অজয় দাশগুপ্ত
বাংলাদেশের ইতিহাসে বিজয় দিবস এক অনন্য দিন। স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের সব দিন সমান গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিজয় দিবস সবচেয়ে বেশি গৌরবের। কেন জানি না, দিনটি তেমনভাবে উদ্যাপিত হয় না। তেমন আলোড়নও দেখি না, যা সত্যিকার অর্থে ছিল বিজয়ের প্রাপ্য। অথচ আমি এমন দুজন বিদেশির কথা জানি, যাঁরা আমার সঙ্গে আলাপচারিতায় দিনটি নিয়ে বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, উভয়ের অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠ টের পেয়েছিলাম ফোনে। তাঁদের একজনের নাম ব্রুস উইলসন। আমি যখন তাঁর কথা জানি এবং তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি, তিনি তখন বিলেতের এক হাসপাতালে শয্যাশায়ী। এখন আর বেঁচে আছেন কি না, জানি না। লন্ডনের সঙ্গে সময় মিলিয়ে যখন ফোনে পেয়েছিলাম, তখন ওখানে সকাল। কী পরিচয় দেব, কী বলব—এসব দ্বিধা দূরে সরিয়ে সরাসরি বলেছিলাম, আমি এক গর্বিত বাংলাদেশি। সিডনিতে থাকি। তাঁকে বলেছিলাম, আমি জানি তিনি একজন অস্ট্রেলিয়ান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস রণাঙ্গনে কাটিয়েছিলেন। মেলবোর্ন এজ পত্রিকার হয়ে ৯ মাস যুদ্ধের খবর কভার করার পাশাপাশি তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের সাহায্য-সহযোগিতা করার পাশাপাশি তাঁদের একজন হয়ে ওঠা ব্রুস যে বিজয় দিবসে আত্মসমর্পণের দিন তখনকার রেসকোর্সে ছিলেন, সে কথাও জানিয়েছিলাম তাঁকে।
ব্যস, তাতেই কাজ হলো। ব্রুস উইলসন শুরুতেই আমাকে চমকে দিয়েছিলেন জন্মগত পরিচয় এবং গোত্র-বর্ণ বিষয়ে তথ্য দিয়ে। আমি যে হিন্দুধর্মে জন্মেছি, তা নাম ও পদবিতে বোঝা কঠিন নয়; কিন্তু একজন বিদেশি কতটুকু জানলে বলে দিতে পারেন, আমি বৈদ্য সম্প্রদায় নামে পরিচিত বর্ণের কেউ। তা ছাড়া সব কথাতেই আমি বারবার টের পেয়েছিলাম, বাংলাদেশের রাস্তাঘাট, এমনকি জনজীবন বিষয়েও অনেক কিছু তাঁর নখদর্পণে। হাসপাতালের বিছানায় শায়িত ব্রুস ১৬ ডিসেম্বর সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ওসমানী বা সেই মাপের কেউ সেদিন উপস্থিত না থাকাটা তাঁদের ভালো লাগেনি। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীনের অনুপস্থিতিও পীড়া দিয়েছিল তাঁকে। তাঁর ধারণায়, পাকিস্তানি বাহিনী বা তারাই চায়নি এমন কিছু। আর ভারত তখন তাড়াতাড়ি আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া সারতে ব্যস্ত। তাদের মাথায় তখনো আমেরিকা-চীনের কথা ঘুরছিল। কারণ পাকিস্তানিদের জন্য এ দুই পরাশক্তি কোনো আক্রমণ শানালে বা যেকোনো কিছু করলে এমন প্রক্রিয়া ভেস্তে যেতে পারে। তাদের অনুমান যে মিথ্যা নয়, তার প্রমাণ বঙ্গোপসাগরে আমেরিকার সপ্তম নৌবহরের আনাগোনা। যদিও পরে তারা মাছ ধরার জন্য এসেছিল—এমন ফালতু হাস্যকর অজুহাত দিয়ে চলে গিয়েছিল।
ব্রুস মনে করতেন, সেদিন যদি সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীনের মতো কেউ থাকতেন, তবে ইতিহাস আরও গতি পেত। অন্য রকম হতো। এত ইতিহাস বিকৃতির শিকার হতো না দেশ। ইতিহাস ও বিজয় দিবস—এ দুই বিষয়ে তাঁর পরিষ্কার ধারণা আর অভিমত আমরা জানলে বা মানলে দেশ ও সমাজেরই উপকার হতো। ব্রুস উইলসন বাংলাদেশি না হয়েও বুঝেছিলেন, আমাদের দুর্বলতার সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে অনৈক্য আর বিভেদ। তাঁর মতে, এই বিভেদের মূল কারণগুলোর একটি হচ্ছে, বিজয় দিবসের প্রতি যথাযথ মনোযোগ আর ধ্যানের অভাব। ব্রুস বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অন্যায় আর অবিচারের পাশাপাশি অবহেলা তাঁর বুকে দাগ কেটেছিল। তিনি তখনই বলেছিলেন, একমাত্র বিজয় দিবসের তাৎপর্য আর উদ্ভাসই পারে মুক্তিযুদ্ধের সম্মান বাঁচাতে। একাত্তরের পর মাত্র একবার গিয়েছিলেন বাংলাদেশে। কিন্তু তখন মুক্তিযুদ্ধের সরকার দেশ শাসনে না থাকায় তিনি ফিরেছিলেন হতাশ হয়ে। তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতার শেষ অংশটুকু অনেক দিন মনে থাকবে আমার। বারবার বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের এ দেশ যদি বিজয় দিবস ও ইতিহাসমুখী না হয়, তাহলে এর চারিত্র্য যেমন সঠিক থাকবে না, তেমনি দেশও থাকবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত। এখন ফিরে তাকালে মনে হয়, স্বদেশ যেন ব্রুস উইলসনের কথামতোই সে পথে এগোচ্ছে।
আরেকজন, যিনি বিজয় দিবসের গর্বিত শরিক, তিনি আমাদের একমাত্র বিদেশি বীর প্রতীক, ডব্লিউ এস ওডারল্যান্ড। মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকার বাটা সু কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। তরুণ যোদ্ধা হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। জন্মসূত্রে ছিলেন নেদারল্যান্ডসের নাগরিক। পরে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব নেন। ওডারল্যান্ড থাকতেন পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরে। যখন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়, তখন তিনি চোখে ভালো দেখতে পেতেন না। স্নায়ুও নিয়ম মেনে চলছিল না। রক্তচাপ ছিল আয়ত্তের বাইরে। ফলে বেশির ভাগ সময় তিনি কাটাতেন বিছানায়। কোনো ধরনের উত্তেজনা বা চাপ নেওয়া ছিল ডাক্তারের বারণ। তবু ‘বাংলাদেশ’ নামটা শুনলেই উত্তেজিত হতেন। মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড আবেগ আর রাগে ফেটে পড়তেন। বারবার চেষ্টার ফলে একসময় তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়। খুব কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে ধীরে ধীরে কথা বলেছিলেন সেদিন। তাঁর কথা ছিল একটাই—যে জাতির জন্য তিনি জান হাতে লড়াই করেছিলেন, তাদের নৈতিক অধঃপতন তাঁর ভালো লাগত না। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং পরে জাতীয় চার নেতাকে কারাগারে হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। যে কারণে রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করা মানুষটি বলেছিলেন, ১৬ ডিসেম্বর যদি ফিকে হয় বা কোনো কারণে অনুজ্জ্বল হয়ে পড়ে, মনে রাখতে হবে, তাঁর বা তাঁর মতো যাঁরা আত্মত্যাগ করেছিলেন, তাঁদের আত্মার অভিশাপ এড়ানো যাবে না। আমি জানি না, এমন অমোঘ সত্য কথাটি তিনি কেমন করে বলেছিলেন সেদিন। আমার গর্ব, এ দুই বিদেশি বীরের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলাম। তাঁদের মতো আরও অনেকেই আছেন আকাশের তারায় তারায়। তাঁদের কথা যেন বিফলে না যায়। এ দেশ ও মাটি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এখন দায় আমাদের।
একটি জাতি স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে আসার পরও যদি তার ইতিহাস আর অতীতকে ভালোভাবে না জানে, তার চেয়ে দুঃখের আর কিছুই হতে পারে না। আজকের প্রজন্ম কিছুই জানে না। এসব বিদেশির কথা শোনেনি। কারণ আমাদের পাঠ্যবই বা আমাদের লেখাপড়ার কোথাও এদের কথা বলা হয় না। এর দায় আমাদের। যাঁরা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে আমাদের মুক্তির জন্য জান দিতে চেয়েছিলেন, ঝুঁকি নিয়েছিলেন; তাঁদের কাজ তাঁরা করে গেছেন। কৃতজ্ঞ জাতি হলে সারা জীবন তা মনে রাখত। আমরা এখনই ভুলে যেতে বসেছি। তবে কি তাঁদের কেউ বেঁচে থাকলে বা তাঁদের উত্তরসূরিরা ধরে নেবেন যে ভুল দেশের ভুল মানুষের জন্য তাঁরা লড়াই করেছিলেন? এর উত্তর আমাদের ইতিহাস। এর জবাব দেবে সরকার। এর দায় নিতে হবে সবাইকে। এত বড় ইতিহাস আর এমন মানুষদের যদি আমরা মনে না রাখি, ইতিহাস আমাদের মার্জনা করবে না। যেসব বিদেশি ভালোবেসে ত্যাগ স্বীকার করে, সঙ্গে থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়কে ত্বরান্বিত ও সফল করেছিলেন, তাঁদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। স্যালুট আপনাদের হে মহান আত্মার বিদেশি স্বজন।
লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট
বাংলাদেশের ইতিহাসে বিজয় দিবস এক অনন্য দিন। স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের সব দিন সমান গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিজয় দিবস সবচেয়ে বেশি গৌরবের। কেন জানি না, দিনটি তেমনভাবে উদ্যাপিত হয় না। তেমন আলোড়নও দেখি না, যা সত্যিকার অর্থে ছিল বিজয়ের প্রাপ্য। অথচ আমি এমন দুজন বিদেশির কথা জানি, যাঁরা আমার সঙ্গে আলাপচারিতায় দিনটি নিয়ে বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, উভয়ের অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠ টের পেয়েছিলাম ফোনে। তাঁদের একজনের নাম ব্রুস উইলসন। আমি যখন তাঁর কথা জানি এবং তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি, তিনি তখন বিলেতের এক হাসপাতালে শয্যাশায়ী। এখন আর বেঁচে আছেন কি না, জানি না। লন্ডনের সঙ্গে সময় মিলিয়ে যখন ফোনে পেয়েছিলাম, তখন ওখানে সকাল। কী পরিচয় দেব, কী বলব—এসব দ্বিধা দূরে সরিয়ে সরাসরি বলেছিলাম, আমি এক গর্বিত বাংলাদেশি। সিডনিতে থাকি। তাঁকে বলেছিলাম, আমি জানি তিনি একজন অস্ট্রেলিয়ান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস রণাঙ্গনে কাটিয়েছিলেন। মেলবোর্ন এজ পত্রিকার হয়ে ৯ মাস যুদ্ধের খবর কভার করার পাশাপাশি তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের সাহায্য-সহযোগিতা করার পাশাপাশি তাঁদের একজন হয়ে ওঠা ব্রুস যে বিজয় দিবসে আত্মসমর্পণের দিন তখনকার রেসকোর্সে ছিলেন, সে কথাও জানিয়েছিলাম তাঁকে।
ব্যস, তাতেই কাজ হলো। ব্রুস উইলসন শুরুতেই আমাকে চমকে দিয়েছিলেন জন্মগত পরিচয় এবং গোত্র-বর্ণ বিষয়ে তথ্য দিয়ে। আমি যে হিন্দুধর্মে জন্মেছি, তা নাম ও পদবিতে বোঝা কঠিন নয়; কিন্তু একজন বিদেশি কতটুকু জানলে বলে দিতে পারেন, আমি বৈদ্য সম্প্রদায় নামে পরিচিত বর্ণের কেউ। তা ছাড়া সব কথাতেই আমি বারবার টের পেয়েছিলাম, বাংলাদেশের রাস্তাঘাট, এমনকি জনজীবন বিষয়েও অনেক কিছু তাঁর নখদর্পণে। হাসপাতালের বিছানায় শায়িত ব্রুস ১৬ ডিসেম্বর সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ওসমানী বা সেই মাপের কেউ সেদিন উপস্থিত না থাকাটা তাঁদের ভালো লাগেনি। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীনের অনুপস্থিতিও পীড়া দিয়েছিল তাঁকে। তাঁর ধারণায়, পাকিস্তানি বাহিনী বা তারাই চায়নি এমন কিছু। আর ভারত তখন তাড়াতাড়ি আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া সারতে ব্যস্ত। তাদের মাথায় তখনো আমেরিকা-চীনের কথা ঘুরছিল। কারণ পাকিস্তানিদের জন্য এ দুই পরাশক্তি কোনো আক্রমণ শানালে বা যেকোনো কিছু করলে এমন প্রক্রিয়া ভেস্তে যেতে পারে। তাদের অনুমান যে মিথ্যা নয়, তার প্রমাণ বঙ্গোপসাগরে আমেরিকার সপ্তম নৌবহরের আনাগোনা। যদিও পরে তারা মাছ ধরার জন্য এসেছিল—এমন ফালতু হাস্যকর অজুহাত দিয়ে চলে গিয়েছিল।
ব্রুস মনে করতেন, সেদিন যদি সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীনের মতো কেউ থাকতেন, তবে ইতিহাস আরও গতি পেত। অন্য রকম হতো। এত ইতিহাস বিকৃতির শিকার হতো না দেশ। ইতিহাস ও বিজয় দিবস—এ দুই বিষয়ে তাঁর পরিষ্কার ধারণা আর অভিমত আমরা জানলে বা মানলে দেশ ও সমাজেরই উপকার হতো। ব্রুস উইলসন বাংলাদেশি না হয়েও বুঝেছিলেন, আমাদের দুর্বলতার সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে অনৈক্য আর বিভেদ। তাঁর মতে, এই বিভেদের মূল কারণগুলোর একটি হচ্ছে, বিজয় দিবসের প্রতি যথাযথ মনোযোগ আর ধ্যানের অভাব। ব্রুস বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অন্যায় আর অবিচারের পাশাপাশি অবহেলা তাঁর বুকে দাগ কেটেছিল। তিনি তখনই বলেছিলেন, একমাত্র বিজয় দিবসের তাৎপর্য আর উদ্ভাসই পারে মুক্তিযুদ্ধের সম্মান বাঁচাতে। একাত্তরের পর মাত্র একবার গিয়েছিলেন বাংলাদেশে। কিন্তু তখন মুক্তিযুদ্ধের সরকার দেশ শাসনে না থাকায় তিনি ফিরেছিলেন হতাশ হয়ে। তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতার শেষ অংশটুকু অনেক দিন মনে থাকবে আমার। বারবার বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের এ দেশ যদি বিজয় দিবস ও ইতিহাসমুখী না হয়, তাহলে এর চারিত্র্য যেমন সঠিক থাকবে না, তেমনি দেশও থাকবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত। এখন ফিরে তাকালে মনে হয়, স্বদেশ যেন ব্রুস উইলসনের কথামতোই সে পথে এগোচ্ছে।
আরেকজন, যিনি বিজয় দিবসের গর্বিত শরিক, তিনি আমাদের একমাত্র বিদেশি বীর প্রতীক, ডব্লিউ এস ওডারল্যান্ড। মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকার বাটা সু কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। তরুণ যোদ্ধা হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। জন্মসূত্রে ছিলেন নেদারল্যান্ডসের নাগরিক। পরে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব নেন। ওডারল্যান্ড থাকতেন পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরে। যখন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়, তখন তিনি চোখে ভালো দেখতে পেতেন না। স্নায়ুও নিয়ম মেনে চলছিল না। রক্তচাপ ছিল আয়ত্তের বাইরে। ফলে বেশির ভাগ সময় তিনি কাটাতেন বিছানায়। কোনো ধরনের উত্তেজনা বা চাপ নেওয়া ছিল ডাক্তারের বারণ। তবু ‘বাংলাদেশ’ নামটা শুনলেই উত্তেজিত হতেন। মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড আবেগ আর রাগে ফেটে পড়তেন। বারবার চেষ্টার ফলে একসময় তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়। খুব কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে ধীরে ধীরে কথা বলেছিলেন সেদিন। তাঁর কথা ছিল একটাই—যে জাতির জন্য তিনি জান হাতে লড়াই করেছিলেন, তাদের নৈতিক অধঃপতন তাঁর ভালো লাগত না। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং পরে জাতীয় চার নেতাকে কারাগারে হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। যে কারণে রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করা মানুষটি বলেছিলেন, ১৬ ডিসেম্বর যদি ফিকে হয় বা কোনো কারণে অনুজ্জ্বল হয়ে পড়ে, মনে রাখতে হবে, তাঁর বা তাঁর মতো যাঁরা আত্মত্যাগ করেছিলেন, তাঁদের আত্মার অভিশাপ এড়ানো যাবে না। আমি জানি না, এমন অমোঘ সত্য কথাটি তিনি কেমন করে বলেছিলেন সেদিন। আমার গর্ব, এ দুই বিদেশি বীরের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলাম। তাঁদের মতো আরও অনেকেই আছেন আকাশের তারায় তারায়। তাঁদের কথা যেন বিফলে না যায়। এ দেশ ও মাটি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এখন দায় আমাদের।
একটি জাতি স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে আসার পরও যদি তার ইতিহাস আর অতীতকে ভালোভাবে না জানে, তার চেয়ে দুঃখের আর কিছুই হতে পারে না। আজকের প্রজন্ম কিছুই জানে না। এসব বিদেশির কথা শোনেনি। কারণ আমাদের পাঠ্যবই বা আমাদের লেখাপড়ার কোথাও এদের কথা বলা হয় না। এর দায় আমাদের। যাঁরা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে আমাদের মুক্তির জন্য জান দিতে চেয়েছিলেন, ঝুঁকি নিয়েছিলেন; তাঁদের কাজ তাঁরা করে গেছেন। কৃতজ্ঞ জাতি হলে সারা জীবন তা মনে রাখত। আমরা এখনই ভুলে যেতে বসেছি। তবে কি তাঁদের কেউ বেঁচে থাকলে বা তাঁদের উত্তরসূরিরা ধরে নেবেন যে ভুল দেশের ভুল মানুষের জন্য তাঁরা লড়াই করেছিলেন? এর উত্তর আমাদের ইতিহাস। এর জবাব দেবে সরকার। এর দায় নিতে হবে সবাইকে। এত বড় ইতিহাস আর এমন মানুষদের যদি আমরা মনে না রাখি, ইতিহাস আমাদের মার্জনা করবে না। যেসব বিদেশি ভালোবেসে ত্যাগ স্বীকার করে, সঙ্গে থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়কে ত্বরান্বিত ও সফল করেছিলেন, তাঁদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। স্যালুট আপনাদের হে মহান আত্মার বিদেশি স্বজন।
লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট
তথ্যের অফুরন্ত ভান্ডার থাকা সত্ত্বেও আজ লেখাটির ইতি টানব। আশা করব, ভবিষ্যতে নতুন প্রজন্মের কেউ একজন আমার হাত থেকে রিলে রেসের ব্যাটনটি তুলে নেবেন এবং ইতিহাসের এই স্বল্প আলোকপাত করা বিষয়টি নিয়ে গভীর গবেষণা করবেন।
৮ ঘণ্টা আগেবিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রতিবছর উদ্যাপনের যেমন উদ্যোগ-আয়োজন দেখা যায়, এবার তেমন দেখা যায়নি। আমার কাছে অন্তত তা-ই মনে হয়েছে। গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পালাবদল কি সত্যি আমাদের চিন্তাচেতনায় বড় পরিবর্তন এনেছে? গণতন্ত্রের ঢং দেখিয়ে টানা ক্ষমতায় থাকা শাসকগোষ্ঠীকে পরাভূত করা নিশ্চয়ই গৌরবের। কিন্তু সে গৌরব কি...
৮ ঘণ্টা আগে১৯ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর পূর্বাচলের ৩০০ ফুট সড়কে এক মাতাল চালকের গাড়ির ধাক্কায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী মুহতাসিম মাসুদ নিহত হন। আহত হন মেহেদী হাসান খান ও অমিত সাহা নামের বুয়েটের সিএসই বিভাগের আরও দুই শিক্ষার্থী। মেহেদী রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে এবং অমিত ঢাকা মেডিকেল কলেজ
৮ ঘণ্টা আগে১৫ বছর ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বলার চেষ্টা করেছে, বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত দরকার। ফ্যাসিবাদী কাঠামো থেকে বের হওয়ার জন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত খুব প্রয়োজন। সেই বন্দোবস্তের রূপরেখাটা কেমন হবে, সেটা নিয়ে বহু বছর ধরে কথা হচ্ছে।
১ দিন আগে