মানহানির মামলা কখন করা যায়, শাস্তি কী?

সুলতান মাহমুদ, ঢাকা
প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৩, ১৮: ২২
আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২৩, ১৮: ৪৬

সামাজিক, পারিবারিক, বংশগত বা ব্যক্তিগত অবস্থানে মানুষ আত্মসম্মান নিয়ে বসবাস করতে চান। কেউ যদি কারও সম্পর্কে কুৎসা রটান, লোকজনের কাছে বাজে মন্তব্য করেন এবং এতে যদি উদ্দিষ্ট ব্যক্তি মনে করেন তাঁর মানহানি হয়েছে—তাহলে তিনি আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন।

কিন্তু চাইলেই কি কেউ কারও বিরুদ্ধে মানহানির মামলা ঠুকে দিতে পারবেন? আইন কিন্তু স্পষ্ট করে দিয়েছে মানহানির বিষয়টি। কোন বিষয়গুলো মানহানি, আর কোন বিষয়গুলো মানহানি নয়। অর্থাৎ আইনে মানহানির সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট করা আছে।

দণ্ডবিধিতে বলা হয়েছে, যদি কেউ কারও মানহানি করে, তবে সেই ব্যক্তির শাস্তি হবে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা দণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কিন্তু চলতি বছরে পাস হওয়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে বলা হয়েছে, যদি কেউ কারও মানহানি করে তার শাস্তি হবে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা। নতুন আইনে কারাদণ্ডের বিধান নেই। 

মানহানির সংজ্ঞা
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারামতে, কোনো ব্যক্তি যদি অন্য কোনো ব্যক্তির খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট করার উদ্দেশ্যে কথিত বা পঠিত হওয়ার জন্য কথা বা চিহ্ন বা দৃশ্যমান কল্পমূর্তির সাহায্যে সেই ব্যক্তি-সম্পর্কিত কোনো নিন্দাবাদ প্রণয়ন বা প্রকাশ করেন, তবে সেটি মানহানি হয়েছে বলে পরিগণিত হবে। উদ্দিষ্ট ব্যক্তির খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট হবে জেনে বা সুনাম নষ্ট হতে পারে বলে বিশ্বাস করার কারণ থাকা সত্ত্বেও যদিও কেউ নিন্দাবাদ প্রণয়ন ও প্রকাশ করেনও তাহলেও সেটি মানহানি বলে গণ্য হবে।

মানহানির শাস্তি
দণ্ডবিধির ৫০০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির মানহানি করে, তবে ওই ব্যক্তি দুই বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদে বিনা শ্রম কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’ 

চলতি বছর পাস হওয়া ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’-এর ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, তাহলে ওই ব্যক্তির এমন কর্মকাণ্ড হবে একটি অপরাধ। এর জন্য তিনি অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এ আইনে মানহানির মামলায় কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়নি।

কোন কাজগুলো মানহানি নয়
দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় কোন কাজগুলো মানহানি হবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। পাশাপাশি এই ধারায় ১০টি ব্যতিক্রমের কথাও বলা হয়েছে। অর্থাৎ এই ব্যতিক্রমগুলো আইন অনুযায়ী মানহানি বলে গণ্য হবে না:

১. জনগণের কল্যাণে কারও প্রতি সত্য দোষারোপ করলে।

২. সরকারি কর্মচারীর সরকারি আচরণ সম্পর্কে সৎ বিশ্বাসে অভিমত প্রকাশ করলে।

৩. সরকারি বিষয়-সংশ্লিষ্ট প্রশ্নে কোনো ব্যক্তির আচরণ নিয়ে মতপ্রকাশ করলে।

৪. আদালতের কার্যবিবরণী প্রতিবেদন প্রকাশ করা মানহানির অন্তর্ভুক্ত হবে না। 

৫. যেকোনো জনসমস্যা সম্পর্কে ও কোনো ব্যক্তির আচরণ সম্পর্কে সৎ বিশ্বাসে অভিমত প্রকাশ করা।

৬. আদালতে সিদ্ধান্তকৃত মামলার দোষ, গুণ বা সাক্ষীদের সম্পর্কে বা অন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আচরণ সম্পর্কে অভিমত দেওয়া।

৭. গণ-অনুষ্ঠানের অনুষ্ঠানাদি সম্পর্কে কোনো মতামত দেওয়া।

৮. কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে সৎ বিশ্বাসে কারও সম্পর্কে অভিযোগ করা হলে সেটিও মানহানি হবে না। যেমন: পুলিশের কাছে কারও ব্যাপারে সৎ বিশ্বাসে অভিযোগ দেওয়া। 

৯. কোনো ব্যক্তি কর্তৃক তার বা অন্য কারও স্বার্থ রক্ষার্থে দোষারোপ করা।

১০. জনকল্যাণের স্বার্থে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে কারও সম্পর্কে কিছু বলা হলে।

বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯ অনুযায়ী বাংলাদেশি নাগরিকদের বাক্‌স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। তবে এর মানে এই নয় যে, কোনো ব্যক্তিকে তার সম্মানহানি বা সুনাম নষ্ট করার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো কথা বলার অধিকার একজন নাগরিককে দেওয়া হয়েছে। 

মানহানির মামলা কোথায় করবেন
কারও বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে চাইলে, আদালতে যেতে হবে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহফুজার রহমান (ইলিয়াস) আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যদি কেউ কারও বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীন মানহানির মামলা করতে চান তাহলে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে হবে। আর যদি দণ্ডবিধির অধীন মামলা করতে চান তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলা করতে হবে।’ 

পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার করা যাবে কি না
সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারা এবং দণ্ডবিধির ৫০০ ধারা আমল অযোগ্য। যদি কেউ আমল অযোগ্য ধারায় মামলা করতে চান তাহলে আদালতে মামলা করতে হবে। আইনজীবী মাহফুজার রহমান (ইলিয়াস) বলেন, ‘আদালত মামলা গ্রহণ করে যদি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি না করেন তাহলে পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে না।’ 

ট্রাইব্যুনাল কত টাকা জরিমানা করবেন
আইনজীবী মাহফুজার রহমান (ইলিয়াস) বলেন, ‘ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচারের জন্য আদালতে মামলা হলে ট্রাইব্যুনাল সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করতে পারবেন। কিন্তু কত টাকা জরিমানা করবেন তা ট্রাইব্যুনাল বিবেচনা করবেন। ট্রাইব্যুনাল ইচ্ছা করলে ১ হাজার টাকাও জরিমানা করতে পারেন। আবার ২৫ লাখ টাকাও জরিমানা করতে পারেন। আইনে বলা আছে, ট্রাইব্যুনাল ২৫ লাখ টাকার বেশি জরিমানা করতে পারবেন না। কিন্তু সর্ব নিম্ন কত টাকা জরিমানা করবেন তা আদালতের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে।’

জরিমানা টাকা আদায় করা হবে কীভাবে

ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৮৬ ধারামতে, 

(১) যে ক্ষেত্রে কোনো আসামিকে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়, তখন শাস্তি দানকারী আদালত দুটি বা উভয় উপায় মোতাবেক জরিমানা আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন—

(ক) অপরাধীর অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয় ও বিক্রয় করে জরিমানা আদায়ের জন্য পরোয়ানা দিতে পারবেন, অথবা

(খ) খেলাপকারীর স্থাবর বা অস্থাবর বা উভয় প্রকার সম্পত্তিতে দেওয়ানি পদ্ধতি মোতাবেক পরোয়ানা বলবৎ করে জরিমানার টাকা আদায়ের ক্ষমতা দিয়ে জেলার কালেক্টরকে পরোয়ানা দিতে পারবেন। 

তবে শর্ত থাকে, যদি দণ্ডাদেশে নির্দেশ থাকে যে, জরিমানা পরিশোধ করা না হলে অপরাধী কারাদণ্ডে সাজাপ্রাপ্ত হবেন এবং যদি অনাদায়ের কারণে কারাদণ্ড ভোগ করেন, তাহলে কোনো আদালত (ক) ও (খ)-এ উল্লেখিত পরোয়ানা দেবেন না। তবে বিশেষ কোনো কারণবশত আবশ্যক মনে করলে আদালত ওই কারণ লিপিবদ্ধ করে পরোয়ানা দেবেন।

(২) সরকার (১) উপধারার (ক) অনুচ্ছেদ পরোয়ানা কার্যকরীকরণের পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়া ওই পরোয়ানা কার্যকরীকরণ প্রসঙ্গে ক্রোককৃত সম্পত্তিতে অপরাধী ছাড়া অপর কোনো ব্যক্তির কোনো দাবি থাকলে সেটি নির্ধারণের ব্যবস্থা করার জন্য বিধি প্রণয়ন করতে পারবে সরকার। 

(৩) আদালত যখন (১) উপধারার (খ) অনুচ্ছেদ মোতাবেক কালেক্টরকে পরোয়ানা দেন তখন ১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধি অনুযায়ী, ওই পরোয়ানাকে ডিক্রি এবং কালেক্টরকে ডিক্রিদার বলে গণ্য করতে হবে। নিকটতম যে দেওয়ানি আদালত অনুরূপ পরিমাণ অর্থের ডিক্রি জারি করতে পারেন, ওই কার্যবিধির উদ্দেশ্যে সেই আদালতকে ওই ডিক্রিদাতা আদালত বলে গণ্য করতে হবে। ডিক্রি জারির ব্যাপারে কার্যবিধির বিধানগুলোও একই ভাবে প্রযোজ্য হবে।

তবে শর্ত থাকে যে, অপরাধীকে গ্রেপ্তার বা কারাগারে আটক রেখে এমন কোনো পরোয়ানা বলবৎ করা যাবে না। 

লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত