কালরাতে স্বামী আর বোনকে হারান, জীবনসায়াহ্নে শেষ আশা ফুলবানুর

ফারুক ছিদ্দিক, ঢাবি 
প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৩, ২২: ৫৮
আপডেট : ২৫ মার্চ ২০২৩, ২৩: ৪১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ি আবাসিক এলাকা। সেখানকার একটি তিনতলা বাসায় একমাত্র ছেলে, ছেলের স্ত্রী ও নাতিকে নিয়ে বসবাস করেন ফুলবানু। নিভৃতে থাকতেই ভালোবাসেন। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে গেলে একরাশ অভিমান ঝরে তাঁর কণ্ঠে। এই রাজধানী শহরে জীবন-জীবিকার টালমাটাল স্রোতে ফুলবানু যে ভীষণ নাস্তানাবুদ, সেটা তাঁর কথায় বোঝা যায়। তিনি বলেন, ‘কী হবে এসব সাক্ষাৎকার দিয়ে!’ ইতিহাস হবে, আপনারা না বললে তো হবে না—তরুণ সাংবাদিকের আবেগভরা কথায় ফুলবানুর অভিমান কিছুটা হলেও দূর হয়। তিনি বলতে শুরু করেন। 

২৫ মার্চের রাত যত বাড়তে থাকে, বুকের ভেতরে ভয়ও তত বাড়তে শুরু করে ফুলবানুর। ভয় অনেক কিছুর। বয়স তাঁর ষোলো বছর। কোলে দুই বছরের সন্তান। ঢাকা তখন গুজব আর গুঞ্জনের শহর। সময় যে দ্রুত কঠিন হয়ে উঠছে, সেটি সবাই বুঝতে পারছে। কিন্তু কী হবে বা হতে পারে, সেটি ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। 

এদিকে তিনি শুনেছেন ‘বাবুর বাপ’ অর্থাৎ তাঁর স্বামী আব্দুল খালেক নাকি ছাত্রদের সঙ্গে ট্রেনিং করছেন যুদ্ধ করার জন্য! তাই রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ও বাড়তে থাকে। ফুলবানু ‘বাবুর বাপরে’ বলেছিলেন গ্রামে চলে যেতে। এই ভয়াবহ সময়ে ঢাকায় থেকে কোনো লাভ নেই। কিন্তু আব্দুল খালেক যাবেন না। তিনি আস্থা রেখেছিলেন রোকেয়া হলের প্রভোস্টের ওপর। বলেছিলেন, তিনিই বাঁচাবেন তাঁদের। কিন্তু সেটি হয়নি। 

২৫ মার্চ রাত। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পান ফুলবানু। তারপর গুলির শব্দ। মানুষের চিৎকার। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাকিস্তানি সেনারা রোকেয়া হলে ফুলবানুদের বাসায় ঢুকে পড়ে দানবের মতো। সে রাতের ঘটনা যেন এখনো তাড়া করে ফেরে ফুলবানুকে। তিনি শিববাড়ি আবাসিক এলাকায় জানালা দিয়ে বাইরে নিষ্পলক তাকিয়ে বলতে থাকেন, ‘আমি বাচ্চাটাকে (হারুনুর রশিদ) বুকে নিয়ে চৌকির নিচে ঢুকে পড়ি। কিন্তু আমার পা দেখা যাচ্ছিল। পায়ে গুলি লাগে, বাবুর ক্ষতি হতে দিইনি। কিন্তু আমার স্বামী আব্দুল খালেক ও আমার ছোট বোন, যে বাবুকে দেখতে এসেছিল ঢাকায়, তাকে মেরে ফেলে পাকিস্তানি সেনারা। আমার হারানোর কিছু নাই। সব হারায়ে ফেলছি সেদিন।’

শহীদ আব্দুল খালেকের স্ত্রী ফুলবানু, ১৯৭৭ সালে তোলাজানালা দিয়ে আসা আলোয় ফুলবানুর অবয়ব তখন সিলিউট হয়ে গেছে। মুখের ওপরে বিজলি বাতির হালকা আলো। তাতে ঠিক বোঝা যায় না ফুলবানুর চোখে পানি কি না। কিন্তু কণ্ঠস্বর বদলে গেছে, তাতে যে বাষ্প জমেছে, সেটা বোঝা যায় স্পষ্ট। কথায় খানিক বিরতি দিলেন তিনি, স্বাভাবিকভাবে যা হওয়ার কথা ছিল। ধাতস্থ হয়ে ফুলবানু বলতে শুরু করেন, ‘সে আমার কথা শুনলে আজকে মারা যেত না। কত ছটফট করেছে! চোখের সামনে দেখেছি। নিজেকে ধরে রাখতে হয়েছে।’ সেদিনের সেই দৃশ্য যেন জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় ফুলবানুর কাছে। অবধারিতভাবে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। আবার বলতে শুরু করেন, ‘ছেলের দিকে চেয়ে একটি সেলাই মেশিন নিয়ে সংসারের হাল ধরেছি। আর কোথাও বিয়ের পিঁড়িতে বসিনি। তাঁকে সম্মান করতাম। এ সম্মান আজীবনের।’

ফুলবানু বলেন, ‘শেখ মুজিব’ তাঁকে দুই হাজার টাকা দিয়েছিলেন। এরপর আর কিছু পাননি—রাষ্ট্র থেকেও না, বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও না। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া ফুলবানুর কণ্ঠে আফসোস ঝরে পড়ে তাঁর স্বামী ছাত্রদের সঙ্গে ট্রেনিং নেওয়ার পরেও যুদ্ধ করতে পারেননি বলে। তবে ফুলবানুর একটিই আশা, ‘শহীদের স্ত্রী হিসেবে মরতে চাই। শহীদ হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্মানটা যেন আমার স্বামী ও বোন পায়, সেই কামনা করি।’ 

শিববাড়ি আবাসিক এলাকা থেকে বেরিয়ে আসি। হাঁটতে থাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে পথে। খানিক এলোমেলো লাগে নিজেকে। একটি প্রশ্নই ঘুরতে থাকে মাথার মধ্যে, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে আমরা কি আশা করতে পারি, ফুলবানু নামে একজন শহীদজায়ার আশা পূরণ হবে?

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত