বিদ্যুৎ গেলে নেটওয়ার্ক থাকে না টেলিটকের, জিপির মেসেজে বিরক্ত: মতবিনিময় সভায় গ্রাহকেরা

বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা
আপডেট : ৩০ মে ২০২৩, ২১: ১১
Thumbnail image

বিদ্যুৎ বিভ্রাটের (লোডশেডিং) পর টেলিটকের নেটওয়ার্ক কাভারেজ থাকে না। গ্রামীণফোন থেকে গ্রাহককে প্রচুর (খুদে বার্তা) মেসেজ প্রদান করা হয়, যা খুবই বিরক্তিকর। মোবাইল অপারেটরসমূহের প্যাকেজ এবং ডাটার মূল্য বিষয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে বিটিআরসির মতবিনিময় সভায় উঠে এসেছে এসব তথ্য। আলোচনায় প্রকাশিত জরিপে সবচেয়ে বেশি মানুষ মতামত দিয়েছেন অব্যবহৃত ডাটা-পরবর্তী প্যাকেজে যুক্ত হওয়ার (ডাটা ক্যারি ফরওয়ার্ড) বিষয়ে।

মানসম্মত টেলিযোগাযোগ সেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে মোবাইল অপারেটরসমূহের প্যাকেজ এবং ডাটার মূল্য নিয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সম্মেলন কক্ষে মঙ্গলবার এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় টেলিকম সেবাগ্রহীতা, সকল মোবাইল অপারেটরের প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং টেলিকম বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

২০১৪ সাল থেকে টেলিটক সিম ব্যবহারকারী আতিক হাসান নামে একজন গ্রাহক টেলিটকের আনলিমিটেড প্যাকেজের মূল্য কমানো ও দেশব্যাপী এর নেটওয়ার্ক সুবিধা বাড়ানোর আহ্বান জানান। জবাবে টেলিটকের পক্ষ থেকে উপস্থিত প্রতিনিধি জানান, অন্য অপারেটরদের চেয়ে টেলিটকের ডাটা সাশ্রয়ে পাওয়া যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও এটা চলমান থাকবে। টেলিটকের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের কার্যক্রম চলছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আগামী বছরে প্রথম প্রান্তিকে টেলিটকের সেবার মান আরও বৃদ্ধি পাবে।

মাইনুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী নেটওয়ার্ক প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন জানিয়ে নেটওয়ার্ক সেবা আরও উন্নত করতে মোবাইল অপারেটরদের প্রতি আহ্বান জানান।

টেলিকম বিশেষজ্ঞ আবু সাঈদ খান বলেন, গ্রাহকদের জন্য মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিতে টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানে সাপ্লাই লাইনে (সরবরাহ লাইন) যেসব অসঙ্গতি রয়েছে, সেগুলো সমাধান করতে হবে যাতে গ্রাহক কোনোভাবে প্রতারিত না হন।

অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (অ্যামটব) মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম ফরহাদ (অব.) বলেন, প্রত্যেক গ্রাহকের ডাটা প্যাকেজের চাহিদা আলাদা। তরুণ প্রজন্ম বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজ চায় জানিয়ে তিনি বলেন, সাধারণ গ্রাহকের জন্য অপারেটর কর্তৃক ৫০টি নিয়মিত প্যাকেজ চালু করেছে যা গ্রাহক চাহিদা বিবেচনায় বেশি বলে প্রতীয়মান নয়।

বিটিআরসির সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাসিম পারভেজ তাঁর উপস্থাপনায় প্যাকেজ সংখ্যা ও ডাটার মূল্যের ওপরে অনলাইনে গ্রাহক জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন। জরিপে ৫৪৯ জনের মধ্যে ৪৯ দশমিক ৫ ভাগ ছাত্র/ছাত্রী, ২৯ দশমিক ১ ভাগ চাকরিজীবী, ৯ দশমিক ৫ ভাগ ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য পেশার ৬ ভাগ গ্রাহক অংশ নেন।

একটি মোবাইল অপারেটর কর্তৃক সর্বোচ্চ কতগুলো অফার থাকা উচিত? এমন প্রশ্নের উত্তরে জরিপে অংশগ্রহণকারী ৫৪ দশমিক ৯ ভাগ ৪০-৪৫টি সর্বোচ্চ প্যাকেজ থাকা উচিত বলে মতামত দিয়েছেন। বাকি ২৩ দশমিক ২ ভাগ অংশগ্রহণকারী ৭১-৮৫টি প্যাকেজ এবং ১৪ ভাগ ৫১-৬০টি প্যাকেজের বিষয়ে মতামত প্রদান করেন।

ডাটা প্যাকেজের মেয়াদ কত দিন থাকা উচিত? এমন প্রশ্নের উত্তরে ৫২ দশমিক ২ ভাগ প্যাকেজের মেয়াদে ৭ দিন, ৩০ দিন ও আনলিমিটেড হওয়া উচিত বলে মতামত দেন। ৪৪ ভাগ অংশগ্রহণকারী ৩ /৭ / ১৫ / ৩০ দিন প্যাকেজের মেয়াদ থাকা উচিত বলে জানিয়েছেন।

৫২ দশমিক ৮ ভাগ মানুষ ডাটার দামের বিষয়ে যেকোনো মেয়াদে প্রতি জিবির মূল্য অভিন্ন থাকা উচিত বলে মত দেন। ২৭ দশমিক ২ ভাগ জানান প্রতি জিবির ডাটার মূল্য বিভিন্ন মেয়াদের জন্য ভিন্ন রকম থাকা উচিত এবং প্রায় ২০ ভাগ মানুষ স্বল্প মেয়াদের ডাটার দাম অধিক মেয়াদের ডাটার দাম অপেক্ষাকৃত কম থাকা উচিত বলে মত দেন।

প্রতি জিবি ডাটার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মূল্যের বিষয়ে ৪৬ ভাগ মতামত সব সময় একটি ফ্লোর (সর্বনিম্ন মূল্য) থাকা উচিত। প্রায় ২১ ভাগের মত ভিন্ন মেয়াদের ডাটার জন্য পৃথক সিলিং থাকা উচিত। আর সতেরো ভাগ অংশগ্রহণকারী জানান প্রতি জিবির জন্য এতটি ফ্লোর (সর্বনিম্ন মূল্য) ও একটি সিলিং (সর্বোচ্চ মূল্য) থাকা উচিত।

টেলিটকের অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (মার্কেটিং, সেলস অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন) সাইফুর রহমান খান বলেন, গ্রাহকের মতামতের ওপর গুরুত্ব দিয়ে টেলিটক ডাটা প্যাকেজের পরবর্তী মূল্য ও সংখ্যা নির্ধারণ করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মইনুল জাবের বলেন, প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ডাটা মূল্য নির্ধারণে নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন হয় না। মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে নজর দেওয়ার পাশাপাশি মানসম্পন্ন ডাটা সেবার নিশ্চয়তা দিতে হবে।

বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান বলেন, বছরখানিক আগে ডাটা মূল্য নিয়ে বেশি আলোচনা হলেও বর্তমানে সেবার মান নিয়ে গ্রাহকেরা প্রশ্ন তুলছেন বেশি। বিভিন্ন পর্যায়ে অপারেটরদের প্রচুর পরিচালন ব্যয় হওয়ায় ডাটার দাম চাইলেই কমানো সম্ভব হয় না। 

রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার মোহাম্মদ সাহেদুল আলম বলেন, গ্রাহক চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অপারেটরদের প্যাকেজ নির্ধারণ করতে হয় বলেই ডাটা প্যাকেজ সংখ্যা বেশি মনে হয়। কর কমানো হলে ডাটার দাম কমানো সম্ভব হবে।

গ্রামীণফোনের সিনিয়র ডিরেক্টর (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) হুসেইন সাদাত বলেন, অপারেটর ও গ্রাহকদের মতামত নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিটিআরসির পক্ষে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হবে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (টেলিকম) মো. মাহবুব-উল-আলম বলেন, বিটিআরসির দায়িত্ব হলো নিরপেক্ষ ভূমিকায় থেকে অপারেটর ও গ্রাহক উভয়ের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে ‘এক দেশ এক রেট’ যেভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে তেমনিভাবে মোবাইল ইন্টারনেট সেবায় ‘এক দেশ এক রেট’ চালু করা দরকার।

গ্রাহক সচেতন হলে মূল্য নির্ধারণ প্রয়োজন হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ প্রযুক্তি সম্পর্কে এখনো তেমন সচেতন নয়, তাই তাদের স্বার্থ বিবেচনায় ডাটার মূল্য ও মেয়াদ নির্ধারণ করতে হবে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিটিআরসির ভাইস-চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, গ্রাহকের মতামত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে আমরা একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।

সভাপতির বক্তব্যে বিটিআরসির স্পেকট্রাম বিভাগের কমিশনার প্রকৌশলী শেখ রিয়াজ আহমেদ বলেন, সকলের মতামত নিয়ে একটি ফলপ্রসূ ও গ্রাহকবান্ধব সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর লক্ষ্যে কাজ করছে বিটিআরসি। অপারেটর ও গ্রাহক উভয়ের মতামত নিয়ে মোবাইল ইন্টারনেটের নিম্নসীমা ও প্যাকেজ সংখ্যার বিষয়ে শিগগিরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত