Ajker Patrika

রোহিঙ্গা শিবিরে আরও বেশি সহায়তা দিতে দাতা দেশগুলোকে অ্যামনেস্টির আহ্বান

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২৫, ১৬: ২০
রোহিঙ্গা শিবিরে আরও বেশি সহায়তা দিতে দাতা দেশগুলোকে অ্যামনেস্টির আহ্বান

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে সহায়তা কমানোর ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। সংস্থাটির সহায়তা কমানোর ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, সহায়তা কমানোর ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জরুরিভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবনে ভয়াবহ প্রভাব এড়ানো যায়।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশে সফরের প্রাক্কালে অ্যামনেস্টির তরফ থেকে এই আহ্বান জানানো হলো।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, সম্প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী মাস থেকে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার জন্য বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সহায়তা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার কারণে তারা চরম সংকটের মুখোমুখি হতে চলেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানিয়েছে, ৯৫ শতাংশ রোহিঙ্গা পরিবার মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।

ডব্লিউএফপি, রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে তাদের খাদ্য সহায়তা অর্ধেকে নামিয়ে আনছে, ফলে প্রত্যেক রোহিঙ্গা প্রতি মাসের জন্য মাত্র ৬ ডলার করে পাবে, যা চরম অপ্রতুল। এমনিতেই সীমিত সম্পদের কারণে শরণার্থীরা সংকটে আছে, তার ওপর এই সিদ্ধান্ত তাদের জীবনে ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলবে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডব্লিউএফপি-এর এই অর্থসংকট সামগ্রিকভাবে তহবিল হ্রাসের কারণে হয়েছে। তবে এটি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল স্থগিতের সরাসরি প্রভাব নয়।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের পরিচালক স্মৃতি সিংহ বলেন, ‘এই অর্থসংকট শরণার্থীশিবিরগুলোতে চলমান খাদ্য ও জরুরি সেবার সংকটকে আরও প্রকট করবে। বিশেষ করে শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও প্রবীণদের ওপর এর ভয়াবহ প্রভাব পড়বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের কড়া বিধিনিষেধের কারণে কক্সবাজারের রোহিঙ্গারা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না, ফলে ডব্লিউএফপির খাদ্য সহায়তার ওপর তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে।’

ডব্লিউএফপির এই সিদ্ধান্তের পর কক্সবাজার আশ্রয়শিবিরে বসবাসকারী ছয় তরুণ রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আয়েস ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নের কারণে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, ‘এই খাদ্যসহায়তা তিনবেলা খাবারের জন্য যথেষ্ট না-ও হতে পারে। অনেকে হয়তো প্রতিদিনের খাবারের পরিমাণ কমাতে বাধ্য হবে।’

২৩ বছর বয়সী স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ মির্জা বলেন, ‘বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী, ৬ ডলার শুধু চাল, ডাল আর লবণের মতো ন্যূনতম কিছু কেনার জন্যই যথেষ্ট হবে। পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় দুধ, ডিম, ফল ও সবজি কেনার সুযোগ থাকবে না। এটি আমাদের জন্য ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে।’

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ডব্লিউএফপির এই কাটছাঁটের ফলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে থাকা অপুষ্টির হার আরও বাড়বে, বিশেষ করে নারী ও শিশুরা চরম ঝুঁকির মুখে পড়বে। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের প্রায় অর্ধেকের শরীরে অপুষ্টির লক্ষণ দেখা গেছে। ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের ১৫ শতাংশ গুরুতর অপুষ্টিতে ভুগছে। ইউএনএইচসিআর-এর মতে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই নারী ও শিশু।

এর আগে, ২০২৩ সালে ডব্লিউএফপি মাসিক খাদ্য রেশন ১২ ডলার থেকে ৮ ডলারে নামিয়ে এনেছিল। পরে কিছু অতিরিক্ত তহবিল পাওয়ার পর তা বাড়ানো হলেও এবারের নতুন সিদ্ধান্ত আরও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ গত বছরের তুলনায় তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা ২৭ শতাংশ বেড়েছে। খাদ্যসহায়তা আরও কমলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে।

অ্যামনেস্টি বলেছে, এই খাদ্যসংকটে নারী প্রধান পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রোহিঙ্গাদের জন্য আয়রোজগারের সুযোগ সীমিত, আর নারীদের জন্য তা আরও কঠিন। ফলে অনেক নারীপ্রধান পরিবার কেবল খাদ্যসহায়তার ওপর নির্ভরশীল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছে এক রোহিঙ্গা জানান, ‘কিছু নারীপ্রধান পরিবার হয়তো বেঁচে থাকার জন্য ভিক্ষা করতে বাধ্য হবে।’

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ২০২৪ সালের অক্টোবরে করা এক গবেষণা দেখিয়েছে, রোহিঙ্গা পরিবারগুলো নতুন আসা আত্মীয়দের সঙ্গে তাদের সীমিত সম্পদ ভাগ করে নিতে বাধ্য হচ্ছে, যাদের অনেকেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ থেকে পালিয়ে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা সংস্থা ইউএসএআইডির অর্থায়ন স্থগিতের সরাসরি প্রভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে স্বাস্থ্যসেবা খাতেও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল পাঁচটি হাসপাতাল তাদের সেবা বন্ধ করে দিয়েছে। এ ছাড়া, ১৪টি চিকিৎসাকেন্দ্র, যেখানে ফিজিওথেরাপি ও অন্যান্য চিকিৎসা সেবা দেওয়া হতো, সেগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের স্মৃতি সিংহ বলেন, ‘দাতা দেশগুলোকে অবশ্যই দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে এই তহবিল ঘাটতি পূরণ করতে হবে, যাতে ইতিমধ্যে সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ না হয়। প্রয়োজনীয় সহায়তা না মিললে রোহিঙ্গারা, যারা ইতিমধ্যেই বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শরণার্থী সংকটের শিকার, আরও গভীর অনাহার ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়বে। এটি কোনোভাবেই ঘটতে দেওয়া যায় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই ১৯৫১ সালের জাতিসংঘ শরণার্থী কনভেনশন ও এর ১৯৬৭ সালের প্রটোকল অনুমোদন করতে হবে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে হবে, যাতে তারা শুধু বেঁচে থাকার জন্য নয়, বরং এই চক্রাকার হতাশা ও সহায়তানির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।’

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত