জাহীদ রেজা নূর
নিউইয়র্কের রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে মনেই হচ্ছে না এখানে একটা বিশাল ঘটনা ঘটে গেছে। নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের এ রকম ভরাডুবি হবে, সে কথা কেউ ভাবতে পারেনি, কিন্তু তার কোনো প্রকাশ চলতি পথে দেখা যাচ্ছে না। জীবনযাপনে যেন তার কোনো রেখাপাত নেই। তবে, নিবিড় গণ্ডিতে এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না, তা নয়।
মার্কিনরা তাদের দেশে নারী প্রেসিডেন্টের জন্য এখনো প্রস্তুত নয়—এ রকম একটা আলোচনা চলছে। এর পেছনে বর্ণবাদ আছে কি না, সেটাও ভাবছেন কেউ কেউ। আল গোর ও হিলারি ক্লিনটন নির্বাচনে হেরে গেলেও পপুলার ভোট পেয়েছিলেন প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি। কমলা হ্যারিস শ্বেতাঙ্গিনী নন বলেই কি পপুলার ভোটেও হারলেন? নাকি মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ইত্যাদি নিয়ে বাইডেন সরকার দিশেহারা ছিল বলে তার বলি হলেন কমলা? আলোচনার শেষ নেই।
মার্কিনদের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসছে কি না, তা নিয়েও জল্পনা-কল্পনা চলছে। তার সবই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। তা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই।
লেবাননের পত্রিকা রাসিফ ২২ মনে করছে, মার্কিন দেশে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় বেশ কিছু আরব দেশ খুশি হয়েছে। কিন্তু আরব দেশগুলো যে সমস্যায় নিমজ্জিত, তার সবগুলোর সমাধান করার ক্ষমতা মার্কিন এই ধনী ব্যক্তির নেই। তার পরও তারা ডেমোক্র্যাটদের চেয়ে রিপাবলিকান ট্রাম্পকেই তাদের বন্ধু বলে মনে করে থাকে। বারাক ওবামা ও জো বাইডেনের শাসনামলে মধ্যপ্রাচ্য যে চাপের মধ্যে ছিল, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে তা থেকে বের হতে পারবে তারা।
ওবামা আর বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি আরবদের জন্য ছিল অস্বস্তির। ইরান যে এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় এবং তারা চাইলেই যে এই এলাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে, এটা মনে রেখে মার্কিনরা ওই দেশের অভ্যন্তরেও অন্তহীন দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সুন্নিদের সহায়তায় শিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইন্ধন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ ছিল অর্থনৈতিক স্বার্থ দ্বারা চালিত। সে সময় উপসাগরীয় দেশগুলো ট্রাম্পের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করেছিল। ট্রাম্প সৌদি আরবের সঙ্গে যোগাযোগ প্রসারিত করেছিলেন এবং আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চুক্তিটিও করেছিলেন। রিয়াদ সফরের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব মোট ৩৮০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। তবে সে সময় ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করেননি। ট্রাম্প আসলে সে সময় কী করেছিলেন? তিনি ভারসাম্য রক্ষার রাজনীতি করেছিলেন। উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে করেছিলেন আর্থিক চুক্তি, সেই সঙ্গে চেয়েছেন ইসরায়েলের জন্য সীমাহীন সমর্থন।
রিয়াদের সঙ্গে স্বস্তিকর এই চুক্তি স্বাক্ষরের এক বছর পর ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে করা পারমাণবিক চুক্তি ছিন্ন করেন এবং ইরানের বিরুদ্ধে পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রগুলোকে তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন যে উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজতন্ত্রকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে যাবে। ইরানের সঙ্গে মার্কিনদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার নতুন সময় যে উপস্থিত হয়েছে, তা আরব দেশগুলোও সহজে বুঝেছিল। ট্রাম্প চেয়েছিলেন উপসাগরীয় দেশগুলোর স্বার্থ হাসিলের বিনিময়ে অর্থ, তাই ‘সবাই যা চেয়েছিল তা পেয়েছে।’
ট্রাম্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো আব্রাহাম অ্যাকর্ডস। আব্রাহাম অ্যাকর্ডস হলো ইসরায়েল এবং কিছু আরব রাষ্ট্রের (ইউএই, বাহরাইন, মরক্কো এবং সুদান) মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তির একটি সিরিজ, যা ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যস্থতায় হয়েছিল। এই চুক্তিতে পারস্পরিকভাবে উপকারী হওয়ার মতো যথেষ্ট উপাদান ছিল। তা দেশগুলোর অর্থনৈতিক সহযোগিতার দ্বার উন্মুক্ত করেছিল। সৌদি আরব আর ইসরায়েলও সে রকম একটি চুক্তি স্বাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে ছিল, কিন্তু তা অপারেশন আল-আকসা, হামাস যেখানে অতর্কিতে ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছিল এবং ইসরায়েলি নাগরিকদের অপহরণ করেছিল আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে গাজা উপত্যকা ও লেবাননে ইসরায়েল যে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে, তার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।
২. আরব রাষ্ট্রগুলোর অনেক নেতাই মনে করেন, ট্রাম্পের সঙ্গে কাজ করা ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে কাজ করার তুলনায় অনেক সহজ। বহু আরব রাষ্ট্রই মনে করে, ট্রাম্প গত মেয়াদের মতো এবারও আরব রাষ্ট্রগুলোর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রাখবেন। তাঁদের অনেকেই মনে করেন, ট্রাম্প জানেন কীভাবে সশস্ত্র সংঘাতের অবসান ঘটাতে হয়। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, ট্রাম্প তাঁর প্রথম শাসনামলে বিশ্বের নানা জায়গায় চলা কোনো সংঘাতেরই কোনো স্থায়ী সমাধান করতে পারেননি। ইয়েমেন থেকে ফিলিস্তিন পর্যন্ত এলাকা নিয়ে কথা বলতে গেলে হতাশার কথাই বলতে হয়।
ট্রাম্প ভালো ভালো অর্থনৈতিক চুক্তি করতে পারেন বলে নয়, ট্রাম্প ইরানকে দেখতে পারেন না, এটা জেনেই অনেক আরব দেশ খুশি। তবে এ কথা বলতেই হবে, ২০১৬-২০২০ মেয়াদে ট্রাম্পের সঙ্গে আরব দেশগুলোর যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সেই বাস্তবতা বর্তমানে বদলে গেছে অনেকটা। ট্রাম্পের বিজয়ে আরব দেশগুলো খুশি হয়েছে বটে, কিন্তু এ কথাও ভোলেনি যে, ট্রাম্পের গত মেয়াদেও আরব দেশগুলো ছিল দোদুল্যমান অবস্থায় এবং ট্রাম্পের কাছে তাদের যে প্রত্যাশা ছিল, তা-ও খুব একটা পূরণ হয়নি। ইয়েমেনের সংঘাতের অবসান হয়নি, হুতিরা এখনো পারস্য উপসাগরের বিভিন্ন আরব দেশের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। তাই অনেক আরব দেশই মনে করে, শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে এ সময় এগিয়ে যাওয়া যাবে না, আরও অনেক দিকেই বাড়িয়ে দিতে হবে বন্ধুত্বের হাত। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে তেলের রাজনীতি যে সম্পর্কগুলো গড়ে তুলেছিল, পৃথিবী এখন তা থেকে অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। তেল থেকে যে আয় হবে, সে আয় দিয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করা এবং ভৌগোলিকভাবে প্রাপ্ত খনিজ সম্পদের যথার্থ ব্যবহার করার দিকে আরব দেশগুলো দৃষ্টি দিচ্ছে।
৩. পরিবর্তিত পরিস্থিতিটাও বুঝতে হবে। ২০২৪ সালে চীন ও সৌদি আরবের মধ্যে বাণিজ্য হয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। প্রতিবছরই তা বাড়ছে। দুই দেশের মধ্যে অন্যান্য সম্পর্কও সুদৃঢ় হচ্ছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে পিপলস ব্যাংক অব চায়না এবং সেন্ট্রাল ব্যাংক অব সৌদি আরব ৫০ বিলিয়ন ইউয়ান (৭ বিলিয়ন ডলার) মূল্যের একটি বৈদেশিক মুদ্রা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ডলার ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় কি না, তার একটা পরীক্ষাও এতে হয়ে যাবে। এই চুক্তির গুরুত্ব হলো, এটি চীনের জন্য বিশ্ববাণিজ্যে তার মুদ্রা পরীক্ষা করার দরজা খুলে দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্ববাণিজ্যে ডলার যেভাবে আধিপত্য বিস্তার করে আসছিল, তা থেকে বিশ্ব সরে আসবে কি না, সেটাও এখন ভাবতে হচ্ছে।
সৌদি আরব আর চীনের মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়েছে, অস্ত্র চুক্তি হয়েছে। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সরাসরি আলোচনায় সহযোগিতা করেছে চীন। ফলে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে যে দূরত্ব এসেছিল, তা ক্রমে কেটে যাচ্ছে। চীন, সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তিও হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ আগে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে যৌথ সামরিক প্রশিক্ষণও হয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গেও চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ৫৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ছিল ২০১৮ সালে, ২০২৩ সালে তা উন্নীত হয়েছে ৯৬ বিলিয়ন ডলারে।
জ্বালানি, বিকল্প শক্তির উৎস সন্ধান, জাহাজনির্মাণ, বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে নতুন সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের কারণে দুই দেশের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক বাড়তে থাকবে।
৪. চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের তো সাপে-নেউলে সম্পর্ক। ফলে, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের অগ্রগতির বিষয়টিও এখন ট্রাম্পকে বিবেচনায় রাখতে হবে। আরব বিশ্ব, মূলত পারস্য উপসাগরপারের দেশগুলোর রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ট্রাম্পের সঙ্গে রাশিয়ার পুতিনের ভালো সম্পর্ক, আবার চীনের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে কীভাবে মার্কিন কূটনীতি চলবে, সেটাও এখন দেখার বিষয়। আরব দেশগুলোর সঙ্গেও এরই মধ্যে রাশিয়ার সম্পর্ক গভীর হয়েছে। চীন এখন আরব দেশগুলোর বন্ধু, সুতরাং মধ্যপ্রাচ্যে নিজের প্রভাব বিস্তার করার সময় যুক্তরাষ্ট্রকেও সেই সত্য এড়িয়ে যাওয়া চলবে না। নিজের রাজনীতির সংশোধন প্রয়োজন হতে পারে।
(নিউইয়র্ক থেকে)
উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
নিউইয়র্কের রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে মনেই হচ্ছে না এখানে একটা বিশাল ঘটনা ঘটে গেছে। নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের এ রকম ভরাডুবি হবে, সে কথা কেউ ভাবতে পারেনি, কিন্তু তার কোনো প্রকাশ চলতি পথে দেখা যাচ্ছে না। জীবনযাপনে যেন তার কোনো রেখাপাত নেই। তবে, নিবিড় গণ্ডিতে এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না, তা নয়।
মার্কিনরা তাদের দেশে নারী প্রেসিডেন্টের জন্য এখনো প্রস্তুত নয়—এ রকম একটা আলোচনা চলছে। এর পেছনে বর্ণবাদ আছে কি না, সেটাও ভাবছেন কেউ কেউ। আল গোর ও হিলারি ক্লিনটন নির্বাচনে হেরে গেলেও পপুলার ভোট পেয়েছিলেন প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি। কমলা হ্যারিস শ্বেতাঙ্গিনী নন বলেই কি পপুলার ভোটেও হারলেন? নাকি মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ইত্যাদি নিয়ে বাইডেন সরকার দিশেহারা ছিল বলে তার বলি হলেন কমলা? আলোচনার শেষ নেই।
মার্কিনদের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসছে কি না, তা নিয়েও জল্পনা-কল্পনা চলছে। তার সবই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। তা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই।
লেবাননের পত্রিকা রাসিফ ২২ মনে করছে, মার্কিন দেশে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় বেশ কিছু আরব দেশ খুশি হয়েছে। কিন্তু আরব দেশগুলো যে সমস্যায় নিমজ্জিত, তার সবগুলোর সমাধান করার ক্ষমতা মার্কিন এই ধনী ব্যক্তির নেই। তার পরও তারা ডেমোক্র্যাটদের চেয়ে রিপাবলিকান ট্রাম্পকেই তাদের বন্ধু বলে মনে করে থাকে। বারাক ওবামা ও জো বাইডেনের শাসনামলে মধ্যপ্রাচ্য যে চাপের মধ্যে ছিল, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে তা থেকে বের হতে পারবে তারা।
ওবামা আর বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি আরবদের জন্য ছিল অস্বস্তির। ইরান যে এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় এবং তারা চাইলেই যে এই এলাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে, এটা মনে রেখে মার্কিনরা ওই দেশের অভ্যন্তরেও অন্তহীন দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সুন্নিদের সহায়তায় শিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইন্ধন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ ছিল অর্থনৈতিক স্বার্থ দ্বারা চালিত। সে সময় উপসাগরীয় দেশগুলো ট্রাম্পের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করেছিল। ট্রাম্প সৌদি আরবের সঙ্গে যোগাযোগ প্রসারিত করেছিলেন এবং আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চুক্তিটিও করেছিলেন। রিয়াদ সফরের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব মোট ৩৮০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। তবে সে সময় ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করেননি। ট্রাম্প আসলে সে সময় কী করেছিলেন? তিনি ভারসাম্য রক্ষার রাজনীতি করেছিলেন। উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে করেছিলেন আর্থিক চুক্তি, সেই সঙ্গে চেয়েছেন ইসরায়েলের জন্য সীমাহীন সমর্থন।
রিয়াদের সঙ্গে স্বস্তিকর এই চুক্তি স্বাক্ষরের এক বছর পর ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে করা পারমাণবিক চুক্তি ছিন্ন করেন এবং ইরানের বিরুদ্ধে পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রগুলোকে তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন যে উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজতন্ত্রকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে যাবে। ইরানের সঙ্গে মার্কিনদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার নতুন সময় যে উপস্থিত হয়েছে, তা আরব দেশগুলোও সহজে বুঝেছিল। ট্রাম্প চেয়েছিলেন উপসাগরীয় দেশগুলোর স্বার্থ হাসিলের বিনিময়ে অর্থ, তাই ‘সবাই যা চেয়েছিল তা পেয়েছে।’
ট্রাম্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো আব্রাহাম অ্যাকর্ডস। আব্রাহাম অ্যাকর্ডস হলো ইসরায়েল এবং কিছু আরব রাষ্ট্রের (ইউএই, বাহরাইন, মরক্কো এবং সুদান) মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তির একটি সিরিজ, যা ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যস্থতায় হয়েছিল। এই চুক্তিতে পারস্পরিকভাবে উপকারী হওয়ার মতো যথেষ্ট উপাদান ছিল। তা দেশগুলোর অর্থনৈতিক সহযোগিতার দ্বার উন্মুক্ত করেছিল। সৌদি আরব আর ইসরায়েলও সে রকম একটি চুক্তি স্বাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে ছিল, কিন্তু তা অপারেশন আল-আকসা, হামাস যেখানে অতর্কিতে ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছিল এবং ইসরায়েলি নাগরিকদের অপহরণ করেছিল আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে গাজা উপত্যকা ও লেবাননে ইসরায়েল যে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে, তার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।
২. আরব রাষ্ট্রগুলোর অনেক নেতাই মনে করেন, ট্রাম্পের সঙ্গে কাজ করা ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে কাজ করার তুলনায় অনেক সহজ। বহু আরব রাষ্ট্রই মনে করে, ট্রাম্প গত মেয়াদের মতো এবারও আরব রাষ্ট্রগুলোর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রাখবেন। তাঁদের অনেকেই মনে করেন, ট্রাম্প জানেন কীভাবে সশস্ত্র সংঘাতের অবসান ঘটাতে হয়। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, ট্রাম্প তাঁর প্রথম শাসনামলে বিশ্বের নানা জায়গায় চলা কোনো সংঘাতেরই কোনো স্থায়ী সমাধান করতে পারেননি। ইয়েমেন থেকে ফিলিস্তিন পর্যন্ত এলাকা নিয়ে কথা বলতে গেলে হতাশার কথাই বলতে হয়।
ট্রাম্প ভালো ভালো অর্থনৈতিক চুক্তি করতে পারেন বলে নয়, ট্রাম্প ইরানকে দেখতে পারেন না, এটা জেনেই অনেক আরব দেশ খুশি। তবে এ কথা বলতেই হবে, ২০১৬-২০২০ মেয়াদে ট্রাম্পের সঙ্গে আরব দেশগুলোর যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সেই বাস্তবতা বর্তমানে বদলে গেছে অনেকটা। ট্রাম্পের বিজয়ে আরব দেশগুলো খুশি হয়েছে বটে, কিন্তু এ কথাও ভোলেনি যে, ট্রাম্পের গত মেয়াদেও আরব দেশগুলো ছিল দোদুল্যমান অবস্থায় এবং ট্রাম্পের কাছে তাদের যে প্রত্যাশা ছিল, তা-ও খুব একটা পূরণ হয়নি। ইয়েমেনের সংঘাতের অবসান হয়নি, হুতিরা এখনো পারস্য উপসাগরের বিভিন্ন আরব দেশের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। তাই অনেক আরব দেশই মনে করে, শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে এ সময় এগিয়ে যাওয়া যাবে না, আরও অনেক দিকেই বাড়িয়ে দিতে হবে বন্ধুত্বের হাত। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে তেলের রাজনীতি যে সম্পর্কগুলো গড়ে তুলেছিল, পৃথিবী এখন তা থেকে অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। তেল থেকে যে আয় হবে, সে আয় দিয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করা এবং ভৌগোলিকভাবে প্রাপ্ত খনিজ সম্পদের যথার্থ ব্যবহার করার দিকে আরব দেশগুলো দৃষ্টি দিচ্ছে।
৩. পরিবর্তিত পরিস্থিতিটাও বুঝতে হবে। ২০২৪ সালে চীন ও সৌদি আরবের মধ্যে বাণিজ্য হয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। প্রতিবছরই তা বাড়ছে। দুই দেশের মধ্যে অন্যান্য সম্পর্কও সুদৃঢ় হচ্ছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে পিপলস ব্যাংক অব চায়না এবং সেন্ট্রাল ব্যাংক অব সৌদি আরব ৫০ বিলিয়ন ইউয়ান (৭ বিলিয়ন ডলার) মূল্যের একটি বৈদেশিক মুদ্রা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ডলার ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় কি না, তার একটা পরীক্ষাও এতে হয়ে যাবে। এই চুক্তির গুরুত্ব হলো, এটি চীনের জন্য বিশ্ববাণিজ্যে তার মুদ্রা পরীক্ষা করার দরজা খুলে দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্ববাণিজ্যে ডলার যেভাবে আধিপত্য বিস্তার করে আসছিল, তা থেকে বিশ্ব সরে আসবে কি না, সেটাও এখন ভাবতে হচ্ছে।
সৌদি আরব আর চীনের মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়েছে, অস্ত্র চুক্তি হয়েছে। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সরাসরি আলোচনায় সহযোগিতা করেছে চীন। ফলে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে যে দূরত্ব এসেছিল, তা ক্রমে কেটে যাচ্ছে। চীন, সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তিও হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ আগে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে যৌথ সামরিক প্রশিক্ষণও হয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গেও চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ৫৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ছিল ২০১৮ সালে, ২০২৩ সালে তা উন্নীত হয়েছে ৯৬ বিলিয়ন ডলারে।
জ্বালানি, বিকল্প শক্তির উৎস সন্ধান, জাহাজনির্মাণ, বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে নতুন সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের কারণে দুই দেশের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক বাড়তে থাকবে।
৪. চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের তো সাপে-নেউলে সম্পর্ক। ফলে, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের অগ্রগতির বিষয়টিও এখন ট্রাম্পকে বিবেচনায় রাখতে হবে। আরব বিশ্ব, মূলত পারস্য উপসাগরপারের দেশগুলোর রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ট্রাম্পের সঙ্গে রাশিয়ার পুতিনের ভালো সম্পর্ক, আবার চীনের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে কীভাবে মার্কিন কূটনীতি চলবে, সেটাও এখন দেখার বিষয়। আরব দেশগুলোর সঙ্গেও এরই মধ্যে রাশিয়ার সম্পর্ক গভীর হয়েছে। চীন এখন আরব দেশগুলোর বন্ধু, সুতরাং মধ্যপ্রাচ্যে নিজের প্রভাব বিস্তার করার সময় যুক্তরাষ্ট্রকেও সেই সত্য এড়িয়ে যাওয়া চলবে না। নিজের রাজনীতির সংশোধন প্রয়োজন হতে পারে।
(নিউইয়র্ক থেকে)
উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
যাঁরা একটু পুরোনো আমলের মানুষ, তাঁদের মনে এখনো আমেরিকা-রাশিয়া নিয়ে অনেক আগ্রহ। পৃথিবী বদলে গেছে। এই রাশিয়া যে বিগত সোভিয়েত ইউনিয়নের আদর্শিক উত্তরসূরি নয়, সে কথাও সবাই জানে। তার পরও সত্তর ও আশির দশকের ঠান্ডা লড়াইকালের রাশিয়া-আমেরিকাকেই এখনো মনের মধ্যে স্থান দিয়ে রাখা হয়েছে।
১৭ ঘণ্টা আগেভেবেছিলাম, সমাজ বিনির্মাণে রাজনীতি নিয়ে লিখব। পরে আমার মনে হলো বিনির্মাণ কেন? নির্মাণের আগে যে ‘বি’ উপসর্গটি যুক্ত, তা ইতিবাচক অর্থে ব্যবহার করা হয়। যে দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচকতা বলে আসলে কিছুই আর নেই, সেই সমাজে ‘সমাজ বিনির্মাণে রাজনীতি’ শিরোনাম কি যুক্তিযুক্ত?
১৮ ঘণ্টা আগেপ্রবীণ জীবনে স্ত্রীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেবাযত্ন, ওষুধপত্র, খাবারদাবার ইত্যাদি বিষয়ে স্ত্রীর নজরদারি থাকে। আমাদের সমাজব্যবস্থায় দাম্পত্যজীবনে স্বামীকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার রেওয়াজ চালু রয়েছে। কার্যত সংসারে স্ত্রীর অভিভাবক স্বামী।
১৮ ঘণ্টা আগেপ্রতিদিনের সংবাদপত্রে অসংখ্য খারাপ খবর পাঠ করে পাঠক যখন ক্লান্ত, ত্যক্তবিরক্ত, ঠিক তখন ২৯ নভেম্বর আজকের পত্রিকায় ‘এবার সবচেয়ে চিকন ধান উদ্ভাবন নূরের’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরটি পড়ে পাঠক খুশি হবেন, আনন্দিত হবেন।
১৮ ঘণ্টা আগে