ড. নাফিস আহমদ
আমি আজ এমন এক কবির কথা বলছি, যিনি তাঁর জীবদ্দশায় কোনো কবিতা লেখেননি, অথবা অন্য কবিদের মতো স্বপ্নে পাওয়া কোনো চরণ কবিতার খাতায় লিপিবদ্ধ করেননি। তারপরও তিনি কবি। তাঁর তুলনা চলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। কবিগুরুর দর্শন যাঁর জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তবে তিনি কবিগুরু থেকে একদিকে এগিয়ে গেছেন। কবিগুরু ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়া তাঁর জন্মভূমিকে দেখে যেতে পারেননি, কিন্তু আমাদের এ কবি তা পেরেছিলেন। শুধু পেরেছিলেন বললে কম বলা হবে, তিনি তাঁর জন্মভূমির স্বাধীনতা অর্জনে পুরো বাঙালি জাতিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
আমি আর কেউ নয়, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বলছি। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পুরোটাই কোনো মহাকাব্য থেকে কোনো অংশে কম নয়। রাজনীতির এই মহাকবির বিষয়ে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রথিতযশা ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় তাঁদের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। তাঁদের বক্তব্যে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর বিশালতার কথা, তাঁর মহাকবি হয়ে ওঠার কথা।
একটা ছোট উদাহরণ দিই। স্বাধীনতার পর কিউবার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকালে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।’
এই হিমালয়প্রতীম মহান এক রাজনৈতিক কবির কালজয়ী কবিতা নিয়েই আজকের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। আর তা হলো ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। এ ভাষণের ঐতিহাসিক পটভূমিকায় যাওয়ার আগে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের এক প্রথিতযশা কবি নির্মলেন্দু গুণের লিখিত ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতার কিছু অংশ উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। কবির ভাষায়—
...একটি কবিতা পড়া হবে তার জন্যে কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের।
‘কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি?’
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে ত্বরিতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি:
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিপুলসংখ্যক মানুষের সামনে দেওয়া ১৮ মিনিটের অলিখিত ভাষণটি বাঙালির হৃদয়ে তখন যে দাগ কেটেছিল, সেই অভিব্যক্তিই ফুটে উঠেছে কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতায়। একজন চারণ কবির মতো অবলীলায় বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের পাঁচালি এক সুনিপুণ ঢঙে। তাঁর সম্মুখে ছিল না কোনো স্ক্রিপ্ট। তাঁর সামনে কেবল ছিল বিপুলসংখ্যক স্বাধীনতাকামী মানুষের বিশাল ক্যানভাস। সেই ১৮ মিনিট তিনি সত্যিকারের এক কবির মতো উপস্থিত সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন।
২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেসকো কর্তৃক ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি পায় ভাষণটি। এই স্বীকৃতিতে বাঙালি হিসেবে আমরা হয়েছি গর্বিত। কিন্তু আসলেই কি তাই? আসলেই কি কেবল আমরা গর্বিত হয়েছি, নাকি ইউনেসকো কালজয়ী এই ভাষণকে তাদের আর্কাইভে রাখতে পেরে ঋদ্ধ হয়েছে?
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ইতিহাস প্রতিশোধ নেয়। ইতিহাস সত্যকে তুলে ধরে। যতই তা মুছতে চেষ্টা করুক, ইতিহাস তার সত্য স্থানটা অবশ্যই করে নেবে। আজকে সেই স্বীকৃতি বাংলাদেশ পেয়েছে।’
লেখক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ২০১৭ সালের ১৮ নভেম্বর এনটিভিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউনেসকোর এই স্বীকৃতির কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘অনেক সময় আমরা যাঁকে পুরস্কার দিই, তাঁকে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করি। অনেক সময় উল্টোটা হয়। যিনি পুরস্কার গ্রহণ করেন, তিনি প্রতিষ্ঠানকে সম্মানিত করেন। ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুর ভাষণটাকে গ্রহণ করে, বঙ্গবন্ধুকে সম্মানিত করেছে, বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছে। কিন্তু আমি বলব, ইউনেসকো সম্মানিত হয়েছে। তারা বলতে পারবে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণটি এখন আমাদের কাছে আছে।’
বস্তুত এ মহাকাব্যিক ভাষণের প্রথম স্বীকৃতি মেলে ২০১৩ সালে প্রকাশিত জ্যাকব এফ ফিল্ডের ‘We Shall Fight on the Beaches: The Speeches that Inspired History’ শীর্ষক গ্রন্থে। এতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩১ অব্দ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২ হাজার ৫০০ বছরের যুদ্ধকালীন উদ্দীপনামূলক ঐতিহাসিক ভাষণগুলোর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। গ্রন্থটিতে গ্রিক রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস থেকে শুরু করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের ভাষণ স্থান পেয়েছে। ১৯৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর গেটিসবার্গে দেওয়া আব্রাহাম লিংকনের সেই ভাষণ, অথবা ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’, এমনকি উইনস্টন চার্চিলের ১৯৪০ সালের ৪ জুন প্রদত্ত ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস’ বক্তব্যের সঙ্গে যদি তুলনা করা যায়, তবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিকে অনেক দৃষ্টিকোণ থেকেই এগিয়ে রাখতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধে নিহত ইউনিয়নপন্থী সৈনিকদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধের ফলক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আব্রাহাম লিংকন এবং কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনদের সমানাধিকার নিয়ে আয়োজিত সমাবেশে লুথার কিং যে বক্তব্য দেন, সেসব অনুষ্ঠানে লিংকন বা কিং কেউই প্রধান বক্তা ছিলেন না। এমনকি যে ভাষণের জন্য চার্চিল উল্লেখিত গ্রন্থে স্থান পেয়েছেন, সেই একই বিষয়ের ওপর তিনি ১৯৪০ সালের ১০ মে কোয়ালিশন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্রিটিশ আইনসভায় ১৯৪৯ সালের ১৩ মে থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত চারটি ভাষণ দেন। আবার লুথার কিংয়ের ভাষণটি ছিল লিখিত। সবকিছু মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি সর্বশ্রেষ্ঠ।
প্রথমত, অন্য যে তিনটি ভাষণের তথা বক্তব্যের কথা বলা হয়েছে, তাতে লিংকন, কিংবা চার্চিল না হয়ে অন্য কেউ দিলেও চলত। কিন্তু পরিবেশ আর প্রেক্ষাপট বিচারে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ লিখিত আকারে তিনি ব্যতীত অন্য কেউ দিলে তা সময়ের দাবি মেটাতে পারত কি? দ্বিতীয়ত, এ ভাষণটি ছিল সম্পূর্ণ অলিখিত।
আমি এ লেখার শুরুতেই বলেছি, বঙ্গবন্ধু এ ভাষণটি এমনভাবে দেন, যেন তিনি এক চারণকবির মতো সদ্য রচিত কবিগান গাইছেন। সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো—এ ভাষণে বঙ্গবন্ধু পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এখানেই এ ভাষণের মূল মাহাত্ম্য। বঙ্গবন্ধুর কাছে তথ্য ছিল যে যদি তিনি রেসকোর্সের সেই জনসভায় সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, তবে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা জনসভায় থাকা মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ করতে পারে। একদিকে মুক্তিকামী জনতার অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা, অন্যদিকে সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কা। প্রত্যাশা আর শঙ্কার দ্বিমুখী চাপের মধ্যেও বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে অক্লেশে যে কথাগুলো বলে গেলেন, তা কেবল এক নির্ভীক কবি, এক অকুতোভয় জননেতাই বলতে পারেন। অন্য কোনো ভাষণের ক্ষেত্রে আমরা এমনটি দেখতে পাই না। আর তাই এ ভাষণ ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ।
এবার আসা যাক এ ঐতিহাসিক ভাষণের মূল পটভূমিকায়। কেন সেদিন সেই জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল, কেন সেদিন এত বিপুল মানুষ সমবেত হয়েছিল রমনার সেই রেসকোর্স ময়দানে, আর কেনই-বা সেদিন বঙ্গবন্ধু শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকলেও দৃপ্ত পায়ে হেঁটে এসেছিলেন মঞ্চে; শুনিয়েছিলেন তাঁর ‘অমর কবিতাখানি’? ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানের বাংলাদেশ) তো বটেই, সমগ্র পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয় পায়। কিন্তু তৎকালীন ইয়াহিয়া সরকার আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা টালবাহানা শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু ঢাকায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা ব্যর্থ হলে এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বয়কটের ঘোষণা দিয়ে দুই প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান করেন। আর এরই ধারাবাহিকতায় ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দিলে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদের জরুরি সভায় ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল এবং ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে জনসভা আহ্বান করা হয়। এমন এক উত্তেজনাকর প্রেক্ষাপটেই রচিত হয়েছিল ৭ মার্চের সেই ভাষণ।
বিশ্বের অন্য সব বিখ্যাত ভাষণের সঙ্গে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের তুলনা আগেই করা হয়েছে। এ পর্যায়ে এ ভাষণের কিছু চুম্বক অংশের ওপর আলোকপাত করব। আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের মূল অংশ যদি ‘...government of the people, by the people, for the people...’ হয়ে থাকে, তবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে এমন অসংখ্য উদ্দীপনামূলক বাক্য। আগেই বলেছি বঙ্গবন্ধু দ্বিমুখী চাপের মধ্যে এ ভাষণটি দেন। এ ভাষণে বঙ্গবন্ধু দুটি চাপই অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে সামলেছেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যাওয়ার জন্য চারটি শর্ত (‘...অ্যাসেম্বলিলি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে; ১) সামরিক আইন মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে,২) সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত যেতে হবে,৩) যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে এবং ৪) আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।’ ) জুড়ে দিয়ে যেমন তিনি পাকিস্তানি শাসক এবং বহির্বিশ্বের বৈরী শক্তির দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিলেন, তেমনি ভাষণের একেবারে অন্তিম লগ্নে ‘...এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাও দিয়ে দিলেন। তাঁর এই কৌশলের কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও জাতির জনককে চতুর হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
ওই প্রতিবেদনে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেল, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না।’ বঙ্গবন্ধু সেদিন বিদেশি সাংবাদিকসহ বহির্বিশ্বের সামনে যেমন তাঁর অবস্থান সুস্পষ্ট করেছিলেন, তেমনি স্বাধীনতাকামী মানুষকে ভবিষ্যতের সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য দিকনির্দেশনাও দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘...তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে, সবকিছু আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’
আজ যাঁরা বলেন, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের আগে জাতিকে কোনো দিকনির্দেশনা দেননি; জাতিকে পাকিস্তানি হায়েনাদের সামনে রেখে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে কৌশলে অন্তরীণ ছিলেন; আর হঠাৎ করে এক সেনা কর্মকর্তা এসে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জাতিকে উদ্ধার করেছেন; জাতিকে পথ দেখিয়েছেন, তাঁরা যেন ৭ মার্চের এই ভাষণ কয়েকবার শুনে দেখেন। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা তো দিয়েছিলেনই, এর পাশাপাশি পাকিস্তানি শাসককে সরাসরি চ্যালেঞ্জও জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘...সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ আর এভাবে ভাষণটি হয়ে উঠেছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা।
এত দূর যা বললাম, তাতে ৭ মার্চের ভাষণকে নির্দ্বিধায় এক মহাকাব্য বলা যায়। সময়, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতার বিচারে এ ভাষণ হোমারের ‘ওডিসি’ অথবা ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’ হতে কোনো অংশে কম নয়। লেখার শুরুতেই কবি ও কবিতার কথা কেন বলেছিলাম, পাঠকের বোধ হয় তা এখন আর বুঝতে বাকি নেই। বাঙালি জাতি হিসেবে এটা আমাদের শ্লাঘার বিষয় যে বঙ্গবন্ধুর মতো এমন এক রাজনৈতিক কবিকে আমরা পেয়েছিলাম, যাঁর আঙুলের ইশারা কবির কলম চালানোর মতো এ দেশের সবুজ জমিনে রচনা করেছিল স্বাধীনতার কাব্যকথা।
তথ্যসূত্র:
১। অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান
২। ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য ৭ মার্চের ভাষণ’, ডয়চেভেলে, ১৮ নভেম্বর ২০১৭
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আমি আজ এমন এক কবির কথা বলছি, যিনি তাঁর জীবদ্দশায় কোনো কবিতা লেখেননি, অথবা অন্য কবিদের মতো স্বপ্নে পাওয়া কোনো চরণ কবিতার খাতায় লিপিবদ্ধ করেননি। তারপরও তিনি কবি। তাঁর তুলনা চলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। কবিগুরুর দর্শন যাঁর জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তবে তিনি কবিগুরু থেকে একদিকে এগিয়ে গেছেন। কবিগুরু ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়া তাঁর জন্মভূমিকে দেখে যেতে পারেননি, কিন্তু আমাদের এ কবি তা পেরেছিলেন। শুধু পেরেছিলেন বললে কম বলা হবে, তিনি তাঁর জন্মভূমির স্বাধীনতা অর্জনে পুরো বাঙালি জাতিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
আমি আর কেউ নয়, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বলছি। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পুরোটাই কোনো মহাকাব্য থেকে কোনো অংশে কম নয়। রাজনীতির এই মহাকবির বিষয়ে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রথিতযশা ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় তাঁদের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। তাঁদের বক্তব্যে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর বিশালতার কথা, তাঁর মহাকবি হয়ে ওঠার কথা।
একটা ছোট উদাহরণ দিই। স্বাধীনতার পর কিউবার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকালে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।’
এই হিমালয়প্রতীম মহান এক রাজনৈতিক কবির কালজয়ী কবিতা নিয়েই আজকের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। আর তা হলো ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। এ ভাষণের ঐতিহাসিক পটভূমিকায় যাওয়ার আগে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের এক প্রথিতযশা কবি নির্মলেন্দু গুণের লিখিত ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতার কিছু অংশ উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। কবির ভাষায়—
...একটি কবিতা পড়া হবে তার জন্যে কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের।
‘কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি?’
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে ত্বরিতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি:
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিপুলসংখ্যক মানুষের সামনে দেওয়া ১৮ মিনিটের অলিখিত ভাষণটি বাঙালির হৃদয়ে তখন যে দাগ কেটেছিল, সেই অভিব্যক্তিই ফুটে উঠেছে কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতায়। একজন চারণ কবির মতো অবলীলায় বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের পাঁচালি এক সুনিপুণ ঢঙে। তাঁর সম্মুখে ছিল না কোনো স্ক্রিপ্ট। তাঁর সামনে কেবল ছিল বিপুলসংখ্যক স্বাধীনতাকামী মানুষের বিশাল ক্যানভাস। সেই ১৮ মিনিট তিনি সত্যিকারের এক কবির মতো উপস্থিত সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন।
২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেসকো কর্তৃক ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি পায় ভাষণটি। এই স্বীকৃতিতে বাঙালি হিসেবে আমরা হয়েছি গর্বিত। কিন্তু আসলেই কি তাই? আসলেই কি কেবল আমরা গর্বিত হয়েছি, নাকি ইউনেসকো কালজয়ী এই ভাষণকে তাদের আর্কাইভে রাখতে পেরে ঋদ্ধ হয়েছে?
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ইতিহাস প্রতিশোধ নেয়। ইতিহাস সত্যকে তুলে ধরে। যতই তা মুছতে চেষ্টা করুক, ইতিহাস তার সত্য স্থানটা অবশ্যই করে নেবে। আজকে সেই স্বীকৃতি বাংলাদেশ পেয়েছে।’
লেখক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ২০১৭ সালের ১৮ নভেম্বর এনটিভিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউনেসকোর এই স্বীকৃতির কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘অনেক সময় আমরা যাঁকে পুরস্কার দিই, তাঁকে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করি। অনেক সময় উল্টোটা হয়। যিনি পুরস্কার গ্রহণ করেন, তিনি প্রতিষ্ঠানকে সম্মানিত করেন। ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুর ভাষণটাকে গ্রহণ করে, বঙ্গবন্ধুকে সম্মানিত করেছে, বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছে। কিন্তু আমি বলব, ইউনেসকো সম্মানিত হয়েছে। তারা বলতে পারবে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণটি এখন আমাদের কাছে আছে।’
বস্তুত এ মহাকাব্যিক ভাষণের প্রথম স্বীকৃতি মেলে ২০১৩ সালে প্রকাশিত জ্যাকব এফ ফিল্ডের ‘We Shall Fight on the Beaches: The Speeches that Inspired History’ শীর্ষক গ্রন্থে। এতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩১ অব্দ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২ হাজার ৫০০ বছরের যুদ্ধকালীন উদ্দীপনামূলক ঐতিহাসিক ভাষণগুলোর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। গ্রন্থটিতে গ্রিক রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস থেকে শুরু করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের ভাষণ স্থান পেয়েছে। ১৯৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর গেটিসবার্গে দেওয়া আব্রাহাম লিংকনের সেই ভাষণ, অথবা ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’, এমনকি উইনস্টন চার্চিলের ১৯৪০ সালের ৪ জুন প্রদত্ত ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস’ বক্তব্যের সঙ্গে যদি তুলনা করা যায়, তবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিকে অনেক দৃষ্টিকোণ থেকেই এগিয়ে রাখতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধে নিহত ইউনিয়নপন্থী সৈনিকদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধের ফলক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আব্রাহাম লিংকন এবং কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনদের সমানাধিকার নিয়ে আয়োজিত সমাবেশে লুথার কিং যে বক্তব্য দেন, সেসব অনুষ্ঠানে লিংকন বা কিং কেউই প্রধান বক্তা ছিলেন না। এমনকি যে ভাষণের জন্য চার্চিল উল্লেখিত গ্রন্থে স্থান পেয়েছেন, সেই একই বিষয়ের ওপর তিনি ১৯৪০ সালের ১০ মে কোয়ালিশন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্রিটিশ আইনসভায় ১৯৪৯ সালের ১৩ মে থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত চারটি ভাষণ দেন। আবার লুথার কিংয়ের ভাষণটি ছিল লিখিত। সবকিছু মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি সর্বশ্রেষ্ঠ।
প্রথমত, অন্য যে তিনটি ভাষণের তথা বক্তব্যের কথা বলা হয়েছে, তাতে লিংকন, কিংবা চার্চিল না হয়ে অন্য কেউ দিলেও চলত। কিন্তু পরিবেশ আর প্রেক্ষাপট বিচারে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ লিখিত আকারে তিনি ব্যতীত অন্য কেউ দিলে তা সময়ের দাবি মেটাতে পারত কি? দ্বিতীয়ত, এ ভাষণটি ছিল সম্পূর্ণ অলিখিত।
আমি এ লেখার শুরুতেই বলেছি, বঙ্গবন্ধু এ ভাষণটি এমনভাবে দেন, যেন তিনি এক চারণকবির মতো সদ্য রচিত কবিগান গাইছেন। সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো—এ ভাষণে বঙ্গবন্ধু পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এখানেই এ ভাষণের মূল মাহাত্ম্য। বঙ্গবন্ধুর কাছে তথ্য ছিল যে যদি তিনি রেসকোর্সের সেই জনসভায় সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, তবে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা জনসভায় থাকা মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ করতে পারে। একদিকে মুক্তিকামী জনতার অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা, অন্যদিকে সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কা। প্রত্যাশা আর শঙ্কার দ্বিমুখী চাপের মধ্যেও বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে অক্লেশে যে কথাগুলো বলে গেলেন, তা কেবল এক নির্ভীক কবি, এক অকুতোভয় জননেতাই বলতে পারেন। অন্য কোনো ভাষণের ক্ষেত্রে আমরা এমনটি দেখতে পাই না। আর তাই এ ভাষণ ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ।
এবার আসা যাক এ ঐতিহাসিক ভাষণের মূল পটভূমিকায়। কেন সেদিন সেই জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল, কেন সেদিন এত বিপুল মানুষ সমবেত হয়েছিল রমনার সেই রেসকোর্স ময়দানে, আর কেনই-বা সেদিন বঙ্গবন্ধু শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকলেও দৃপ্ত পায়ে হেঁটে এসেছিলেন মঞ্চে; শুনিয়েছিলেন তাঁর ‘অমর কবিতাখানি’? ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানের বাংলাদেশ) তো বটেই, সমগ্র পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয় পায়। কিন্তু তৎকালীন ইয়াহিয়া সরকার আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা টালবাহানা শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু ঢাকায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা ব্যর্থ হলে এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বয়কটের ঘোষণা দিয়ে দুই প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান করেন। আর এরই ধারাবাহিকতায় ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দিলে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদের জরুরি সভায় ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল এবং ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে জনসভা আহ্বান করা হয়। এমন এক উত্তেজনাকর প্রেক্ষাপটেই রচিত হয়েছিল ৭ মার্চের সেই ভাষণ।
বিশ্বের অন্য সব বিখ্যাত ভাষণের সঙ্গে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের তুলনা আগেই করা হয়েছে। এ পর্যায়ে এ ভাষণের কিছু চুম্বক অংশের ওপর আলোকপাত করব। আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের মূল অংশ যদি ‘...government of the people, by the people, for the people...’ হয়ে থাকে, তবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে এমন অসংখ্য উদ্দীপনামূলক বাক্য। আগেই বলেছি বঙ্গবন্ধু দ্বিমুখী চাপের মধ্যে এ ভাষণটি দেন। এ ভাষণে বঙ্গবন্ধু দুটি চাপই অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে সামলেছেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যাওয়ার জন্য চারটি শর্ত (‘...অ্যাসেম্বলিলি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে; ১) সামরিক আইন মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে,২) সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত যেতে হবে,৩) যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে এবং ৪) আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।’ ) জুড়ে দিয়ে যেমন তিনি পাকিস্তানি শাসক এবং বহির্বিশ্বের বৈরী শক্তির দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিলেন, তেমনি ভাষণের একেবারে অন্তিম লগ্নে ‘...এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাও দিয়ে দিলেন। তাঁর এই কৌশলের কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও জাতির জনককে চতুর হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
ওই প্রতিবেদনে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেল, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না।’ বঙ্গবন্ধু সেদিন বিদেশি সাংবাদিকসহ বহির্বিশ্বের সামনে যেমন তাঁর অবস্থান সুস্পষ্ট করেছিলেন, তেমনি স্বাধীনতাকামী মানুষকে ভবিষ্যতের সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য দিকনির্দেশনাও দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘...তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে, সবকিছু আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’
আজ যাঁরা বলেন, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের আগে জাতিকে কোনো দিকনির্দেশনা দেননি; জাতিকে পাকিস্তানি হায়েনাদের সামনে রেখে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে কৌশলে অন্তরীণ ছিলেন; আর হঠাৎ করে এক সেনা কর্মকর্তা এসে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জাতিকে উদ্ধার করেছেন; জাতিকে পথ দেখিয়েছেন, তাঁরা যেন ৭ মার্চের এই ভাষণ কয়েকবার শুনে দেখেন। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা তো দিয়েছিলেনই, এর পাশাপাশি পাকিস্তানি শাসককে সরাসরি চ্যালেঞ্জও জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘...সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ আর এভাবে ভাষণটি হয়ে উঠেছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা।
এত দূর যা বললাম, তাতে ৭ মার্চের ভাষণকে নির্দ্বিধায় এক মহাকাব্য বলা যায়। সময়, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতার বিচারে এ ভাষণ হোমারের ‘ওডিসি’ অথবা ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’ হতে কোনো অংশে কম নয়। লেখার শুরুতেই কবি ও কবিতার কথা কেন বলেছিলাম, পাঠকের বোধ হয় তা এখন আর বুঝতে বাকি নেই। বাঙালি জাতি হিসেবে এটা আমাদের শ্লাঘার বিষয় যে বঙ্গবন্ধুর মতো এমন এক রাজনৈতিক কবিকে আমরা পেয়েছিলাম, যাঁর আঙুলের ইশারা কবির কলম চালানোর মতো এ দেশের সবুজ জমিনে রচনা করেছিল স্বাধীনতার কাব্যকথা।
তথ্যসূত্র:
১। অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান
২। ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য ৭ মার্চের ভাষণ’, ডয়চেভেলে, ১৮ নভেম্বর ২০১৭
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে নীতিনির্ধারণী একটি বিষয় অগ্রাধিকার বিবেচনার জন্য অপেক্ষমাণ আছে, আর তা হলো, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তন করা, নাকি যথাশিগগির নির্বাচন আয়োজন করা? অনেক ধরনের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তনের জন্য জাতীয় সংসদের বিকল্প কিছু আছে বলে মনে হয় না।
১২ ঘণ্টা আগেকিছু কিছু বিতর্ক তৈরি করা হয় সমসাময়িক বিষয় থেকে দৃষ্টি দূরে সরিয়ে রাখার জন্য। পুরো পাকিস্তান আমলেই রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে বিতর্ক জারি রাখা হয়েছিল। আমলাতন্ত্র আর সামরিক আমলাতন্ত্র মিলে পাকিস্তান নামক দেশটায় যে স্বৈরশাসন কায়েম করে রেখেছিল, সেদিকে যেন সচেতন মানুষের চোখ না যায়, সে অভিসন্ধি থেকেই রবীন্দ্রনাথ
১২ ঘণ্টা আগেএকটি কলা। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। একটি সাধারণ কলা, যা নিলামে বিক্রি হলো ৭৪ কোটি টাকায়। এটি শিল্প, না কৌতুক, না সামাজিক শ্লেষ—নাকি তিনটির মিশেল? ইতালীয় শিল্পী মরিজিও ক্যাটালানের এই ‘কমেডিয়ান’ আমাদের শিল্পের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আর বাজারজাত সৃজনশীলতার প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।
১২ ঘণ্টা আগে‘গণতন্ত্র মঞ্চ’র অন্যতম নেতা সাইফুল হক বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্র ঐক্য ফোরামের নেতা ছিলেন। তিনি পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন। এখন পর্যন্ত ২০টি বই লিখেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার এবং দেশের রাজনীতি নিয়ে...
১ দিন আগে