Ajker Patrika

হঠাৎ খোলার সিদ্ধান্তে অন্তহীন ভোগান্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ০১ আগস্ট ২০২১, ০৮: ২৫
হঠাৎ খোলার সিদ্ধান্তে  অন্তহীন ভোগান্তি

কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। যে যেভাবে পারছে ঢাকার আসছে। দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ থাকায় গতকাল সারা দিন শ্রমজীবী মানুষের ঢাকা ফেরার চিত্র ছিল ভয়ংকর। পণ্যবাহী ট্রাক, পিকআপ, লঞ্চ, ছোট ছোট যানবাহনে গাদাগাদি-ঠাসাঠাসি করে ফেরার চেষ্টা; শেষ ভরসা ছিল হাঁটা। এই কষ্টকর যাত্রাপথে কোথাও ছিল না স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই। ফেরিঘাটগুলোর চেহারা ছিল আরও ভয়ংকর।

গত শুক্রবার বিকেলে সরকারের পক্ষ থেকে হঠাৎ ঘোষণা দেওয়া হয়, রোববার থেকে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দেওয়া হবে। ফলে চাকরি বাঁচাতে কয়েক গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে কর্মস্থলে ফিরেছেন এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা। কারখানা খুলে দেওয়ার কথা বলা হলেও বিপুলসংখ্যক শ্রমিক কীভাবে কর্মস্থলে ফিরবেন, তার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে যে যার মতো করে বিকল্প ব্যবস্থায় ফিরেছেন অন্তহীন ভোগান্তি নিয়ে।

কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে ৫ আগস্টের আগে শিল্পকলকারখানা খোলা হবে না বলে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই পাল্টে যায় চিত্র। শিল্পমালিকদের দাবির মুখে আজ সকাল ৬টা থেকে রপ্তানিমুখী সব শিল্পকলকারখানা খোলার অনুমতি দিয়ে গতকাল বিকেলে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এরপরই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ যেসব অঞ্চলে বেশি শিল্পকারখানা রয়েছে, গতকাল সকাল থেকে সেসব এলাকায় সারা দেশ থেকে আসতে শুরু করেন শ্রমিকেরা। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় হেঁটে, রিকশা, ভ্যান, অটোরিকশা, ভাড়ার মোটরসাইকেল, পণ্যবাহী ট্রাক, পিকআপ আর লঞ্চে গাদাগাদি করে কর্মস্থলে ফেরেন তাঁরা।

 ‘লকডাউনের’ মধ্যে ঢাকামুখী শ্রমিকদের স্রোত দেখে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, কোনো শ্রমিক ৫ আগস্টের আগে কর্মস্থলে যোগ না দিলে চাকরি যাবে না। তাঁদের কোনো সমস্যা হবে না। এর ব্যাখ্যায় গতকাল আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ঈদে যেসব শ্রমিক বাড়ি যাননি এবং ঈদের পরদিন যারা ফিরেছেন তাঁদের নিয়ে স্বল্প পরিসরে কারখানা খোলার শর্ত দিয়ে রপ্তানিমুখী শিল্পকলকারখানা খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যদিও কারখানা খোলার বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে এ নিয়ে কিছু বলা হয়নি।

গতকাল বিজিএমইএ এক বিবৃতিতে বলেছে, বিধিনিষেধ শেষ হওয়া পর্যন্ত শ্রমিকেরা কাজে যোগ না দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। বিবৃতিতে সংগঠনটির সভাপতি ফারুক হাসান কারখানা মালিকদের উদ্দেশে বলেন, বিধিনিষেধ পুরোপুরি প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত গ্রামে অবস্থানরত কোনো শ্রমিক-কর্মচারী কারখানায় কাজে যোগ দিতে না পারলে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।

বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা ছুটির আগেই শ্রমিকদের বলেছিলাম ১ আগস্ট কারখানা চালু হতে পারে। এ জন্য কিছু শ্রমিক গ্রামে যাননি। এ ছাড়া যাঁরা গ্রামে গিয়েছিলেন তাঁদের অনেকে চলে এসেছেন। তাঁদের নিয়েই কারখানা চালু করব।’ বিকেএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘আজ কারখানা খোলার পর শ্রমিকদের উপস্থিতির হার দেখে অন্যদের কীভাবে আনা যায়, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ 
বিধিনিষেধের মধ্যে ঢাকায় ফেরা শ্রমিকেরা বলছেন, ‘চাকরি বাঁচাতেই অনেক কষ্ট করে ফিরেছেন তাঁরা। কারণ, কারখানা খোলার পর হাজির না থাকলে চাকরি থাকবে না। কারখানা থেকে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য অনেককে ফোন ও এসএমএস করা হয়েছে।’

গতকাল সকাল থেকে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া, মাদারীপুরের বাংলাবাজার, মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া, রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে ছিল শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের উপচে পড়া ভিড়। ফরিদপুর থেকে ঢাকায় এসেছেন ইসলাম আলী। তিনি বলেন, ‘মাহেন্দ ভাড়া করে দৌলতদিয়া ঘাট পর্যন্ত আসতে ৬০০ টাকা লেগেছে। কাল (রোববার) থেকে গার্মেন্টস খোলা, তাই যেতেই হবে। খুবই ভোগান্তি হচ্ছে বাস না চলায়।’

সিরাজগঞ্জ থেকে ট্রাকে করে কর্মস্থলে ফিরেছেন পোশাক কারখানার শ্রমিক আয়েশা বেগম। তিনি বলেন, ‘শুক্রবার রাতে জানতে পেরেছি রোববার থেকে কারখানা চালু হবে। এ জন্য উপায় না পেয়ে ট্রাকে করে এসেছি।’ বাইপাইলে তাঁদের কারখানার আরও কয়েকজন সহকর্মী তাঁর সঙ্গে একই ট্রাকে করে সিরাজগঞ্জ থেকে ফিরেছেন বলে জানান তিনি।

শরীয়তপুরের জাজিরা থেকে আসা মো. মিলন বলেন, ‘লকডাউনের প্রথমেই বাড়িতে চইলা আসছিলাম। ঢাকায় হকারি করি। কলকারখানা বন্ধ থাকায় ব্যবসাও আমার বন্ধ আছিল। রোববার কলকারখানা খুলবে। তাই ঢাকা যাইতাছি। প্যাডে (পেটে) ভাত না থাকলে স্বাস্থ্যবিধি দিয়া কি করমু?’ গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থেকে আসা রহিমা বেগম বলেন, ‘গার্মেন্টস খোলার খবরে যাইতাছি। মনে শান্তি পাইছি খবর পাইয়া। কামকাইজ করতে না পারলে না খাইয়া মরতে হইবে।’ মাদারীপুর থেকে আসা মো. ফারুক বলেন, ‘লকডাউনে কাজ ছিল না। বাড়িতে থেকে জমানো টাকা সব খরচ করে ফেলেছি। কাজে যোগ দিতে শত কষ্ট হলেও ঢাকায় যেতে হবে।’

ফরিদপুরের মধুখালীর বাঘাট থেকে ঢাকা বেড়িবাঁধ যাচ্ছিলেন গার্মেন্টস কর্মী মো. মানিক। তিনি বলেন, ‘গার্মেন্টসে স্যাম্পল সেকশনে কাজ করি। রোববার থেকে আমাদের কারখানা খুলবে। অফিস থেকে ফোনে মেসেজ দিয়ে কাজে যোগ দিতে বলেছে।’ পাবনার বেড়ার নাকালিয়া থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে ট্রলারে করে রাজধানীর সদরঘাটে আসেন দুই শ মানুষ। এদের একজন নুরুজ্জামান জানান, তাঁদের প্রত্যেককে সাড়ে তিন শ টাকা করে ভাড়া দিতে হয়েছে। 
বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডে পোশাকশ্রমিক মো. সুমন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি গাইবান্ধা থেকে এসেছি। গতকাল অফিস থেকে ফোন করে জানিয়েছে যে রোববার ফ্যাক্টরি খুলবে। তাই বাধ্য হয়েই চলে এসেছি। রোববার অফিসে না গেলে চাকরি থাকবে না।’

 বিআইডব্লিউটিসির বাংলাবাজার ঘাটের ব্যবস্থাপক মো. সালাউদ্দিন আহমেদ জানান, যাত্রীর চাপ বেশি থাকায় ফেরিতে শ্রমিকদের বহন করা হয়েছে। গতকাল রাজধানীর প্রবেশমুখগুলোতে ঢাকায় ফেরা মানুষের ঢল ছিল। চেকপোস্টগুলোতে পুলিশও কিছু বলেনি। গাবতলীতে পোশাক কারখানার শ্রমিক শাহিন আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভোগান্তি নয়, অত্যাচারিত হচ্ছি। গণপরিবহন ছাড়া সব যানবাহনই রাস্তায় দেখা যাচ্ছে।’ 

শিথিল হচ্ছে বিধিনিষেধ
আগামী ৫ আগস্টের পরেও কঠোর বিধিনিষেধ থাকবে নাকি বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করা হবে, আগামী ৩ বা ৪ আগস্ট তা জানানো হবে বলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে অনেকগুলো পরামর্শ আছে। বিধিনিষেধ আরও ১০ দিন বাড়াতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে সুপারিশ করেছে, তা–ও আমাদের মাথায় আছে। বিকল্প কী হতে পারে, তা নিয়েও আমরা ভাবছি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর কঠোর বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করার পরিকল্পনা হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি অফিস স্বল্প পরিসরে খুলে দেওয়ার পাশাপাশি নিত্যপণ্যের দোকানপাট এবং অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে জেলার ভেতরে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেওয়া হতে পারে। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন ক্যালিফোর্নিয়ার পরিবহন বিশেষজ্ঞ

‘তল্লাশির’ জন্য উসকানি দিয়েছে গুলশানের ওই বাসার সাবেক কেয়ারটেকার: প্রেস উইং

প্রধান উপদেষ্টার আরও দুই বিশেষ সহকারী নিয়োগ

খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা মাসুদ আহমেদের সব পদ স্থগিত

টিআইএন নেওয়ার পরে কিন্তু ঘুমাইতে পারবেন না: এনবিআর চেয়ারম্যান

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত