ১৮৯ জন। গত ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই শিক্ষকদের যোগদানের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখনো যোগদান করেনি ৩ হাজার ৩২৫ জন। 
অর্থাৎ ৫৪ হাজারের গণবিজ্ঞপ্তিতে শেষ পর্যন্ত যোগদান করেছে ৩০ হাজার ৮৬৪ জন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত এই শিক্ষকদের বদলির সুযোগ নেই। তাই অনেকেই চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। এর সঙ্গে বেতন জটিলতা থাকায় আরও কয়েক হাজার পদ শূন্য হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

এ বিষয়ে এনটিআরসিএর সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষক ফোরামের সভাপতি শান্ত আহাদ বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সুপারিশ করে এনটিআরসিএ নন-এমপিও শিক্ষকদের জীবনকে দুর্বিষহ অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।’

এই সম্পর্কিত পড়ুন:

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত