বিজয়নগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি
এই, তুই খুনি! তুই আমার বোনকে খুন করেছিস।
বয়স্ক লোকটি এভাবেই এক যুবককে বকাঝকা করছেন। যুবকটি সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। কিন্তু কিছু বলছেন না। একবার বললেন, ভাইয়া, আমি কেন খুন করতে যাব?
‘ভাইয়া’ ডাক শুনেই খেপে গেলেন লোকটি। আরও জোরে বললেন, তুই আমাকে ভাই ডাকিস ক্যান? আমি তোর কেমন ভাই? লোকটির বকাঝকা থামছে না।
একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন–তুই আমার বোনের বাড়িতে কোন অধিকারে থাকিস? টাকার লোভে, সম্পদের লোভে? তোকে আমি পুলিশে দেব। বলেই লোকটি সেই যুবককে টানতে টানতে পাশে দাঁড়ানো পুলিশের কাছে নিয়ে গেলেন। এক পুলিশ সদস্য দুজনকে থামিয়ে দিয়ে যুবকটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এখানে দাঁড়াও। যুবকটি কিছু না বলে পুলিশের পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন।
ঘটনা কী হচ্ছে, আমরা তার কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি আর কথা শুনছি।
সে সময় জনকণ্ঠে রিপোর্টারদের প্রতিদিনের মিটিং হতো বেলা ১১টা থেকে। সেই মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় এক সহকর্মী খবর দিলেন, মোহাম্মদপুরে ষাটোর্ধ্ব এক বিদুষী নারী খুন হয়েছেন। আমাকে বলা হলো মিটিং বাদ দিয়ে সেখানে যেতে।
ঘটনাস্থল কোথায়, তা জানার জন্য ফোন দিলাম মোহাম্মদপুর থানার ওসি শহীদুল্লাহকে। তিনি আমার পরিচিত। ফোন পেয়ে বললেন, ‘ডেডবডি ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিকেলে আছে।’ বললেন, তিনি নিজেও সেখানে যাচ্ছেন। এ ঘটনার বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশ মেডিকেলের যাত্রা শুরু হয়। হাসপাতালটি সবে নামডাক করেছে। সেই মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখি, সেখান থেকে মরদেহ লাশঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। লাশঘরের পাশে অনেক মানুষের ভিড়। কক্ষের ভেতরে এক নারীর লাশ রাখা। কক্ষের বাইরে এসে দেখা হলো বকাঝকা করা সেই বয়স্ক লোকের সঙ্গে। এটা ১৯৯৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, সোমবার সকালের ঘটনা।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি, মোহাম্মদপুর থানার ওসি আগেই সেখানে পৌঁছে গেছেন। তিনি থাকায় তথ্য জোগাড় একটু সহজ হলো। বকাঝকা করা লোকটির কাছে গিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিতেই তিনি একটু থামতে বললেন। এরপর ওসিকে দূরে ডেকে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কথা বললেন। ফিরে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, তাঁর নাম বজলুর রহমান, পেশায় ডেন্টাল সার্জন। আরেকজন নারীও তাঁর পাশে ছিলেন, তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ও আমার ছোট বোন শামসুন্নাহার। যিনি মারা গেছেন তিনিও আমার বোন। ওর নাম তৌফিকা বেগম। এরপর তিনি তৌফিকা বেগম সম্পর্কে বলতে থাকলেন।
তাঁদের পিতা হাজি মো. ইউসুফ ছিলেন প্রকৌশলী। তাঁরা ধানমন্ডির বাসিন্দা। ৮ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তৌফিকা বেগম ছিলেন তৃতীয়। তৌফিকা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রী। দর্শনশাস্ত্রে এমএ করে বৈরুত বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল করতে যান। পরে অক্সফোর্ড থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করেন। দেশে ফিরে এসে শান্ত নামের এক সেনা কর্মকর্তাকে বিয়ে করেন। বুশরা নামে তাঁদের একটি মেয়ে আছে। সে স্বামীর সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকে। তবে ১৯৬৪ সালে শান্তর সঙ্গে তৌফিকার ছাড়াছাড়ি হয়। এরপর থেকে তিনি একাই ছিলেন।
তৌফিকার পেশা শিক্ষকতা। তিনি কুড়িগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ সরকারি মহিলা কলেজ, রংপুর মহিলা কলেজসহ বেশ কিছু কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি মোহাম্মদপুরের কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ের ৮১ নম্বর বাসার চারতলার ফ্ল্যাটে ওঠেন। এটি তাঁর নিজের ফ্ল্যাট।
এ ঘটনা কী করে জানলেন? প্রশ্ন করতেই বজলুর রহমানের বোন শামসুন্নাহার ইসলাম বললেন, তৌফিকার প্রতিবেশীরা তাঁদের ফোন করেছিলেন। সেই ফোন পেয়ে তাঁরা বাংলাদেশ মেডিকেলে ছুটে আসেন। এসে দেখেন তাঁর বোন মারা গেছেন। তাঁদের সন্দেহ, বোন খুন হয়েছে। বোনের বাসায় ফারুক হোসেন নামে এক যুবক থাকত। সম্পত্তির লোভে সে-ই তাঁর বোনকে খুন করে। তাঁরা ফারুকের বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলেও জানালেন।
এবার বোঝা গেল যে যুবককে বয়স্ক লোকটি বকাঝকা করছিলেন, তাঁরই নাম ফারুক হোসেন। আমরা ফারুকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে শামসুন্নাহার বললেন, তার সব কথা বিশ্বাস করবেন না। সে একজন প্রতারক।
একটু দুরে ফারুক নামের সেই যুবককে দুজন পুলিশ আগলে রেখেছে, যাতে পালাতে না পারে। কিন্তু ফারুককে দেখে মনে হলো তাঁর পালানোর কোনো ইচ্ছেই নেই। ফারুক নির্বিকার, তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তিনি কোনো কথা বলছেন না, আবার প্রতিবাদও করছেন না। যুবকটি দেখতে খুবই স্মার্ট, কিন্তু পোশাক-আশাক সাদামাটা। আমি ফারুকের কাছে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে এক পুলিশ সদস্য আপত্তি করলেন। কিন্তু মোহাম্মদপুর থানার ওসির ইশারা পেয়ে তিনি আর কিছু বললেন না।
ফারুকের কাছে জানতে চাইলাম, আপনি কী করেন? বললেন, আগে মোজাইক মিস্ত্রি ছিলাম। এখন কিছুই করি না। তাহলে এই নারীর বাসায় কী কাজ করতেন? তিনি বললেন, বাসায় যা যা করার থাকে সবই করতাম। কীভাবে পরিচয়? জবাবে ফারুক বললেন, ৫ মাস আগে ফ্ল্যাটের মোজাইকের কাজ করতে এসে পরিচয়। যুবকটি খুব মেপে মেপে কথার উত্তর দেন।
আমাদের এসব প্রশ্নোত্তর সেই পুলিশ সদস্যও শুনছিলেন। তিনি ফারুককে বললেন, ওই মিয়া আসল কথাটা কও না ক্যা? কও। জানতে চাইলাম আসল কথা কী? ফারুক কিছু বলেন না। পুলিশ সদস্যই বললেন, ‘ওই বুড়ি তো এই ছেলেটার বউ’। একটু অবাক হয়ে ফারুকের কাছে জানতে চাইলাম—আপনার বয়স কত? বললেন, ২৯-৩০। আর ওই নারীর? বললেন, ৬২-৬৩। বিয়ে হলো কীভাবে?
এবার মুখ খুললেন ফারুক। বললেন, বাড়িতে দুই মাস ধরে মোজাইকের কাজ করার সময় তৌফিকা বেগমের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। একদিন তৌফিকা বেগম নিজেই তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। ফারুক এই নারীর প্রস্তাব শুনে একটু ভয় পেয়ে যান। কয়েক দিন আসা-যাওয়া বন্ধ করে দেন। পরে তৌফিকা তাঁকে লোক দিয়ে খুঁজে আনেন। ফারুক বললেন, বিয়েতে তিনি রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু একপর্যায়ে তাঁর মনে হলো এমন জীবন হয়তো তিনি কোনো দিন পাবেন না। একপর্যায়ে রাজি হয়ে যান। কবে বিয়ে হলো? ১৯৯৭ সালের ২৭ অক্টোবর, মোহাম্মদপুর কাজী অফিসে।
বিয়ের পর আপনার জীবন কেমন ছিল? জানতে চাইলে ফারুক বললেন, বিয়ের পর থেকে তৌফিকা বেগম বাইরে বের হতেন না। তিনি বেশির ভাগ সময় ঘরেই থাকতেন। আর বিয়ের পর মোজাইকের কাজ ছেড়ে ফারুকও বাসায় থাকতে শুরু করেন। ঢাকায় তাঁর পরিবারের কেউ থাকে না বলে জানালেন।
তৌফিকা বেগমের মৃত্যু হলো কীভাবে? ফারুক বললেন, রোববার বিকেল থেকে তৌফিকা বেগম বুকে ব্যথা অনুভব করছিলেন। রাতে ব্যথাটা আরও বেড়ে যায়। একপর্যায়ে তিনি বুকে ও পিঠে তেল গরম করে দেন। রাত ২টার সময় সে ব্যথা প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। তিনি বাথরুমে গিয়ে গায়ে একটু পানি দিতেই তাঁর নিশ্বাস আটকে যায়। এরপর তিনি বাথরুমের মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন।
তখন আপনি কী করলেন? ফারুক বলেন, তিনি প্রতিবেশীদের খবর দেন। একজন অ্যাম্বুলেন্সের জন্য হাসপাতালে ফোন করেন। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স পাননি। এরপর তিনি রিকশায় করে রাত সাড়ে ৩টার দিকে তাঁকে বাংলাদেশ মেডিকেলে নিয়ে আসেন। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। ফারুক বারবার বলছিলেন, ‘আপনারা বিশ্বাস করেন, আমি খুনি না। তাঁকে খুন করে আমার কী লাভ? তাঁর সম্পদের কোনো কিছুই তো আমার নামে নেই।’
বজলুর রহমান লিখিত অভিযোগ করলেন ফারুকের বিরুদ্ধে। পুলিশ একটি খুনের মামলা নিয়ে ফারুককে গ্রেপ্তার করল। তৌফিকা বেগমের লাশ আনা হলো বজলুর রহমানের ধানমন্ডি ১৯ নম্বর রোডের বাসায়। একজন সাব ইন্সপেক্টর সেই লাশের সুরতহাল করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠিয়ে দিলেন।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এক সাংবাদিক বন্ধুকে নিয়ে গেলাম মোহাম্মদপুরে তৌফিকা যে বাসায় থাকতেন, সেখানে। সেখানে প্রতিবেশীদের বক্তব্য ফারুকের সঙ্গে মিলে গেল। সেখান থেকে খুব অল্প দূরে মোহাম্মদপুরের কাজী অফিস। সেখানে গিয়ে কাজী এমএম আনসার আলীকে পেয়ে গেলাম। তিনি সব শুনে চিনতে পারলেন। বললেন, ৪ মাস আগে এই বিয়ে হয়েছিল। দুজনের বয়সের অসমতা দেখে তিনি প্রথমে রাজি হননি। পরে তৌফিকা বেগমের ইচ্ছায় তিনি রেজিস্ট্রি করান। কাবিননামায় ফারুকের ঠিকানা রয়েছে—গ্রাম দনিয়া, থানা ও জেলা ভোলা। সাক্ষী আছেন ফারুকের ভাই সাইফুল ও ভগ্নিপতি জয়নাল আবেদিন।
পরের দিন ফলোআপ করতে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে শুনলাম পাঁচ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড লাশের ময়নাতদন্ত করেছে। তারা মৃতের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন দেখেননি। চিকিৎসকেরা মনে করছেন, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু।
দুদিন পরে গেলাম মোহাম্মদপুর থানায়। খুনের মামলায় ফারুককে দুদিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। হাজতের দরজায় উঁকি দিয়ে দেখি ফারুক মেঝেতে বসে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, স্যার একটু বলেন, আমি খুন করিনি। পুলিশ আমার কথা শুনছে না। শুধু মারধর করছে। এরপর হাজতের গ্রিল ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন, পারলেন না। তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
ফারুকের এই অবস্থা দেখে আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। অফিসে আসব বলে থানা থেকে বের হয়ে এলাম। মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিতেই আমার চিফ রিপোর্টারের কথা মনে পড়ে গেল–ক্রাইম রিপোর্টারের মন খারাপ করতে নেই।
আরও পড়ুন:
এই, তুই খুনি! তুই আমার বোনকে খুন করেছিস।
বয়স্ক লোকটি এভাবেই এক যুবককে বকাঝকা করছেন। যুবকটি সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। কিন্তু কিছু বলছেন না। একবার বললেন, ভাইয়া, আমি কেন খুন করতে যাব?
‘ভাইয়া’ ডাক শুনেই খেপে গেলেন লোকটি। আরও জোরে বললেন, তুই আমাকে ভাই ডাকিস ক্যান? আমি তোর কেমন ভাই? লোকটির বকাঝকা থামছে না।
একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন–তুই আমার বোনের বাড়িতে কোন অধিকারে থাকিস? টাকার লোভে, সম্পদের লোভে? তোকে আমি পুলিশে দেব। বলেই লোকটি সেই যুবককে টানতে টানতে পাশে দাঁড়ানো পুলিশের কাছে নিয়ে গেলেন। এক পুলিশ সদস্য দুজনকে থামিয়ে দিয়ে যুবকটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এখানে দাঁড়াও। যুবকটি কিছু না বলে পুলিশের পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন।
ঘটনা কী হচ্ছে, আমরা তার কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি আর কথা শুনছি।
সে সময় জনকণ্ঠে রিপোর্টারদের প্রতিদিনের মিটিং হতো বেলা ১১টা থেকে। সেই মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় এক সহকর্মী খবর দিলেন, মোহাম্মদপুরে ষাটোর্ধ্ব এক বিদুষী নারী খুন হয়েছেন। আমাকে বলা হলো মিটিং বাদ দিয়ে সেখানে যেতে।
ঘটনাস্থল কোথায়, তা জানার জন্য ফোন দিলাম মোহাম্মদপুর থানার ওসি শহীদুল্লাহকে। তিনি আমার পরিচিত। ফোন পেয়ে বললেন, ‘ডেডবডি ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিকেলে আছে।’ বললেন, তিনি নিজেও সেখানে যাচ্ছেন। এ ঘটনার বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশ মেডিকেলের যাত্রা শুরু হয়। হাসপাতালটি সবে নামডাক করেছে। সেই মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখি, সেখান থেকে মরদেহ লাশঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। লাশঘরের পাশে অনেক মানুষের ভিড়। কক্ষের ভেতরে এক নারীর লাশ রাখা। কক্ষের বাইরে এসে দেখা হলো বকাঝকা করা সেই বয়স্ক লোকের সঙ্গে। এটা ১৯৯৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, সোমবার সকালের ঘটনা।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি, মোহাম্মদপুর থানার ওসি আগেই সেখানে পৌঁছে গেছেন। তিনি থাকায় তথ্য জোগাড় একটু সহজ হলো। বকাঝকা করা লোকটির কাছে গিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিতেই তিনি একটু থামতে বললেন। এরপর ওসিকে দূরে ডেকে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কথা বললেন। ফিরে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, তাঁর নাম বজলুর রহমান, পেশায় ডেন্টাল সার্জন। আরেকজন নারীও তাঁর পাশে ছিলেন, তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ও আমার ছোট বোন শামসুন্নাহার। যিনি মারা গেছেন তিনিও আমার বোন। ওর নাম তৌফিকা বেগম। এরপর তিনি তৌফিকা বেগম সম্পর্কে বলতে থাকলেন।
তাঁদের পিতা হাজি মো. ইউসুফ ছিলেন প্রকৌশলী। তাঁরা ধানমন্ডির বাসিন্দা। ৮ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তৌফিকা বেগম ছিলেন তৃতীয়। তৌফিকা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রী। দর্শনশাস্ত্রে এমএ করে বৈরুত বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল করতে যান। পরে অক্সফোর্ড থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করেন। দেশে ফিরে এসে শান্ত নামের এক সেনা কর্মকর্তাকে বিয়ে করেন। বুশরা নামে তাঁদের একটি মেয়ে আছে। সে স্বামীর সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকে। তবে ১৯৬৪ সালে শান্তর সঙ্গে তৌফিকার ছাড়াছাড়ি হয়। এরপর থেকে তিনি একাই ছিলেন।
তৌফিকার পেশা শিক্ষকতা। তিনি কুড়িগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ সরকারি মহিলা কলেজ, রংপুর মহিলা কলেজসহ বেশ কিছু কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি মোহাম্মদপুরের কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ের ৮১ নম্বর বাসার চারতলার ফ্ল্যাটে ওঠেন। এটি তাঁর নিজের ফ্ল্যাট।
এ ঘটনা কী করে জানলেন? প্রশ্ন করতেই বজলুর রহমানের বোন শামসুন্নাহার ইসলাম বললেন, তৌফিকার প্রতিবেশীরা তাঁদের ফোন করেছিলেন। সেই ফোন পেয়ে তাঁরা বাংলাদেশ মেডিকেলে ছুটে আসেন। এসে দেখেন তাঁর বোন মারা গেছেন। তাঁদের সন্দেহ, বোন খুন হয়েছে। বোনের বাসায় ফারুক হোসেন নামে এক যুবক থাকত। সম্পত্তির লোভে সে-ই তাঁর বোনকে খুন করে। তাঁরা ফারুকের বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলেও জানালেন।
এবার বোঝা গেল যে যুবককে বয়স্ক লোকটি বকাঝকা করছিলেন, তাঁরই নাম ফারুক হোসেন। আমরা ফারুকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে শামসুন্নাহার বললেন, তার সব কথা বিশ্বাস করবেন না। সে একজন প্রতারক।
একটু দুরে ফারুক নামের সেই যুবককে দুজন পুলিশ আগলে রেখেছে, যাতে পালাতে না পারে। কিন্তু ফারুককে দেখে মনে হলো তাঁর পালানোর কোনো ইচ্ছেই নেই। ফারুক নির্বিকার, তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তিনি কোনো কথা বলছেন না, আবার প্রতিবাদও করছেন না। যুবকটি দেখতে খুবই স্মার্ট, কিন্তু পোশাক-আশাক সাদামাটা। আমি ফারুকের কাছে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে এক পুলিশ সদস্য আপত্তি করলেন। কিন্তু মোহাম্মদপুর থানার ওসির ইশারা পেয়ে তিনি আর কিছু বললেন না।
ফারুকের কাছে জানতে চাইলাম, আপনি কী করেন? বললেন, আগে মোজাইক মিস্ত্রি ছিলাম। এখন কিছুই করি না। তাহলে এই নারীর বাসায় কী কাজ করতেন? তিনি বললেন, বাসায় যা যা করার থাকে সবই করতাম। কীভাবে পরিচয়? জবাবে ফারুক বললেন, ৫ মাস আগে ফ্ল্যাটের মোজাইকের কাজ করতে এসে পরিচয়। যুবকটি খুব মেপে মেপে কথার উত্তর দেন।
আমাদের এসব প্রশ্নোত্তর সেই পুলিশ সদস্যও শুনছিলেন। তিনি ফারুককে বললেন, ওই মিয়া আসল কথাটা কও না ক্যা? কও। জানতে চাইলাম আসল কথা কী? ফারুক কিছু বলেন না। পুলিশ সদস্যই বললেন, ‘ওই বুড়ি তো এই ছেলেটার বউ’। একটু অবাক হয়ে ফারুকের কাছে জানতে চাইলাম—আপনার বয়স কত? বললেন, ২৯-৩০। আর ওই নারীর? বললেন, ৬২-৬৩। বিয়ে হলো কীভাবে?
এবার মুখ খুললেন ফারুক। বললেন, বাড়িতে দুই মাস ধরে মোজাইকের কাজ করার সময় তৌফিকা বেগমের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। একদিন তৌফিকা বেগম নিজেই তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। ফারুক এই নারীর প্রস্তাব শুনে একটু ভয় পেয়ে যান। কয়েক দিন আসা-যাওয়া বন্ধ করে দেন। পরে তৌফিকা তাঁকে লোক দিয়ে খুঁজে আনেন। ফারুক বললেন, বিয়েতে তিনি রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু একপর্যায়ে তাঁর মনে হলো এমন জীবন হয়তো তিনি কোনো দিন পাবেন না। একপর্যায়ে রাজি হয়ে যান। কবে বিয়ে হলো? ১৯৯৭ সালের ২৭ অক্টোবর, মোহাম্মদপুর কাজী অফিসে।
বিয়ের পর আপনার জীবন কেমন ছিল? জানতে চাইলে ফারুক বললেন, বিয়ের পর থেকে তৌফিকা বেগম বাইরে বের হতেন না। তিনি বেশির ভাগ সময় ঘরেই থাকতেন। আর বিয়ের পর মোজাইকের কাজ ছেড়ে ফারুকও বাসায় থাকতে শুরু করেন। ঢাকায় তাঁর পরিবারের কেউ থাকে না বলে জানালেন।
তৌফিকা বেগমের মৃত্যু হলো কীভাবে? ফারুক বললেন, রোববার বিকেল থেকে তৌফিকা বেগম বুকে ব্যথা অনুভব করছিলেন। রাতে ব্যথাটা আরও বেড়ে যায়। একপর্যায়ে তিনি বুকে ও পিঠে তেল গরম করে দেন। রাত ২টার সময় সে ব্যথা প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। তিনি বাথরুমে গিয়ে গায়ে একটু পানি দিতেই তাঁর নিশ্বাস আটকে যায়। এরপর তিনি বাথরুমের মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন।
তখন আপনি কী করলেন? ফারুক বলেন, তিনি প্রতিবেশীদের খবর দেন। একজন অ্যাম্বুলেন্সের জন্য হাসপাতালে ফোন করেন। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স পাননি। এরপর তিনি রিকশায় করে রাত সাড়ে ৩টার দিকে তাঁকে বাংলাদেশ মেডিকেলে নিয়ে আসেন। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। ফারুক বারবার বলছিলেন, ‘আপনারা বিশ্বাস করেন, আমি খুনি না। তাঁকে খুন করে আমার কী লাভ? তাঁর সম্পদের কোনো কিছুই তো আমার নামে নেই।’
বজলুর রহমান লিখিত অভিযোগ করলেন ফারুকের বিরুদ্ধে। পুলিশ একটি খুনের মামলা নিয়ে ফারুককে গ্রেপ্তার করল। তৌফিকা বেগমের লাশ আনা হলো বজলুর রহমানের ধানমন্ডি ১৯ নম্বর রোডের বাসায়। একজন সাব ইন্সপেক্টর সেই লাশের সুরতহাল করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠিয়ে দিলেন।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এক সাংবাদিক বন্ধুকে নিয়ে গেলাম মোহাম্মদপুরে তৌফিকা যে বাসায় থাকতেন, সেখানে। সেখানে প্রতিবেশীদের বক্তব্য ফারুকের সঙ্গে মিলে গেল। সেখান থেকে খুব অল্প দূরে মোহাম্মদপুরের কাজী অফিস। সেখানে গিয়ে কাজী এমএম আনসার আলীকে পেয়ে গেলাম। তিনি সব শুনে চিনতে পারলেন। বললেন, ৪ মাস আগে এই বিয়ে হয়েছিল। দুজনের বয়সের অসমতা দেখে তিনি প্রথমে রাজি হননি। পরে তৌফিকা বেগমের ইচ্ছায় তিনি রেজিস্ট্রি করান। কাবিননামায় ফারুকের ঠিকানা রয়েছে—গ্রাম দনিয়া, থানা ও জেলা ভোলা। সাক্ষী আছেন ফারুকের ভাই সাইফুল ও ভগ্নিপতি জয়নাল আবেদিন।
পরের দিন ফলোআপ করতে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে শুনলাম পাঁচ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড লাশের ময়নাতদন্ত করেছে। তারা মৃতের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন দেখেননি। চিকিৎসকেরা মনে করছেন, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু।
দুদিন পরে গেলাম মোহাম্মদপুর থানায়। খুনের মামলায় ফারুককে দুদিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। হাজতের দরজায় উঁকি দিয়ে দেখি ফারুক মেঝেতে বসে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, স্যার একটু বলেন, আমি খুন করিনি। পুলিশ আমার কথা শুনছে না। শুধু মারধর করছে। এরপর হাজতের গ্রিল ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন, পারলেন না। তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
ফারুকের এই অবস্থা দেখে আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। অফিসে আসব বলে থানা থেকে বের হয়ে এলাম। মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিতেই আমার চিফ রিপোর্টারের কথা মনে পড়ে গেল–ক্রাইম রিপোর্টারের মন খারাপ করতে নেই।
আরও পড়ুন:
দেশে বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা সাড়ে ১৫ লাখের মতো। তাদের সবাইকে আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দিতে হবে। তবে এরপর প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তা জমা দিতে হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে গত ১ সেপ্টেম্বর এমনটাই জানানো হয়েছে।
৩ ঘণ্টা আগেফরিদপুরের মল্লিকপুরে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে খাগড়াছড়ি পরিবহন ও গ্রিন এক্সপ্রেস বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষের দুর্ঘটনাস্থলকে ‘ব্ল্যাক স্পট’ বা বারংবার দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছে জাতীয় তদন্ত কমিটি। মৃতুফাঁদে পরিণত ওই সড়কটির কাঠামোগত ত্রুটি সারানোসহ একগুচ্ছ সুপারিশ করে জরুরি ভিত্তিতে তা বাস্তবায়নের
৪ ঘণ্টা আগেদেশের সব টিভি চ্যানেল ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দিনে কমপক্ষে দুবার প্রচার করতে হবে ‘জুলাই অনির্বাণ’ ভিডিওচিত্র। আজ শুক্রবার (২২ নভেম্বর) এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ কথা জানায় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের আত্মত্যাগ জনগণকে অবহিত করার লক্ষ্যে তথ্য..
৫ ঘণ্টা আগেনতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন ও অপর চার নির্বাচন কমিশনারের শপথ আগামী রোববার অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ রোববার বেলা দেড়টায় সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে তাঁদের শপথ পাঠ করাবেন। সুপ্রিম কোর্টের জনসংযোগ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে এ কথা জানান।
৬ ঘণ্টা আগে