বিদেশি ফলে ভরছে দেশের মাঠ, ৫টির চাষ সবচেয়ে বেশি

সাইফুল মাসুম, ঢাকা
আপডেট : ২০ জুন ২০২৪, ১২: ১৬
Thumbnail image

মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার ফল ড্রাগন। কয়েক বছর আগেও দেশে আমদানি করতে হতো। চড়া দামে মিলত অভিজাত ফলের দোকানে। ক্রেতারা ছিলেন উচ্চবিত্তের। দাম কমায় বড়লোকের সেই ফল এখন মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্নবিত্তের মানুষও চাইলে মহল্লার দোকান থেকে কিনতে পারছেন। এর কারণ, ড্রাগন ফল এখন চাষ হচ্ছে দেশেই।

ড্রাগনসহ ৩৪টি বিদেশি ফল এখন দেশেই চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে আটটির চাষ হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। লাভ হওয়ায় চাষ বাড়ছে। দেশে এসব ফল মেলায় কমেছে আমদানি। সাশ্রয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে বর্তমানে ৭২ রকমের ফল চাষ হচ্ছে। এর প্রায় অর্ধেকই বিদেশি ফল। বর্তমানে ১১ হাজার হেক্টর জমিতে বিদেশি ফলের চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে আড়াই হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে ড্রাগনের। দেশে উৎপাদিত বিদেশি ফলের বাজারমূল্য প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক হামিদুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিদেশি ফল দেশের মানুষের ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করছে। কিন্তু আমাদের আদি ফলগুলোর জাত উন্নয়ন করা জরুরি। তা না করা হলে বিদেশি ফলের আড়ালে দেশি ফল হারিয়ে যাবে।’

আজকের পত্রিকার প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, ৩৮ জেলায় বিদেশি বিভিন্ন ফলের চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে ৩৬ জেলায় হচ্ছে ড্রাগন ফলের চাষ। মাল্টা ২৮ জেলায়, কমলা ২১ জেলায়, স্ট্রবেরি ১৩ জেলায়, রকমেলন ৭ জেলায় এবং থাই পেয়ারা ও সৌদি খেজুর চাষ হচ্ছে ৬ জেলায়।

দেশে চাষ হওয়া অন্য বিদেশি ফলগুলোর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাম্বুটান; মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার ফল অ্যাভোকাডো; ভিয়েতনামের ছোট জাতের নারকেল, আম; চীনের পার্সিমন, লংগান (কাঠলিচু), বারোমাসি আঠাবিহীন কাঁঠাল, এমবি২ আনারস, থাই কুল, থাই পেঁপে, থাই সফেদা, আঙুর, নাশপাতি, জাবটিকাবা, সুইট লেমন, থাই মিষ্টি তেঁতুল, তিন (আদি নিবাস মধ্যপ্রাচ্য), গোল্ডেন ক্রাউন (হলুদ তরমুজ), মালবেরি (আদি নিবাস চীন), আপেল, করোসল ইত্যাদি। এ ছাড়া বিদেশি কাজুবাদাম ও আলুবোখারাও দেশে চাষ হচ্ছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের বিদেশি ফল আমদানি হয়েছে। এসব ফলের মধ্যে রয়েছে খেজুর, আঙুর, কমলা, নাশপাতি ও আপেল। ধারণা করা হয়, দেশে বছরে বিদেশি ফলের বাজার ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, দেশে বিদেশি ফল উৎপাদন হওয়ায় আমদানি কমেছে। দুই বছর আগেও থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে ড্রাগন ফল আমদানি করতে হতো। এখন চাহিদার ৯০ শতাংশই দেশে হয়। লিচু, আম, আনারসের চাহিদার পুরোটাই দেশে হয়। তবে বিপুল পরিমাণ খেজুর, আঙুর, কমলা, নাশপাতি ও আপেল আমদানি করতে হয়।

জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দেশে বিদেশি ফল উৎপাদনে আমরা দুইভাবে লাভবান হচ্ছি। একদিকে তাজা ফল পাচ্ছি। ফলের বৈচিত্র্য বেড়েছে। অন্যদিকে গত পাঁচ বছরে বিদেশ থেকে ফল আমদানি তুলনামূলক কম হয়েছে।’ তাঁর মতে, বিদেশি ফল উৎপাদন বাড়াতে সরকারের আরও সহযোগিতা প্রয়োজন।

খুলনায় ড্রাগন ও সবুজ মাল্টা বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। জেলার ফুলতলা, ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা ও রূপসা উপজেলায় এ দুটি বিদেশি ফল চাষ করে অনেক বেকার যুবক স্বাবলম্বী হয়েছেন। ফুলতলার গাড়াখোলা গ্রামের আকরাম হোসেন ১৫ শতাংশ জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে ১০০ ড্রাগনের চারা রোপণ করে দেড় লাখ টাকা আয় করেন। তাঁকে দেখে ওই এলাকার কৃষকেরা ড্রাগনে আগ্রহী হন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও ড্রাগন ও মাল্টার চাষ বেড়েছে।

চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় এ বছর ২৮৫ হেক্টর জমিতে ৩ হাজার ৪০০ টন ড্রাগন, ৩২৭ হেক্টর জমিতে প্রায় ৫ হাজার টন রকমেলন উৎপাদিত হয়েছে।

উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ জেলায় বিভিন্ন বিদেশি ফলের চাষ হচ্ছে। ঠাকুরগাঁওয়ে চাষ হচ্ছে ড্রাগন, চায়না কমলা, তিন, রকমেলন, স্ট্রবেরি ও সৌ‌দি খেজুর। মাল্টা ও ড্রাগন চাষ হচ্ছে কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুরে। কমলা, স্ট্রবেরি, ড্রাগন ও মাল্টার চাষ হচ্ছে রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে। জয়পুরহাটে চাষ হচ্ছে ড্রাগন, স্ট্রবেরি, মাল্টা, কমলা।

সিলেটে চাষ হচ্ছে ড্রাগন, স্ট্রবেরি ও কাজুবাদামের। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, সিলেটের উপপরিচালক মোহাম্মদ খায়ের উদ্দিন মোল্লা জানান, সিলেটে চার-পাঁচ বছর ধরে ড্রাগন ও স্ট্রবেরি এবং দুই বছর ধরে কাজুবাদাম চাষ হচ্ছে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে চাষ হচ্ছে রাম্বুটান, ড্রাগন, চায়না কমলা ও লিচুর।
চাঁদপুরে চাষ হচ্ছে মাল্টা, আম, কমলাসহ কয়েকটি বিদেশি ফল।

তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে এক লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে আম, ড্রাগন, কমলা, মাল্টাসহ মিশ্র ফলের বাগান গড়ে উঠেছে। কাজুবাদামও চাষ হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রাঙামাটি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক তপন কুমার পাল বলেন, চলতি মৌসুমে তিন পার্বত্য জেলায় ফলের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১৭ লাখ টন। চট্টগ্রামেও ড্রাগনের চাষ হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ প্রকল্পের অধীনে দেশি ফলের পাশাপাশি চাষ হয়েছে ১০টি বিদেশি ফল। প্রকল্প পরিচালক ড. মো. মেহেদী মাসুদ বলেন, দেশে উৎপাদন হওয়ায় ড্রাগন, মাল্টার মতো বিদেশি ফল ক্রেতা কম দামে পাচ্ছেন। চাষিদেরও ভালো আয় হচ্ছে।

বিদেশি ফল চাষের ক্ষেত্রে সংগনিরোধে জোর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন রাজশাহীর ফল গবেষণা কেন্দ্রের (বিএআরআই) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. খো. হাবিবুল আলম। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিদেশি ফলের আমদানিকৃত উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত পণ্য সংগনিরোধ করা খুব দরকার। অনেক সময় পরীক্ষা ছাড়াই বিদেশি জাতের ফল দেশে আনা হয়। এতে ফলের জাতের সঙ্গে রোগবালাই-পোকামাকড়ও চলে আসে। ভালো ফলনের আশায় কৃষক চাষাবাদ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আজকের পত্রিকার সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিরা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত