অন্তর্বর্তী সরকারের ৩ মাস

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে অবাধে, নামে-বেনামে

ডয়চে ভেলে  
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০০: ৪৬
আপডেট : ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪: ৫৪
ফাইল ছবি

ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ব্যাপক সমালোচিত। এই সরকারের বিরুদ্ধে পূঞ্জীভূত ক্ষোভের জমিনে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার অভুত্থানের ফসল হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার তিন মাস পার করতে যাচ্ছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার স্লোগান দিচ্ছে এই সরকার। কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ ও মানবাধিকার পরিস্থিতিতে কোনো উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে কি?

গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের সরকার দায়িত্ব নেয়৷ মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে গণপিটুনি বা তথাকথিত ‘মব জাস্টিসের’ শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ৬৮ জন। অথচ, গত সরকারের আমলে ২০২৩ সালে পুরো বছরে ওভাবে নিহত হন ৫১ জন।

আসকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ২০ জন৷ আর চলতি বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস আগস্ট থেকে অক্টোবরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ওভাবে নিহত হন সাত জন৷ চলতি নভেম্বরেও একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷

এবিষয়ে জানতে চাইলে মানবাধিকার কর্মী ও গুম কমিশনের সদস্য নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এখন আমরা দেখছি মব জাস্টিসের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা ভয়াবহভাবে ফিরে এসেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে।’

আর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘পতিত শেখ হাসিনা সরকারের গত বছরের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তিন মাসের তুলনায় বর্তমান সরকারের তিন মাসে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও মব জাস্টিসের নামে হত্যা বেড়েছে।’

এই সময়ে যারা কথিত গণপিটুনি বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কথা বলতে চাইছেন না৷

গত বুধবার রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে ইয়াকুব ও আলমগীর নামে দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাদের চাচা আব্দুল হালিম ফোনে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘পিটিয়ে হত্যার পর আমরা খবর পেয়ে হাসপাতালে যাই। কিন্তু কেন হত্যা করা হয়েছে, কারা হত্যা করেছে তার কিছুই আমরা জানি না।’

পুলিশের ভাষ্য, উত্তেজিত জনতা ‘ছিনতাইকারী’ বলে তাঁদের পিটিয়ে হত্যা করেছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের বোনের ছেলে শেখ আরিফুজ্জামান রূপমকে (৩৪) গতকাল সোমবার সকালে খুলনায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর মত্যু নিয়ে কথা বলতে চাননি তার চাচা এস এম মাহমুদ৷ আজ মঙ্গলবার তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমরা এখন তাঁর দাফন নিয়ে ব্যস্ত, কথা বলা সম্ভব নয়। কারা মেরেছে, কেন মেরেছে বলতে পারছি না। আর পুলিশের কাছে যেয়ে কী হবে?’

গত ৩০ অক্টোবর নড়াইলে মাইকিং করে গরু চোর সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ১ নভেম্বর ভোর রাতে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার খলিশাখালি এলাকায় যৌথ বাহিনীর অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের সময় তথাকথিত গণপিটুনিতে কামরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। মামলা হলেও কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।

এর আগের তথাকথিত মব জাস্টিসের শিকার হয়ে বেশকিছু মৃত্যু দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছে৷ গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে ‘চোর’ সন্দেহের ধরে নিয়ে গিয়ে রীতিমতো পরিকল্পনা করে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার আগে তোফায়েলের খিদে পেলে তাকে ভাত খেতে দেয়া হয়। ভাত খাওয়ার পর আবার তাকে পেটানো হয়। হাসপাতালে নিলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন৷

একই রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে৷ এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা৷

চট্টগ্রামে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নেচে-গেয়ে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ হত্যার এক মাস পর ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে৷

গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় চোর সন্দেহে মামুন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ তার জেরে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে চার জন আদিবাসী নিহত হন৷ ঘর-বাড়িতে হামলা চালিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়৷

কয়েকদিন পর আবারো পাহাড়ে একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের অভিযোগে আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোহেল রানা নামের ওই শিক্ষকে পিটিয়ে হত্যার পর পাহাড়ি বাঙালি সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়৷

নূর খান বলেন, ‘একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে একজনকে হত্যার ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার ছাড়া এই ধরনের ঘটনায় আর কোনো গ্রেপ্তারের খবর আমার জানা নাই৷’

গুম কমিশন মঙ্গলবার জানিয়েছে, ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত তাদের কাছে প্রায় এক হাজার ৬০০ গুমের অভিযোগ জমা পড়েছে৷ এগুলো গত সরকারের আমলের ঘটনা৷ এর মধ্যে ৪০০ অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়েছে৷ পর্যায়ক্রমে বাকিগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷

৪০০ অভিযোগের মধ্যে ১৭২টি অভিযোগের সঙ্গে র‌্যাবের সংশ্লিষ্টতা আছে৷ কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ৩৭টি অভিযোগের সঙ্গে৷ ডিবির (গোয়েন্দা পুলিশ) সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ৫৫টির সঙ্গে৷ প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ২৬টির সঙ্গে৷ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ২৫টি অভিযোগের সঙ্গে৷

অন্যদিকে ২০০৪ সালে র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ২০ বছরে অন্তত দুই হাজার ৯৫৪টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত তথ্য পেয়েছে আসক।

মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচারের কোনো প্রক্রিয়া দেখছি না৷ আগের সরকারের আমলে হয়েছে, এখন আবার হচ্ছে৷ এটা তো জট পাকিয়ে যাচ্ছে৷ আগের বিচারই হচ্ছে না৷ এখনকার বিচার কে, কখন করবে?’

এলিনা খান মনে করেন, বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলে এই ধরনের অপরাধের বিচারের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘন কমত৷ কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। আগে বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক প্রভাবাধীন ছিল আর এখন বিচার ব্যবস্থার কাঠামোই নেই।

তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত র‌্যাব ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিচারের আওতায় আনতে৷ তা-ও করা হচ্ছে না।’

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে ‘নতুন আলামত’ তুলে ধরে মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘আগে করতো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, এখন সেটা মব জাস্টিসের নামে করা হচ্ছে; গণপিটুনির নামে হচ্ছে— এটা আরো ভয়াবহ আকারে এসেছে। আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেও নিহত হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘আসলে এইসব বন্ধ এবং বিচারের জন্য সরকারের কমিটমেন্ট খুব জরুরি। কিন্তু সেটা দৃশ্যমান নয়। বিচারের আওতায় আনা, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া খুব জরুরি৷’

বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘এই অল্প সময় (তিন মাসের) তুলনা করলে আগের সরকারের চেয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও মব জাস্টিস বেড়েছে। এটা হয়েছে সরকারের কমিটমেন্টের অভাবে। সরকার মুখে বলছে, কিন্তু কাজে করছে না। এর মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানবাধিকার রক্ষা সুদূরপরাহত।’

আর বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘মব জাস্টিসের নামে যা চলছে তা গ্রহণযোগ্য নয়৷ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। মানবাধিকার, মানুষের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার— এগুলো প্রতিষ্ঠা করতে হলে ওইসব অপরাধ বন্ধ করতে হবে। অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। আমরা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সময়ে যা দেখেছি, এখনো তা দেখতে চাই না।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে রাজনৈতিক কমিটমেন্ট না থাকলে এই সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধ হবে না। এজন্যই তো আমরা দ্রুত নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানাচ্ছি।’

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য ঘটনা সম্পর্কে চেষ্টা করেও পুলিশ সদর দপ্তরের বক্তব্য জানা যায়নি৷

তবে এর আগে পুলিশের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন, ‘পুলিশ সদর দপ্তরে পুলিশ কর্মকর্তাদের বৈঠকে মব জাস্টিস বন্ধ করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে। দেশের থানাসহ সব পুলিশ ইউনিটকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘এই ধরনের ঘটনা কোথাও ঘটলে পুলিশকে দ্রুত খবর দিতে জনসাধারণকে বার বার অনুরোধ করা হচ্ছে। পুলিশ সর্বনিম্ন সময়ের মধ্যে রেসপন্স করবে। আর পুলিশ যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটায় তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত