এস এম নূর মোহাম্মদ, ঢাকা
কোটা বিরোধী আন্দোলনে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে গত কয়েক দিনে সারা দেশে নিহতের সংখ্যা দুই শতাধিক। আহতের সংখ্যা কয়েক হাজার। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিনের কর্মসূচিতে আন্দোলনকারীদের বাইরেও অনেক নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছেন। অনেকে গুলিতে মারা গেছেন নিজের ঘরে। আর হতাহতদের অনেকেরই গুলি লেগেছে চোখে, মাথায়, ঘাড়ে ও পেটে। অনেকে গুলির কারণে চিরতরে হারিয়েছেন চোখের আলো।
উল্লেখ্য, রোববারও দেশব্যাপী সহিংসতায় প্রায় ১০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যেও অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
গত বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, মরদেহের ময়নাতদন্তে যে চাইনিজ রাইফেল ও শটগানের গুলি পাওয়া গেছে তা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবহার করে। এসব গুলিই প্রমাণ করে সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরীহ ছাত্র ও আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করেছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলিতে বাসার বারান্দা এবং ছাদে থাকা বাচ্চারাও নিহত হয় বলে দাবি করেন তিনি।
আইনজ্ঞরা বলছেন, মানুষের জীবন ও শান্তিশৃঙ্খলা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করলে বা বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করলে তা আইন অনুযায়ী প্রতিরোধ করার দায়িত্বও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। তবে আইনের বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত বল প্রয়োগও শাস্তিযোগ্য। কেননা কারও প্রাণ হরণ করতে হলেও তা আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে করতে হবে। যেভাবে গুলি করা হয়েছে এবং মানুষ হতাহত হয়েছে তাতে এটি আইনানুগ বলা যাবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইন মেনে দায়িত্বশীল আচরণ করলে প্রাণহানি এই পর্যায়ে যেতো না বলে মত তাঁদের।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, গুলি করার বিধান হলো–আত্মরক্ষার্থে এবং যে পরিস্থিতিতে গুলি না করলে অনেক মানুষ হতাহত হবে। যখন–তখন গুলি করে দিলে হবে না। গুলি করার কারণ ও পদ্ধতি আছে। কেন করবেন সেটাও ব্যাখ্যা করতে হবে। গুলি করার ঘটনায় মামলা হলে ব্যাখ্যা দিতে হয়। হতাহতের ঘটনায় প্রতিটিরই মামলা হওয়া উচিত। প্রত্যেকটি মৃত্যুর তদন্ত হওয়া উচিত। কেননা কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে গুলির সামনে গিয়ে মারা যায়নি। নিশ্চয়ই কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে মেরেছে। চলমান আন্দোলনে ৬ জনের নিহত হওয়ার ঘটনায় বিচারবিভাগীয় কমিশন কাজ করছে। একই ঘটনায় বাকিদের ক্ষেত্রেও হওয়া উচিত বলে মনে করেন এই সিনিয়র আইনজীবী।
সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার। আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।
সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না। আর ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়ার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।
আইন ও সালিস কেন্দ্রের চেয়ারপারসন এবং সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, গুলি করার জন্য আইন আছে। প্রথমেই ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি লাগবে। পিআরবিতে আছে, হাঁটুর নিচে গুলি করতে হবে। মাথায়, মুখে, বুকে গুলি করার কোনো এখতিয়ার নেই। যেভাবে গুলি করা হয়েছে সেটি আইনানুগ হয়নি। আইনানুগভাবে আগে গ্রেপ্তার করতে পারত। প্রাথমিক পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি লাগবে। এই ধরনের কার্যকলাপ গ্রহণযোগ্য না। প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হওয়া উচিত।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোন অবস্থায় কতটুকু বল প্রয়োগ করতে পারবে তাও আইনে নির্ধারণ করা আছে। পুলিশ প্রবিধানে পুলিশকে তিনটি ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তির আত্মরক্ষা বা সম্পত্তি রক্ষার অধিকার প্রয়োগ, বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করা এবং কতিপয় পরিস্থিতিতে গ্রেপ্তার কার্যকর করার জন্য।
১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোনো বেআইনি সমাবেশ বা সর্ব সাধারণের শান্তি বিনষ্ট হওয়ার কারণ ঘটাতে পারে এরূপ সমাবেশ ছত্রভঙ্গ হতে আদেশ দিতে পারেন। ১২৮ ধারায় বলা হয়েছে, আদেশ পাওয়ার পরও কোনো সমাবেশ যদি ছত্রভঙ্গ না হয় তাহলে কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলপ্রয়োগ করে সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য অগ্রসর হতে পারবেন। একই সঙ্গে সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্য দাবি করতে পারেন এবং সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারবেন।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ বলেন, আইনে স্পষ্ট করে বলা আছে, গুলি করতে হলে কী কী প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে। সংবিধান আমাকে বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছে। গুলি করতে হলে আইন অনুযায়ী যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তার নির্দেশে হতে হবে। গুলি করার উদ্দেশ্য কাউকে হত্যা করা নয়, ঠেকানো।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সহিংসতায় দুই শতাধিক মৃত্যুর ঘটনায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি দেওয়া খোলা চিঠিতে অ্যামনেস্টির সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস কলামার্দ বলেন, বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বেআইনি বল প্রয়োগ হয়েছে। আবদ্ধ স্থানে কাঁদানে গ্যাস এবং নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা অ্যাসল্ট রাইফেলের মতো প্রাণঘাতী অস্ত্রের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ দ্বারা সংঘটিত সহিংসতার দিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে চিঠিতে।
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৯৬-১০৬ ধারায় আত্মরক্ষার অধিকার সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। দণ্ডবিধির ৯৯ ধারায় বলা হয়েছে আঘাত যতটুকু প্রতিকারও ঠিক ততটুকু করতে পারবে। প্রতিঘাত আঘাতের বেশি হতে পারবে না।
মনজিল মোরসেদ বলেন, কারও গুলি লেগেছে চোখে, মুখে, মাথায়। কোনো আইন এভাবে গুলি করে হত্যা করা সমর্থন করে না। গুলি করার একটি প্রক্রিয়া আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইন মেনে গুলি করলে এত লোক মারা যেত না। যারা করেছেন এগুলো তদন্ত হওয়া দরকার। কমিশন হয়েছে ৬ জনের বিষয়ে। দুইশ’র বেশি মৃত্যু হয়েছে। তাই সবগুলোর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। আইনের বিধান প্রতিটি মৃত্যুর–হত্যার বিচার হতে হবে। যাদের নির্দেশে হয়েছে, যারা করেছে সবার বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে।
নারায়ণগঞ্জ সদরের নয়ামাটি এলাকায় দুপুরে খাওয়ার পর গত ১৯ জুলাই ছাদে খেলতে গিয়েছিল সাড়ে ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপ। রাস্তায় হইহল্লা শুনে বাবা ছুটে যান ছাদ থেকে মেয়েকে ঘরে আনতে। কোলে নিতেই একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় শিশুটির মাথায়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ জুলাই মারা যায় ছোট্ট শিশু রিয়া। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রিয়ার মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হয়, ‘গানশট ইনজুরি’।
একইদিন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে মিরপুরে কাফরুল থানার সামনের সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া ঢুকছিল সামিরের ঘরে। জানালা বন্ধ করতে গেলে বাইরে থেকে গুলি এসে ১১ বছরের সাফকাত সামিরের চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার খুলি ভেদ করে বেরিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সামির। এ সময় ঘরে থাকা সামিরের চাচা ১৭ বছরের মশিউর রহমানের কাঁধেও গুলি লাগে।
গুলি না করার নির্দেশ চেয়ে করা রিট খারিজ করেছে হাইকোর্ট
আন্দোলনে গুলি না করার নির্দেশনা চেয়ে নাগরিকদের করা রিট খারিজ করে রোববার কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলনের বেঞ্চ।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ মিছিল, সমাবেশ ও জনসভায় অংশগ্রহণের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।
হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণে বলেন, সংবিধান অনুসারে প্রত্যেক নাগরিকের শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশ এবং জনসভা করার অধিকার রয়েছে। মানুষের জীবন সবচেয়ে দামি সম্পদ। মানুষের জীবন ও মর্যাদা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। যেখানে কঠিনভাবে প্রয়োজন কেবল সেখানেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফোর্স ব্যবহার করতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে মানুষের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করতে হবে এবং সকলের মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে হবে।
আদালত বলেন, কেউ আইন লঙ্ঘন করলে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ও তারপরে প্রাণঘাতী গুলি ব্যবহার করতে পারে। যদি কোনো লঙ্ঘন না ঘটে বা কোনো দাঙ্গা না হয়, তবে কোনো প্রাণঘাতী গুলি (লাইভ বুলেট) ব্যবহার করা যাবে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের মৌলিক দিক ও নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে পুলিশের কাজ করা অপরিহার্য।
হাইকোর্ট আরও বলেন, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ কোনো প্রকার বৈষম্য করতে পারবে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আইনের বাধ্যবাধকতা মানতে হবে এবং ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। কোনো শান্তিপূর্ণ সমাবেশ বেআইনিতে (সহিংস, দাঙ্গা) পরিণত হলে পুলিশকে সংবিধান, ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৭-১৩২, পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল (পিআরবি) এর ১৫৩,১৫৪, ১৫৫,১৫৬, ১৫৭ এবং দণ্ডবিধির ৯৬-১০৬ পর্যন্ত অনুসরণ করতে হবে।
উচ্চ আদালত বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে এটা প্রয়োজনীয় যে, পুলিশ আইনের চারটি কর্নার (সংবিধান, পিআরবি, সিআরপিসি ও দণ্ড বিধি) অনুসারে দায়িত্ব পালন করবে। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের জনগণের দেওয়া অধিকার অনুসারে।
কোটা বিরোধী আন্দোলনে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে গত কয়েক দিনে সারা দেশে নিহতের সংখ্যা দুই শতাধিক। আহতের সংখ্যা কয়েক হাজার। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিনের কর্মসূচিতে আন্দোলনকারীদের বাইরেও অনেক নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছেন। অনেকে গুলিতে মারা গেছেন নিজের ঘরে। আর হতাহতদের অনেকেরই গুলি লেগেছে চোখে, মাথায়, ঘাড়ে ও পেটে। অনেকে গুলির কারণে চিরতরে হারিয়েছেন চোখের আলো।
উল্লেখ্য, রোববারও দেশব্যাপী সহিংসতায় প্রায় ১০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যেও অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
গত বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, মরদেহের ময়নাতদন্তে যে চাইনিজ রাইফেল ও শটগানের গুলি পাওয়া গেছে তা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবহার করে। এসব গুলিই প্রমাণ করে সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরীহ ছাত্র ও আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করেছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলিতে বাসার বারান্দা এবং ছাদে থাকা বাচ্চারাও নিহত হয় বলে দাবি করেন তিনি।
আইনজ্ঞরা বলছেন, মানুষের জীবন ও শান্তিশৃঙ্খলা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করলে বা বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করলে তা আইন অনুযায়ী প্রতিরোধ করার দায়িত্বও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। তবে আইনের বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত বল প্রয়োগও শাস্তিযোগ্য। কেননা কারও প্রাণ হরণ করতে হলেও তা আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে করতে হবে। যেভাবে গুলি করা হয়েছে এবং মানুষ হতাহত হয়েছে তাতে এটি আইনানুগ বলা যাবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইন মেনে দায়িত্বশীল আচরণ করলে প্রাণহানি এই পর্যায়ে যেতো না বলে মত তাঁদের।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, গুলি করার বিধান হলো–আত্মরক্ষার্থে এবং যে পরিস্থিতিতে গুলি না করলে অনেক মানুষ হতাহত হবে। যখন–তখন গুলি করে দিলে হবে না। গুলি করার কারণ ও পদ্ধতি আছে। কেন করবেন সেটাও ব্যাখ্যা করতে হবে। গুলি করার ঘটনায় মামলা হলে ব্যাখ্যা দিতে হয়। হতাহতের ঘটনায় প্রতিটিরই মামলা হওয়া উচিত। প্রত্যেকটি মৃত্যুর তদন্ত হওয়া উচিত। কেননা কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে গুলির সামনে গিয়ে মারা যায়নি। নিশ্চয়ই কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে মেরেছে। চলমান আন্দোলনে ৬ জনের নিহত হওয়ার ঘটনায় বিচারবিভাগীয় কমিশন কাজ করছে। একই ঘটনায় বাকিদের ক্ষেত্রেও হওয়া উচিত বলে মনে করেন এই সিনিয়র আইনজীবী।
সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার। আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।
সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না। আর ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়ার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।
আইন ও সালিস কেন্দ্রের চেয়ারপারসন এবং সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, গুলি করার জন্য আইন আছে। প্রথমেই ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি লাগবে। পিআরবিতে আছে, হাঁটুর নিচে গুলি করতে হবে। মাথায়, মুখে, বুকে গুলি করার কোনো এখতিয়ার নেই। যেভাবে গুলি করা হয়েছে সেটি আইনানুগ হয়নি। আইনানুগভাবে আগে গ্রেপ্তার করতে পারত। প্রাথমিক পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি লাগবে। এই ধরনের কার্যকলাপ গ্রহণযোগ্য না। প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হওয়া উচিত।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোন অবস্থায় কতটুকু বল প্রয়োগ করতে পারবে তাও আইনে নির্ধারণ করা আছে। পুলিশ প্রবিধানে পুলিশকে তিনটি ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তির আত্মরক্ষা বা সম্পত্তি রক্ষার অধিকার প্রয়োগ, বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করা এবং কতিপয় পরিস্থিতিতে গ্রেপ্তার কার্যকর করার জন্য।
১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোনো বেআইনি সমাবেশ বা সর্ব সাধারণের শান্তি বিনষ্ট হওয়ার কারণ ঘটাতে পারে এরূপ সমাবেশ ছত্রভঙ্গ হতে আদেশ দিতে পারেন। ১২৮ ধারায় বলা হয়েছে, আদেশ পাওয়ার পরও কোনো সমাবেশ যদি ছত্রভঙ্গ না হয় তাহলে কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলপ্রয়োগ করে সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য অগ্রসর হতে পারবেন। একই সঙ্গে সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্য দাবি করতে পারেন এবং সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারবেন।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ বলেন, আইনে স্পষ্ট করে বলা আছে, গুলি করতে হলে কী কী প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে। সংবিধান আমাকে বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছে। গুলি করতে হলে আইন অনুযায়ী যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তার নির্দেশে হতে হবে। গুলি করার উদ্দেশ্য কাউকে হত্যা করা নয়, ঠেকানো।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সহিংসতায় দুই শতাধিক মৃত্যুর ঘটনায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি দেওয়া খোলা চিঠিতে অ্যামনেস্টির সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস কলামার্দ বলেন, বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বেআইনি বল প্রয়োগ হয়েছে। আবদ্ধ স্থানে কাঁদানে গ্যাস এবং নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা অ্যাসল্ট রাইফেলের মতো প্রাণঘাতী অস্ত্রের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ দ্বারা সংঘটিত সহিংসতার দিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে চিঠিতে।
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৯৬-১০৬ ধারায় আত্মরক্ষার অধিকার সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। দণ্ডবিধির ৯৯ ধারায় বলা হয়েছে আঘাত যতটুকু প্রতিকারও ঠিক ততটুকু করতে পারবে। প্রতিঘাত আঘাতের বেশি হতে পারবে না।
মনজিল মোরসেদ বলেন, কারও গুলি লেগেছে চোখে, মুখে, মাথায়। কোনো আইন এভাবে গুলি করে হত্যা করা সমর্থন করে না। গুলি করার একটি প্রক্রিয়া আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইন মেনে গুলি করলে এত লোক মারা যেত না। যারা করেছেন এগুলো তদন্ত হওয়া দরকার। কমিশন হয়েছে ৬ জনের বিষয়ে। দুইশ’র বেশি মৃত্যু হয়েছে। তাই সবগুলোর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। আইনের বিধান প্রতিটি মৃত্যুর–হত্যার বিচার হতে হবে। যাদের নির্দেশে হয়েছে, যারা করেছে সবার বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে।
নারায়ণগঞ্জ সদরের নয়ামাটি এলাকায় দুপুরে খাওয়ার পর গত ১৯ জুলাই ছাদে খেলতে গিয়েছিল সাড়ে ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপ। রাস্তায় হইহল্লা শুনে বাবা ছুটে যান ছাদ থেকে মেয়েকে ঘরে আনতে। কোলে নিতেই একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় শিশুটির মাথায়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ জুলাই মারা যায় ছোট্ট শিশু রিয়া। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রিয়ার মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হয়, ‘গানশট ইনজুরি’।
একইদিন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে মিরপুরে কাফরুল থানার সামনের সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া ঢুকছিল সামিরের ঘরে। জানালা বন্ধ করতে গেলে বাইরে থেকে গুলি এসে ১১ বছরের সাফকাত সামিরের চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার খুলি ভেদ করে বেরিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সামির। এ সময় ঘরে থাকা সামিরের চাচা ১৭ বছরের মশিউর রহমানের কাঁধেও গুলি লাগে।
গুলি না করার নির্দেশ চেয়ে করা রিট খারিজ করেছে হাইকোর্ট
আন্দোলনে গুলি না করার নির্দেশনা চেয়ে নাগরিকদের করা রিট খারিজ করে রোববার কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলনের বেঞ্চ।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ মিছিল, সমাবেশ ও জনসভায় অংশগ্রহণের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।
হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণে বলেন, সংবিধান অনুসারে প্রত্যেক নাগরিকের শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশ এবং জনসভা করার অধিকার রয়েছে। মানুষের জীবন সবচেয়ে দামি সম্পদ। মানুষের জীবন ও মর্যাদা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। যেখানে কঠিনভাবে প্রয়োজন কেবল সেখানেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফোর্স ব্যবহার করতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে মানুষের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করতে হবে এবং সকলের মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে হবে।
আদালত বলেন, কেউ আইন লঙ্ঘন করলে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ও তারপরে প্রাণঘাতী গুলি ব্যবহার করতে পারে। যদি কোনো লঙ্ঘন না ঘটে বা কোনো দাঙ্গা না হয়, তবে কোনো প্রাণঘাতী গুলি (লাইভ বুলেট) ব্যবহার করা যাবে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের মৌলিক দিক ও নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে পুলিশের কাজ করা অপরিহার্য।
হাইকোর্ট আরও বলেন, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ কোনো প্রকার বৈষম্য করতে পারবে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আইনের বাধ্যবাধকতা মানতে হবে এবং ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। কোনো শান্তিপূর্ণ সমাবেশ বেআইনিতে (সহিংস, দাঙ্গা) পরিণত হলে পুলিশকে সংবিধান, ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৭-১৩২, পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল (পিআরবি) এর ১৫৩,১৫৪, ১৫৫,১৫৬, ১৫৭ এবং দণ্ডবিধির ৯৬-১০৬ পর্যন্ত অনুসরণ করতে হবে।
উচ্চ আদালত বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে এটা প্রয়োজনীয় যে, পুলিশ আইনের চারটি কর্নার (সংবিধান, পিআরবি, সিআরপিসি ও দণ্ড বিধি) অনুসারে দায়িত্ব পালন করবে। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের জনগণের দেওয়া অধিকার অনুসারে।
পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে ৫৪ জন কর্মকর্তাকে বদলি ও নতুন কর্মস্থলে পদায়ন করা হয়েছে। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে ৩১ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং ২৩ জন সহকারী পুলিশ সুপার রয়েছেন। গতকাল বুধবার (২০ নভেম্বর) প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেছেন বিদায়ী পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম।
৩৫ মিনিট আগেবাংলাদেশে মানবাধিকার সমুন্নত দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি বলেছে, বাংলাদেশে আগের সরকারের সময় মানবাধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান যা ছিল, বর্তমান সরকারের সময়ও সেটাই আছে। স্থানীয় গতকাল বুধবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার...
২ ঘণ্টা আগেতত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল, সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোট, প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ করে দেওয়ার সুপারিশ করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় জাতীয় পত্রিকার সম্পাদকেরা। আজ বৃহস্পতিবার নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদকেরা এসব সুপারিশ করেন
২ ঘণ্টা আগেআইনজীবী জেড আই খান পান্না মানবিক বিবেচনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার পক্ষে লড়তে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। গণমামলা ও সুষ্ঠু নির্বাচনের গুরুত্ব নিয়েও মন্তব্য করেছেন তিনি।
২ ঘণ্টা আগে