প্রবীণের মানবাধিকার রক্ষায় প্রজন্মের ভূমিকা

হাসান আলী
প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২৩, ১২: ৪৩
আপডেট : ০১ অক্টোবর ২০২৩, ১২: ৪৩

জাতিসংঘ ১ অক্টোবরকে ১৯৯১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। প্রতিবছরই দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরতে মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় প্রবীণদের জন্য প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণে প্রজন্মের ভূমিকা’। মানবাধিকার হলো জন্মসূত্রে মানুষ যেসব অধিকার  লাভ করে। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের মুখবন্ধে লেখা হয়েছে, ‘মানুষ যাতে অত্যাচার ও উৎপীড়নের মুখে সর্বশেষ উপায় হিসেবে বিদ্রোহ করতে বাধ্য না হয়, সে জন্য আইনের শাসন দ্বারা মানবাধিকার সংরক্ষণ করা অতি জরুরি।

ধারা ২৫(১) বলা হয়েছে, ‘খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় সমাজকল্যাণ কার্যাদির সুযোগ এবং এর সঙ্গে পীড়া, অক্ষমতা, বৈধব্য, বার্ধক্য অথবা জীবনযাপনে অনিবার্য কারণে সংঘটিত অন্যান্য অপারগতার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং বেকার হলে নিরাপত্তার অধিকারসহ নিজের এবং নিজের পরিবারের স্বাস্থ্য এবং কল্যাণের জন্য পর্যাপ্ত জীবন মানের অধিকার প্রত্যেকের রয়েছে।’

পৃথিবীজুড়ে প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দুই কোটি হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো বার্ধক্য মোকাবিলা করার নানান রকমের প্রস্তুতি নিয়েছে।

বাংলাদেশে প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩, পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন-২০২৩, বয়স্ক ভাতা, প্রবীণ নিবাস, বৃদ্ধাশ্রম, প্রবীণ হাসপাতাল ইত্যাদি করা হয়েছে। প্রবীণদের স্বস্তিদায়ক ও শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্য আরও কিছু করার বাকি রয়েছে। বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জ দিন দিন তীব্র আকার ধারণ করেছে।

এবারের আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের প্রতিপাদ্যের আলোকে কিছু কথা বলা খুবই জরুরি জরুরি বলে মনে করছি।

স্পেনের মাদ্রিদে ২০০২ সালে ১৫৯ দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে প্রবীণবিষয়ক দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নাগরিক হিসেবে প্রবীণেরা যাতে পূর্ণ অধিকার, নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে সমাজের সবক্ষেত্রে কাজ করতে পারেন, সেদিকে লক্ষ রেখে বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের জন্য বিশ্ব সম্মেলনের ঘোষণাগুলো গ্রহণ করেছে এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। প্রবীণবিষয়ক দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে একবিংশ শতাব্দীতে তিনটি অগ্রাধিকারমূলক নির্দেশক অনুসরণ করে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। এগুলো হলো ১. প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও উন্নয়ন। ২. প্রবীণ বয়সে স্বাস্থ্য ও সচ্ছলতা বৃদ্ধি। ৩. প্রবীণদের জন্য সক্ষমতা ও সহায়তামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করা।

সম্মেলনে রাষ্ট্রগুলো ১৮ ক্ষেত্র এবং ২৩৯টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে সম্মত হয়েছে।

প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও উন্নয়ন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, জীবনব্যাপী শিক্ষা, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অংশগ্রহণ বা অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখতে প্রবীণদের উৎসাহিত করতে বিভিন্ন সুযোগ, কর্মসূচি বা সহায়তা প্রদান করা। সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য মানবাধিকার সনদগুলো বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে সব মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার ভোগ নিশ্চিত করা।

কর্মক্ষম বয়সী জনগোষ্ঠীর শ্রমবাজারে সক্রিয় থাকার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ, যাতে শেষ জীবনে নির্ভরশীলতা বা কাজ থেকে ছাঁটাই হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। কোনো ধরনের বৈষম্য, বিশেষ করে জেন্ডারবৈষম্য ছাড়া ঋণের সুযোগ নিশ্চিত করে ছোট ও ক্ষুদ্র উদ্যোগে উন্নয়নের মাধ্যমে প্রবীণদের আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা। আর্থিক, অবকাঠামোগত সেবা খাত এবং খামার কৌশল ও প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ অব্যাহত রাখার মাধ্যমে প্রবীণ কৃষকদের সক্ষমতা আরও জোরদার করা। অর্থনৈতিক সম্পর্কে অংশীদার ও নিয়ন্ত্রণের সমান অধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রবীণ নারীদের অধিকার নিশ্চিত করা। অভিবাসিত দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে প্রবীণ অভিবাসীদের অঙ্গীভূত করা এবং তাদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও কর্মসূচি প্রণয়ন করা।

প্রশ্ন হলো, গত ২০ বছরে উন্নত বিশ্ব এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রবীণের মানবাধিকার রক্ষায় কী ভূমিকা পালন করেছে? কার্যত তেমন কোনো ভূমিকা কিংবা উল্লেখযোগ্য কোনো চেষ্টা করেনি।

প্রবীণ জীবনকে দুর্বিষহ করার হাত থেকে রক্ষা করতে বরং নির্লিপ্ত থাকতে দেখা গেছে। অতিমারি করোনাকালে প্রবীণেরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু প্রবীণদের হয়েছে। চিকিৎসা, সেবা, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াসহ নানান বিষয়ে অসম্মান, অমর্যাদার শিকার হতে দেখা গেছে। সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়, নির্মাণ, তৈরি, সরবরাহ ইত্যাদিতে মনোযোগ গভীর থেকে আরও গভীর হচ্ছে। দেশে দেশে  দমন-পীড়ন চালাতে কোনো ধরনের রাখঢাক নেই। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আন্তর্জাতিক মহলের উদাসীনতা দৃশ্যমান। সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে গুটিকয়েক মানুষের হাতে। ফলে সামাজিক ভারসাম্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। উন্নত দেশগুলো চায় পুরো পৃথিবীর হর্তাকর্তা, দণ্ডমুণ্ডের মালিক হতে। সারা পৃথিবী আজ বৈষম্যের জালে আটকা পড়েছে। বৈষম্য বজায় রেখে মানবাধিকারের চর্চা করা প্রায় অসম্ভব একটা বিষয়। পৃথিবীর ওপর সব মানুষের অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার আঞ্চলিকতা বা জাতিগত স্বার্থ রক্ষার জন্য বিসর্জন দেওয়া যায় না। হাজার তরুণ প্রতিনিয়ত সাগর পাড়ি দিয়ে কিংবা জঙ্গল ডিঙিয়ে জীবনকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ করে পিতা-মাতার চোখের পানি ঝরায়। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে সামরিক বা বেসামরিক  লোকজন হতাহত হচ্ছে, যা তাদের প্রবীণ মা-বাবার ব্যথা-বেদনা, দুঃখ-দুর্দশা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য করণীয় নির্ধারণে আমাদের নীরবতা ভাঙে না। প্রবীণের মানবাধিকার রক্ষায় প্রজন্মের ভূমিকা হলো গোটা পৃথিবীতে বিরাজমান অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, বৈষম্য, শোষণ, নিপীড়নকে চ্যালেঞ্জ জানানো। 

লেখক: প্রবীণবিষয়ক লেখক, গবেষক ও সংগঠক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি চাকরিজীবীরা সম্পদের হিসাব না দিলে যেসব শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন

ভারতের পাল্টা আক্রমণে দিশেহারা অস্ট্রেলিয়া

ঢাকা কলেজে সংঘর্ষকালে বোমা বিস্ফোরণের ছিটকে পড়েন সেনাসদস্য—ভাইরাল ভিডিওটির প্রকৃত ঘটনা

ঐশ্বরিয়ার বিচ্ছেদের খবরে মুখ খুললেন অমিতাভ

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত