কামরুল হাসান, ঢাকা
উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরের ১০ নম্বর সড়কের ঠিক মাঝামাঝি একটি জায়গায় গাড়িটি পার্ক করা। কালো কাচে ঘেরা বলে ভেতরের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আশপাশের বাড়ির দারোয়ান ও নিরাপত্তাকর্মীরা ভাবছিলেন, কোনো অতিথি গাড়িটি রাস্তায় রেখে বাসার ভেতরে গেছেন। সময় গড়িয়ে যায়, গাড়ি আর নড়ে না। সন্দেহ বাড়ে। দুপুরের পর উৎসুক এক দারোয়ান বার কয়েক উঁকি দিয়ে দেখেন, সিটের সঙ্গে বেল্টে বাঁধা রক্তাক্ত একটি মৃতদেহ। ব্যস, হুলুস্থুল পড়ে যায়। যথারীতি পুলিশ আসে। দেখা গেল, সেই মৃতদেহ এক শিল্পপতির। তাঁকে খুন করা হয়েছে।
গাড়ির ভেতরে কিছু কাগজপত্র পাওয়া গেল। সেসব ঘেঁটে এএসআই আবদুর রহিম বললেন, নিহত ব্যক্তির নাম গোলাম কিবরিয়া। তিনি কল্লোল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক। কল্লোল গ্রুপের তখন অনেক নামডাক। টেক্সটাইল, ইলেকট্রনিক, নারকেল তেলসহ নানা পণ্য বাজারে। সেই সব পণ্যের বিজ্ঞাপন হরহামেশা দেখা যায় টিভিতে। ও রকম শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকের খুন হওয়া নিয়ে নড়েচড়ে বসল পুলিশ। যে খুনের গল্পটা বলছি, সেটি ২১ বছর আগের, ২০০১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির। যত দূর মনে পড়ে, সেদিন ছিল শুক্রবার।
এমনিতেই কোনো শিল্পপতি খুন হলে প্রথমে সন্দেহ করা হয় কোনো ব্যবসায়িক বিরোধকে। আবার দেখা যায়, পুলিশ কর্মকর্তারা অকুস্থলে গিয়েই বড় বড় মন্তব্য করে বসেন। সেদিনও তা-ই হয়েছিল। আমি ঘটনাস্থলে পৌঁছালাম বিকেলে। একটু পরে এলেন ডিএমপি কমিশনার মতিউর রহমান। তিনি গাড়ি থেকে নেমে সাংবাদিকদের বললেন, ‘অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে’ এই শিল্পপতিকে খুন করা হয়েছে। এই খুন ঠান্ডা মাথায় না গরম মাথায় হয়েছে, সেটা বলার জন্য কোনো বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার ছিল না। তবু তিনি বললেন। পরদিন সব কাগজে ছাপাও হলো সেটাই।
আমি ওই শিল্পপতির একটি ঠিকুজি বের করে ফেললাম। দেখি, তাঁদের পরিবারের আদিবাস নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার কেশবপাড়ায়। পিতার নাম আবদুল মোতালেব। তাঁর স্ত্রী শিমুল নারায়ণগঞ্জের পালপাড়ার মেয়ে। সাদনান নামে তাঁদের একটি সন্তান রয়েছে। তাঁরা নারায়ণগঞ্জে থাকেন। খুনের ঘটনা শুনে কিবরিয়ার স্ত্রী শিমুল উত্তরায় আসতে চেয়েছিলেন। অর্ধেক পথ আসার পর জানতে পারেন, মৃতদেহ থানায় নেওয়া হয়েছে। এরপর গাড়ি ঘুরিয়ে বনানীতে চলে যান কিবরিয়ার বড় ভাই গোলাম মোস্তফার বাসায়। শিমুলের সঙ্গে আমার দেখা হয় সেই বাড়িতেই।
শিমুল আমাকে বললেন, ঘটনার আগের দিন নারায়ণগঞ্জের বাসা থেকে কিবরিয়া নিজে গাড়ি চালিয়ে তেজগাঁওয়ে কারখানায় আসেন। রাত ১০টার দিকে স্ত্রী ফোন করলে তিনি বলেন, ফিরতে আরও এক ঘণ্টা দেরি হবে। রাত ১১টায় আবার ফোন করে দেখেন সেটি বন্ধ। শিমুল আমাকে বললেন, কিবরিয়া অনেক রাতে বাড়ি ফিরতেন, মাঝে মাঝে ফিরতেনও না। সে কারণে তিনি এত চিন্তা করেননি। শুক্রবার দুপুরের পর পুলিশ ফোন করে তাঁকে খুনের খবর দেয়। তিনি আরও বললেন, কিবরিয়া প্রায়ই গভীর রাতে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরতেন।
ঘটনাস্থল ছিল ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায়। কিবরিয়ার ভাই বাদী হয়ে খুনের মামলা করলেন আসামির নাম না দিয়ে। সে সময় ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি ছিলেন আনোয়ার হোসেন। দুই দিনের মধ্যে তিনি খুনের কারণ খুঁজে বের করলেন। ক্লু কীভাবে পেলেন জানতে চাইলে ওসি বললেন, কিবরিয়ার গাড়িচালক ছিলেন তাঁদের প্রথম সূত্র। তাঁর মাধ্যমে শাহিদা নামের এক নারীকে আটক করে জানতে পারেন, উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের ২৬ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে কিবরিয়ার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। সেখানেই খুন হয়ে থাকতে পারেন তিনি। এরপর সেই বাড়ির সবাইকে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তাঁরা খুনের কথা স্বীকার করেন।
ওসি আনোয়ারের সঙ্গে একদিন আমিও গেলাম সেই বাড়িতে। চারতলা বাড়ির তৃতীয় তলায় বিশাল ড্রয়িংরুমটি ছিল জলসাঘরের মতো। মেঝেতে দামি কার্পেটের ওপরে শতরঞ্জি পেতে মেহমানদের বসার ব্যবস্থা, পাশে ছোট ছোট তাকিয়া, মাঝখানে নগ্ন-চুম্বনরত যুবক-যুবতীর মূর্তি। দেয়ালে ঝোলানো দামি পেইন্টিং—সবকিছুতেই নগ্ন নারীর প্রতিকৃতি। আমার কাছে সবকিছু খুব অদ্ভুত লাগছিল। আসবাবগুলো মনে হলো অনেক দামি। তিন কক্ষের আলিশান ফ্ল্যাটটিতে বাস করতেন সাবিকুন নাহার বুলি, তাঁর স্বামী ইমরান হোসেন, মেয়ে পুনম, ছেলে পুলক ও পুনমের স্বামী নাজমুল।
ওই বাড়িতে বসে ওসি আনোয়ার হোসেন আমাকে বললেন, ‘ভালো করে দেখলে এদের জীবনযাপনটা বুঝতে পারবেন।’ তিনি জানালেন, সাবিকুন নাহার বুলির স্বামী ইমরান ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিলেও তাঁর কোনো ব্যবসা নেই। স্ত্রীর রোজগারে সংসার চলে। বুলির পুত্র পুলক এসএসসি পরীক্ষার্থী, পুনম এইচএসসি পাসের পর বিয়ে করেছেন। বুলির সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে এই বাসায় কিবরিয়ার যাতায়াত। পরিবারটির সবকিছু কিবরিয়া নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাদের বাহারি জীবনের সব খরচও তিনিই বহন করতেন। বিনিময়ে তাদের বাড়িতে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ফুর্তি করতেন কিবরিয়া। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর সবাই একসঙ্গে বসে মদ পান করতেন। ওসির ভাষায়, এটি ছিল শিল্পপতির ‘হেরেমখানা’। এই আসরে শামিল হতেন বড় বড় শিল্পপতি আর তাঁদের নারী বন্ধুরা। তাঁরা রাতভর ফুর্তি আর হইচই করতেন। প্রথম দিকে বুলির পরিবারও মেতে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে শুরু হয় বিরক্তি। একপর্যায়ে তারা অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। কিন্তু কিবরিয়াকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। ওসি বললেন, পুলিশ ২৫ জন নারীর খোঁজ পেয়েছে, যাঁদের ওই আসরে যাতায়াত ছিল।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বুলি ও তাঁর পরিবারের লোকেরা বলেছিলেন, মাতাল হয়ে প্রায়ই বাড়াবাড়ি করতেন কিবরিয়া। সেটা সহ্য করার মতো ছিল না। তাঁর সেই আচরণের কারণেই খুন করা হয়। এরপর ভোরে লাশ গাড়িতে তুলে রাস্তায় রেখে আসেন, যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে। ওই বাসার দারোয়ান রফিক ও ড্রাইভার জুয়েলও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন। মনে আছে, ক্যান্টনমেন্ট থানা হেফাজতে বুলি আমাকে বলেছিলেন, ‘ঢাকা শহরের অনেক বাড়িতেই বৃহস্পতিবার এ রকম পার্টি হয়; এটা দোষের কী?’
যাই হোক, সেই মামলায় পুলিশ চার্জশিট দিয়েছিল বুলিসহ তাঁর পরিবারের ছয়জনকে আসামি করে। অনেক দিন সেই মামলার খবর নেওয়া হয়নি। গতকাল সেই খবর নিতে আজকের পত্রিকার সাংবাদিক আল-আমিন রাজু গিয়েছিলেন ক্যান্টনমেন্ট থানায়। প্রথমে ডিউটি অফিসার এসআই আনোয়ার হোসেন তাঁর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। তবে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সদয় হন, তিনি সব তথ্য দেন। জানান, ওই মামলায় ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছিলেন এসআই হাফিজুল ইসলাম। কিন্তু কোনো অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। এতে সব আসামি খালাস পেয়ে যান।
আজকের পত্রিকার নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি সাবিত আল হাসান কাল নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কে সাধু পৌলের গির্জার পেছনে বুলির পরিবারের খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন। বুলির বোন কামরুন্নাহার ইভা তাঁকে জানান, ওই মামলা থেকে তাঁর বোনের পরিবারের সবাই অব্যাহতি পেয়েছেন। তবে সেই পরিবারের সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগাযোগ নেই। তাঁরা কোথায় থাকেন তা-ও জানেন না।
নিহত কিবরিয়ার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। খুঁজে পেলাম না।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন কয়েক বছর আগে চার দিনের সফরে ঢাকায় এসেছিলেন। তখন আমি তাঁর প্রটোকলের দায়িত্বে ছিলাম। একদিন আমি তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, অর্থ কেন অনর্থের মূল হলো? তিনি বললেন, সমাজে কিছু মানুষ থাকে, যাদের হাতে টাকাপয়সা এলে তারা শুধু নিজেই সেটা ভোগ করে, জৌলুশ বাড়ায়, যা খুশি করে বেড়ায়। এতে সমাজের অনিষ্ট হয়, মানুষের মনে হিংসা ছড়ায়। তখনই অর্থ অনর্থের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আমার মনে হলো, ব্যবসায়ী গোলাম কিবরিয়াও সেই অনিষ্টকারী মানুষ। যাঁরা সমাজের কোনো কাজে আসেন না।
আরও পড়ুন:
উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরের ১০ নম্বর সড়কের ঠিক মাঝামাঝি একটি জায়গায় গাড়িটি পার্ক করা। কালো কাচে ঘেরা বলে ভেতরের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আশপাশের বাড়ির দারোয়ান ও নিরাপত্তাকর্মীরা ভাবছিলেন, কোনো অতিথি গাড়িটি রাস্তায় রেখে বাসার ভেতরে গেছেন। সময় গড়িয়ে যায়, গাড়ি আর নড়ে না। সন্দেহ বাড়ে। দুপুরের পর উৎসুক এক দারোয়ান বার কয়েক উঁকি দিয়ে দেখেন, সিটের সঙ্গে বেল্টে বাঁধা রক্তাক্ত একটি মৃতদেহ। ব্যস, হুলুস্থুল পড়ে যায়। যথারীতি পুলিশ আসে। দেখা গেল, সেই মৃতদেহ এক শিল্পপতির। তাঁকে খুন করা হয়েছে।
গাড়ির ভেতরে কিছু কাগজপত্র পাওয়া গেল। সেসব ঘেঁটে এএসআই আবদুর রহিম বললেন, নিহত ব্যক্তির নাম গোলাম কিবরিয়া। তিনি কল্লোল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক। কল্লোল গ্রুপের তখন অনেক নামডাক। টেক্সটাইল, ইলেকট্রনিক, নারকেল তেলসহ নানা পণ্য বাজারে। সেই সব পণ্যের বিজ্ঞাপন হরহামেশা দেখা যায় টিভিতে। ও রকম শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকের খুন হওয়া নিয়ে নড়েচড়ে বসল পুলিশ। যে খুনের গল্পটা বলছি, সেটি ২১ বছর আগের, ২০০১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির। যত দূর মনে পড়ে, সেদিন ছিল শুক্রবার।
এমনিতেই কোনো শিল্পপতি খুন হলে প্রথমে সন্দেহ করা হয় কোনো ব্যবসায়িক বিরোধকে। আবার দেখা যায়, পুলিশ কর্মকর্তারা অকুস্থলে গিয়েই বড় বড় মন্তব্য করে বসেন। সেদিনও তা-ই হয়েছিল। আমি ঘটনাস্থলে পৌঁছালাম বিকেলে। একটু পরে এলেন ডিএমপি কমিশনার মতিউর রহমান। তিনি গাড়ি থেকে নেমে সাংবাদিকদের বললেন, ‘অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে’ এই শিল্পপতিকে খুন করা হয়েছে। এই খুন ঠান্ডা মাথায় না গরম মাথায় হয়েছে, সেটা বলার জন্য কোনো বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার ছিল না। তবু তিনি বললেন। পরদিন সব কাগজে ছাপাও হলো সেটাই।
আমি ওই শিল্পপতির একটি ঠিকুজি বের করে ফেললাম। দেখি, তাঁদের পরিবারের আদিবাস নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার কেশবপাড়ায়। পিতার নাম আবদুল মোতালেব। তাঁর স্ত্রী শিমুল নারায়ণগঞ্জের পালপাড়ার মেয়ে। সাদনান নামে তাঁদের একটি সন্তান রয়েছে। তাঁরা নারায়ণগঞ্জে থাকেন। খুনের ঘটনা শুনে কিবরিয়ার স্ত্রী শিমুল উত্তরায় আসতে চেয়েছিলেন। অর্ধেক পথ আসার পর জানতে পারেন, মৃতদেহ থানায় নেওয়া হয়েছে। এরপর গাড়ি ঘুরিয়ে বনানীতে চলে যান কিবরিয়ার বড় ভাই গোলাম মোস্তফার বাসায়। শিমুলের সঙ্গে আমার দেখা হয় সেই বাড়িতেই।
শিমুল আমাকে বললেন, ঘটনার আগের দিন নারায়ণগঞ্জের বাসা থেকে কিবরিয়া নিজে গাড়ি চালিয়ে তেজগাঁওয়ে কারখানায় আসেন। রাত ১০টার দিকে স্ত্রী ফোন করলে তিনি বলেন, ফিরতে আরও এক ঘণ্টা দেরি হবে। রাত ১১টায় আবার ফোন করে দেখেন সেটি বন্ধ। শিমুল আমাকে বললেন, কিবরিয়া অনেক রাতে বাড়ি ফিরতেন, মাঝে মাঝে ফিরতেনও না। সে কারণে তিনি এত চিন্তা করেননি। শুক্রবার দুপুরের পর পুলিশ ফোন করে তাঁকে খুনের খবর দেয়। তিনি আরও বললেন, কিবরিয়া প্রায়ই গভীর রাতে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরতেন।
ঘটনাস্থল ছিল ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায়। কিবরিয়ার ভাই বাদী হয়ে খুনের মামলা করলেন আসামির নাম না দিয়ে। সে সময় ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি ছিলেন আনোয়ার হোসেন। দুই দিনের মধ্যে তিনি খুনের কারণ খুঁজে বের করলেন। ক্লু কীভাবে পেলেন জানতে চাইলে ওসি বললেন, কিবরিয়ার গাড়িচালক ছিলেন তাঁদের প্রথম সূত্র। তাঁর মাধ্যমে শাহিদা নামের এক নারীকে আটক করে জানতে পারেন, উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের ২৬ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে কিবরিয়ার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। সেখানেই খুন হয়ে থাকতে পারেন তিনি। এরপর সেই বাড়ির সবাইকে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তাঁরা খুনের কথা স্বীকার করেন।
ওসি আনোয়ারের সঙ্গে একদিন আমিও গেলাম সেই বাড়িতে। চারতলা বাড়ির তৃতীয় তলায় বিশাল ড্রয়িংরুমটি ছিল জলসাঘরের মতো। মেঝেতে দামি কার্পেটের ওপরে শতরঞ্জি পেতে মেহমানদের বসার ব্যবস্থা, পাশে ছোট ছোট তাকিয়া, মাঝখানে নগ্ন-চুম্বনরত যুবক-যুবতীর মূর্তি। দেয়ালে ঝোলানো দামি পেইন্টিং—সবকিছুতেই নগ্ন নারীর প্রতিকৃতি। আমার কাছে সবকিছু খুব অদ্ভুত লাগছিল। আসবাবগুলো মনে হলো অনেক দামি। তিন কক্ষের আলিশান ফ্ল্যাটটিতে বাস করতেন সাবিকুন নাহার বুলি, তাঁর স্বামী ইমরান হোসেন, মেয়ে পুনম, ছেলে পুলক ও পুনমের স্বামী নাজমুল।
ওই বাড়িতে বসে ওসি আনোয়ার হোসেন আমাকে বললেন, ‘ভালো করে দেখলে এদের জীবনযাপনটা বুঝতে পারবেন।’ তিনি জানালেন, সাবিকুন নাহার বুলির স্বামী ইমরান ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিলেও তাঁর কোনো ব্যবসা নেই। স্ত্রীর রোজগারে সংসার চলে। বুলির পুত্র পুলক এসএসসি পরীক্ষার্থী, পুনম এইচএসসি পাসের পর বিয়ে করেছেন। বুলির সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে এই বাসায় কিবরিয়ার যাতায়াত। পরিবারটির সবকিছু কিবরিয়া নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাদের বাহারি জীবনের সব খরচও তিনিই বহন করতেন। বিনিময়ে তাদের বাড়িতে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ফুর্তি করতেন কিবরিয়া। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর সবাই একসঙ্গে বসে মদ পান করতেন। ওসির ভাষায়, এটি ছিল শিল্পপতির ‘হেরেমখানা’। এই আসরে শামিল হতেন বড় বড় শিল্পপতি আর তাঁদের নারী বন্ধুরা। তাঁরা রাতভর ফুর্তি আর হইচই করতেন। প্রথম দিকে বুলির পরিবারও মেতে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে শুরু হয় বিরক্তি। একপর্যায়ে তারা অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। কিন্তু কিবরিয়াকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। ওসি বললেন, পুলিশ ২৫ জন নারীর খোঁজ পেয়েছে, যাঁদের ওই আসরে যাতায়াত ছিল।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বুলি ও তাঁর পরিবারের লোকেরা বলেছিলেন, মাতাল হয়ে প্রায়ই বাড়াবাড়ি করতেন কিবরিয়া। সেটা সহ্য করার মতো ছিল না। তাঁর সেই আচরণের কারণেই খুন করা হয়। এরপর ভোরে লাশ গাড়িতে তুলে রাস্তায় রেখে আসেন, যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে। ওই বাসার দারোয়ান রফিক ও ড্রাইভার জুয়েলও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন। মনে আছে, ক্যান্টনমেন্ট থানা হেফাজতে বুলি আমাকে বলেছিলেন, ‘ঢাকা শহরের অনেক বাড়িতেই বৃহস্পতিবার এ রকম পার্টি হয়; এটা দোষের কী?’
যাই হোক, সেই মামলায় পুলিশ চার্জশিট দিয়েছিল বুলিসহ তাঁর পরিবারের ছয়জনকে আসামি করে। অনেক দিন সেই মামলার খবর নেওয়া হয়নি। গতকাল সেই খবর নিতে আজকের পত্রিকার সাংবাদিক আল-আমিন রাজু গিয়েছিলেন ক্যান্টনমেন্ট থানায়। প্রথমে ডিউটি অফিসার এসআই আনোয়ার হোসেন তাঁর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। তবে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সদয় হন, তিনি সব তথ্য দেন। জানান, ওই মামলায় ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছিলেন এসআই হাফিজুল ইসলাম। কিন্তু কোনো অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। এতে সব আসামি খালাস পেয়ে যান।
আজকের পত্রিকার নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি সাবিত আল হাসান কাল নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কে সাধু পৌলের গির্জার পেছনে বুলির পরিবারের খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন। বুলির বোন কামরুন্নাহার ইভা তাঁকে জানান, ওই মামলা থেকে তাঁর বোনের পরিবারের সবাই অব্যাহতি পেয়েছেন। তবে সেই পরিবারের সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগাযোগ নেই। তাঁরা কোথায় থাকেন তা-ও জানেন না।
নিহত কিবরিয়ার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। খুঁজে পেলাম না।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন কয়েক বছর আগে চার দিনের সফরে ঢাকায় এসেছিলেন। তখন আমি তাঁর প্রটোকলের দায়িত্বে ছিলাম। একদিন আমি তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, অর্থ কেন অনর্থের মূল হলো? তিনি বললেন, সমাজে কিছু মানুষ থাকে, যাদের হাতে টাকাপয়সা এলে তারা শুধু নিজেই সেটা ভোগ করে, জৌলুশ বাড়ায়, যা খুশি করে বেড়ায়। এতে সমাজের অনিষ্ট হয়, মানুষের মনে হিংসা ছড়ায়। তখনই অর্থ অনর্থের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আমার মনে হলো, ব্যবসায়ী গোলাম কিবরিয়াও সেই অনিষ্টকারী মানুষ। যাঁরা সমাজের কোনো কাজে আসেন না।
আরও পড়ুন:
যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ: গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সংকট’ সম্মেলনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ড. এম সাখাওয়াত হোসেন শেখ হাসিনাকে নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট দেশত্যাগ না করলে বিক্ষুব্ধ জনতার সহিংসতার শিকার হতে পারতেন হাসিনা। বিস্তারিত জানুন এই
৪ মিনিট আগেদেশে বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা সাড়ে ১৫ লাখের মতো। তাদের সবাইকে আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দিতে হবে। তবে এরপর প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তা জমা দিতে হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে গত ১ সেপ্টেম্বর এমনটাই জানানো হয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগেফরিদপুরের মল্লিকপুরে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে খাগড়াছড়ি পরিবহন ও গ্রিন এক্সপ্রেস বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষের দুর্ঘটনাস্থলকে ‘ব্ল্যাক স্পট’ বা বারংবার দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছে জাতীয় তদন্ত কমিটি। মৃতুফাঁদে পরিণত ওই সড়কটির কাঠামোগত ত্রুটি সারানোসহ একগুচ্ছ সুপারিশ করে জরুরি ভিত্তিতে তা বাস্তবায়নের
১০ ঘণ্টা আগেদেশের সব টিভি চ্যানেল ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দিনে কমপক্ষে দুবার প্রচার করতে হবে ‘জুলাই অনির্বাণ’ ভিডিওচিত্র। আজ শুক্রবার (২২ নভেম্বর) এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ কথা জানায় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের আত্মত্যাগ জনগণকে অবহিত করার লক্ষ্যে তথ্য..
১২ ঘণ্টা আগে