কামরুল হাসান, ঢাকা
ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) তখন ক্রাইম বিভাগ চারটি। পূর্ব বিভাগের ডিসি ছিলেন মোখলেসুর রহমান, যিনি পরে অতিরিক্ত আইজি হয়েছিলেন। একদিন রাত ৯টার দিকে তাঁর ফোন। বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে। তাঁর কথায় হতাশার সুর। জানতে চাইলাম, কী এমন হয়েছে? তিনি বললেন, তাঁর টিমের সবচেয়ে ভালো সার্জেন্টকে একদল ছিনতাইকারী গাড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে। ছেলেটির মাথা থেঁতলে গেছে। কথা বলতে পারছে না, অবস্থা খুবই খারাপ। বললাম, কী নাম? তিনি খুব মৃদু স্বরে বললেন, সার্জেন্ট আহাদ।
ইয়াসিন কবীর জয় তখন উদীয়মান ফটোসাংবাদিক। তিনিও খবর পেয়েছেন। বললেন, চলো, পিওতে (প্লেস অব অকারেন্স বা ঘটনাস্থল) যাই। ইস্কাটন থেকে মতিঝিলে বলাকা ভবনের সামনে ঘটনাস্থলে পৌঁছে শুনি, আহাদকে তখনকার রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। গেলাম সেখানে, শুনি পিজি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। জয় বললেন, তাঁর ছবি লাগবে। এখানে থেকে লাভ নেই। ছবির সন্ধানে জয় ছুটলেন ইস্কাটন গার্ডেনের প্রোপার্টি হাউজিংয়ে, আহাদের বাসায়।
রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের লোকেরা কিছু বলতে পারছিলেন না। ঘটনা সম্পর্কে যাঁরা জানেন, তাঁরা সবাই আহাদকে নিয়ে তখনকার পিজি হাসপাতালে গেছেন। আবার ফিরে এলাম মতিঝিলে। দেখি রাস্তায় এক পাশে ট্রাফিক পুলিশের কয়েকজন কনস্টেবল জড়ো হয়ে কথা বলছেন। সঙ্গে দুজন সার্জেন্ট আছেন।
তাঁদের কাছে জানতে চাইলাম, কী হয়েছে। একজন সার্জেন্ট এক কনস্টেবলকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তাঁর কাছে শোনেন, সে উইটনেস (প্রত্যক্ষদর্শী)।’ ওটা ছিল ১৯৯৯ সালের ২৮ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার রাত। সে সময় রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ছিনতাইকারীদের তৎপরতা অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। প্রায় দিনই ছিনতাইয়ের খবর পাওয়া যেত। ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হওয়ার ঘটনাও ছিল। তখন নানা কায়দায় ছিনতাই হতো। একটি কায়দা ছিল—তিন চাকার টেম্পো নিয়ে ছিনতাই। ছিনতাইকারীরা নিজেদের টেম্পোতে যাত্রী সেজে ওত পেতে থাকত। এরপর যাত্রী উঠলে তাঁদের কোনো একটি ফাঁকা জায়গায় নিয়ে সবকিছু কেড়ে নিত। সেই যাত্রীবেশী ছিনতাইকারীদের ধরতে সেদিন তিনটি বিশেষ টিম নামিয়েছিল ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। একটি দলের প্রধান ছিলেন সার্জেন্ট আহাদ, অন্যটির দায়িত্বে ছিলেন পরিদর্শক সাহাব উদ্দিন ও সার্জেন্ট আনোয়ার। তৃতীয় দলটির দায়িত্বে ছিলেন সার্জেন্ট মেজবা।
সেই কনস্টেবল আমাকে বললেন, সার্জেন্ট আহাদ ছিলেন হোটেল পূর্বাণীর কাছে। আর সার্জেন্ট আনোয়ার ছিলেন একটু দূরে, বিমান অফিসের কাছে। বিমান অফিসের অন্য পাশে ছিলেন পরিদর্শক সাহাব উদ্দিন। আবার জনতা ব্যাংকের সামনে ছিলেন সার্জেন্ট মেজবা।
রাত সাড়ে ৮টার দিকে কয়েকজন যাত্রীবেশী ছিনতাইকারী একটি টেম্পো নিয়ে শিল্প ভবন থেকে পূর্বাণী ও বিমান অফিসের মাঝের রাস্তা দিয়ে শাপলা চত্বরে যাচ্ছিল। টেম্পোটি দেখেই তাঁদের সন্দেহ হয়। সার্জেন্ট আনোয়ার টেম্পোটিকে থামার সংকেত দেন। কিন্তু বিপদ বুঝে সেটা না থেমে বিমান অফিসের পশ্চিম পাশ দিয়ে জনতা ব্যাংক ভবনের দিকে যেতে থাকে। এরপর সার্জেন্ট আহাদ দৌড়ে সেই টেম্পোর পেছনে উঠে পড়েন। টেম্পো চলতে থাকে আর তিনি পেছনে ঝুলতে থাকেন। সার্জেন্ট মেজবা সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় লাঠি দিয়ে টেম্পোর গ্লাস ভেঙে ফেলেন। বৃহস্পতিবারের মতিঝিলে ফাঁকা রাস্তা পেয়ে বেপরোয়া গতিতে টেম্পোটি বাংলার বাণী অফিসের সামনের রাস্তায় এসে জিকজ্যাক করে চলতে থাকে। এতে পেছনে থাকা আহাদ প্রায় বেসামাল হয়ে পড়েন। এই সুযোগে এক ছিনতাইকারী তাঁকে ধাক্কা মেরে টেম্পো থেকে ফেলে দেয়। রাস্তায় পড়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান আহাদ। ছিনতাইকারীরা অবস্থা বুঝে টেম্পো ফেলে পালিয়ে যায়।পরে সেটি জনতা পুড়িয়ে দেয়।
পিজি হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও আহাদের ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছিলেন না। এরপর তাঁকে নেওয়া হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। রাত ১১টার দিকে সেখানেই তিনি মারা যান। আহাদের মৃত্যুর পর ডিসি মোখলেসুর রহমান আমাকে বলেছিলেন, পূর্ব তিমুর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যাওয়ার জন্য আহাদ মনোনীত হয়েছিলেন। সাত দিন পরই তাঁর ফ্লাইট। তখন তিনি ছুটিতেই ছিলেন। কিন্তু তার পরও কেন তিনি ডিউটিতে এলেন, তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না।
আহাদের বন্ধু এক সার্জেন্ট আমাকে বলেছিলেন, আহাদ ছিলেন খুবই সাহসী। ছুটিতে থাকার পরও ছিনতাইকারী ধরার কথা শুনে তিনি ছুটে আসেন। সেই বন্ধু আফসোস করে বললেন, আসলে মৃত্যু তাঁকে টেনে এনেছিল।
আহাদ তখন অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচীকে বিয়ে করে ইস্কাটনে থাকতেন। তাঁদের একমাত্র মেয়ে লামিছা রিমঝিম তখন তিন বছরের। আহাদ যখন মারা যান, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩৮ বছর। ১৯৮৫ সালে তিনি সার্জেন্ট পদে যোগ দিয়েছিলেন। আর জন্মেছিলেন ১৯৬৪ সালের ৪ নভেম্বর শেরপুরের নালিতাবাড়ীর আমবাগানে। তাঁর ভাই আসলাম ইকবালও পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। আহাদ মারা যাওয়ার কয়েক বছর পর তিনিও কর্মস্থলে মারা যান।
আহাদের মৃত্যু পুলিশ বাহিনীকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। কিছুদিন পর গুলিস্তানে একটি পুলিশ বক্স হলে নাম রাখা হয় ‘সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্স’। আউটার স্টেডিয়ামে গুলিস্তান হকার সমিতি একটি গাছ লাগিয়ে স্থাপন করে সার্জেন্ট আহাদ স্মৃতিফলক, নাট্যচক্র নামে একটি সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যতত্ত্ব বিভাগে চালু করে সার্জেন্ট আহাদ মেধাবৃত্তি। আর তাঁর জন্মভূমি নালিতাবাড়ীতে স্থাপন করা হয় সার্জেন্ট আহাদ স্মৃতি প্রাঙ্গণ।
সবকিছু ঠিকই ছিল, কোনো কিছুতেই কোনো তাল ভঙ্গ হয়নি। এর মধ্যে সরকার বদল হয়ে গেল। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসেই সবকিছু উলটপালট করে দিল। আহাদ নিহত হওয়ার পর তাঁর স্ত্রী অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচীকে একটি চাকরি দেওয়া হয়েছিল শিল্পকলা একাডেমিতে। একদিন সেই চাকরি থেকে বাদ দিয়ে তাঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো। রোকেয়া প্রাচীর চাকরি হারানো নিয়ে একটি রিপোর্ট করেছিলাম জনকণ্ঠে। সেই রিপোর্টের পর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। গতকাল রোকেয়া প্রাচী আমাকে বললেন, তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সেই খবর দেখে তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আর চাকরির জন্য যাননি।
আহাদ খুনের মামলা করেছিলেন মতিঝিল থানার এসআই মেজবা উদ্দিন খান। আর তদন্ত করে অভিযোগপত্র দিয়েছিলেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ। তিনি ১৩ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দিয়েছিলেন। কিন্তু মহানগর দায়রা জজ হোসেন শহীদ আহমেদ মাত্র ৩ জনকে সাজা দিতে পেরেছিলেন। বাকি ১০ জনকে বেকসুর খালাস দিয়ে বলেছিলেন, আহাদের পুলিশ সহকর্মীরা সেদিন তাঁদের হাতে থাকা অস্ত্র দিয়ে গুলি না ছুড়ে আহাদকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, সেই পুলিশ সদস্যরা আদালতে এসে বলেছেন, গ্রেপ্তার করা আসামিদেরও তাঁরা চেনেন না। রায় দেওয়ার সময় আদালত আক্ষেপ করে বলেছিলেন, এই পুলিশ সদস্যরা বাহিনীতে থাকার যোগ্য নয়, তারা বাহিনীর কলঙ্ক।
২০০৩ সালের নভেম্বরে এই মামলার রায় হয়েছিল। রোকেয়া প্রাচী সেদিন জজ আদালতের বটতলায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। পাশে ছিল রিমঝিম। সে এখন অস্ট্রেলিয়ায় স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। রোকেয়া প্রাচী সেদিন আহাদের পছন্দ করা জামদানি পরে হাতে মেহেদি লাগিয়েছিলেন। আমি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, তিনি ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন, যেন পাহাড়সম বেদনা তাঁকে কুরে কুরে রিক্ত করেছিল। সেই কান্না হয়তো এখনো কাঁদেন রোকেয়া প্রাচী। কাল তিনি আমাকে বললেন, ‘আহাদ যে আমার জীবনের অংশ হয়ে আছে। তাকে ভুলি কী করে!’
আষাঢ়ে নয় সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) তখন ক্রাইম বিভাগ চারটি। পূর্ব বিভাগের ডিসি ছিলেন মোখলেসুর রহমান, যিনি পরে অতিরিক্ত আইজি হয়েছিলেন। একদিন রাত ৯টার দিকে তাঁর ফোন। বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে। তাঁর কথায় হতাশার সুর। জানতে চাইলাম, কী এমন হয়েছে? তিনি বললেন, তাঁর টিমের সবচেয়ে ভালো সার্জেন্টকে একদল ছিনতাইকারী গাড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে। ছেলেটির মাথা থেঁতলে গেছে। কথা বলতে পারছে না, অবস্থা খুবই খারাপ। বললাম, কী নাম? তিনি খুব মৃদু স্বরে বললেন, সার্জেন্ট আহাদ।
ইয়াসিন কবীর জয় তখন উদীয়মান ফটোসাংবাদিক। তিনিও খবর পেয়েছেন। বললেন, চলো, পিওতে (প্লেস অব অকারেন্স বা ঘটনাস্থল) যাই। ইস্কাটন থেকে মতিঝিলে বলাকা ভবনের সামনে ঘটনাস্থলে পৌঁছে শুনি, আহাদকে তখনকার রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। গেলাম সেখানে, শুনি পিজি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। জয় বললেন, তাঁর ছবি লাগবে। এখানে থেকে লাভ নেই। ছবির সন্ধানে জয় ছুটলেন ইস্কাটন গার্ডেনের প্রোপার্টি হাউজিংয়ে, আহাদের বাসায়।
রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের লোকেরা কিছু বলতে পারছিলেন না। ঘটনা সম্পর্কে যাঁরা জানেন, তাঁরা সবাই আহাদকে নিয়ে তখনকার পিজি হাসপাতালে গেছেন। আবার ফিরে এলাম মতিঝিলে। দেখি রাস্তায় এক পাশে ট্রাফিক পুলিশের কয়েকজন কনস্টেবল জড়ো হয়ে কথা বলছেন। সঙ্গে দুজন সার্জেন্ট আছেন।
তাঁদের কাছে জানতে চাইলাম, কী হয়েছে। একজন সার্জেন্ট এক কনস্টেবলকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তাঁর কাছে শোনেন, সে উইটনেস (প্রত্যক্ষদর্শী)।’ ওটা ছিল ১৯৯৯ সালের ২৮ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার রাত। সে সময় রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ছিনতাইকারীদের তৎপরতা অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। প্রায় দিনই ছিনতাইয়ের খবর পাওয়া যেত। ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হওয়ার ঘটনাও ছিল। তখন নানা কায়দায় ছিনতাই হতো। একটি কায়দা ছিল—তিন চাকার টেম্পো নিয়ে ছিনতাই। ছিনতাইকারীরা নিজেদের টেম্পোতে যাত্রী সেজে ওত পেতে থাকত। এরপর যাত্রী উঠলে তাঁদের কোনো একটি ফাঁকা জায়গায় নিয়ে সবকিছু কেড়ে নিত। সেই যাত্রীবেশী ছিনতাইকারীদের ধরতে সেদিন তিনটি বিশেষ টিম নামিয়েছিল ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। একটি দলের প্রধান ছিলেন সার্জেন্ট আহাদ, অন্যটির দায়িত্বে ছিলেন পরিদর্শক সাহাব উদ্দিন ও সার্জেন্ট আনোয়ার। তৃতীয় দলটির দায়িত্বে ছিলেন সার্জেন্ট মেজবা।
সেই কনস্টেবল আমাকে বললেন, সার্জেন্ট আহাদ ছিলেন হোটেল পূর্বাণীর কাছে। আর সার্জেন্ট আনোয়ার ছিলেন একটু দূরে, বিমান অফিসের কাছে। বিমান অফিসের অন্য পাশে ছিলেন পরিদর্শক সাহাব উদ্দিন। আবার জনতা ব্যাংকের সামনে ছিলেন সার্জেন্ট মেজবা।
রাত সাড়ে ৮টার দিকে কয়েকজন যাত্রীবেশী ছিনতাইকারী একটি টেম্পো নিয়ে শিল্প ভবন থেকে পূর্বাণী ও বিমান অফিসের মাঝের রাস্তা দিয়ে শাপলা চত্বরে যাচ্ছিল। টেম্পোটি দেখেই তাঁদের সন্দেহ হয়। সার্জেন্ট আনোয়ার টেম্পোটিকে থামার সংকেত দেন। কিন্তু বিপদ বুঝে সেটা না থেমে বিমান অফিসের পশ্চিম পাশ দিয়ে জনতা ব্যাংক ভবনের দিকে যেতে থাকে। এরপর সার্জেন্ট আহাদ দৌড়ে সেই টেম্পোর পেছনে উঠে পড়েন। টেম্পো চলতে থাকে আর তিনি পেছনে ঝুলতে থাকেন। সার্জেন্ট মেজবা সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় লাঠি দিয়ে টেম্পোর গ্লাস ভেঙে ফেলেন। বৃহস্পতিবারের মতিঝিলে ফাঁকা রাস্তা পেয়ে বেপরোয়া গতিতে টেম্পোটি বাংলার বাণী অফিসের সামনের রাস্তায় এসে জিকজ্যাক করে চলতে থাকে। এতে পেছনে থাকা আহাদ প্রায় বেসামাল হয়ে পড়েন। এই সুযোগে এক ছিনতাইকারী তাঁকে ধাক্কা মেরে টেম্পো থেকে ফেলে দেয়। রাস্তায় পড়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান আহাদ। ছিনতাইকারীরা অবস্থা বুঝে টেম্পো ফেলে পালিয়ে যায়।পরে সেটি জনতা পুড়িয়ে দেয়।
পিজি হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও আহাদের ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছিলেন না। এরপর তাঁকে নেওয়া হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। রাত ১১টার দিকে সেখানেই তিনি মারা যান। আহাদের মৃত্যুর পর ডিসি মোখলেসুর রহমান আমাকে বলেছিলেন, পূর্ব তিমুর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যাওয়ার জন্য আহাদ মনোনীত হয়েছিলেন। সাত দিন পরই তাঁর ফ্লাইট। তখন তিনি ছুটিতেই ছিলেন। কিন্তু তার পরও কেন তিনি ডিউটিতে এলেন, তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না।
আহাদের বন্ধু এক সার্জেন্ট আমাকে বলেছিলেন, আহাদ ছিলেন খুবই সাহসী। ছুটিতে থাকার পরও ছিনতাইকারী ধরার কথা শুনে তিনি ছুটে আসেন। সেই বন্ধু আফসোস করে বললেন, আসলে মৃত্যু তাঁকে টেনে এনেছিল।
আহাদ তখন অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচীকে বিয়ে করে ইস্কাটনে থাকতেন। তাঁদের একমাত্র মেয়ে লামিছা রিমঝিম তখন তিন বছরের। আহাদ যখন মারা যান, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩৮ বছর। ১৯৮৫ সালে তিনি সার্জেন্ট পদে যোগ দিয়েছিলেন। আর জন্মেছিলেন ১৯৬৪ সালের ৪ নভেম্বর শেরপুরের নালিতাবাড়ীর আমবাগানে। তাঁর ভাই আসলাম ইকবালও পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। আহাদ মারা যাওয়ার কয়েক বছর পর তিনিও কর্মস্থলে মারা যান।
আহাদের মৃত্যু পুলিশ বাহিনীকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। কিছুদিন পর গুলিস্তানে একটি পুলিশ বক্স হলে নাম রাখা হয় ‘সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্স’। আউটার স্টেডিয়ামে গুলিস্তান হকার সমিতি একটি গাছ লাগিয়ে স্থাপন করে সার্জেন্ট আহাদ স্মৃতিফলক, নাট্যচক্র নামে একটি সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যতত্ত্ব বিভাগে চালু করে সার্জেন্ট আহাদ মেধাবৃত্তি। আর তাঁর জন্মভূমি নালিতাবাড়ীতে স্থাপন করা হয় সার্জেন্ট আহাদ স্মৃতি প্রাঙ্গণ।
সবকিছু ঠিকই ছিল, কোনো কিছুতেই কোনো তাল ভঙ্গ হয়নি। এর মধ্যে সরকার বদল হয়ে গেল। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসেই সবকিছু উলটপালট করে দিল। আহাদ নিহত হওয়ার পর তাঁর স্ত্রী অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচীকে একটি চাকরি দেওয়া হয়েছিল শিল্পকলা একাডেমিতে। একদিন সেই চাকরি থেকে বাদ দিয়ে তাঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো। রোকেয়া প্রাচীর চাকরি হারানো নিয়ে একটি রিপোর্ট করেছিলাম জনকণ্ঠে। সেই রিপোর্টের পর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। গতকাল রোকেয়া প্রাচী আমাকে বললেন, তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সেই খবর দেখে তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আর চাকরির জন্য যাননি।
আহাদ খুনের মামলা করেছিলেন মতিঝিল থানার এসআই মেজবা উদ্দিন খান। আর তদন্ত করে অভিযোগপত্র দিয়েছিলেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ। তিনি ১৩ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দিয়েছিলেন। কিন্তু মহানগর দায়রা জজ হোসেন শহীদ আহমেদ মাত্র ৩ জনকে সাজা দিতে পেরেছিলেন। বাকি ১০ জনকে বেকসুর খালাস দিয়ে বলেছিলেন, আহাদের পুলিশ সহকর্মীরা সেদিন তাঁদের হাতে থাকা অস্ত্র দিয়ে গুলি না ছুড়ে আহাদকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, সেই পুলিশ সদস্যরা আদালতে এসে বলেছেন, গ্রেপ্তার করা আসামিদেরও তাঁরা চেনেন না। রায় দেওয়ার সময় আদালত আক্ষেপ করে বলেছিলেন, এই পুলিশ সদস্যরা বাহিনীতে থাকার যোগ্য নয়, তারা বাহিনীর কলঙ্ক।
২০০৩ সালের নভেম্বরে এই মামলার রায় হয়েছিল। রোকেয়া প্রাচী সেদিন জজ আদালতের বটতলায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। পাশে ছিল রিমঝিম। সে এখন অস্ট্রেলিয়ায় স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। রোকেয়া প্রাচী সেদিন আহাদের পছন্দ করা জামদানি পরে হাতে মেহেদি লাগিয়েছিলেন। আমি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, তিনি ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন, যেন পাহাড়সম বেদনা তাঁকে কুরে কুরে রিক্ত করেছিল। সেই কান্না হয়তো এখনো কাঁদেন রোকেয়া প্রাচী। কাল তিনি আমাকে বললেন, ‘আহাদ যে আমার জীবনের অংশ হয়ে আছে। তাকে ভুলি কী করে!’
আষাঢ়ে নয় সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘দেশের চলমান অর্থনৈতিক ভঙ্গুর অবস্থা ও সংকটের মূলে আছে স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি ও অনাচারী অর্থনীতি। বিগত সরকারের সময়ে অনাচারী অর্থনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার
২ ঘণ্টা আগেসারা দেশের বিভিন্ন জেলায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবুর রহমানের নামে থাকা ৬টি মেডিকেল কলেজের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। ব্যক্তির নাম বাদ দিয়ে মেডিকেল কলেজগুলোর নামকরণ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর নামে
৩ ঘণ্টা আগেনির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ দিতে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি করেছে সরকার। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীকে সভাপতি করে আজ বৃহস্পতিবার সার্চ কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
৪ ঘণ্টা আগেরাষ্ট্র সংস্কারে অগ্রাধিকার দেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর নির্বাচনের জন্য চাপ বাড়ছে। বিএনপি শুরুতে সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বললেও এখন দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ চাইছে।
৫ ঘণ্টা আগে