আনোয়ারুলকে চেতনানাশকে অজ্ঞান করে বাঁধা হয় চেয়ারে: আসামি মোস্তাফিজুরের স্বীকারোক্তি 

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২৪, ২১: ৫৪
আপডেট : ০২ জুলাই ২০২৪, ২২: ৩৪

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনারকে কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে নিয়ে আগে চেতনানাশক ব্যবহার করে অজ্ঞান করা হয়। পরে চেয়ারে বেঁধে ফেলা হয়। চেয়ারে বাঁধার এই কাজটি করেছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান।

ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় এমপি আনোয়ারুল অপহরণ মামলায় গ্রেপ্তার মোস্তাফিজুর রহমান আজ মঙ্গলবার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যার দায় স্বীকার করে এ কথা বলেছেন। ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের খাস কামরায় মোস্তাফিজ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।

দুপুরের দিকে মোস্তাফিজকে আদালতে হাজির করে ডিবি পুলিশ। তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহফুজুর রহমান আসামি মোস্তাফিজের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার আবেদন করেন। পরে আদালত তাঁর জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন। জবানবন্দি শেষ হওয়ার পর তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।

আদালতের শেরেবাংলা নগর থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা এসআই জালাল উদ্দিন জবানবন্দির বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

গত ২৭ জুন এমপি আনোয়ারুলকে অপহরণে জড়িত থাকার অভিযোগে ফয়সাল আলী ওরফে সাইজি ওরফে সাজী ও মোস্তাফিজুর রহমানকে ছয় দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। ২৬ জুন ডিবি অভিযান চালিয়ে চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা থেকে তাঁদের আটক করে। গ্রেপ্তারের পর তাঁরা জানান, ধর্মীয় পরিচয় গোপন করে পাহাড়ের পাতাল কালীমন্দিরে ২৩ দিন আত্মগোপনে ছিলেন তাঁরা। মন্দিরের লোকজনের কাছে মোস্তাফিজ নিজের পরিচয় দেন শিমুল রায় নামে। ফয়সালের পরিচয় ছিল পলাশ রায়।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, মোস্তাফিজ আদালতকে বলেছেন, তিনি চরমপন্থী নেতা শিমুল ভূঁইয়ার সহযোগী। দীর্ঘদিন ধরে শিমুল ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করছেন তিনি। শিমুল ভূঁইয়া এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। আর এই পরিকল্পনার প্রধান রূপকার আখতারুজ্জামান শাহীন।

মোস্তাফিজ স্বীকারোক্তিতে বলেন, তাঁদের টাকার প্রয়োজন থাকায় গত মার্চ মাসে শিমুলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শিমুল ভূঁইয়া বড় অঙ্কের টাকার লোভ দেখান। তিনি বলেন, এই টাকা পেতে হলে তোমাদের কলকাতায় যেতে হবে। এতে মোস্তাফিজ ও ফয়সাল রাজি হন। পরে পাসপোর্ট করার জন্য কিছু টাকাও শিমুল ভূঁইয়া দুজনকে দেন। পাসপোর্ট করার পর গত এপ্রিলে তাঁরা ঢাকায় আসেন। ঢাকায় এসে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আখতারুজ্জামান শাহীনের বাসায় ওঠেন। সেখানে কয়েক দিন থাকার পর আখতারুজ্জামান শাহীনের পিএস সিয়াম দুজনের ভিসার ব্যবস্থা করে দেন।

শিমুল ভূঁইয়ার নির্দেশনা অনুযায়ী মোস্তাফিজ ও ফয়সাল হত্যাকাণ্ডের ১১ দিন আগে অর্থাৎ ২ মে কলকাতায় যান। সেখানকার নিউমার্কেট এলাকার ‘হোটেল প্লাজা’য় ওঠেন।

পরে হত্যাকাণ্ডের একদিন আগে আখতারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে বিমানবন্দরের পাশের একটি রেস্টুরেন্টে তাঁরা মিটিং করে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেন।

জবানবন্দিতে মোস্তাফিজ হত্যার পর লাশ টুকরা টুকরা করা, বাইরে টুকরাগুলো বস্তায় ভরে নেওয়ার ঘটনা এবং হত্যাকাণ্ডে কার কী ভূমিকা ছিল সব বর্ণনা করেছেন বলে জানা গেছে।

মোস্তাফিজ জবানবন্দিতে আরও বলেন, খুনের ছয় দিন পর তিনি ও ফয়সাল ঢাকায় ফিরে আত্মগোপনে চলে যান। তাঁরা পরিচয় গোপন করে চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় একটি মন্দিরে আশ্রয় নেন। গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁরা এই কাজ করেন বলে আদালতকে জানান।

আনোয়ারুল আজীম ভারতে খুন হওয়ার ঘটনায় গত ২২ মে ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় অপহরণের পর বাবাকে গুম করার অভিযোগে মামলা করেন তাঁর মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন।

মামলার এজাহারে এমপির মেয়ে উল্লেখ করেন, ৯ মে রাত ৮টার দিকে তাঁর বাবা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর সংসদ সদস্য ভবনের বাসা থেকে গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে যাওয়ার উদ্দেশে রওনা হন। ১১ মে ৪টা ৪৫ মিনিটে তাঁর বাবার সঙ্গে মোবাইলে ভিডিও কলে কথা বললে বাবার কথাবার্তায় কিছুটা অসংলগ্নতা মনে হয়। এরপর মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন দিলে বন্ধ পান।

গত ১৩ মে আনারের ভারতীয় নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ আসে। মেসেজে লেখা ছিল-‘আমি হঠাৎ করে দিল্লি যাচ্ছি, আমার সঙ্গে ভিআইপি আছে। আমি অমিত শাহের কাছে যাচ্ছি। আমাকে ফোন দেওয়ার দরকার নেই। পরে ফোন দেব।’ এ ছাড়া আরও কয়েকটি মেসেজ আসে। মেসেজগুলো মুনতারিনের বাবার মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অপহরণকারীরা করে থাকতে পারে বলে এজাহারে বলা হয়।

এজাহারে আরও বলা হয়, বাদীর বাবা ভারতে খুন হয়েছেন বলে তিনি জানতে পেরেছেন। তবে এখনো বাবার লাশ পায়নি তাঁর পরিবার। তাঁর বাবাকে অপহরণ করে খুন করা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।

আনোয়ারুল আজীম গত ১২ মে দর্শনা–গেদে সীমান্ত দিয়ে চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। বরাহনগরের স্বর্ণ ব্যবসায়ী বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন। কিন্তু ১৬ মে থেকে তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে না পারায় নিখোঁজ জানিয়ে ১৮ মে বরাহনগর থানায় জিডি করেন গোপাল বিশ্বাস।

গত ২২ মে সকালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে আনোয়ারুল আজীম খুন হওয়ার খবর আসে। এরপর তাঁর মেয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় অপহরণের পর গুম করার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন।

এর আগে এই মামলায় শিমুল ভূঁইয়া, তাঁর ভাতিজা তানভীর ভূঁইয়া, শিলাস্তি রহমান, ঝিনাইদহের আরেক আওয়ামী লীগ নেতা কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুকে ও ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই পাঁচজন কারাগারে আছেন। মিন্টু ছাড়া বাকি চারজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে সংসদ সদস্য আনারকে হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। মোস্তাফিজের সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া ফয়সাল এখনো রিমান্ডে রয়েছেন।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত