দুর্নীতির মচ্ছব বন্ধে বিশেষ কমিশন গঠনের দাবি মেননের

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৪, ২২: ১২
আপডেট : ২৪ জুন ২০২৪, ২২: ৩৭

দুর্নীতির মচ্ছব বন্ধে বিশেষ কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। দুর্নীতিবাজদের অর্থ–সম্পদ বাজেয়াপ্ত, বিচার করে কঠিনতম শাস্তির দাবিও জানিয়েছেন তিনি। 

আজ সোমবার ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব দাবি জানান। 

সরকারের উদ্দেশে রাশেদ খান মেনন বলেন, দুর্নীতির এই মচ্ছব বন্ধ করতে এখনই বিশেষ কমিশন গঠন করুন, দুর্নীতিবাজদের অর্থ–সম্পদ বাজেয়াপ্ত, বিচার করে কঠিনতম শাস্তি দিন। ঋণখেলাপি অর্থ আত্মসাৎকারীদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করুন। 

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বলেন, ‘এ কথা এখন আর অস্বীকার করার উপায় নাই যে সাবেক পুলিশপ্রধান ও সেনাপ্রধানের দুর্নীতির চিত্র হিমশৈলের ক্ষুদ্র উপরিভাগ মাত্র। এখনই বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে দুর্নীতির এই বিস্তার রোধ করা না গেলে হিমশৈলের ধাক্কায় দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির সলিলসমাধি হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমরা এখানে দেখলাম পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন থেকে দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার জন্য সাংবাদিকদের ধমক দেওয়া হয়েছে। অনেক মন্ত্রী এ তথ্যকে অনুমানভিত্তিক বলে অভিহিত করছেন।’ 

তিনি বলেন, মার্কিন ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি ইনস্টিটিউশন দেখিয়েছে, বছরে ৭ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই অর্থ বিনিয়োগ হচ্ছে কানাডার বেগমপাড়ায়, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে, সিঙ্গাপুর, দুবাইয়ের আধুনিক শপিং মল, রিয়েল এস্টেট ও হুন্ডি ব্যবসায়। এই টাকার লভ্যাংশও দেশে আসছে না। পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ প্রবাসীরা বিদেশে হাড়ভাঙা খাটুনির যে আয় দেশে পাঠান, এর ওপর কর বসানো হচ্ছে। তাঁদের বিদেশযাত্রা নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। 

মেনন বলেন, এই অর্থ–সম্পদ উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে তা ফেরত না দেওয়া। ব্যাংক লুট ও দুর্নীতি। ২০০৯ সালে ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকার ঋণ এখন ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। পুনঃ তফসিলীকরণ ও অবলোপন ধরলে এর পরিমাণ ৪ থেকে ৫ লাখ হাজার কোটি টাকা দাঁড়াবে। 

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বলেন, ব্যাংকিং ক্ষেত্রে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে ‘ব্যাংক কমিশন’ গঠন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবদুল মুহিত। পরের অর্থমন্ত্রী তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। আর এখন ব্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তুঘলকি  কাণ্ড করছে। 

কালোটাকা সাদা করার সুযোগের বিরোধিতা করে মেনন বলেন, ‘লুটের টাকাকে যখন সাদা করার জন্য সৎ উপায়ে অর্জিত অর্থের চেয়ে অর্ধেক কর দিয়ে সাদা করার প্রস্তাব করা হয়, তখন সেটা সততার জন্য তিরস্কার ও অসততার জন্য পুরস্কারের শামিল হয়ে দাঁড়ায়। এ সম্পর্কে যেসব যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তা কেবল অসাড়ই নয়, এ প্রসঙ্গে সরকারের অতীত অবস্থানের বিপরীত। খালেদা জিয়ার জন্য যেটা অনৈতিক, বর্তমানেও সেটা অনৈতিক। আশা করি অর্থমন্ত্রী এই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে সংসদকে এর দায়ভার থেকে রেহাই দেবেন।’ 

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম খুনের ঘটনা প্রসঙ্গে মেনন বলেন, এই দুঃখজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের স্বর্ণ-মাদক চোরাচালানি ও অপরাধ জগতের যে চিত্র বেরিয়ে আসছে, যে খবর প্রকাশিত হচ্ছে—তাতে সংসদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এ বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখা দরকার। আত্মসমালোচনা দরকার। 

রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে ভারত তিস্তার পানি প্রবাহ বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতার কথা বলেছে। কিন্তু তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি কোথায় গেল আমরা জানি না। তিস্তার পানি চুক্তি না করে এই সহযোগিতা গাছের গোড়া কেটে ওপর দিয়ে পানি ঢালার শামিল। ওই সফরে গঙ্গা চুক্তির নবায়নের কথা এসেছে। এর জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু ওই চুক্তিতে গঙ্গার পানি প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য সংকোশ থেকে খাল কেটে গঙ্গার পানি প্রবাহ বৃদ্ধির যে বিষয়টি ছিল তা ৩০ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। বরং এখন ফারাক্কার ওপরে আরেকটি ব্যারেজ তৈরির কথা এসেছে।’ 

মেনন বলেন, প্রধানমন্ত্রী সংসদে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কথা বলেছেন। কিন্তু বাজেটে এর জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। বাজেট বরাদ্দে প্রতিটি ক্ষেত্রেই রংপুর বিভাগ বঞ্চিত হয়েছে। এই আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করে তিস্তাসহ উত্তরবঙ্গের জন্য সম বরাদ্দের ব্যবস্থা নিতে হবে। তিস্তা নিয়ে যেন আমরা ভূরাজনীতির দ্বৈরথের শিকার না হই। প্রয়োজনে পদ্মা সেতুর মতো নিজেদের অর্থায়নে তিস্তা কর্তৃপক্ষ গঠন করে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। 

রাশেদ খান মেনন বলেন, নিষ্ঠুর অলিগার্করা দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই অলিগার্কের স্বার্থ রক্ষার্থে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা যায়নি। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংকিং খাতে লুট ও নৈরাজ্য, খেলাপি ঋণের বিশাল পাহাড় দেশের অর্থনীতিকে ভঙ্গুর অবস্থায় উপনীত করেছে। এর থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার, জন ও রাষ্ট্রীয় জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনাই ছিল বর্তমান সময়ের জরুরি কর্তব্য। কিন্তু সেই লক্ষ্যে বাজেটে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যায় না। আওয়ামী লীগের যে নির্বাচনী ইশতেহারের কথা বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে বাজেট প্রস্তাবনা তার থেকে যোজন যোজন দূরে, সাংঘর্ষিক। 

মেনন বলেন, বাজার সিন্ডিকেট আগের মতো খেলা করছে। মানুষকে তার শিকারে পরিণত করছে। সরকার স্বীকার করছে সিন্ডিকেট রয়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেট ভাঙার কোনো উদ্যোগ দেখি না। 

রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘বিএনপি আমলে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পাঁচ–পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করেছি। আমি সে সময় বিভিন্ন লেখায় দেখিয়েছিলাম দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলেই আমাদের প্রবৃদ্ধি ২.৫ ভাগ বৃদ্ধি পেত। বিএনপি আমলের দুর্নীতির বিশ্ব সূচকে আমাদের সেই কলঙ্ক দূর হলেও ওই সূচকে বাংলাদেশ এখনো শীর্ষ দশের মধ্যে রয়েছে। বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির সম্প্রতি যে চিত্র বেরিয়ে আসছে। তা দেশের ভাবমূর্তি কেবল নয়, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জনমনে অনাস্থা সৃষ্টি করছে।’

সরকারি দলের সংসদ সদস্য শ ম রেজাউল করিম মামলা জট নিরসনের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। এ জন্য তিনি নতুন বিচারক নিয়োগ, উচ্চ ও নিম্ন আদালতে বিচারকদের বেতন–ভাতা বাড়ানো, বিচার বিভাগকে আরও শক্তিশালী করার দাবি জানান। তিনি বলেন, বিচার বিভাগ শক্তিশালী হলে গণতন্ত্রও শক্তিশালী হবে। 

ঝিনাইদহ-৩ আসনের সরকারদলীয় এমপি সালাহ উদ্দিন মিয়াজী বলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকা সীমান্তবর্তী এলাকা। তারকাঁটাবিহীন প্রায় ১৭ কিলোমিটার সীমান্ত দিয়ে সোনা চোরাচালান, নারী-শিশু পাচার ও মাদকদ্রব্যের চোরাচালানের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। জনগণকে সম্পৃক্ত করে প্রশাসন এবং নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনীকে সমন্বয় করে একটি স্পেশাল টাস্কফোর্স গঠন এবং রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানাব।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত