দলের দুপক্ষের সংঘর্ষ রোধ করা যাচ্ছে না কেন

স্বপ্না রেজা
আপডেট : ০৮ নভেম্বর ২০২১, ১৪: ৫৫
Thumbnail image

যেকোনো একটি রাজনৈতিক সংগঠনের অভ্যন্তরে দুই পক্ষের সংঘর্ষ দলের ভেতর সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার কথা কিন্তু বলে না। মানতেই হবে যে তা প্রমাণ করে না। এই অসুস্থতাই ক্রমেই ভয়ংকর একটি রূপ নিয়ে দলকে তো বটেই, দেশ ও জাতিকেও অনিরাপদ করে দিতে পারে। 

রাজনীতিতে পক্ষ ও বিপক্ষ দুটি দল থাকে। অন্যভাবে বললে সরকারি ও বিরোধী দল। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক নেতা, কর্মী ও মতাদর্শ থাকে। থাকতে হয়। এসবের সঙ্গে থাকে আন্দোলন। আরও থাকে সংঘর্ষ, ধরপাকড়। গালিগালাজ, কাদা ছোড়াছুড়িও কম হয় না। দোষারোপের সংস্কৃতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে রাজনৈতিক দলগুলো। কাজের চেয়ে কে চোর, কে মিথ্যাবাদী, কে দেশপ্রেমিক আর কে দেশপ্রেমিক না ইত্যাদি বিষয়ে চলে ঠেলাঠেলি। এই ঠেলাঠেলিটা হয় সাধারণত দলের ওপরের দিকে। আর নিচের দিকে হয় মারামারি, ধস্তাধস্তি, খুনোখুনি।

রাজনৈতিক দলের এসব কাণ্ডকারখানা দেখেন সাধারণ জনগণ। তাঁরাই দর্শক। কখনোসখনো এই সব কাণ্ডকারখানা জনগণকে বিপর্যস্ত করে। বিচলিত করে। অনিরাপদও করে তোলে। নিরীহ মানুষের প্রাণহানি কিংবা ক্ষতির ঘটনাও ঘটে। উদাহরণ আছে বেশ।

অথচ প্রতিটি রাজনৈতিক সংগঠনের থাকে নিজস্ব আদর্শ ও গঠনতন্ত্র। যেখানে জনগণের ও দেশের স্বার্থরক্ষা, কল্যাণের কথা স্পষ্টত উল্লেখ থাকে। বড় নেতারা সেই মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেন কর্মী-সমর্থকদের মাঝে। কর্মীরা হয়ে ওঠেন একপর্যায়ে ছোট নেতা, অতঃপর মাঝারি নেতা। একসময় এমন রাজনৈতিক চর্চা ছিল দৃশ্যমান। ধীরে ধীরে যেন দৃশ্যপট বদলে গেছে।

আদর্শ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য সংগঠনের গঠনতন্ত্রে যা-ই লেখা থাকুক না কেন, রাজনৈতিক আচরণে তা নেই। ওসব মুদ্রিত হয়ে কাগজে আছে। রাজনৈতিক আচরণে তা দেখা যায় না। তাহলে কী দেখা যায়? দেখা যায় সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে যেমন পরস্পরবিরোধী সংঘর্ষ আছে, মতবিরোধ আছে, খুনোখুনি আছে, তেমন সংঘর্ষ, খুনোখুনি আছে একটি দলের ভেতর নিজেদের মধ্যেই। রাজনৈতিক অঙ্গনে শেষ সংঘর্ষটাই, অর্থাৎ নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি, বিরোধটাই মারাত্মক আকার ধারণ করেছে এবং এই সংঘর্ষটা ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক, দলীয় নয়। দেশের স্বার্থতে তো নয়ই। নিজেদের মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক এই সংঘর্ষ বিরোধী দলের ভেতর যেমন আছে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরেও আছে।

এখানে একটা বিষয় প্রমাণিত হয় যে রাজনীতির চর্চাটা দিনে দিনে প্রবলরকম ক্ষমতা ও স্বার্থকেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে ক্ষমতা ও স্বার্থ একেকজন রাজনীতিককে প্রাচুর্য পাইয়ে দেয়, বিত্তবান করে দেয়। মোহাবিষ্ট করে। ফলে আজকাল অনেকেই রাজনীতিকে বিত্তবৈভবের জন্য উত্তম পেশা মনে করে থাকে। ধনী হওয়ার উত্তম ও নিষ্কণ্টক পথ মনে করে। তরুণদের অনেকের কাছেই লোভনীয় পেশা যেন রাজনীতি।

কিছুদিন আগে কোথায় যেন বিএনপির দুটো গ্রুপের ভেতর সংঘর্ষ বাধল। এ রকম ঘটনা নতুন নয়, অতীতেও ঘটেছে। অনেকেই ভাবলেন বিএনপির রাজনৈতিক তৎপরতাটা জনগণমুখী ছিল না, হয়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিন তারা আন্দোলন করেছে খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুতে। অথচ জনগণের পক্ষে আন্দোলনের অনেক ইস্যু ছিল, যেখানে বিএনপির রাজনৈতিক সক্রিয়তা থাকলে হয়তো সাধারণ মানুষের সমর্থন দলটি পেত। নীরব, অনেকটা নিষ্ক্রিয় রাজনৈতিক দল হয়েও নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ থেকে তারা কিন্তু বিরত থাকেনি। যা হোক। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের মধ্যেও সংঘর্ষ হয় এবং তা নিয়ম করে, প্রতিনিয়ত।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মারামারি হয়। এতে শিক্ষার্থী মাহাদি আকিব গুরুতর আহত হন। জানা গেছে, মাথার খুলিতে চরম আঘাতপ্রাপ্ত হন। ফলে ওই দিনই চমেক হাসপাতালে মাহাদির অস্ত্রোপচার হয়। অস্ত্রোপচারের পর মাথার খুলির একটি অংশ তাঁর পেটের চামড়ার নিচে রেখে দেওয়া হয়েছে। পরে সেটা প্রতিস্থাপন করা হবে। মাথার খুলির হাড় প্রসঙ্গে চিকিৎসক বলেছেন, সাধারণ নিয়ম হচ্ছে তিন মাসের মধ্যে হাড় প্রতিস্থাপন করা। তবে দ্রুত ব্রেনের উন্নতি হলে এবং সবকিছু ভালো থাকলে এক মাসে সেটি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। পরিষ্কার যে মাহাদির জখম স্বাভাবিক নয়। ঝুঁকি নেই, তা বলা যায় না। জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে বললে অযৌক্তিক হবে বলে মনে হয় না। যখন লেখাটা লিখছি, তখন মাহাদি চমেকের আইসিইউতে।

মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি কিংবা পাবলিক যেকোনো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীর মেধা ও যোগ্যতা লাগে। সেখানে এমন দুর্ঘটনা অভিভাবকদের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। গোটা জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। দেশ মেধাশূন্য হয়ে পড়ার নিশ্চিত আশঙ্কা। আমরা কি তাই-ই চাইছি? আমি বড় নেতাদের কাছে প্রশ্ন রাখছি। যত দূর পত্রিকান্তরে জানা গেছে, মাহাদি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী পক্ষের সমর্থক। আর যাঁরা মাহাদিকে আঘাত করেছেন, তাঁরা সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সমর্থক। এই ঘটনায় পাল্টাপাল্টি মামলা করা হয়েছে এবং তা চমেকের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। যেহেতু এই শিক্ষার্থীরা দুই পক্ষের সমর্থক। যে নেতাদের অনুসারী হয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা জীবন বাজি রেখে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হলেন, তাঁরা আদতে কেমন নেতা, তার একটা মূল্যায়ন হওয়া জরুরি এবং তা রাজনৈতিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে।

কী এমন কারণ থাকে যাতে কিনা এমন দুর্ধর্ষ ও প্রাণহানিকর ঘটনায় ছাত্র, সমর্থক ও অনুসারীদের লিপ্ত হতে হয়! এমন নেতাদের দিয়ে দেশের তো নয়-ই, দলেরও কোনো উপকারে আসে না। সংঘাত, স্বার্থদ্বন্দ্ব কখন সমর্থক, অনুসারীদের মধ্যে জেগে ওঠে, তা খতিয়ে না দেখলে রাজনীতির প্রতি জনগণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়বে। আবার নেতাদের স্বার্থ রক্ষায় ও ক্ষমতা দখলের জন্য ছাত্রদের ব্যবহার একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। নেতারা যদি তাঁর অনুসারী ও সমর্থকদের সংগঠনের আদর্শ, মূল্যবোধে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, তাহলে সেই নেতার নেতৃত্ব নিয়ে সংশয় থাকা দরকার দলের উচ্চপর্যায়ে। আর এটা সত্য যে এ ধরনের সংঘাত ভিন্নরূপে, ভিন্ন কৌশলে সমাজের বিভিন্ন স্তরে পৌঁছে যায়। মনে রাখা দরকার, স্বার্থসংশ্লিষ্ট সংঘাত দ্রুত সংক্রমিত হয় সমাজে এবং তা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে। ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলার আগে তাঁরা যাঁদের অনুসারী, তাঁদের কাছ থেকে জবাব নেওয়ার দরকার ছিল। দেশের অন্য সব সম্পদ ক্ষতির পেছনে যেমন জবাবদিহি থাকে, থাকে শাস্তির ব্যবস্থা, ঠিক তেমনি আগামীর মানবসম্পদ এই সব মেডিকেল শিক্ষার্থীর ক্ষতির জন্য
নেতাদের জবাবদিহি নেওয়া ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় আনার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু, ভাবা দরকার।

এই লেখার শেষ পর্যায়ে যখন পৌঁছালাম, তখন পত্রিকায় প্রকাশিত হলো, নরসিংদীতে নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের দুপক্ষের সংঘর্ষে প্রাণ হারালেন এক সপ্তাহের মধ্যে ছয়জন।

আত্মঘাতী হামলার মতোই এই সব সংঘর্ষ। বিভিন্ন ইস্যুতে এই সব সংঘর্ষ মূলত এলাকাভিত্তিক হয়ে থাকে। রাজনৈতিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে এই সব নিয়ন্ত্রণ করা বা দেখাশোনা করা হয় কি না, জানা নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না যে এই সব আত্মঘাতী আচরণে কেন্দ্রীয় নেতাদের কোনো শাসন বা নিয়ন্ত্রণ আছে।

পরিশেষে বলব, যেকোনো একটি রাজনৈতিক সংগঠনের অভ্যন্তরে দুই পক্ষের সংঘর্ষ দলের ভেতর সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার কথা কিন্তু বলে না। মানতেই হবে যে তা প্রমাণ করে না। এই অসুস্থতাই ক্রমেই ভয়ংকর একটি রূপ নিয়ে দলকে তো বটেই, দেশ ও জাতিকেও অনিরাপদ করে দিতে পারে। আর মেধাবী ছাত্রদের বুঝতে হবে যে তাঁর মেধা দিয়ে দেশকে সর্বোৎকৃষ্ট যে সেবা দিতে পারবেন, প্রচলিত রাজনীতির অবিবেচক নেতাদের দিয়ে তা পারবেন না। 

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আব্বু আমাকে এতিম করে চলে গেলেন: দুর্বৃত্তের হামলায় নিহত পুলিশের ছেলে

ট্রাম্পের ‘ন্যাশনাল প্রেয়ার ব্রেকফাস্টে’ তারেক, ফখরুল ও খসরুকে আমন্ত্রণ

জুলকারনাইন সায়েরকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফেসবুক পোস্ট মুছার আলটিমেটাম দিলেন বিএনপির গউছ

শ্রীপুরে গার্মেন্ট শ্রমিককে নির্যাতন, মুক্তিপণ চেয়ে ধর্মবোনকে ডেকে নিয়ে গণধর্ষণ

শিগগিরই নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত