কামরুল হাসান, ঢাকা
সেবার ডিসেম্বরে বড্ড শীত পড়েছিল। সেই শীতের এক সন্ধ্যায় সিএসডিতে কাবাব খেতে গিয়ে দেখা কর্নেল গুলজার উদ্দিনের সঙ্গে। কিছুক্ষণ আড্ডা, তারপর এ-কথা, সে-কথা। এক ফাঁকে বললেন, ‘ওস্তাদ, জ্যাকেট রেডি রাইখেন।’ গুলজারের এই কথার মানে আমি জানি, ‘ভয়ংকর কিছুর জন্য অপেক্ষা করো’।
এরপর কয়েক দিন ধরে একটি ফোনের জন্য অপেক্ষা করছি। আমি নিশ্চিত, সেই ফোন আসবে গভীর রাতে। কিন্তু ফোন আর বাজে না। রোজ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফোনটা নেড়েচেড়ে দেখি, সব ঠিকঠাক আছে কি না। অপেক্ষা আসলেই বড় কঠিন।
অবশেষে ফোন এল, তা-ও পাঁচ দিন পরে। ২০০৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাত দুইটা-আড়াইটার দিকে ফোন করলেন কমান্ডার মাসুক হাসান আহমেদ। তিনি তখন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক। ছোট করে বললেন, ‘জালে বিগ ফিশ আছে, ময়মনসিংহের দিকে আসেন।’ ময়মনসিংহ অনেক বড় জায়গা। কোথায় যেতে হবে, পরিষ্কার করে কিছুই বললেন না, তবু পথে নামলাম।
সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে হেঁটে বেইলি রোডে এসে দেখি, সুইস বেকারির সামনে হলুদ রঙের একটি ট্যাক্সি ক্যাব দাঁড়িয়ে। ময়মনসিংহ যেতে হবে শুনে প্রথমে চালক রাজি হলেন না। ট্যাক্সি ক্যাব তখন শুধু রাজধানীতে চলত, ঢাকার বাইরে গেলেই পুলিশের ঝামেলা। পরে আমার প্রয়োজন আর পরিচয় শুনে বললেন, ‘ওডেন স্যার, যা করে আল্লায়।’
এত রাতে ঢাকার রাস্তায় কোনো যানবাহন নেই। ড্যাশবোর্ডে ‘রিজার্ভ’ লেখা বসিয়ে দিয়ে ঘন কুয়াশা মাড়িয়ে আমরা ছুটে চলছি ময়মনসিংহের দিকে। গাড়ি চলছে ঝড়ের গতিতে। গাজীপুর চৌরাস্তা পেরোতেই ফোন দিলাম মাসুক হাসানকে। বললেন, ‘নাক বরাবর আসতে থাকেন।’
ঘণ্টা দুয়েক পরে পৌঁছালাম ময়মনসিংহ শহরের কাছে। অন্ধকার আর ঘন কুয়াশা, কোন দিকে যাব বুঝতে পারছি না। সামনে একটি পেট্রলপাম্প। সেখানে গাড়ি থামিয়ে আবার ফোন দিলাম মাসুক হাসানকে। এবার বললেন, আকুয়া মোড়লপাড়ার দিকে আসেন। এই শহরে আমি আগেও এসেছি, কিন্তু রাতে কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। আকুয়া কোন দিকে, তা-ও জানি না। পেট্রলপাম্পের এক কর্মচারীর কাছে জানতে চাইলাম, আকুয়া যাব কীভাবে? আমার প্রশ্ন শুনে ঘুম মোছা চোখে বললেন, ওদিকে গোলাগুলি হচ্ছে। বললাম, তবু আমি সেখানেই যাব। কর্মচারী অবাক হয়ে পথ দেখিয়ে দিলেন।
পাম্প থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে মোড় নিতেই র্যাবের কয়েকজন সদস্য গাড়ি থামালেন। পরিচয় পেয়ে গাড়ি ছেড়ে সাবধানে হেঁটে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। তাঁদের কথা শুনে একটু এগোতেই দেখি, রাস্তার ওপর বোমার মতো কিছু পড়ে আছে। একটু পর আরেকটা। যত এগোচ্ছি, একটার পর একটা। মনে হচ্ছে, পরিত্যক্ত কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছি। আরেকটু সামনে এগোতেই পেয়ে গেলাম গুলজার উদ্দিন ও তাঁর দলবলকে। আমাকে দেখে তিনি হেসে বললেন, ‘ওস্তাদ, মিশন ফেল, বিগ সর্ট এসকেপ করেছে।’
একটি মোড়ে আমরা দাঁড়িয়ে কথা বলছি, এর মধ্যে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের এক সদস্য দৌড়ে এসে বললেন, ‘স্যার, সর্বনাশ, সব তো লাইট সেনসিটিভ বোম্ব!’ এ কথা শুনে দলের সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সূর্যের আলো পড়লেই নাকি বোমাগুলো বিস্ফোরিত হবে। সূর্য ওঠার আগেই সবগুলো সরাতে হবে। শুরু হলো পাতা কুড়ানোর মতো করে বোমা কুড়ানোর কাজ। সবাই আতঙ্কিত। অবশেষে বোমাগুলো সরানো শেষ হলো। ততক্ষণে দিনের আলো ফুটেছে। ময়মনসিংহ শহরের সব সাংবাদিক শীতে কাঁপতে কাঁপতে ঘটনাস্থলে হাজির। সেই দলে মাফলারে মুখ বেঁধে এসেছেন নিয়ামুল কবীর সজল। আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, ভাই, আপনি!
র্যাবের কাছে খবর ছিল, ময়মনসিংহের একটি বাড়িতে জেএমবির মজলিসে শুরার গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা লুকিয়ে আছেন। সেই তথ্য পেয়েই এই অভিযান। র্যাবের দলটি প্রথমে যায় আকুয়া উত্তরপাড়ার ফুলবাড়িয়া রোডে, নাসিরাবাদ স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক খোরশেদ উদ্দীন আকন্দের বাড়ি ‘নোঙর’-এ। সেই বাড়ির নিচতলায় পাওয়া যায় তৈরি বোমা ও বিস্ফোরকের বিশাল স্তূপ। দোতলার দুটি কক্ষের সবখানেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা শক্তিশালী বোমা।
বাড়িওয়ালা আমাদের বললেন, আসাদুজ্জামান নামের এক যুবক বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিল। তার সঙ্গে শহীদ নামের এক ছেলে থাকত। সে আনন্দ মোহন কলেজে ইংরেজিতে অনার্স পড়ত। আর ছিল শিশুকন্যাসহ তাদের এক বোন।
পরের অভিযান হলো আকুয়া মোড়লপাড়ার নূরুদ্দিন মাস্টারের বাড়ি ‘নূরমহল’-এ। সেই বাড়ির নিচতলা ছিল জঙ্গি আস্তানা। র্যাব নূরমহলে ঢোকার চেষ্টা করতেই জঙ্গিরা টের পেয়ে যায়। প্রথমে তারা হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়ে মারে। এরপর একে একে শক্তিশালী বোমা ছুড়ে দেয়। তারা চারদিকের বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে হাওয়া হয়ে যায়। র্যাব পলাতক জঙ্গিদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল, জবাবে তারা বোমা ছোড়ে। ৩০ মিনিট ধরে বোমা ও গুলিবিনিময় হয়। র্যাবকে প্রতিহত করতে আধা কিলোমিটারজুড়ে বোমা ফেলে দেয় জঙ্গিরা। আস্তানা ছাড়ার আগে জঙ্গিরা তাদের কম্পিউটার বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়।
এই অভিযানে ১২ জনকে আটক করা হয়। দুই আস্তানা থেকে পাওয়া যায় বিপুলসংখ্যক বোমা, ব্যাপক বিস্ফোরক ও সরঞ্জাম।
অভিযান শেষ, আমরা সবাই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। মিলল না কোনো রাঘববোয়াল। কিন্তু বেরিয়ে এল আরেক অজানা কাহিনি। হঠাৎ সেই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে দেখে সন্দেহ করলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলাম। তাঁকে আটক করা হলো। নাম আসাদ। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি নিজেকে জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত বলে দাবি করলেন। বললেন, এই বোমাগুলো সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন নামের এক ব্যক্তি তাঁকে দিয়েছেন। আরও জানালেন, তাঁর সঙ্গে যে নারী থাকতেন, তিনি জেএমবির এক নেতার স্ত্রী, তাঁর বোন নন। সংগঠনের নির্দেশে তাঁকে আশ্রয় দেন।
জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে আসাদ স্বীকার করেন, অভিযানের আগে নূরমহলে লুকিয়ে ছিলেন জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান ও শায়খ আবদুর রহমানের ভাই আতাউর রহমান সানির সেকেন্ড ইন কমান্ড সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন। অভিযান টের পেয়ে পথে বোমা ফাটিয়ে নিরাপদে সরে পড়েন সালাউদ্দিন। আর যাওয়ার আগে বোমা মেরে নিজের কম্পিউটারটিও উড়িয়ে দেন। ঢাকায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগে সানিও নাকি এখানে এসেছিলেন।
কিন্তু ওই যে কথায় আছে, চোরের সাত দিন আর গৃহস্থের এক দিন। সালাউদ্দিনকেও ধরা পড়তে হয়। ২০০৬ সালের ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থেকে ধরা পড়েন সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন। এই সালাউদ্দিন ছিলেন জেএমবির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। নারায়ণগঞ্জের রফিকুল ইসলামের ছেলে সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে ৪০ টির বেশি মামলা আছে। এর মধ্যে ১৩ মামলায় তাঁর সাজা হয়েছে,৩ টিতে হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।
আদালতে সালাউদ্দিন যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন, তাতে বলেছিলেন, ১৯৯৭ সালে বন্দর বিএম ইউনিয়ন স্কুল থেকে পাস করে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকার তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। সেখানে পরিচয় হয় আতাউর রহমান সানির সঙ্গে। এরপর জঙ্গিবাদে জড়ান। জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমান তাঁকে ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ২০০২ সালে সিলেটের দায়িত্বও তাঁকে দেওয়া হয়। ওই সময় জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী থানার সানা কৈর গ্রামে হৃদয় রায় নামের এক তরুণকে হত্যা করেন সালেহীন ও তাঁর সহযোগীরা। বরিশালের ছেলে হৃদয় খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে একটি মিশনের হয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে অভিনয় করে যিশুর জীবনকাহিনি তুলে ধরতেন। হৃদয় হত্যা মামলায় ২০১৩ সালে হাইকোর্ট সালেহীনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। সে বছর গনি গোমেজ নামের আরেক ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টানকে হত্যার দায়ে হাইকোর্ট সালেহীনসহ দুই জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তবে এসব রায়ের বিরুদ্ধে কোনো দিন আপিল করেননি সালাউদ্দিন; বরং তিনি দেশের প্রচলিত বিচারব্যবস্থা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন।
২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকায় প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে হাফেজ মাহমুদ, বোমা মিজান আর সালাউদ্দিনকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় সহযোগী জঙ্গিরা। সেই থেকে সালাউদ্দিন পলাতক। পুলিশ তাঁকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকার পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল। পুলিশ এখন বলছে, তিনি ভারতে আছেন।
২০১৪ সালের ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান শহরের উপকণ্ঠে খাগড়াগড়ের একটি বাড়িতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এরপর ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ মিজান আর সালাউদ্দিনের খোঁজে অনুসন্ধান শুরু করে। পরে মিজান ধরা পড়ে। কিন্তু সালাউদ্দিনকে আর ধরতে পারেনি। হিন্দুস্তান টাইমসে দেখলাম, সালাউদ্দিন ও মিজানকে নিয়ে রিপোর্ট করেছে। বলেছে, এরা ভারতের ভেতরে জামাআতুল মুজাহিদীন ইন্ডিয়া বা জেএমআই নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে।
২০ নভেম্বর ঢাকার আদালত থেকে যে কায়দায় দুই জঙ্গি ছিনতাই হলো, তাতে সালাউদ্দিনের মতো কারও হাত আছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরও পড়ুন:
সেবার ডিসেম্বরে বড্ড শীত পড়েছিল। সেই শীতের এক সন্ধ্যায় সিএসডিতে কাবাব খেতে গিয়ে দেখা কর্নেল গুলজার উদ্দিনের সঙ্গে। কিছুক্ষণ আড্ডা, তারপর এ-কথা, সে-কথা। এক ফাঁকে বললেন, ‘ওস্তাদ, জ্যাকেট রেডি রাইখেন।’ গুলজারের এই কথার মানে আমি জানি, ‘ভয়ংকর কিছুর জন্য অপেক্ষা করো’।
এরপর কয়েক দিন ধরে একটি ফোনের জন্য অপেক্ষা করছি। আমি নিশ্চিত, সেই ফোন আসবে গভীর রাতে। কিন্তু ফোন আর বাজে না। রোজ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফোনটা নেড়েচেড়ে দেখি, সব ঠিকঠাক আছে কি না। অপেক্ষা আসলেই বড় কঠিন।
অবশেষে ফোন এল, তা-ও পাঁচ দিন পরে। ২০০৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাত দুইটা-আড়াইটার দিকে ফোন করলেন কমান্ডার মাসুক হাসান আহমেদ। তিনি তখন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক। ছোট করে বললেন, ‘জালে বিগ ফিশ আছে, ময়মনসিংহের দিকে আসেন।’ ময়মনসিংহ অনেক বড় জায়গা। কোথায় যেতে হবে, পরিষ্কার করে কিছুই বললেন না, তবু পথে নামলাম।
সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে হেঁটে বেইলি রোডে এসে দেখি, সুইস বেকারির সামনে হলুদ রঙের একটি ট্যাক্সি ক্যাব দাঁড়িয়ে। ময়মনসিংহ যেতে হবে শুনে প্রথমে চালক রাজি হলেন না। ট্যাক্সি ক্যাব তখন শুধু রাজধানীতে চলত, ঢাকার বাইরে গেলেই পুলিশের ঝামেলা। পরে আমার প্রয়োজন আর পরিচয় শুনে বললেন, ‘ওডেন স্যার, যা করে আল্লায়।’
এত রাতে ঢাকার রাস্তায় কোনো যানবাহন নেই। ড্যাশবোর্ডে ‘রিজার্ভ’ লেখা বসিয়ে দিয়ে ঘন কুয়াশা মাড়িয়ে আমরা ছুটে চলছি ময়মনসিংহের দিকে। গাড়ি চলছে ঝড়ের গতিতে। গাজীপুর চৌরাস্তা পেরোতেই ফোন দিলাম মাসুক হাসানকে। বললেন, ‘নাক বরাবর আসতে থাকেন।’
ঘণ্টা দুয়েক পরে পৌঁছালাম ময়মনসিংহ শহরের কাছে। অন্ধকার আর ঘন কুয়াশা, কোন দিকে যাব বুঝতে পারছি না। সামনে একটি পেট্রলপাম্প। সেখানে গাড়ি থামিয়ে আবার ফোন দিলাম মাসুক হাসানকে। এবার বললেন, আকুয়া মোড়লপাড়ার দিকে আসেন। এই শহরে আমি আগেও এসেছি, কিন্তু রাতে কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। আকুয়া কোন দিকে, তা-ও জানি না। পেট্রলপাম্পের এক কর্মচারীর কাছে জানতে চাইলাম, আকুয়া যাব কীভাবে? আমার প্রশ্ন শুনে ঘুম মোছা চোখে বললেন, ওদিকে গোলাগুলি হচ্ছে। বললাম, তবু আমি সেখানেই যাব। কর্মচারী অবাক হয়ে পথ দেখিয়ে দিলেন।
পাম্প থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে মোড় নিতেই র্যাবের কয়েকজন সদস্য গাড়ি থামালেন। পরিচয় পেয়ে গাড়ি ছেড়ে সাবধানে হেঁটে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। তাঁদের কথা শুনে একটু এগোতেই দেখি, রাস্তার ওপর বোমার মতো কিছু পড়ে আছে। একটু পর আরেকটা। যত এগোচ্ছি, একটার পর একটা। মনে হচ্ছে, পরিত্যক্ত কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছি। আরেকটু সামনে এগোতেই পেয়ে গেলাম গুলজার উদ্দিন ও তাঁর দলবলকে। আমাকে দেখে তিনি হেসে বললেন, ‘ওস্তাদ, মিশন ফেল, বিগ সর্ট এসকেপ করেছে।’
একটি মোড়ে আমরা দাঁড়িয়ে কথা বলছি, এর মধ্যে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের এক সদস্য দৌড়ে এসে বললেন, ‘স্যার, সর্বনাশ, সব তো লাইট সেনসিটিভ বোম্ব!’ এ কথা শুনে দলের সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সূর্যের আলো পড়লেই নাকি বোমাগুলো বিস্ফোরিত হবে। সূর্য ওঠার আগেই সবগুলো সরাতে হবে। শুরু হলো পাতা কুড়ানোর মতো করে বোমা কুড়ানোর কাজ। সবাই আতঙ্কিত। অবশেষে বোমাগুলো সরানো শেষ হলো। ততক্ষণে দিনের আলো ফুটেছে। ময়মনসিংহ শহরের সব সাংবাদিক শীতে কাঁপতে কাঁপতে ঘটনাস্থলে হাজির। সেই দলে মাফলারে মুখ বেঁধে এসেছেন নিয়ামুল কবীর সজল। আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, ভাই, আপনি!
র্যাবের কাছে খবর ছিল, ময়মনসিংহের একটি বাড়িতে জেএমবির মজলিসে শুরার গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা লুকিয়ে আছেন। সেই তথ্য পেয়েই এই অভিযান। র্যাবের দলটি প্রথমে যায় আকুয়া উত্তরপাড়ার ফুলবাড়িয়া রোডে, নাসিরাবাদ স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক খোরশেদ উদ্দীন আকন্দের বাড়ি ‘নোঙর’-এ। সেই বাড়ির নিচতলায় পাওয়া যায় তৈরি বোমা ও বিস্ফোরকের বিশাল স্তূপ। দোতলার দুটি কক্ষের সবখানেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা শক্তিশালী বোমা।
বাড়িওয়ালা আমাদের বললেন, আসাদুজ্জামান নামের এক যুবক বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিল। তার সঙ্গে শহীদ নামের এক ছেলে থাকত। সে আনন্দ মোহন কলেজে ইংরেজিতে অনার্স পড়ত। আর ছিল শিশুকন্যাসহ তাদের এক বোন।
পরের অভিযান হলো আকুয়া মোড়লপাড়ার নূরুদ্দিন মাস্টারের বাড়ি ‘নূরমহল’-এ। সেই বাড়ির নিচতলা ছিল জঙ্গি আস্তানা। র্যাব নূরমহলে ঢোকার চেষ্টা করতেই জঙ্গিরা টের পেয়ে যায়। প্রথমে তারা হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়ে মারে। এরপর একে একে শক্তিশালী বোমা ছুড়ে দেয়। তারা চারদিকের বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে হাওয়া হয়ে যায়। র্যাব পলাতক জঙ্গিদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল, জবাবে তারা বোমা ছোড়ে। ৩০ মিনিট ধরে বোমা ও গুলিবিনিময় হয়। র্যাবকে প্রতিহত করতে আধা কিলোমিটারজুড়ে বোমা ফেলে দেয় জঙ্গিরা। আস্তানা ছাড়ার আগে জঙ্গিরা তাদের কম্পিউটার বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়।
এই অভিযানে ১২ জনকে আটক করা হয়। দুই আস্তানা থেকে পাওয়া যায় বিপুলসংখ্যক বোমা, ব্যাপক বিস্ফোরক ও সরঞ্জাম।
অভিযান শেষ, আমরা সবাই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। মিলল না কোনো রাঘববোয়াল। কিন্তু বেরিয়ে এল আরেক অজানা কাহিনি। হঠাৎ সেই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে দেখে সন্দেহ করলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলাম। তাঁকে আটক করা হলো। নাম আসাদ। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি নিজেকে জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত বলে দাবি করলেন। বললেন, এই বোমাগুলো সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন নামের এক ব্যক্তি তাঁকে দিয়েছেন। আরও জানালেন, তাঁর সঙ্গে যে নারী থাকতেন, তিনি জেএমবির এক নেতার স্ত্রী, তাঁর বোন নন। সংগঠনের নির্দেশে তাঁকে আশ্রয় দেন।
জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে আসাদ স্বীকার করেন, অভিযানের আগে নূরমহলে লুকিয়ে ছিলেন জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান ও শায়খ আবদুর রহমানের ভাই আতাউর রহমান সানির সেকেন্ড ইন কমান্ড সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন। অভিযান টের পেয়ে পথে বোমা ফাটিয়ে নিরাপদে সরে পড়েন সালাউদ্দিন। আর যাওয়ার আগে বোমা মেরে নিজের কম্পিউটারটিও উড়িয়ে দেন। ঢাকায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগে সানিও নাকি এখানে এসেছিলেন।
কিন্তু ওই যে কথায় আছে, চোরের সাত দিন আর গৃহস্থের এক দিন। সালাউদ্দিনকেও ধরা পড়তে হয়। ২০০৬ সালের ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থেকে ধরা পড়েন সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন। এই সালাউদ্দিন ছিলেন জেএমবির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। নারায়ণগঞ্জের রফিকুল ইসলামের ছেলে সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে ৪০ টির বেশি মামলা আছে। এর মধ্যে ১৩ মামলায় তাঁর সাজা হয়েছে,৩ টিতে হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।
আদালতে সালাউদ্দিন যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন, তাতে বলেছিলেন, ১৯৯৭ সালে বন্দর বিএম ইউনিয়ন স্কুল থেকে পাস করে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকার তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। সেখানে পরিচয় হয় আতাউর রহমান সানির সঙ্গে। এরপর জঙ্গিবাদে জড়ান। জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমান তাঁকে ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ২০০২ সালে সিলেটের দায়িত্বও তাঁকে দেওয়া হয়। ওই সময় জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী থানার সানা কৈর গ্রামে হৃদয় রায় নামের এক তরুণকে হত্যা করেন সালেহীন ও তাঁর সহযোগীরা। বরিশালের ছেলে হৃদয় খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে একটি মিশনের হয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে অভিনয় করে যিশুর জীবনকাহিনি তুলে ধরতেন। হৃদয় হত্যা মামলায় ২০১৩ সালে হাইকোর্ট সালেহীনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। সে বছর গনি গোমেজ নামের আরেক ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টানকে হত্যার দায়ে হাইকোর্ট সালেহীনসহ দুই জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তবে এসব রায়ের বিরুদ্ধে কোনো দিন আপিল করেননি সালাউদ্দিন; বরং তিনি দেশের প্রচলিত বিচারব্যবস্থা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন।
২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকায় প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে হাফেজ মাহমুদ, বোমা মিজান আর সালাউদ্দিনকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় সহযোগী জঙ্গিরা। সেই থেকে সালাউদ্দিন পলাতক। পুলিশ তাঁকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকার পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল। পুলিশ এখন বলছে, তিনি ভারতে আছেন।
২০১৪ সালের ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান শহরের উপকণ্ঠে খাগড়াগড়ের একটি বাড়িতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এরপর ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ মিজান আর সালাউদ্দিনের খোঁজে অনুসন্ধান শুরু করে। পরে মিজান ধরা পড়ে। কিন্তু সালাউদ্দিনকে আর ধরতে পারেনি। হিন্দুস্তান টাইমসে দেখলাম, সালাউদ্দিন ও মিজানকে নিয়ে রিপোর্ট করেছে। বলেছে, এরা ভারতের ভেতরে জামাআতুল মুজাহিদীন ইন্ডিয়া বা জেএমআই নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে।
২০ নভেম্বর ঢাকার আদালত থেকে যে কায়দায় দুই জঙ্গি ছিনতাই হলো, তাতে সালাউদ্দিনের মতো কারও হাত আছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরও পড়ুন:
যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ: গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সংকট’ সম্মেলনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ড. এম সাখাওয়াত হোসেন শেখ হাসিনাকে নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট দেশত্যাগ না করলে বিক্ষুব্ধ জনতার সহিংসতার শিকার হতে পারতেন হাসিনা। বিস্তারিত জানুন এই
৬ মিনিট আগেদেশে বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা সাড়ে ১৫ লাখের মতো। তাদের সবাইকে আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দিতে হবে। তবে এরপর প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তা জমা দিতে হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে গত ১ সেপ্টেম্বর এমনটাই জানানো হয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগেফরিদপুরের মল্লিকপুরে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে খাগড়াছড়ি পরিবহন ও গ্রিন এক্সপ্রেস বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষের দুর্ঘটনাস্থলকে ‘ব্ল্যাক স্পট’ বা বারংবার দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছে জাতীয় তদন্ত কমিটি। মৃতুফাঁদে পরিণত ওই সড়কটির কাঠামোগত ত্রুটি সারানোসহ একগুচ্ছ সুপারিশ করে জরুরি ভিত্তিতে তা বাস্তবায়নের
১০ ঘণ্টা আগেদেশের সব টিভি চ্যানেল ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দিনে কমপক্ষে দুবার প্রচার করতে হবে ‘জুলাই অনির্বাণ’ ভিডিওচিত্র। আজ শুক্রবার (২২ নভেম্বর) এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ কথা জানায় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের আত্মত্যাগ জনগণকে অবহিত করার লক্ষ্যে তথ্য..
১২ ঘণ্টা আগে