
তানজিম আহমদ সোহেল তাজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সন্তান। ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি গাজীপুর-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের রাজনীতি, দেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব ও ভবিষ্যতের রাজনীতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন।
সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন

প্রধান উপদেষ্টা আপনাকে ফোন করেছিলেন। কী কথা হলো তাঁর সঙ্গে?
আমি খুবই সম্মানিত হয়েছি। কারণ, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা একজন নোবেল লরিয়েট, বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য ব্যক্তি। তিনি যে এত অমায়িকভাবে আমাকে ফোন দেবেন, আমি এতে খুবই আশ্চর্য হয়েছি, খুবই মুগ্ধ হয়েছি। তিনি ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে আমি যেদিন পদযাত্রা করেছি, সেদিন তিনি দেখা করতে পারেননি। তিনি স্বীকার করেছেন আমাদের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। এ বিষয়টা তিনি দেখবেন। আমার বাবাসহ মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় নেতাদের অবদানের কথা বললেন।
আপনি ৩ নভেম্বর তিনটি দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে পদযাত্রা করেছেন। বলেছেন এটি আপনার শেষ পদযাত্রা। শেষ পদযাত্রা কেন?
আমি এই পদযাত্রাটা তিন বছর ধরে করছি। আগের দুই বছর কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব যে দল দিয়েছিল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সেই দল সরকারে ছিল। এটা যদি সত্যিকারের নীতি-আদর্শের আওয়ামী লীগ হতো, অবশ্যই আমার দাবিগুলো বাস্তবায়ন করে ফেলত। তারা তো তা করেইনি বরং উপেক্ষা করেছে।
এবার দেখছি আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে অনেকের বিবৃতি আসছে। অথচ দুই বছর আগে আমাকে তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে হয়েছে জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে পোস্ট দেওয়ার বিষয়টি। দুই বছর আগে আমি তাদের পেজে এমন কমেন্ট করেছি।
ওই যে একাত্তরের ইতিহাস, ওই যে একটা বিবাদ—সেটারই প্রতিফলন। আসলে একটা পরিবার আওয়ামী লীগ নামের দলটাকে কুক্ষিগত করে ফেলেছে। এটা আওয়ামী লীগ না।
আমি তো এই ছিনতাই হওয়া আওয়ামী লীগের কাছে কিছু পেলাম না। তাই এবার গেলাম প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের কাছে। কারণ, সারা দেশের মানুষের তাঁর ওপর অনেক আশা-ভরসা। আমরা সবাই আশা করছি সংস্কার হবে, যাতে করে আগামী দিনে যে গণতান্ত্রিক সরকার আসবে, তারা যেন সঠিক পথে দেশ পরিচালনা করতে পারে।
আমি কেন বলছি শেষ পদযাত্রা? কারণ, রাষ্ট্রের কাছে আমার বাবাসহ জাতীয় নেতাদের সন্তান হিসেবে তাঁদের প্রতি সম্মান জানানোর অধিকার চাওয়ার বিষয়টি আমাকে খুব লজ্জিত করছে।
এরপরও যদি মানুষের কোনো সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হয়, তখনো কি এমন পদযাত্রা আর করবেন না?
আমি তো অনবরত কথা বলে যাচ্ছি। তবে একই দাবিতে পদযাত্রাটা শেষ করতে চাই, কারণ এতে আমি নিজে বিব্রত হচ্ছি। এটা খুব দুঃখজনক। আমার দাবি তিনটা সহজ। প্রথম, ৩ নভেম্বরকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া, যাতে মানুষ জানতে পারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল। কারা এই চার নেতা? যাঁরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পৃথিবীতে শুধু দুটি রাষ্ট্র ‘ডিক্লেয়ারেশন অব ইনডিপেনডেন্সের’ মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে—যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ। আমাদের একটা ডিক্লেয়ারেশন অব ইনডিপেনডেন্স আছে—প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স। ওইটার ভিত্তিতে আমরা ১০ এপ্রিল ১৯৭১ একটা সরকার গঠন করেছিলাম। ইতিহাস সংরক্ষণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে যদি সেই দিনকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এটা দ্বিতীয় দাবি। আমার তৃতীয় দাবি স্পষ্ট—জাতীয় চার নেতাসহ আমাদের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন—সকল বীর, হিরো, সুপারহিরো—যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের জীবনী তথা তাঁদের অবদান পাঠ্যপুস্তকে লিপিবদ্ধ করা এবং সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা; যেন একজন তরুণ বা তরুণী পড়ে বলতে পারেন, ‘ও মাই গড, তাঁরা এত বিসর্জন দিয়েছেন দেশের জন্য! এটা অনুপ্রেরণা জাগায়, একদম রক্ত গরম করে ফেলে। তাঁরা আমার দেশের জন্য এত করেছেন, তাহলে আমাদের আরও ভালো কিছু করতে হবে।’ এই যৌক্তিক দাবি পূরণ না করার তো কোনো কারণ আমি দেখছি না।
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক আছে। এই ব্যাপারে আপনার কী জানা আছে?
আমি যা জেনেছি এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। গণহত্যা যখন শুরু হলো ২৫ মার্চ, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেপ্তার হলেন, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আমার বাবা সে রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ছিলেন। তিনি একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে গিয়েছিলেন। কথা ছিল যে বঙ্গবন্ধু এই টেপ রেকর্ডারে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন এবং একটা কাগজে স্বাক্ষর দেওয়ার কথা ছিল একই মর্মে। সেই সময়ে শাহবাগে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সব সাংবাদিক অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই রেকর্ডেড মেসেজটা দেননি এবং ওই কাগজে স্বাক্ষর দেননি। আমার বাবা পরে বাসায় চলে আসেন। আমার মা-বোনদের মুখ থেকে শুনেছি, বাবা বাসায় এসে সব ফাইলপত্র ফেলে, তছনছ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের ২৩ বছরের আন্দোলন নষ্ট হয়ে গেল।’
আমি যেটা ধারণা করছি, যেহেতু বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন এবং আমার বাবা তখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে মুক্তির সংগ্রামে যোগ দেবেন, এই সময়টুকুর মধ্যে ইপিআরে আক্রমণ হয়েছে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এই খবরগুলো ছড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে। জিয়াউর রহমান ছিলেন চট্টগ্রামে। আমি মনে করছি, যেহেতু জিয়াউর রহমান দেখেছিলেন যে রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে কোনো ঘোষণা আসেনি, তিনি তখন নিজ উদ্যোগে ঘোষণা দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন প্রথমবার। প্রথমবার তিনি কিন্তু বলেছিলেন, ‘আই, প্রেসিডেন্ট জিয়া...’। তারপর রাজনৈতিক নেতারা তাঁকে বলেন যে আপনি ঘোষণাটা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দিন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘অন বিহাফ আওয়ার গ্রেট লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান...’। এগুলো হচ্ছে ইতিহাসের টুকরা টুকরা ঘটনা। এগুলোকে আমাদের পূর্ণাঙ্গভাবে বিবেচনা, বিশ্লেষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জিয়াউর রহমান যেটা করেছিলেন একজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে, তাঁর অবস্থান থেকে ওই সময়, ওই মুহূর্তে সেটা তিনি সঠিক মনে করেছিলেন। মানুষ তো রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঘোষণার অপেক্ষায় থাকে, সেটা যখন আসছিল না, তখন তিনি নিজে এই পদক্ষেপটা নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে আবার রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকেই নির্দেশনা আসে। কিন্তু এখানে ২৫, ২৬, ২৭ মার্চের গ্যাপটা কেন সৃষ্টি হলো, এটাও প্রশ্নের একটা বিষয়।
মুক্তিযুদ্ধে আপনি সবার অবদানের কথা বলছেন। তাহলে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মনে করেন কি না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে জেনেছি, পড়েছি। আমার কাছে মনে হয়, অনেকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক, আবার বলছি। জনগণ তাঁর নামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাঁর নামেই যুদ্ধ হয়েছে। তাঁর নামেই সরকার যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। এখানে কিছু প্রশ্ন আসে। তাঁর কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি কোনো ভূমিকা ছিল না। আমার মতে, আমরা ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ বলতে পারি—বঙ্গবন্ধু একজন এবং বাকি যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁরা সবাই ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ হতে পারেন। আমরা তো এটাকে শেয়ার করতে পারি। কেন আমরা একজনের ওপরে দিয়ে দিচ্ছি সবকিছু? একজনই যদি হতে হয় তাহলে সেটা মানুষ সিদ্ধান্ত নিক যে তিনি জাতির পিতা কি না। যদি মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়, হ্যাঁ তিনিই জাতির পিতা এবং সঙ্গে ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ ছিল, সেটাও ঠিক আছে।
১৫-১৬ বছরে বঙ্গবন্ধুকে ব্যানার হিসেবে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে কি তাঁর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করেন?
হ্যাঁ, অবশ্যই। এত বছরের লাগামহীন দুর্নীতি, কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা, পাশাপাশি আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা, হত্যা, গুম, মানে অরাজকতার একটা মহোৎসব চলছিল। এখন যেহেতু তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করেছেন, সেহেতু এই পুরো জিনিসটাই বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রতিফলিত হলো। মানুষ তো এখন বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে দেখছে। এ জন্যই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যগুলোর ওপর তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। মানুষ এখন লিংক করছে এই অনিয়ম, দুর্নীতি, অত্যাচার—সবকিছু এই ব্যক্তির নামে হয়েছে। এটা তো খুবই অন্যায় করা হলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে।
আপনি কি রাজনীতি ছেড়েছেন নাকি রাজনীতি আপনাকে ছেড়েছে?
এটা তো খুবই ইন্টারেস্টিং একটা প্রশ্ন। ২০০৮ সালে আমি খুব আশা নিয়ে এসেছিলাম দিনবদলের সনদ বাস্তবায়ন করব বলে। সরকারের প্রথম ছয় মাসের যে কর্মকাণ্ড দেখেছি, আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। আমি হুবহু আঁচ না করতে পারলেও আন্দাজ করতে পেরেছিলাম যে ৫ আগস্টের মতো ঘটনা হয়তো আসবে সামনে। ২০১৪-তে যদি সঠিক নির্বাচন দেওয়া হতো তাহলে হয়তো আর ৫ আগস্ট আসত না।
আমার অবস্থান থেকে, নৈতিকতার দিক থেকে আমি একটা শপথ নিয়েছিলাম বাংলাদেশের জনগণের কাছে, আমি যখন প্রতিমন্ত্রী হই। সেই শপথটা ছিল, আমি আমার সবকিছু দিয়ে সৎভাবে, সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করব। যখন দেখলাম আমাকে সেই দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না, যখন দেখলাম লাগামহীন দুর্নীতি শুরু হয়েছে, যখন দেখলাম রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন না এনে দ্বিগুণ গতিতে একই ধারা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন আমার সিদ্ধান্ত ছিল পদত্যাগ করা। পদত্যাগের মাধ্যমে আমি চেয়েছিলাম প্রতিবাদের একটা বীজ বপন করে দিতে।
শুধু কি এই কারণেই আপনাকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হলো? শেখ সেলিমের সঙ্গে নাকি আপনার বিরোধ হয়েছিল?
না, এ রকম কিছু হয়নি। হ্যাঁ, দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, কিন্তু ওটা কারণ ছিল না। কারণটা হচ্ছে, এক পরিবারের নিয়ন্ত্রণে সবকিছু ছিল এবং কোনো না কোনোভাবে পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তার করা ছিল একটা প্রধান কারণ। আমি চেষ্টা করছিলাম প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য। কিন্তু ওই বিশেষ পারিবারিক চাপ ছিল পুলিশের ওপর। এটাও একটা কারণ, ব্যক্তিগতভাবে কোনো দ্বন্দ্ব হয়নি। কিন্তু তাদের প্রভাব ছিল। সেই প্রভাবটা আমি বুঝতে পেরেছি, সেই প্রভাবটা একটা ফ্যাক্টর।
পদত্যাগের আর একটা কারণ ছিল বিডিআর বিদ্রোহের তদন্ত। যেভাবে তদন্ত হচ্ছিল আমার কাছে এটা ভালো লাগেনি। আমি চেয়েছিলাম তদন্তটা একদম পরিষ্কার হবে, স্বচ্ছ হবে। কিন্তু দেখা গেল তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলো তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল ফারুক খানকে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুরোপুরি বাইপাস করে, যেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ছিল বিডিআর। দৃশ্য থেকে আমাদের পুরোপুরি বাইরে রাখা হলো এবং তদন্তটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছিল। আমি তো মে মাস পর্যন্ত ছিলাম, তদন্ত চলেছে তার পরেও। এরপর কী হয়েছে আমি জানি না। ওই পর্যন্ত যখন আমি দেখলাম তদন্তটা আমাদের হাত থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, আমার কাছে এটা খুব অস্বাভাবিক লেগেছে। এটা তো হওয়ার কথা না। এখানে তো আমাদের সম্পৃক্ত থাকার কথা। আমি যদি সম্পৃক্ত থাকতাম, চেষ্টা করতাম স্বচ্ছ একটা তদন্ত করাতে। এখন অনেক প্রশ্ন উঠেছে বিডিআরের তদন্ত নিয়ে।
শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। আবার তিনিই কি দলটির বড় ক্ষতির কারণ হলেন?
আমি এটাই বলব, আশি ও নব্বইয়ের দশকে দলের মধ্যে কিছুটা ব্যালান্স ছিল। কারণ ওই সময় পর্যন্ত দলীয় ফোরামগুলোতে কথা বলা যেত। বিভিন্ন বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক হতো। কেউ কোনো বিষয়ে মতামত দিলে সেটা একেবারে অগ্রাহ্য করা হতো না। কিন্তু পরে ওই গণতন্ত্রটা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন অধঃপতন শুরু হয়। দুর্ভাগ্যবশত আমরা নীতি-আদর্শকেন্দ্রিক না হয়ে সুবিধাকেন্দ্রিক হয়ে যাই। আপনি যখন এককভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করবেন, আপনার কিন্তু লাইক-মাইন্ডের লোকজন লাগবে, যাঁরা আপনাকে অন্ধভাবে সমর্থন করবেন। তাই নীতি-আদর্শ বিচ্যুত করে আপনি দলের ভেতর এমন কিছু লোকজন ঢুকিয়েছেন, যাঁরা স্বার্থান্বেষী, যাঁরা নিজের পকেট ভারী করার জন্য, ক্ষমতা পাওয়ার জন্য এ দলটাকে একেবার মূল নৈতিক জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।
সম্প্রতি আপনার বোন শারমিন আহমদ বলেছেন, গণ-অভ্যুত্থানের সময় অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনায় আওয়ামী লীগের কারও মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। তাই এই দলটিতে তিনি যাবেন না, দল গড়বেন না। বোনের সঙ্গে কি আপনি একমত?
আমি সম্পূর্ণভাবে একমত। আমি বারবার বলছি, শেখ হাসিনাসহ এই আওয়ামী লীগ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতার আওয়ামী লীগ না। খাঁটি আওয়ামী লীগ না। আওয়ামী লীগটাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নামটা ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ভেতরে কিন্তু ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। আমার আম্মা একটা কথা বলতেন সব সময়, মাছের পচন ধরে মাছের মাথা থেকে, রাজনৈতিক দলের পচনও ধরে মাথা থেকে।
আপনি আওয়ামী লীগের হাল ধরবেন বলে শোনা যাচ্ছিল। কথাটি কি ঠিক?
কথাটা একেবারেই সত্যি না। অনেকেই অনেক জায়গা থেকে বলছেন। আমি জানি না কেন বলছেন। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, আমি রাজনীতিতে এলে তাঁদের অসুবিধা হয়ে যাবে, হয়তো আমি জনপ্রিয় বেশি, ঈর্ষান্বিত হচ্ছেন—আমি জানি না। কিন্তু আমি পরিষ্কারভাবে বলেছি, আমি রাজনীতিতে আসছি না। আমি যেখানে আছি, আমার কাজ নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। আমি স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কাজ করছি।
বাংলাদেশে এখন বিশাল একটা সমস্যা হচ্ছে, এই যে চারদিকে এখন হাসপাতালে ভরে গেছে। চিকিৎসাখানা, ফার্মেসি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে মানুষ ভুগছে। এটার কারণ হচ্ছে, একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখন আধুনিক জীবনযাপন করছে, শহরকেন্দ্রিক। যার ফলে আমরা নানাবিধ অসুখ-বিসুখে ভুগছি। আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছি। আমি হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের জীবন বদলে দিয়েছি—এটা আমাকে সাংঘাতিকভাবে সন্তুষ্টি দেয়। কারণ একটা মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হচ্ছে স্বাস্থ্য, সুস্থতা। এখন আমি কথা বলছি, এটা যদি রাজনীতি হয়, তাহলে রাজনীতি। আমি তো কথা বলেই যাব, এটা তো আমার দেশ, আমার অধিকার আছে কথা বলার। কিন্তু ওই প্ল্যাটফর্ম করে রাজনীতি করার ইচ্ছা আমার নেই।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের যে প্রভাব গড়ে উঠেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী বলে আপনি মনে করেন?
উপায় হচ্ছে নতুন প্রজন্ম, নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। ছাত্র-জনতা গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পরিবর্তন আনল। তাই এখন নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের মালিকানা নিতে হবে। কিন্তু সেটা অবশ্যই একাত্তর সালকে ভুলে গিয়ে না। কারণ, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমাদের প্রাণশক্তি। আর ৫ আগস্ট হচ্ছে সেটারই ধারাবাহিকতা। আবার বলছি, ৫ আগস্টের যে দাবিদাওয়া ছিল, সেগুলো কিন্তু মুক্তিযুদ্ধেরও দাবিদাওয়া। সেই সময়ের মানুষ যেটা চেয়েছিল, ৫ আগস্টেও ছাত্র-জনতা তা-ই চেয়েছে। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ একই সূত্রে গাথা। নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে ইতিহাস থেকে। সেটাকে প্রাণশক্তি করে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে বিনির্মাণ করতে হবে। তাদের এগিয়ে আসতে হবে, কিন্তু তাদের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসও জানতে হবে। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আমরা অনুপ্রেরণা নিতে পারব তাঁদের কাছ থেকে, যাঁরা অবদান রেখেছেন বাংলাদেশের জন্য।
যেকোনো সভ্যতার দিকে যদি তাকাই, আমি রোমের কথা, গ্রিসের কথাই বলব। তারা এতদূর এগোতে পেরেছিল একটা কারণে—তারা তাদের নায়কদের সম্মান করত। তাই আপনার জন্য যাঁরা অবদান রেখেছেন, বলিদান দিয়েছেন, আপনি যদি তাঁদের সম্মান না দেন তাহলে আপনার কোনো ভবিষ্যৎ হবে না। এটা ইতিহাসই বলে দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে আপনি কেন দলটির তেমন সমালোচনা করেননি, এখন যেমন করছেন?
আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমার এক ভাগনেকেও কিন্তু গুম করা হয়েছিল। তাকে ১১ দিন আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল। আমি যখন পদত্যাগ নাটকের শিকার হই—পদত্যাগ করতেও কিন্তু আমাকে প্রায় যুদ্ধ করতে হয়েছিল। পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হচ্ছিল না, বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছিল, অনেক যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত আমি সংসদ সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছি। এখানেও আবার নাটক—আমি স্পিকার হামিদ সাহেবের কাছে পাঠিয়েছিলাম পদত্যাগপত্র। তিনি বললেন, এটা কে না কে পাঠিয়েছে! অথচ আমি তাঁকে ফোন করে বললাম, ‘হামিদ কাকু (তাঁকে কাকু ডাকতাম), আমি কিন্তু পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছি। পরে আমি নিজে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিলাম। এটা শুনে প্রধানমন্ত্রী খুব আশ্চর্য হলেন, ‘তুমি পদত্যাগ করে আসছো?’ তার আগে অনেক ঘটনা ছিল। অনেকভাবে চেষ্টা করা হয়েছিল আমাকে রাখার জন্য।
যাই হোক, এখানে বুঝতে হবে, বিডিআর বিদ্রোহ, ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা ঘটনা পরম্পরায় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়েছে। রীতিমতো একনায়কতন্ত্রের পথে যাত্রা। ডিজিএফআই, এনএসআইয়ের প্রভাব চারদিকে ছিল। ২০১১, ২০১২, ২০১৩ সালের দিকে কিন্তু গুম হওয়া শুরু করল। খোঁজ করে দেখেন, এই সংস্কৃতিটা শুরু হয়েছে তখন। এই অবস্থায় আমার আরেক ভাগনেকে পুলিশ বেধড়ক মারধর করল। এগুলো সব আমার জন্য ইশারা ছিল।
আমরা দেখেছি, সরকার যে-ই হোক না কেন, একটা পর্যায়ে গিয়ে ‘ফ্যাসিস্ট’ আচরণ প্রকাশ পেতে থাকে। জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ বইটি নিশ্চয়ই পড়েছেন, অনেকটা সে রকম। যেখানে শাসক বদলালেও স্বৈরশাসন বারবার ফিরে আসে। উপন্যাসটির সঙ্গে বাস্তবতার মিল পান কি?
‘অল অ্যানিমেলস আর ইক্যুয়াল বাট সাম অ্যানিমেলস আর মোর ইক্যুয়াল।’ পড়েছি অ্যানিমেল ফার্ম। যাই হোক, ফ্যাসিস্ট আচরণ আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট সরকার ছিল না। কারণ, এখানে ফ্যাসিস্ট সংজ্ঞার একটা বিষয় আছে। ফ্যাসিজম একটা মতাদর্শকে প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু এখানে তো কোনো মতাদর্শ ছিল না। এটা তো একটা দুর্নীতি, হত্যাযজ্ঞ, গুম, খুনের উৎসব ছিল। আমি বলব এটা একটা ক্লেপ্টোক্রেসি, মাফিয়া এবং পরিবারতন্ত্রের সম্মিলন—তিনটার সংমিশ্রণে এটা একটা হাইব্রিড ফিউশন সিস্টেম। এটার নাম এখনো কেউ দিতে পারেনি। এ জন্যই আমরা বলি ফ্যাসিস্ট।
কেন যেন এই উপমহাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা পরিবারকেন্দ্রিক। আমরা শ্রীলঙ্কায় সেটা দেখেছি। পাকিস্তানে দেখেছি। বাংলাদেশে দেখেছি। একমাত্র ভারত কিছুটা বেরিয়ে এসেছে, কারণ ওরা গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। যদিও কংগ্রেস আছে কিন্তু ওদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এত মজবুত যে ওই সুবিধা ওরা পাচ্ছে না আমাদের তুলনায়। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও মজবুত করতে হবে, যাতে এ রকম ক্লেপ্টোক্রেসি, মাফিওক্রেসি পরিবারতন্ত্র আর মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে। আমাদের সবার এক থাকতে হবে এই জায়গাটায়। সব রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য যেন হয় জনসেবা। রাজনীতির মূলে আমাদের চলে যেতে হবে। এ জন্য জনগণেরই চাপ সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু জনগণ তো খুব অসহায়।
শেখ হাসিনার ১৫-১৬ বছরের সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে আচরণ, সেটা কি তাঁর নিজের গড়া, নাকি আশপাশের কারও মাধ্যমে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন? আপনার কী মনে হয়?
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমি তাঁর খুব কাছাকাছি থেকে বিরোধীদলীয় রাজনীতি করেছিলাম। পরে ২০০৮-০৯ সালে যখন মন্ত্রিসভায় ছিলাম, তাঁকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তাঁর ভাবভঙ্গি, আচার পুরোপুরি ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। তিনি আগে যেমন ছিলেন, তা থেকে রাতারাতি পরিবর্তিত হয়ে গেলেন। আমি যতটুকু দেখেছি, তাঁকে পরামর্শ দেওয়ার মতো কেউ নেই বাংলাদেশে। যা কিছু হতো, তাঁর ইচ্ছায় হতো। দলীয় ফোরামে এবং ইনফরমাল মিটিংয়ে কোনো বিষয়ে কথা হলে সবাই ভেবেছি তাঁকে এই ব্যাপারে বলতে হবে, কিন্তু তিনি আসার পর সবাই চুপ থাকতেন এবং তিনি কী শুনতে চান, সেটা আঁচ করে অন্যরা সুর পাল্টে ফেলতেন।
আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
আপাতত আমার কোনো নির্ধারিত পরিকল্পনা নেই। আমি যে কাজটা করছি সেটা করেই আমি তৃপ্তি পাই, খুব সন্তুষ্ট আছি। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা তো আমাদের কারোরই জানা নেই। এটা মহান আল্লাহ তাআলাই জানেন।
কিন্তু অনেকের বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে একটা আশা ছিল যে সোহেল তাজ একটা দল গঠন করবেন, দিশা দেখাবেন।
আমি বিশ্বাস করি যে তরুণদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা প্রত্যেকে একটা করে দুর্গ হতে পারি বাংলাদেশের জন্য। প্রত্যেককেই নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নীতি-আদর্শ থাকতে হবে এবং দৃঢ়তা থাকতে হবে। আমরা যদি এই অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে পারি, তাহলে আরও অনেকেই চলে আসবে। সবাইকে নিজ উদ্যোগে বেরিয়ে আসতে হবে, কারও জন্য অপেক্ষা করলে হবে না। তাহলে আপনা-আপনি একটা নেতৃত্ব চলে আসবে।
বর্তমান তরুণদের ওপর আপনার আস্থা কতটুকু?
আসলে আমরা সবাই আশ্চর্য হয়েছি এবারের এই আন্দোলনটা দেখে। আমরা ভেবেছিলাম জেন-জি হচ্ছে মোবাইল ডিভাইস নিয়ে বসে থাকে। কিন্তু তারা প্রমাণ করল যে তারাও আন্দোলন করতে পারে, অধিকারের জন্য লড়াই করতে পারে। জীবন দিতে পারে। এটা আমাদের আশান্বিত করে যে তারা পারবে।
এই অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু সফল বা ব্যর্থ বলে আপনি মনে করেন?
আমাদের বাংলাদেশ কিন্তু একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখনো আমরা এটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কারণ, ১৫-১৬ বছরে যে একনায়কতন্ত্র কায়েম করা হয়েছিল, তাতে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছে। দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা—সব ক্ষেত্রে ‘ইয়েস ম্যান’ বসিয়ে তাদের মতলব হাসিল করা হয়েছে। এখন এই অন্তর্বর্তী সরকার এসে এ রকম একটা পরিস্থিতির ভেতরে পড়েছে। তাদের কোনো দল নেই। তাদের বসিয়েছে ছাত্ররা। অন্যদিকে বড় বড় রাজনৈতিক দল আছে, যাদের সমর্থক গোষ্ঠী সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে। আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় আওয়ামী লীগে এখনো ন্যূনতম সমর্থক আছে ৩০ শতাংশ। বিএনপির আছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। ২০-২৫ শতাংশ আছে স্বতন্ত্র। বাকিরা জামায়াতের সমর্থক। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আপনি যখন সংস্কার করতে যাবেন, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল কিন্তু তাদের সুবিধাগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য নানাভাবে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করবে।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা। গণ-অভ্যুত্থান যখন ঘটে, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা কিন্তু আকাশচুম্বী হয়। জনগণ খুশি থাকে কখন? তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কাজ যখন সুন্দরভাবে করতে পারে। এর মধ্যে আছে দ্রব্যমূল্য, নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা। দুর্ভাগ্যবশত এই ক্ষেত্রগুলো কিন্তু এখনো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি এই সরকার। আমি আগে যে প্রতিকূলতার কথা বললাম, তাদের ওই বাধাগুলো অতিক্রম করতে একটু সময় লাগছে। আমি মনে করি, এদিকে নজর দেওয়া উচিত। সিন্ডিকেটগুলো ভাঙতে পারেনি। এখন উল্টো দাম বেড়ে যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। আমার বিনীত পরামর্শ থাকবে যে এদিকে একটু বেশি মনোনিবেশ করার। কারণ, জনগণ যদি আবার তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো না পায় তাহলে কথা বলা শুরু করবে। তাই আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নাগালের মধ্যে আনতে হবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ। ধন্যবাদ আজকের পত্রিকার পাঠকদেরও।
প্রধান উপদেষ্টা আপনাকে ফোন করেছিলেন। কী কথা হলো তাঁর সঙ্গে?
আমি খুবই সম্মানিত হয়েছি। কারণ, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা একজন নোবেল লরিয়েট, বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য ব্যক্তি। তিনি যে এত অমায়িকভাবে আমাকে ফোন দেবেন, আমি এতে খুবই আশ্চর্য হয়েছি, খুবই মুগ্ধ হয়েছি। তিনি ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে আমি যেদিন পদযাত্রা করেছি, সেদিন তিনি দেখা করতে পারেননি। তিনি স্বীকার করেছেন আমাদের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। এ বিষয়টা তিনি দেখবেন। আমার বাবাসহ মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় নেতাদের অবদানের কথা বললেন।
আপনি ৩ নভেম্বর তিনটি দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে পদযাত্রা করেছেন। বলেছেন এটি আপনার শেষ পদযাত্রা। শেষ পদযাত্রা কেন?
আমি এই পদযাত্রাটা তিন বছর ধরে করছি। আগের দুই বছর কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব যে দল দিয়েছিল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সেই দল সরকারে ছিল। এটা যদি সত্যিকারের নীতি-আদর্শের আওয়ামী লীগ হতো, অবশ্যই আমার দাবিগুলো বাস্তবায়ন করে ফেলত। তারা তো তা করেইনি বরং উপেক্ষা করেছে।
এবার দেখছি আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে অনেকের বিবৃতি আসছে। অথচ দুই বছর আগে আমাকে তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে হয়েছে জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে পোস্ট দেওয়ার বিষয়টি। দুই বছর আগে আমি তাদের পেজে এমন কমেন্ট করেছি।
ওই যে একাত্তরের ইতিহাস, ওই যে একটা বিবাদ—সেটারই প্রতিফলন। আসলে একটা পরিবার আওয়ামী লীগ নামের দলটাকে কুক্ষিগত করে ফেলেছে। এটা আওয়ামী লীগ না।
আমি তো এই ছিনতাই হওয়া আওয়ামী লীগের কাছে কিছু পেলাম না। তাই এবার গেলাম প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের কাছে। কারণ, সারা দেশের মানুষের তাঁর ওপর অনেক আশা-ভরসা। আমরা সবাই আশা করছি সংস্কার হবে, যাতে করে আগামী দিনে যে গণতান্ত্রিক সরকার আসবে, তারা যেন সঠিক পথে দেশ পরিচালনা করতে পারে।
আমি কেন বলছি শেষ পদযাত্রা? কারণ, রাষ্ট্রের কাছে আমার বাবাসহ জাতীয় নেতাদের সন্তান হিসেবে তাঁদের প্রতি সম্মান জানানোর অধিকার চাওয়ার বিষয়টি আমাকে খুব লজ্জিত করছে।
এরপরও যদি মানুষের কোনো সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হয়, তখনো কি এমন পদযাত্রা আর করবেন না?
আমি তো অনবরত কথা বলে যাচ্ছি। তবে একই দাবিতে পদযাত্রাটা শেষ করতে চাই, কারণ এতে আমি নিজে বিব্রত হচ্ছি। এটা খুব দুঃখজনক। আমার দাবি তিনটা সহজ। প্রথম, ৩ নভেম্বরকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া, যাতে মানুষ জানতে পারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল। কারা এই চার নেতা? যাঁরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পৃথিবীতে শুধু দুটি রাষ্ট্র ‘ডিক্লেয়ারেশন অব ইনডিপেনডেন্সের’ মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে—যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ। আমাদের একটা ডিক্লেয়ারেশন অব ইনডিপেনডেন্স আছে—প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স। ওইটার ভিত্তিতে আমরা ১০ এপ্রিল ১৯৭১ একটা সরকার গঠন করেছিলাম। ইতিহাস সংরক্ষণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে যদি সেই দিনকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এটা দ্বিতীয় দাবি। আমার তৃতীয় দাবি স্পষ্ট—জাতীয় চার নেতাসহ আমাদের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন—সকল বীর, হিরো, সুপারহিরো—যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের জীবনী তথা তাঁদের অবদান পাঠ্যপুস্তকে লিপিবদ্ধ করা এবং সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা; যেন একজন তরুণ বা তরুণী পড়ে বলতে পারেন, ‘ও মাই গড, তাঁরা এত বিসর্জন দিয়েছেন দেশের জন্য! এটা অনুপ্রেরণা জাগায়, একদম রক্ত গরম করে ফেলে। তাঁরা আমার দেশের জন্য এত করেছেন, তাহলে আমাদের আরও ভালো কিছু করতে হবে।’ এই যৌক্তিক দাবি পূরণ না করার তো কোনো কারণ আমি দেখছি না।
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক আছে। এই ব্যাপারে আপনার কী জানা আছে?
আমি যা জেনেছি এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। গণহত্যা যখন শুরু হলো ২৫ মার্চ, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেপ্তার হলেন, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আমার বাবা সে রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ছিলেন। তিনি একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে গিয়েছিলেন। কথা ছিল যে বঙ্গবন্ধু এই টেপ রেকর্ডারে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন এবং একটা কাগজে স্বাক্ষর দেওয়ার কথা ছিল একই মর্মে। সেই সময়ে শাহবাগে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সব সাংবাদিক অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই রেকর্ডেড মেসেজটা দেননি এবং ওই কাগজে স্বাক্ষর দেননি। আমার বাবা পরে বাসায় চলে আসেন। আমার মা-বোনদের মুখ থেকে শুনেছি, বাবা বাসায় এসে সব ফাইলপত্র ফেলে, তছনছ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের ২৩ বছরের আন্দোলন নষ্ট হয়ে গেল।’
আমি যেটা ধারণা করছি, যেহেতু বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন এবং আমার বাবা তখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে মুক্তির সংগ্রামে যোগ দেবেন, এই সময়টুকুর মধ্যে ইপিআরে আক্রমণ হয়েছে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এই খবরগুলো ছড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে। জিয়াউর রহমান ছিলেন চট্টগ্রামে। আমি মনে করছি, যেহেতু জিয়াউর রহমান দেখেছিলেন যে রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে কোনো ঘোষণা আসেনি, তিনি তখন নিজ উদ্যোগে ঘোষণা দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন প্রথমবার। প্রথমবার তিনি কিন্তু বলেছিলেন, ‘আই, প্রেসিডেন্ট জিয়া...’। তারপর রাজনৈতিক নেতারা তাঁকে বলেন যে আপনি ঘোষণাটা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দিন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘অন বিহাফ আওয়ার গ্রেট লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান...’। এগুলো হচ্ছে ইতিহাসের টুকরা টুকরা ঘটনা। এগুলোকে আমাদের পূর্ণাঙ্গভাবে বিবেচনা, বিশ্লেষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জিয়াউর রহমান যেটা করেছিলেন একজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে, তাঁর অবস্থান থেকে ওই সময়, ওই মুহূর্তে সেটা তিনি সঠিক মনে করেছিলেন। মানুষ তো রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঘোষণার অপেক্ষায় থাকে, সেটা যখন আসছিল না, তখন তিনি নিজে এই পদক্ষেপটা নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে আবার রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকেই নির্দেশনা আসে। কিন্তু এখানে ২৫, ২৬, ২৭ মার্চের গ্যাপটা কেন সৃষ্টি হলো, এটাও প্রশ্নের একটা বিষয়।
মুক্তিযুদ্ধে আপনি সবার অবদানের কথা বলছেন। তাহলে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মনে করেন কি না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে জেনেছি, পড়েছি। আমার কাছে মনে হয়, অনেকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক, আবার বলছি। জনগণ তাঁর নামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাঁর নামেই যুদ্ধ হয়েছে। তাঁর নামেই সরকার যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। এখানে কিছু প্রশ্ন আসে। তাঁর কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি কোনো ভূমিকা ছিল না। আমার মতে, আমরা ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ বলতে পারি—বঙ্গবন্ধু একজন এবং বাকি যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁরা সবাই ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ হতে পারেন। আমরা তো এটাকে শেয়ার করতে পারি। কেন আমরা একজনের ওপরে দিয়ে দিচ্ছি সবকিছু? একজনই যদি হতে হয় তাহলে সেটা মানুষ সিদ্ধান্ত নিক যে তিনি জাতির পিতা কি না। যদি মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়, হ্যাঁ তিনিই জাতির পিতা এবং সঙ্গে ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ ছিল, সেটাও ঠিক আছে।
১৫-১৬ বছরে বঙ্গবন্ধুকে ব্যানার হিসেবে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে কি তাঁর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করেন?
হ্যাঁ, অবশ্যই। এত বছরের লাগামহীন দুর্নীতি, কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা, পাশাপাশি আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা, হত্যা, গুম, মানে অরাজকতার একটা মহোৎসব চলছিল। এখন যেহেতু তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করেছেন, সেহেতু এই পুরো জিনিসটাই বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রতিফলিত হলো। মানুষ তো এখন বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে দেখছে। এ জন্যই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যগুলোর ওপর তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। মানুষ এখন লিংক করছে এই অনিয়ম, দুর্নীতি, অত্যাচার—সবকিছু এই ব্যক্তির নামে হয়েছে। এটা তো খুবই অন্যায় করা হলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে।
আপনি কি রাজনীতি ছেড়েছেন নাকি রাজনীতি আপনাকে ছেড়েছে?
এটা তো খুবই ইন্টারেস্টিং একটা প্রশ্ন। ২০০৮ সালে আমি খুব আশা নিয়ে এসেছিলাম দিনবদলের সনদ বাস্তবায়ন করব বলে। সরকারের প্রথম ছয় মাসের যে কর্মকাণ্ড দেখেছি, আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। আমি হুবহু আঁচ না করতে পারলেও আন্দাজ করতে পেরেছিলাম যে ৫ আগস্টের মতো ঘটনা হয়তো আসবে সামনে। ২০১৪-তে যদি সঠিক নির্বাচন দেওয়া হতো তাহলে হয়তো আর ৫ আগস্ট আসত না।
আমার অবস্থান থেকে, নৈতিকতার দিক থেকে আমি একটা শপথ নিয়েছিলাম বাংলাদেশের জনগণের কাছে, আমি যখন প্রতিমন্ত্রী হই। সেই শপথটা ছিল, আমি আমার সবকিছু দিয়ে সৎভাবে, সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করব। যখন দেখলাম আমাকে সেই দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না, যখন দেখলাম লাগামহীন দুর্নীতি শুরু হয়েছে, যখন দেখলাম রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন না এনে দ্বিগুণ গতিতে একই ধারা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন আমার সিদ্ধান্ত ছিল পদত্যাগ করা। পদত্যাগের মাধ্যমে আমি চেয়েছিলাম প্রতিবাদের একটা বীজ বপন করে দিতে।
শুধু কি এই কারণেই আপনাকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হলো? শেখ সেলিমের সঙ্গে নাকি আপনার বিরোধ হয়েছিল?
না, এ রকম কিছু হয়নি। হ্যাঁ, দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, কিন্তু ওটা কারণ ছিল না। কারণটা হচ্ছে, এক পরিবারের নিয়ন্ত্রণে সবকিছু ছিল এবং কোনো না কোনোভাবে পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তার করা ছিল একটা প্রধান কারণ। আমি চেষ্টা করছিলাম প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য। কিন্তু ওই বিশেষ পারিবারিক চাপ ছিল পুলিশের ওপর। এটাও একটা কারণ, ব্যক্তিগতভাবে কোনো দ্বন্দ্ব হয়নি। কিন্তু তাদের প্রভাব ছিল। সেই প্রভাবটা আমি বুঝতে পেরেছি, সেই প্রভাবটা একটা ফ্যাক্টর।
পদত্যাগের আর একটা কারণ ছিল বিডিআর বিদ্রোহের তদন্ত। যেভাবে তদন্ত হচ্ছিল আমার কাছে এটা ভালো লাগেনি। আমি চেয়েছিলাম তদন্তটা একদম পরিষ্কার হবে, স্বচ্ছ হবে। কিন্তু দেখা গেল তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলো তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল ফারুক খানকে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুরোপুরি বাইপাস করে, যেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ছিল বিডিআর। দৃশ্য থেকে আমাদের পুরোপুরি বাইরে রাখা হলো এবং তদন্তটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছিল। আমি তো মে মাস পর্যন্ত ছিলাম, তদন্ত চলেছে তার পরেও। এরপর কী হয়েছে আমি জানি না। ওই পর্যন্ত যখন আমি দেখলাম তদন্তটা আমাদের হাত থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, আমার কাছে এটা খুব অস্বাভাবিক লেগেছে। এটা তো হওয়ার কথা না। এখানে তো আমাদের সম্পৃক্ত থাকার কথা। আমি যদি সম্পৃক্ত থাকতাম, চেষ্টা করতাম স্বচ্ছ একটা তদন্ত করাতে। এখন অনেক প্রশ্ন উঠেছে বিডিআরের তদন্ত নিয়ে।
শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। আবার তিনিই কি দলটির বড় ক্ষতির কারণ হলেন?
আমি এটাই বলব, আশি ও নব্বইয়ের দশকে দলের মধ্যে কিছুটা ব্যালান্স ছিল। কারণ ওই সময় পর্যন্ত দলীয় ফোরামগুলোতে কথা বলা যেত। বিভিন্ন বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক হতো। কেউ কোনো বিষয়ে মতামত দিলে সেটা একেবারে অগ্রাহ্য করা হতো না। কিন্তু পরে ওই গণতন্ত্রটা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন অধঃপতন শুরু হয়। দুর্ভাগ্যবশত আমরা নীতি-আদর্শকেন্দ্রিক না হয়ে সুবিধাকেন্দ্রিক হয়ে যাই। আপনি যখন এককভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করবেন, আপনার কিন্তু লাইক-মাইন্ডের লোকজন লাগবে, যাঁরা আপনাকে অন্ধভাবে সমর্থন করবেন। তাই নীতি-আদর্শ বিচ্যুত করে আপনি দলের ভেতর এমন কিছু লোকজন ঢুকিয়েছেন, যাঁরা স্বার্থান্বেষী, যাঁরা নিজের পকেট ভারী করার জন্য, ক্ষমতা পাওয়ার জন্য এ দলটাকে একেবার মূল নৈতিক জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।
সম্প্রতি আপনার বোন শারমিন আহমদ বলেছেন, গণ-অভ্যুত্থানের সময় অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনায় আওয়ামী লীগের কারও মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। তাই এই দলটিতে তিনি যাবেন না, দল গড়বেন না। বোনের সঙ্গে কি আপনি একমত?
আমি সম্পূর্ণভাবে একমত। আমি বারবার বলছি, শেখ হাসিনাসহ এই আওয়ামী লীগ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতার আওয়ামী লীগ না। খাঁটি আওয়ামী লীগ না। আওয়ামী লীগটাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নামটা ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ভেতরে কিন্তু ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। আমার আম্মা একটা কথা বলতেন সব সময়, মাছের পচন ধরে মাছের মাথা থেকে, রাজনৈতিক দলের পচনও ধরে মাথা থেকে।
আপনি আওয়ামী লীগের হাল ধরবেন বলে শোনা যাচ্ছিল। কথাটি কি ঠিক?
কথাটা একেবারেই সত্যি না। অনেকেই অনেক জায়গা থেকে বলছেন। আমি জানি না কেন বলছেন। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, আমি রাজনীতিতে এলে তাঁদের অসুবিধা হয়ে যাবে, হয়তো আমি জনপ্রিয় বেশি, ঈর্ষান্বিত হচ্ছেন—আমি জানি না। কিন্তু আমি পরিষ্কারভাবে বলেছি, আমি রাজনীতিতে আসছি না। আমি যেখানে আছি, আমার কাজ নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। আমি স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কাজ করছি।
বাংলাদেশে এখন বিশাল একটা সমস্যা হচ্ছে, এই যে চারদিকে এখন হাসপাতালে ভরে গেছে। চিকিৎসাখানা, ফার্মেসি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে মানুষ ভুগছে। এটার কারণ হচ্ছে, একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখন আধুনিক জীবনযাপন করছে, শহরকেন্দ্রিক। যার ফলে আমরা নানাবিধ অসুখ-বিসুখে ভুগছি। আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছি। আমি হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের জীবন বদলে দিয়েছি—এটা আমাকে সাংঘাতিকভাবে সন্তুষ্টি দেয়। কারণ একটা মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হচ্ছে স্বাস্থ্য, সুস্থতা। এখন আমি কথা বলছি, এটা যদি রাজনীতি হয়, তাহলে রাজনীতি। আমি তো কথা বলেই যাব, এটা তো আমার দেশ, আমার অধিকার আছে কথা বলার। কিন্তু ওই প্ল্যাটফর্ম করে রাজনীতি করার ইচ্ছা আমার নেই।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের যে প্রভাব গড়ে উঠেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী বলে আপনি মনে করেন?
উপায় হচ্ছে নতুন প্রজন্ম, নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। ছাত্র-জনতা গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পরিবর্তন আনল। তাই এখন নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের মালিকানা নিতে হবে। কিন্তু সেটা অবশ্যই একাত্তর সালকে ভুলে গিয়ে না। কারণ, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমাদের প্রাণশক্তি। আর ৫ আগস্ট হচ্ছে সেটারই ধারাবাহিকতা। আবার বলছি, ৫ আগস্টের যে দাবিদাওয়া ছিল, সেগুলো কিন্তু মুক্তিযুদ্ধেরও দাবিদাওয়া। সেই সময়ের মানুষ যেটা চেয়েছিল, ৫ আগস্টেও ছাত্র-জনতা তা-ই চেয়েছে। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ একই সূত্রে গাথা। নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে ইতিহাস থেকে। সেটাকে প্রাণশক্তি করে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে বিনির্মাণ করতে হবে। তাদের এগিয়ে আসতে হবে, কিন্তু তাদের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসও জানতে হবে। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আমরা অনুপ্রেরণা নিতে পারব তাঁদের কাছ থেকে, যাঁরা অবদান রেখেছেন বাংলাদেশের জন্য।
যেকোনো সভ্যতার দিকে যদি তাকাই, আমি রোমের কথা, গ্রিসের কথাই বলব। তারা এতদূর এগোতে পেরেছিল একটা কারণে—তারা তাদের নায়কদের সম্মান করত। তাই আপনার জন্য যাঁরা অবদান রেখেছেন, বলিদান দিয়েছেন, আপনি যদি তাঁদের সম্মান না দেন তাহলে আপনার কোনো ভবিষ্যৎ হবে না। এটা ইতিহাসই বলে দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে আপনি কেন দলটির তেমন সমালোচনা করেননি, এখন যেমন করছেন?
আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমার এক ভাগনেকেও কিন্তু গুম করা হয়েছিল। তাকে ১১ দিন আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল। আমি যখন পদত্যাগ নাটকের শিকার হই—পদত্যাগ করতেও কিন্তু আমাকে প্রায় যুদ্ধ করতে হয়েছিল। পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হচ্ছিল না, বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছিল, অনেক যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত আমি সংসদ সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছি। এখানেও আবার নাটক—আমি স্পিকার হামিদ সাহেবের কাছে পাঠিয়েছিলাম পদত্যাগপত্র। তিনি বললেন, এটা কে না কে পাঠিয়েছে! অথচ আমি তাঁকে ফোন করে বললাম, ‘হামিদ কাকু (তাঁকে কাকু ডাকতাম), আমি কিন্তু পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছি। পরে আমি নিজে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিলাম। এটা শুনে প্রধানমন্ত্রী খুব আশ্চর্য হলেন, ‘তুমি পদত্যাগ করে আসছো?’ তার আগে অনেক ঘটনা ছিল। অনেকভাবে চেষ্টা করা হয়েছিল আমাকে রাখার জন্য।
যাই হোক, এখানে বুঝতে হবে, বিডিআর বিদ্রোহ, ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা ঘটনা পরম্পরায় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়েছে। রীতিমতো একনায়কতন্ত্রের পথে যাত্রা। ডিজিএফআই, এনএসআইয়ের প্রভাব চারদিকে ছিল। ২০১১, ২০১২, ২০১৩ সালের দিকে কিন্তু গুম হওয়া শুরু করল। খোঁজ করে দেখেন, এই সংস্কৃতিটা শুরু হয়েছে তখন। এই অবস্থায় আমার আরেক ভাগনেকে পুলিশ বেধড়ক মারধর করল। এগুলো সব আমার জন্য ইশারা ছিল।
আমরা দেখেছি, সরকার যে-ই হোক না কেন, একটা পর্যায়ে গিয়ে ‘ফ্যাসিস্ট’ আচরণ প্রকাশ পেতে থাকে। জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ বইটি নিশ্চয়ই পড়েছেন, অনেকটা সে রকম। যেখানে শাসক বদলালেও স্বৈরশাসন বারবার ফিরে আসে। উপন্যাসটির সঙ্গে বাস্তবতার মিল পান কি?
‘অল অ্যানিমেলস আর ইক্যুয়াল বাট সাম অ্যানিমেলস আর মোর ইক্যুয়াল।’ পড়েছি অ্যানিমেল ফার্ম। যাই হোক, ফ্যাসিস্ট আচরণ আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট সরকার ছিল না। কারণ, এখানে ফ্যাসিস্ট সংজ্ঞার একটা বিষয় আছে। ফ্যাসিজম একটা মতাদর্শকে প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু এখানে তো কোনো মতাদর্শ ছিল না। এটা তো একটা দুর্নীতি, হত্যাযজ্ঞ, গুম, খুনের উৎসব ছিল। আমি বলব এটা একটা ক্লেপ্টোক্রেসি, মাফিয়া এবং পরিবারতন্ত্রের সম্মিলন—তিনটার সংমিশ্রণে এটা একটা হাইব্রিড ফিউশন সিস্টেম। এটার নাম এখনো কেউ দিতে পারেনি। এ জন্যই আমরা বলি ফ্যাসিস্ট।
কেন যেন এই উপমহাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা পরিবারকেন্দ্রিক। আমরা শ্রীলঙ্কায় সেটা দেখেছি। পাকিস্তানে দেখেছি। বাংলাদেশে দেখেছি। একমাত্র ভারত কিছুটা বেরিয়ে এসেছে, কারণ ওরা গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। যদিও কংগ্রেস আছে কিন্তু ওদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এত মজবুত যে ওই সুবিধা ওরা পাচ্ছে না আমাদের তুলনায়। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও মজবুত করতে হবে, যাতে এ রকম ক্লেপ্টোক্রেসি, মাফিওক্রেসি পরিবারতন্ত্র আর মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে। আমাদের সবার এক থাকতে হবে এই জায়গাটায়। সব রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য যেন হয় জনসেবা। রাজনীতির মূলে আমাদের চলে যেতে হবে। এ জন্য জনগণেরই চাপ সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু জনগণ তো খুব অসহায়।
শেখ হাসিনার ১৫-১৬ বছরের সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে আচরণ, সেটা কি তাঁর নিজের গড়া, নাকি আশপাশের কারও মাধ্যমে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন? আপনার কী মনে হয়?
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমি তাঁর খুব কাছাকাছি থেকে বিরোধীদলীয় রাজনীতি করেছিলাম। পরে ২০০৮-০৯ সালে যখন মন্ত্রিসভায় ছিলাম, তাঁকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তাঁর ভাবভঙ্গি, আচার পুরোপুরি ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। তিনি আগে যেমন ছিলেন, তা থেকে রাতারাতি পরিবর্তিত হয়ে গেলেন। আমি যতটুকু দেখেছি, তাঁকে পরামর্শ দেওয়ার মতো কেউ নেই বাংলাদেশে। যা কিছু হতো, তাঁর ইচ্ছায় হতো। দলীয় ফোরামে এবং ইনফরমাল মিটিংয়ে কোনো বিষয়ে কথা হলে সবাই ভেবেছি তাঁকে এই ব্যাপারে বলতে হবে, কিন্তু তিনি আসার পর সবাই চুপ থাকতেন এবং তিনি কী শুনতে চান, সেটা আঁচ করে অন্যরা সুর পাল্টে ফেলতেন।
আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
আপাতত আমার কোনো নির্ধারিত পরিকল্পনা নেই। আমি যে কাজটা করছি সেটা করেই আমি তৃপ্তি পাই, খুব সন্তুষ্ট আছি। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা তো আমাদের কারোরই জানা নেই। এটা মহান আল্লাহ তাআলাই জানেন।
কিন্তু অনেকের বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে একটা আশা ছিল যে সোহেল তাজ একটা দল গঠন করবেন, দিশা দেখাবেন।
আমি বিশ্বাস করি যে তরুণদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা প্রত্যেকে একটা করে দুর্গ হতে পারি বাংলাদেশের জন্য। প্রত্যেককেই নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নীতি-আদর্শ থাকতে হবে এবং দৃঢ়তা থাকতে হবে। আমরা যদি এই অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে পারি, তাহলে আরও অনেকেই চলে আসবে। সবাইকে নিজ উদ্যোগে বেরিয়ে আসতে হবে, কারও জন্য অপেক্ষা করলে হবে না। তাহলে আপনা-আপনি একটা নেতৃত্ব চলে আসবে।
বর্তমান তরুণদের ওপর আপনার আস্থা কতটুকু?
আসলে আমরা সবাই আশ্চর্য হয়েছি এবারের এই আন্দোলনটা দেখে। আমরা ভেবেছিলাম জেন-জি হচ্ছে মোবাইল ডিভাইস নিয়ে বসে থাকে। কিন্তু তারা প্রমাণ করল যে তারাও আন্দোলন করতে পারে, অধিকারের জন্য লড়াই করতে পারে। জীবন দিতে পারে। এটা আমাদের আশান্বিত করে যে তারা পারবে।
এই অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু সফল বা ব্যর্থ বলে আপনি মনে করেন?
আমাদের বাংলাদেশ কিন্তু একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখনো আমরা এটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কারণ, ১৫-১৬ বছরে যে একনায়কতন্ত্র কায়েম করা হয়েছিল, তাতে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছে। দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা—সব ক্ষেত্রে ‘ইয়েস ম্যান’ বসিয়ে তাদের মতলব হাসিল করা হয়েছে। এখন এই অন্তর্বর্তী সরকার এসে এ রকম একটা পরিস্থিতির ভেতরে পড়েছে। তাদের কোনো দল নেই। তাদের বসিয়েছে ছাত্ররা। অন্যদিকে বড় বড় রাজনৈতিক দল আছে, যাদের সমর্থক গোষ্ঠী সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে। আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় আওয়ামী লীগে এখনো ন্যূনতম সমর্থক আছে ৩০ শতাংশ। বিএনপির আছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। ২০-২৫ শতাংশ আছে স্বতন্ত্র। বাকিরা জামায়াতের সমর্থক। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আপনি যখন সংস্কার করতে যাবেন, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল কিন্তু তাদের সুবিধাগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য নানাভাবে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করবে।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা। গণ-অভ্যুত্থান যখন ঘটে, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা কিন্তু আকাশচুম্বী হয়। জনগণ খুশি থাকে কখন? তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কাজ যখন সুন্দরভাবে করতে পারে। এর মধ্যে আছে দ্রব্যমূল্য, নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা। দুর্ভাগ্যবশত এই ক্ষেত্রগুলো কিন্তু এখনো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি এই সরকার। আমি আগে যে প্রতিকূলতার কথা বললাম, তাদের ওই বাধাগুলো অতিক্রম করতে একটু সময় লাগছে। আমি মনে করি, এদিকে নজর দেওয়া উচিত। সিন্ডিকেটগুলো ভাঙতে পারেনি। এখন উল্টো দাম বেড়ে যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। আমার বিনীত পরামর্শ থাকবে যে এদিকে একটু বেশি মনোনিবেশ করার। কারণ, জনগণ যদি আবার তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো না পায় তাহলে কথা বলা শুরু করবে। তাই আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নাগালের মধ্যে আনতে হবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ। ধন্যবাদ আজকের পত্রিকার পাঠকদেরও।

তানজিম আহমদ সোহেল তাজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সন্তান। ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি গাজীপুর-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের রাজনীতি, দেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব ও ভবিষ্যতের রাজনীতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন।
সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন

প্রধান উপদেষ্টা আপনাকে ফোন করেছিলেন। কী কথা হলো তাঁর সঙ্গে?
আমি খুবই সম্মানিত হয়েছি। কারণ, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা একজন নোবেল লরিয়েট, বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য ব্যক্তি। তিনি যে এত অমায়িকভাবে আমাকে ফোন দেবেন, আমি এতে খুবই আশ্চর্য হয়েছি, খুবই মুগ্ধ হয়েছি। তিনি ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে আমি যেদিন পদযাত্রা করেছি, সেদিন তিনি দেখা করতে পারেননি। তিনি স্বীকার করেছেন আমাদের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। এ বিষয়টা তিনি দেখবেন। আমার বাবাসহ মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় নেতাদের অবদানের কথা বললেন।
আপনি ৩ নভেম্বর তিনটি দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে পদযাত্রা করেছেন। বলেছেন এটি আপনার শেষ পদযাত্রা। শেষ পদযাত্রা কেন?
আমি এই পদযাত্রাটা তিন বছর ধরে করছি। আগের দুই বছর কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব যে দল দিয়েছিল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সেই দল সরকারে ছিল। এটা যদি সত্যিকারের নীতি-আদর্শের আওয়ামী লীগ হতো, অবশ্যই আমার দাবিগুলো বাস্তবায়ন করে ফেলত। তারা তো তা করেইনি বরং উপেক্ষা করেছে।
এবার দেখছি আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে অনেকের বিবৃতি আসছে। অথচ দুই বছর আগে আমাকে তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে হয়েছে জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে পোস্ট দেওয়ার বিষয়টি। দুই বছর আগে আমি তাদের পেজে এমন কমেন্ট করেছি।
ওই যে একাত্তরের ইতিহাস, ওই যে একটা বিবাদ—সেটারই প্রতিফলন। আসলে একটা পরিবার আওয়ামী লীগ নামের দলটাকে কুক্ষিগত করে ফেলেছে। এটা আওয়ামী লীগ না।
আমি তো এই ছিনতাই হওয়া আওয়ামী লীগের কাছে কিছু পেলাম না। তাই এবার গেলাম প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের কাছে। কারণ, সারা দেশের মানুষের তাঁর ওপর অনেক আশা-ভরসা। আমরা সবাই আশা করছি সংস্কার হবে, যাতে করে আগামী দিনে যে গণতান্ত্রিক সরকার আসবে, তারা যেন সঠিক পথে দেশ পরিচালনা করতে পারে।
আমি কেন বলছি শেষ পদযাত্রা? কারণ, রাষ্ট্রের কাছে আমার বাবাসহ জাতীয় নেতাদের সন্তান হিসেবে তাঁদের প্রতি সম্মান জানানোর অধিকার চাওয়ার বিষয়টি আমাকে খুব লজ্জিত করছে।
এরপরও যদি মানুষের কোনো সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হয়, তখনো কি এমন পদযাত্রা আর করবেন না?
আমি তো অনবরত কথা বলে যাচ্ছি। তবে একই দাবিতে পদযাত্রাটা শেষ করতে চাই, কারণ এতে আমি নিজে বিব্রত হচ্ছি। এটা খুব দুঃখজনক। আমার দাবি তিনটা সহজ। প্রথম, ৩ নভেম্বরকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া, যাতে মানুষ জানতে পারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল। কারা এই চার নেতা? যাঁরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পৃথিবীতে শুধু দুটি রাষ্ট্র ‘ডিক্লেয়ারেশন অব ইনডিপেনডেন্সের’ মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে—যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ। আমাদের একটা ডিক্লেয়ারেশন অব ইনডিপেনডেন্স আছে—প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স। ওইটার ভিত্তিতে আমরা ১০ এপ্রিল ১৯৭১ একটা সরকার গঠন করেছিলাম। ইতিহাস সংরক্ষণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে যদি সেই দিনকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এটা দ্বিতীয় দাবি। আমার তৃতীয় দাবি স্পষ্ট—জাতীয় চার নেতাসহ আমাদের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন—সকল বীর, হিরো, সুপারহিরো—যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের জীবনী তথা তাঁদের অবদান পাঠ্যপুস্তকে লিপিবদ্ধ করা এবং সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা; যেন একজন তরুণ বা তরুণী পড়ে বলতে পারেন, ‘ও মাই গড, তাঁরা এত বিসর্জন দিয়েছেন দেশের জন্য! এটা অনুপ্রেরণা জাগায়, একদম রক্ত গরম করে ফেলে। তাঁরা আমার দেশের জন্য এত করেছেন, তাহলে আমাদের আরও ভালো কিছু করতে হবে।’ এই যৌক্তিক দাবি পূরণ না করার তো কোনো কারণ আমি দেখছি না।
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক আছে। এই ব্যাপারে আপনার কী জানা আছে?
আমি যা জেনেছি এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। গণহত্যা যখন শুরু হলো ২৫ মার্চ, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেপ্তার হলেন, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আমার বাবা সে রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ছিলেন। তিনি একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে গিয়েছিলেন। কথা ছিল যে বঙ্গবন্ধু এই টেপ রেকর্ডারে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন এবং একটা কাগজে স্বাক্ষর দেওয়ার কথা ছিল একই মর্মে। সেই সময়ে শাহবাগে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সব সাংবাদিক অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই রেকর্ডেড মেসেজটা দেননি এবং ওই কাগজে স্বাক্ষর দেননি। আমার বাবা পরে বাসায় চলে আসেন। আমার মা-বোনদের মুখ থেকে শুনেছি, বাবা বাসায় এসে সব ফাইলপত্র ফেলে, তছনছ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের ২৩ বছরের আন্দোলন নষ্ট হয়ে গেল।’
আমি যেটা ধারণা করছি, যেহেতু বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন এবং আমার বাবা তখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে মুক্তির সংগ্রামে যোগ দেবেন, এই সময়টুকুর মধ্যে ইপিআরে আক্রমণ হয়েছে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এই খবরগুলো ছড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে। জিয়াউর রহমান ছিলেন চট্টগ্রামে। আমি মনে করছি, যেহেতু জিয়াউর রহমান দেখেছিলেন যে রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে কোনো ঘোষণা আসেনি, তিনি তখন নিজ উদ্যোগে ঘোষণা দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন প্রথমবার। প্রথমবার তিনি কিন্তু বলেছিলেন, ‘আই, প্রেসিডেন্ট জিয়া...’। তারপর রাজনৈতিক নেতারা তাঁকে বলেন যে আপনি ঘোষণাটা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দিন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘অন বিহাফ আওয়ার গ্রেট লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান...’। এগুলো হচ্ছে ইতিহাসের টুকরা টুকরা ঘটনা। এগুলোকে আমাদের পূর্ণাঙ্গভাবে বিবেচনা, বিশ্লেষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জিয়াউর রহমান যেটা করেছিলেন একজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে, তাঁর অবস্থান থেকে ওই সময়, ওই মুহূর্তে সেটা তিনি সঠিক মনে করেছিলেন। মানুষ তো রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঘোষণার অপেক্ষায় থাকে, সেটা যখন আসছিল না, তখন তিনি নিজে এই পদক্ষেপটা নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে আবার রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকেই নির্দেশনা আসে। কিন্তু এখানে ২৫, ২৬, ২৭ মার্চের গ্যাপটা কেন সৃষ্টি হলো, এটাও প্রশ্নের একটা বিষয়।
মুক্তিযুদ্ধে আপনি সবার অবদানের কথা বলছেন। তাহলে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মনে করেন কি না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে জেনেছি, পড়েছি। আমার কাছে মনে হয়, অনেকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক, আবার বলছি। জনগণ তাঁর নামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাঁর নামেই যুদ্ধ হয়েছে। তাঁর নামেই সরকার যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। এখানে কিছু প্রশ্ন আসে। তাঁর কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি কোনো ভূমিকা ছিল না। আমার মতে, আমরা ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ বলতে পারি—বঙ্গবন্ধু একজন এবং বাকি যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁরা সবাই ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ হতে পারেন। আমরা তো এটাকে শেয়ার করতে পারি। কেন আমরা একজনের ওপরে দিয়ে দিচ্ছি সবকিছু? একজনই যদি হতে হয় তাহলে সেটা মানুষ সিদ্ধান্ত নিক যে তিনি জাতির পিতা কি না। যদি মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়, হ্যাঁ তিনিই জাতির পিতা এবং সঙ্গে ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ ছিল, সেটাও ঠিক আছে।
১৫-১৬ বছরে বঙ্গবন্ধুকে ব্যানার হিসেবে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে কি তাঁর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করেন?
হ্যাঁ, অবশ্যই। এত বছরের লাগামহীন দুর্নীতি, কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা, পাশাপাশি আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা, হত্যা, গুম, মানে অরাজকতার একটা মহোৎসব চলছিল। এখন যেহেতু তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করেছেন, সেহেতু এই পুরো জিনিসটাই বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রতিফলিত হলো। মানুষ তো এখন বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে দেখছে। এ জন্যই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যগুলোর ওপর তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। মানুষ এখন লিংক করছে এই অনিয়ম, দুর্নীতি, অত্যাচার—সবকিছু এই ব্যক্তির নামে হয়েছে। এটা তো খুবই অন্যায় করা হলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে।
আপনি কি রাজনীতি ছেড়েছেন নাকি রাজনীতি আপনাকে ছেড়েছে?
এটা তো খুবই ইন্টারেস্টিং একটা প্রশ্ন। ২০০৮ সালে আমি খুব আশা নিয়ে এসেছিলাম দিনবদলের সনদ বাস্তবায়ন করব বলে। সরকারের প্রথম ছয় মাসের যে কর্মকাণ্ড দেখেছি, আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। আমি হুবহু আঁচ না করতে পারলেও আন্দাজ করতে পেরেছিলাম যে ৫ আগস্টের মতো ঘটনা হয়তো আসবে সামনে। ২০১৪-তে যদি সঠিক নির্বাচন দেওয়া হতো তাহলে হয়তো আর ৫ আগস্ট আসত না।
আমার অবস্থান থেকে, নৈতিকতার দিক থেকে আমি একটা শপথ নিয়েছিলাম বাংলাদেশের জনগণের কাছে, আমি যখন প্রতিমন্ত্রী হই। সেই শপথটা ছিল, আমি আমার সবকিছু দিয়ে সৎভাবে, সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করব। যখন দেখলাম আমাকে সেই দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না, যখন দেখলাম লাগামহীন দুর্নীতি শুরু হয়েছে, যখন দেখলাম রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন না এনে দ্বিগুণ গতিতে একই ধারা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন আমার সিদ্ধান্ত ছিল পদত্যাগ করা। পদত্যাগের মাধ্যমে আমি চেয়েছিলাম প্রতিবাদের একটা বীজ বপন করে দিতে।
শুধু কি এই কারণেই আপনাকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হলো? শেখ সেলিমের সঙ্গে নাকি আপনার বিরোধ হয়েছিল?
না, এ রকম কিছু হয়নি। হ্যাঁ, দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, কিন্তু ওটা কারণ ছিল না। কারণটা হচ্ছে, এক পরিবারের নিয়ন্ত্রণে সবকিছু ছিল এবং কোনো না কোনোভাবে পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তার করা ছিল একটা প্রধান কারণ। আমি চেষ্টা করছিলাম প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য। কিন্তু ওই বিশেষ পারিবারিক চাপ ছিল পুলিশের ওপর। এটাও একটা কারণ, ব্যক্তিগতভাবে কোনো দ্বন্দ্ব হয়নি। কিন্তু তাদের প্রভাব ছিল। সেই প্রভাবটা আমি বুঝতে পেরেছি, সেই প্রভাবটা একটা ফ্যাক্টর।
পদত্যাগের আর একটা কারণ ছিল বিডিআর বিদ্রোহের তদন্ত। যেভাবে তদন্ত হচ্ছিল আমার কাছে এটা ভালো লাগেনি। আমি চেয়েছিলাম তদন্তটা একদম পরিষ্কার হবে, স্বচ্ছ হবে। কিন্তু দেখা গেল তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলো তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল ফারুক খানকে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুরোপুরি বাইপাস করে, যেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ছিল বিডিআর। দৃশ্য থেকে আমাদের পুরোপুরি বাইরে রাখা হলো এবং তদন্তটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছিল। আমি তো মে মাস পর্যন্ত ছিলাম, তদন্ত চলেছে তার পরেও। এরপর কী হয়েছে আমি জানি না। ওই পর্যন্ত যখন আমি দেখলাম তদন্তটা আমাদের হাত থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, আমার কাছে এটা খুব অস্বাভাবিক লেগেছে। এটা তো হওয়ার কথা না। এখানে তো আমাদের সম্পৃক্ত থাকার কথা। আমি যদি সম্পৃক্ত থাকতাম, চেষ্টা করতাম স্বচ্ছ একটা তদন্ত করাতে। এখন অনেক প্রশ্ন উঠেছে বিডিআরের তদন্ত নিয়ে।
শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। আবার তিনিই কি দলটির বড় ক্ষতির কারণ হলেন?
আমি এটাই বলব, আশি ও নব্বইয়ের দশকে দলের মধ্যে কিছুটা ব্যালান্স ছিল। কারণ ওই সময় পর্যন্ত দলীয় ফোরামগুলোতে কথা বলা যেত। বিভিন্ন বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক হতো। কেউ কোনো বিষয়ে মতামত দিলে সেটা একেবারে অগ্রাহ্য করা হতো না। কিন্তু পরে ওই গণতন্ত্রটা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন অধঃপতন শুরু হয়। দুর্ভাগ্যবশত আমরা নীতি-আদর্শকেন্দ্রিক না হয়ে সুবিধাকেন্দ্রিক হয়ে যাই। আপনি যখন এককভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করবেন, আপনার কিন্তু লাইক-মাইন্ডের লোকজন লাগবে, যাঁরা আপনাকে অন্ধভাবে সমর্থন করবেন। তাই নীতি-আদর্শ বিচ্যুত করে আপনি দলের ভেতর এমন কিছু লোকজন ঢুকিয়েছেন, যাঁরা স্বার্থান্বেষী, যাঁরা নিজের পকেট ভারী করার জন্য, ক্ষমতা পাওয়ার জন্য এ দলটাকে একেবার মূল নৈতিক জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।
সম্প্রতি আপনার বোন শারমিন আহমদ বলেছেন, গণ-অভ্যুত্থানের সময় অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনায় আওয়ামী লীগের কারও মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। তাই এই দলটিতে তিনি যাবেন না, দল গড়বেন না। বোনের সঙ্গে কি আপনি একমত?
আমি সম্পূর্ণভাবে একমত। আমি বারবার বলছি, শেখ হাসিনাসহ এই আওয়ামী লীগ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতার আওয়ামী লীগ না। খাঁটি আওয়ামী লীগ না। আওয়ামী লীগটাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নামটা ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ভেতরে কিন্তু ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। আমার আম্মা একটা কথা বলতেন সব সময়, মাছের পচন ধরে মাছের মাথা থেকে, রাজনৈতিক দলের পচনও ধরে মাথা থেকে।
আপনি আওয়ামী লীগের হাল ধরবেন বলে শোনা যাচ্ছিল। কথাটি কি ঠিক?
কথাটা একেবারেই সত্যি না। অনেকেই অনেক জায়গা থেকে বলছেন। আমি জানি না কেন বলছেন। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, আমি রাজনীতিতে এলে তাঁদের অসুবিধা হয়ে যাবে, হয়তো আমি জনপ্রিয় বেশি, ঈর্ষান্বিত হচ্ছেন—আমি জানি না। কিন্তু আমি পরিষ্কারভাবে বলেছি, আমি রাজনীতিতে আসছি না। আমি যেখানে আছি, আমার কাজ নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। আমি স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কাজ করছি।
বাংলাদেশে এখন বিশাল একটা সমস্যা হচ্ছে, এই যে চারদিকে এখন হাসপাতালে ভরে গেছে। চিকিৎসাখানা, ফার্মেসি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে মানুষ ভুগছে। এটার কারণ হচ্ছে, একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখন আধুনিক জীবনযাপন করছে, শহরকেন্দ্রিক। যার ফলে আমরা নানাবিধ অসুখ-বিসুখে ভুগছি। আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছি। আমি হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের জীবন বদলে দিয়েছি—এটা আমাকে সাংঘাতিকভাবে সন্তুষ্টি দেয়। কারণ একটা মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হচ্ছে স্বাস্থ্য, সুস্থতা। এখন আমি কথা বলছি, এটা যদি রাজনীতি হয়, তাহলে রাজনীতি। আমি তো কথা বলেই যাব, এটা তো আমার দেশ, আমার অধিকার আছে কথা বলার। কিন্তু ওই প্ল্যাটফর্ম করে রাজনীতি করার ইচ্ছা আমার নেই।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের যে প্রভাব গড়ে উঠেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী বলে আপনি মনে করেন?
উপায় হচ্ছে নতুন প্রজন্ম, নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। ছাত্র-জনতা গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পরিবর্তন আনল। তাই এখন নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের মালিকানা নিতে হবে। কিন্তু সেটা অবশ্যই একাত্তর সালকে ভুলে গিয়ে না। কারণ, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমাদের প্রাণশক্তি। আর ৫ আগস্ট হচ্ছে সেটারই ধারাবাহিকতা। আবার বলছি, ৫ আগস্টের যে দাবিদাওয়া ছিল, সেগুলো কিন্তু মুক্তিযুদ্ধেরও দাবিদাওয়া। সেই সময়ের মানুষ যেটা চেয়েছিল, ৫ আগস্টেও ছাত্র-জনতা তা-ই চেয়েছে। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ একই সূত্রে গাথা। নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে ইতিহাস থেকে। সেটাকে প্রাণশক্তি করে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে বিনির্মাণ করতে হবে। তাদের এগিয়ে আসতে হবে, কিন্তু তাদের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসও জানতে হবে। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আমরা অনুপ্রেরণা নিতে পারব তাঁদের কাছ থেকে, যাঁরা অবদান রেখেছেন বাংলাদেশের জন্য।
যেকোনো সভ্যতার দিকে যদি তাকাই, আমি রোমের কথা, গ্রিসের কথাই বলব। তারা এতদূর এগোতে পেরেছিল একটা কারণে—তারা তাদের নায়কদের সম্মান করত। তাই আপনার জন্য যাঁরা অবদান রেখেছেন, বলিদান দিয়েছেন, আপনি যদি তাঁদের সম্মান না দেন তাহলে আপনার কোনো ভবিষ্যৎ হবে না। এটা ইতিহাসই বলে দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে আপনি কেন দলটির তেমন সমালোচনা করেননি, এখন যেমন করছেন?
আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমার এক ভাগনেকেও কিন্তু গুম করা হয়েছিল। তাকে ১১ দিন আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল। আমি যখন পদত্যাগ নাটকের শিকার হই—পদত্যাগ করতেও কিন্তু আমাকে প্রায় যুদ্ধ করতে হয়েছিল। পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হচ্ছিল না, বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছিল, অনেক যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত আমি সংসদ সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছি। এখানেও আবার নাটক—আমি স্পিকার হামিদ সাহেবের কাছে পাঠিয়েছিলাম পদত্যাগপত্র। তিনি বললেন, এটা কে না কে পাঠিয়েছে! অথচ আমি তাঁকে ফোন করে বললাম, ‘হামিদ কাকু (তাঁকে কাকু ডাকতাম), আমি কিন্তু পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছি। পরে আমি নিজে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিলাম। এটা শুনে প্রধানমন্ত্রী খুব আশ্চর্য হলেন, ‘তুমি পদত্যাগ করে আসছো?’ তার আগে অনেক ঘটনা ছিল। অনেকভাবে চেষ্টা করা হয়েছিল আমাকে রাখার জন্য।
যাই হোক, এখানে বুঝতে হবে, বিডিআর বিদ্রোহ, ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা ঘটনা পরম্পরায় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়েছে। রীতিমতো একনায়কতন্ত্রের পথে যাত্রা। ডিজিএফআই, এনএসআইয়ের প্রভাব চারদিকে ছিল। ২০১১, ২০১২, ২০১৩ সালের দিকে কিন্তু গুম হওয়া শুরু করল। খোঁজ করে দেখেন, এই সংস্কৃতিটা শুরু হয়েছে তখন। এই অবস্থায় আমার আরেক ভাগনেকে পুলিশ বেধড়ক মারধর করল। এগুলো সব আমার জন্য ইশারা ছিল।
আমরা দেখেছি, সরকার যে-ই হোক না কেন, একটা পর্যায়ে গিয়ে ‘ফ্যাসিস্ট’ আচরণ প্রকাশ পেতে থাকে। জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ বইটি নিশ্চয়ই পড়েছেন, অনেকটা সে রকম। যেখানে শাসক বদলালেও স্বৈরশাসন বারবার ফিরে আসে। উপন্যাসটির সঙ্গে বাস্তবতার মিল পান কি?
‘অল অ্যানিমেলস আর ইক্যুয়াল বাট সাম অ্যানিমেলস আর মোর ইক্যুয়াল।’ পড়েছি অ্যানিমেল ফার্ম। যাই হোক, ফ্যাসিস্ট আচরণ আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট সরকার ছিল না। কারণ, এখানে ফ্যাসিস্ট সংজ্ঞার একটা বিষয় আছে। ফ্যাসিজম একটা মতাদর্শকে প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু এখানে তো কোনো মতাদর্শ ছিল না। এটা তো একটা দুর্নীতি, হত্যাযজ্ঞ, গুম, খুনের উৎসব ছিল। আমি বলব এটা একটা ক্লেপ্টোক্রেসি, মাফিয়া এবং পরিবারতন্ত্রের সম্মিলন—তিনটার সংমিশ্রণে এটা একটা হাইব্রিড ফিউশন সিস্টেম। এটার নাম এখনো কেউ দিতে পারেনি। এ জন্যই আমরা বলি ফ্যাসিস্ট।
কেন যেন এই উপমহাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা পরিবারকেন্দ্রিক। আমরা শ্রীলঙ্কায় সেটা দেখেছি। পাকিস্তানে দেখেছি। বাংলাদেশে দেখেছি। একমাত্র ভারত কিছুটা বেরিয়ে এসেছে, কারণ ওরা গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। যদিও কংগ্রেস আছে কিন্তু ওদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এত মজবুত যে ওই সুবিধা ওরা পাচ্ছে না আমাদের তুলনায়। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও মজবুত করতে হবে, যাতে এ রকম ক্লেপ্টোক্রেসি, মাফিওক্রেসি পরিবারতন্ত্র আর মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে। আমাদের সবার এক থাকতে হবে এই জায়গাটায়। সব রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য যেন হয় জনসেবা। রাজনীতির মূলে আমাদের চলে যেতে হবে। এ জন্য জনগণেরই চাপ সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু জনগণ তো খুব অসহায়।
শেখ হাসিনার ১৫-১৬ বছরের সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে আচরণ, সেটা কি তাঁর নিজের গড়া, নাকি আশপাশের কারও মাধ্যমে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন? আপনার কী মনে হয়?
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমি তাঁর খুব কাছাকাছি থেকে বিরোধীদলীয় রাজনীতি করেছিলাম। পরে ২০০৮-০৯ সালে যখন মন্ত্রিসভায় ছিলাম, তাঁকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তাঁর ভাবভঙ্গি, আচার পুরোপুরি ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। তিনি আগে যেমন ছিলেন, তা থেকে রাতারাতি পরিবর্তিত হয়ে গেলেন। আমি যতটুকু দেখেছি, তাঁকে পরামর্শ দেওয়ার মতো কেউ নেই বাংলাদেশে। যা কিছু হতো, তাঁর ইচ্ছায় হতো। দলীয় ফোরামে এবং ইনফরমাল মিটিংয়ে কোনো বিষয়ে কথা হলে সবাই ভেবেছি তাঁকে এই ব্যাপারে বলতে হবে, কিন্তু তিনি আসার পর সবাই চুপ থাকতেন এবং তিনি কী শুনতে চান, সেটা আঁচ করে অন্যরা সুর পাল্টে ফেলতেন।
আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
আপাতত আমার কোনো নির্ধারিত পরিকল্পনা নেই। আমি যে কাজটা করছি সেটা করেই আমি তৃপ্তি পাই, খুব সন্তুষ্ট আছি। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা তো আমাদের কারোরই জানা নেই। এটা মহান আল্লাহ তাআলাই জানেন।
কিন্তু অনেকের বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে একটা আশা ছিল যে সোহেল তাজ একটা দল গঠন করবেন, দিশা দেখাবেন।
আমি বিশ্বাস করি যে তরুণদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা প্রত্যেকে একটা করে দুর্গ হতে পারি বাংলাদেশের জন্য। প্রত্যেককেই নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নীতি-আদর্শ থাকতে হবে এবং দৃঢ়তা থাকতে হবে। আমরা যদি এই অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে পারি, তাহলে আরও অনেকেই চলে আসবে। সবাইকে নিজ উদ্যোগে বেরিয়ে আসতে হবে, কারও জন্য অপেক্ষা করলে হবে না। তাহলে আপনা-আপনি একটা নেতৃত্ব চলে আসবে।
বর্তমান তরুণদের ওপর আপনার আস্থা কতটুকু?
আসলে আমরা সবাই আশ্চর্য হয়েছি এবারের এই আন্দোলনটা দেখে। আমরা ভেবেছিলাম জেন-জি হচ্ছে মোবাইল ডিভাইস নিয়ে বসে থাকে। কিন্তু তারা প্রমাণ করল যে তারাও আন্দোলন করতে পারে, অধিকারের জন্য লড়াই করতে পারে। জীবন দিতে পারে। এটা আমাদের আশান্বিত করে যে তারা পারবে।
এই অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু সফল বা ব্যর্থ বলে আপনি মনে করেন?
আমাদের বাংলাদেশ কিন্তু একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখনো আমরা এটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কারণ, ১৫-১৬ বছরে যে একনায়কতন্ত্র কায়েম করা হয়েছিল, তাতে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছে। দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা—সব ক্ষেত্রে ‘ইয়েস ম্যান’ বসিয়ে তাদের মতলব হাসিল করা হয়েছে। এখন এই অন্তর্বর্তী সরকার এসে এ রকম একটা পরিস্থিতির ভেতরে পড়েছে। তাদের কোনো দল নেই। তাদের বসিয়েছে ছাত্ররা। অন্যদিকে বড় বড় রাজনৈতিক দল আছে, যাদের সমর্থক গোষ্ঠী সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে। আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় আওয়ামী লীগে এখনো ন্যূনতম সমর্থক আছে ৩০ শতাংশ। বিএনপির আছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। ২০-২৫ শতাংশ আছে স্বতন্ত্র। বাকিরা জামায়াতের সমর্থক। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আপনি যখন সংস্কার করতে যাবেন, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল কিন্তু তাদের সুবিধাগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য নানাভাবে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করবে।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা। গণ-অভ্যুত্থান যখন ঘটে, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা কিন্তু আকাশচুম্বী হয়। জনগণ খুশি থাকে কখন? তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কাজ যখন সুন্দরভাবে করতে পারে। এর মধ্যে আছে দ্রব্যমূল্য, নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা। দুর্ভাগ্যবশত এই ক্ষেত্রগুলো কিন্তু এখনো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি এই সরকার। আমি আগে যে প্রতিকূলতার কথা বললাম, তাদের ওই বাধাগুলো অতিক্রম করতে একটু সময় লাগছে। আমি মনে করি, এদিকে নজর দেওয়া উচিত। সিন্ডিকেটগুলো ভাঙতে পারেনি। এখন উল্টো দাম বেড়ে যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। আমার বিনীত পরামর্শ থাকবে যে এদিকে একটু বেশি মনোনিবেশ করার। কারণ, জনগণ যদি আবার তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো না পায় তাহলে কথা বলা শুরু করবে। তাই আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নাগালের মধ্যে আনতে হবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ। ধন্যবাদ আজকের পত্রিকার পাঠকদেরও।
প্রধান উপদেষ্টা আপনাকে ফোন করেছিলেন। কী কথা হলো তাঁর সঙ্গে?
আমি খুবই সম্মানিত হয়েছি। কারণ, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা একজন নোবেল লরিয়েট, বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য ব্যক্তি। তিনি যে এত অমায়িকভাবে আমাকে ফোন দেবেন, আমি এতে খুবই আশ্চর্য হয়েছি, খুবই মুগ্ধ হয়েছি। তিনি ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে আমি যেদিন পদযাত্রা করেছি, সেদিন তিনি দেখা করতে পারেননি। তিনি স্বীকার করেছেন আমাদের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। এ বিষয়টা তিনি দেখবেন। আমার বাবাসহ মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় নেতাদের অবদানের কথা বললেন।
আপনি ৩ নভেম্বর তিনটি দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে পদযাত্রা করেছেন। বলেছেন এটি আপনার শেষ পদযাত্রা। শেষ পদযাত্রা কেন?
আমি এই পদযাত্রাটা তিন বছর ধরে করছি। আগের দুই বছর কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব যে দল দিয়েছিল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সেই দল সরকারে ছিল। এটা যদি সত্যিকারের নীতি-আদর্শের আওয়ামী লীগ হতো, অবশ্যই আমার দাবিগুলো বাস্তবায়ন করে ফেলত। তারা তো তা করেইনি বরং উপেক্ষা করেছে।
এবার দেখছি আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে অনেকের বিবৃতি আসছে। অথচ দুই বছর আগে আমাকে তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে হয়েছে জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে পোস্ট দেওয়ার বিষয়টি। দুই বছর আগে আমি তাদের পেজে এমন কমেন্ট করেছি।
ওই যে একাত্তরের ইতিহাস, ওই যে একটা বিবাদ—সেটারই প্রতিফলন। আসলে একটা পরিবার আওয়ামী লীগ নামের দলটাকে কুক্ষিগত করে ফেলেছে। এটা আওয়ামী লীগ না।
আমি তো এই ছিনতাই হওয়া আওয়ামী লীগের কাছে কিছু পেলাম না। তাই এবার গেলাম প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের কাছে। কারণ, সারা দেশের মানুষের তাঁর ওপর অনেক আশা-ভরসা। আমরা সবাই আশা করছি সংস্কার হবে, যাতে করে আগামী দিনে যে গণতান্ত্রিক সরকার আসবে, তারা যেন সঠিক পথে দেশ পরিচালনা করতে পারে।
আমি কেন বলছি শেষ পদযাত্রা? কারণ, রাষ্ট্রের কাছে আমার বাবাসহ জাতীয় নেতাদের সন্তান হিসেবে তাঁদের প্রতি সম্মান জানানোর অধিকার চাওয়ার বিষয়টি আমাকে খুব লজ্জিত করছে।
এরপরও যদি মানুষের কোনো সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হয়, তখনো কি এমন পদযাত্রা আর করবেন না?
আমি তো অনবরত কথা বলে যাচ্ছি। তবে একই দাবিতে পদযাত্রাটা শেষ করতে চাই, কারণ এতে আমি নিজে বিব্রত হচ্ছি। এটা খুব দুঃখজনক। আমার দাবি তিনটা সহজ। প্রথম, ৩ নভেম্বরকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া, যাতে মানুষ জানতে পারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল। কারা এই চার নেতা? যাঁরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পৃথিবীতে শুধু দুটি রাষ্ট্র ‘ডিক্লেয়ারেশন অব ইনডিপেনডেন্সের’ মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে—যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ। আমাদের একটা ডিক্লেয়ারেশন অব ইনডিপেনডেন্স আছে—প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স। ওইটার ভিত্তিতে আমরা ১০ এপ্রিল ১৯৭১ একটা সরকার গঠন করেছিলাম। ইতিহাস সংরক্ষণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে যদি সেই দিনকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এটা দ্বিতীয় দাবি। আমার তৃতীয় দাবি স্পষ্ট—জাতীয় চার নেতাসহ আমাদের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন—সকল বীর, হিরো, সুপারহিরো—যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের জীবনী তথা তাঁদের অবদান পাঠ্যপুস্তকে লিপিবদ্ধ করা এবং সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা; যেন একজন তরুণ বা তরুণী পড়ে বলতে পারেন, ‘ও মাই গড, তাঁরা এত বিসর্জন দিয়েছেন দেশের জন্য! এটা অনুপ্রেরণা জাগায়, একদম রক্ত গরম করে ফেলে। তাঁরা আমার দেশের জন্য এত করেছেন, তাহলে আমাদের আরও ভালো কিছু করতে হবে।’ এই যৌক্তিক দাবি পূরণ না করার তো কোনো কারণ আমি দেখছি না।
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক আছে। এই ব্যাপারে আপনার কী জানা আছে?
আমি যা জেনেছি এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। গণহত্যা যখন শুরু হলো ২৫ মার্চ, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেপ্তার হলেন, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আমার বাবা সে রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ছিলেন। তিনি একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে গিয়েছিলেন। কথা ছিল যে বঙ্গবন্ধু এই টেপ রেকর্ডারে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন এবং একটা কাগজে স্বাক্ষর দেওয়ার কথা ছিল একই মর্মে। সেই সময়ে শাহবাগে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সব সাংবাদিক অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই রেকর্ডেড মেসেজটা দেননি এবং ওই কাগজে স্বাক্ষর দেননি। আমার বাবা পরে বাসায় চলে আসেন। আমার মা-বোনদের মুখ থেকে শুনেছি, বাবা বাসায় এসে সব ফাইলপত্র ফেলে, তছনছ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের ২৩ বছরের আন্দোলন নষ্ট হয়ে গেল।’
আমি যেটা ধারণা করছি, যেহেতু বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন এবং আমার বাবা তখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে মুক্তির সংগ্রামে যোগ দেবেন, এই সময়টুকুর মধ্যে ইপিআরে আক্রমণ হয়েছে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এই খবরগুলো ছড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে। জিয়াউর রহমান ছিলেন চট্টগ্রামে। আমি মনে করছি, যেহেতু জিয়াউর রহমান দেখেছিলেন যে রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে কোনো ঘোষণা আসেনি, তিনি তখন নিজ উদ্যোগে ঘোষণা দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন প্রথমবার। প্রথমবার তিনি কিন্তু বলেছিলেন, ‘আই, প্রেসিডেন্ট জিয়া...’। তারপর রাজনৈতিক নেতারা তাঁকে বলেন যে আপনি ঘোষণাটা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দিন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘অন বিহাফ আওয়ার গ্রেট লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান...’। এগুলো হচ্ছে ইতিহাসের টুকরা টুকরা ঘটনা। এগুলোকে আমাদের পূর্ণাঙ্গভাবে বিবেচনা, বিশ্লেষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জিয়াউর রহমান যেটা করেছিলেন একজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে, তাঁর অবস্থান থেকে ওই সময়, ওই মুহূর্তে সেটা তিনি সঠিক মনে করেছিলেন। মানুষ তো রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঘোষণার অপেক্ষায় থাকে, সেটা যখন আসছিল না, তখন তিনি নিজে এই পদক্ষেপটা নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে আবার রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকেই নির্দেশনা আসে। কিন্তু এখানে ২৫, ২৬, ২৭ মার্চের গ্যাপটা কেন সৃষ্টি হলো, এটাও প্রশ্নের একটা বিষয়।
মুক্তিযুদ্ধে আপনি সবার অবদানের কথা বলছেন। তাহলে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মনে করেন কি না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে জেনেছি, পড়েছি। আমার কাছে মনে হয়, অনেকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক, আবার বলছি। জনগণ তাঁর নামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাঁর নামেই যুদ্ধ হয়েছে। তাঁর নামেই সরকার যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। এখানে কিছু প্রশ্ন আসে। তাঁর কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি কোনো ভূমিকা ছিল না। আমার মতে, আমরা ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ বলতে পারি—বঙ্গবন্ধু একজন এবং বাকি যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁরা সবাই ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ হতে পারেন। আমরা তো এটাকে শেয়ার করতে পারি। কেন আমরা একজনের ওপরে দিয়ে দিচ্ছি সবকিছু? একজনই যদি হতে হয় তাহলে সেটা মানুষ সিদ্ধান্ত নিক যে তিনি জাতির পিতা কি না। যদি মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়, হ্যাঁ তিনিই জাতির পিতা এবং সঙ্গে ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ ছিল, সেটাও ঠিক আছে।
১৫-১৬ বছরে বঙ্গবন্ধুকে ব্যানার হিসেবে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে কি তাঁর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করেন?
হ্যাঁ, অবশ্যই। এত বছরের লাগামহীন দুর্নীতি, কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা, পাশাপাশি আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা, হত্যা, গুম, মানে অরাজকতার একটা মহোৎসব চলছিল। এখন যেহেতু তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করেছেন, সেহেতু এই পুরো জিনিসটাই বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রতিফলিত হলো। মানুষ তো এখন বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে দেখছে। এ জন্যই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যগুলোর ওপর তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। মানুষ এখন লিংক করছে এই অনিয়ম, দুর্নীতি, অত্যাচার—সবকিছু এই ব্যক্তির নামে হয়েছে। এটা তো খুবই অন্যায় করা হলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে।
আপনি কি রাজনীতি ছেড়েছেন নাকি রাজনীতি আপনাকে ছেড়েছে?
এটা তো খুবই ইন্টারেস্টিং একটা প্রশ্ন। ২০০৮ সালে আমি খুব আশা নিয়ে এসেছিলাম দিনবদলের সনদ বাস্তবায়ন করব বলে। সরকারের প্রথম ছয় মাসের যে কর্মকাণ্ড দেখেছি, আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। আমি হুবহু আঁচ না করতে পারলেও আন্দাজ করতে পেরেছিলাম যে ৫ আগস্টের মতো ঘটনা হয়তো আসবে সামনে। ২০১৪-তে যদি সঠিক নির্বাচন দেওয়া হতো তাহলে হয়তো আর ৫ আগস্ট আসত না।
আমার অবস্থান থেকে, নৈতিকতার দিক থেকে আমি একটা শপথ নিয়েছিলাম বাংলাদেশের জনগণের কাছে, আমি যখন প্রতিমন্ত্রী হই। সেই শপথটা ছিল, আমি আমার সবকিছু দিয়ে সৎভাবে, সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করব। যখন দেখলাম আমাকে সেই দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না, যখন দেখলাম লাগামহীন দুর্নীতি শুরু হয়েছে, যখন দেখলাম রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন না এনে দ্বিগুণ গতিতে একই ধারা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন আমার সিদ্ধান্ত ছিল পদত্যাগ করা। পদত্যাগের মাধ্যমে আমি চেয়েছিলাম প্রতিবাদের একটা বীজ বপন করে দিতে।
শুধু কি এই কারণেই আপনাকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হলো? শেখ সেলিমের সঙ্গে নাকি আপনার বিরোধ হয়েছিল?
না, এ রকম কিছু হয়নি। হ্যাঁ, দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, কিন্তু ওটা কারণ ছিল না। কারণটা হচ্ছে, এক পরিবারের নিয়ন্ত্রণে সবকিছু ছিল এবং কোনো না কোনোভাবে পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তার করা ছিল একটা প্রধান কারণ। আমি চেষ্টা করছিলাম প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য। কিন্তু ওই বিশেষ পারিবারিক চাপ ছিল পুলিশের ওপর। এটাও একটা কারণ, ব্যক্তিগতভাবে কোনো দ্বন্দ্ব হয়নি। কিন্তু তাদের প্রভাব ছিল। সেই প্রভাবটা আমি বুঝতে পেরেছি, সেই প্রভাবটা একটা ফ্যাক্টর।
পদত্যাগের আর একটা কারণ ছিল বিডিআর বিদ্রোহের তদন্ত। যেভাবে তদন্ত হচ্ছিল আমার কাছে এটা ভালো লাগেনি। আমি চেয়েছিলাম তদন্তটা একদম পরিষ্কার হবে, স্বচ্ছ হবে। কিন্তু দেখা গেল তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলো তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল ফারুক খানকে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুরোপুরি বাইপাস করে, যেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ছিল বিডিআর। দৃশ্য থেকে আমাদের পুরোপুরি বাইরে রাখা হলো এবং তদন্তটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছিল। আমি তো মে মাস পর্যন্ত ছিলাম, তদন্ত চলেছে তার পরেও। এরপর কী হয়েছে আমি জানি না। ওই পর্যন্ত যখন আমি দেখলাম তদন্তটা আমাদের হাত থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, আমার কাছে এটা খুব অস্বাভাবিক লেগেছে। এটা তো হওয়ার কথা না। এখানে তো আমাদের সম্পৃক্ত থাকার কথা। আমি যদি সম্পৃক্ত থাকতাম, চেষ্টা করতাম স্বচ্ছ একটা তদন্ত করাতে। এখন অনেক প্রশ্ন উঠেছে বিডিআরের তদন্ত নিয়ে।
শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। আবার তিনিই কি দলটির বড় ক্ষতির কারণ হলেন?
আমি এটাই বলব, আশি ও নব্বইয়ের দশকে দলের মধ্যে কিছুটা ব্যালান্স ছিল। কারণ ওই সময় পর্যন্ত দলীয় ফোরামগুলোতে কথা বলা যেত। বিভিন্ন বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক হতো। কেউ কোনো বিষয়ে মতামত দিলে সেটা একেবারে অগ্রাহ্য করা হতো না। কিন্তু পরে ওই গণতন্ত্রটা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন অধঃপতন শুরু হয়। দুর্ভাগ্যবশত আমরা নীতি-আদর্শকেন্দ্রিক না হয়ে সুবিধাকেন্দ্রিক হয়ে যাই। আপনি যখন এককভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করবেন, আপনার কিন্তু লাইক-মাইন্ডের লোকজন লাগবে, যাঁরা আপনাকে অন্ধভাবে সমর্থন করবেন। তাই নীতি-আদর্শ বিচ্যুত করে আপনি দলের ভেতর এমন কিছু লোকজন ঢুকিয়েছেন, যাঁরা স্বার্থান্বেষী, যাঁরা নিজের পকেট ভারী করার জন্য, ক্ষমতা পাওয়ার জন্য এ দলটাকে একেবার মূল নৈতিক জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।
সম্প্রতি আপনার বোন শারমিন আহমদ বলেছেন, গণ-অভ্যুত্থানের সময় অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনায় আওয়ামী লীগের কারও মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। তাই এই দলটিতে তিনি যাবেন না, দল গড়বেন না। বোনের সঙ্গে কি আপনি একমত?
আমি সম্পূর্ণভাবে একমত। আমি বারবার বলছি, শেখ হাসিনাসহ এই আওয়ামী লীগ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতার আওয়ামী লীগ না। খাঁটি আওয়ামী লীগ না। আওয়ামী লীগটাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নামটা ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ভেতরে কিন্তু ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। আমার আম্মা একটা কথা বলতেন সব সময়, মাছের পচন ধরে মাছের মাথা থেকে, রাজনৈতিক দলের পচনও ধরে মাথা থেকে।
আপনি আওয়ামী লীগের হাল ধরবেন বলে শোনা যাচ্ছিল। কথাটি কি ঠিক?
কথাটা একেবারেই সত্যি না। অনেকেই অনেক জায়গা থেকে বলছেন। আমি জানি না কেন বলছেন। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, আমি রাজনীতিতে এলে তাঁদের অসুবিধা হয়ে যাবে, হয়তো আমি জনপ্রিয় বেশি, ঈর্ষান্বিত হচ্ছেন—আমি জানি না। কিন্তু আমি পরিষ্কারভাবে বলেছি, আমি রাজনীতিতে আসছি না। আমি যেখানে আছি, আমার কাজ নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। আমি স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কাজ করছি।
বাংলাদেশে এখন বিশাল একটা সমস্যা হচ্ছে, এই যে চারদিকে এখন হাসপাতালে ভরে গেছে। চিকিৎসাখানা, ফার্মেসি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে মানুষ ভুগছে। এটার কারণ হচ্ছে, একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখন আধুনিক জীবনযাপন করছে, শহরকেন্দ্রিক। যার ফলে আমরা নানাবিধ অসুখ-বিসুখে ভুগছি। আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছি। আমি হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের জীবন বদলে দিয়েছি—এটা আমাকে সাংঘাতিকভাবে সন্তুষ্টি দেয়। কারণ একটা মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হচ্ছে স্বাস্থ্য, সুস্থতা। এখন আমি কথা বলছি, এটা যদি রাজনীতি হয়, তাহলে রাজনীতি। আমি তো কথা বলেই যাব, এটা তো আমার দেশ, আমার অধিকার আছে কথা বলার। কিন্তু ওই প্ল্যাটফর্ম করে রাজনীতি করার ইচ্ছা আমার নেই।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের যে প্রভাব গড়ে উঠেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী বলে আপনি মনে করেন?
উপায় হচ্ছে নতুন প্রজন্ম, নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। ছাত্র-জনতা গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পরিবর্তন আনল। তাই এখন নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের মালিকানা নিতে হবে। কিন্তু সেটা অবশ্যই একাত্তর সালকে ভুলে গিয়ে না। কারণ, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমাদের প্রাণশক্তি। আর ৫ আগস্ট হচ্ছে সেটারই ধারাবাহিকতা। আবার বলছি, ৫ আগস্টের যে দাবিদাওয়া ছিল, সেগুলো কিন্তু মুক্তিযুদ্ধেরও দাবিদাওয়া। সেই সময়ের মানুষ যেটা চেয়েছিল, ৫ আগস্টেও ছাত্র-জনতা তা-ই চেয়েছে। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ একই সূত্রে গাথা। নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে ইতিহাস থেকে। সেটাকে প্রাণশক্তি করে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে বিনির্মাণ করতে হবে। তাদের এগিয়ে আসতে হবে, কিন্তু তাদের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসও জানতে হবে। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আমরা অনুপ্রেরণা নিতে পারব তাঁদের কাছ থেকে, যাঁরা অবদান রেখেছেন বাংলাদেশের জন্য।
যেকোনো সভ্যতার দিকে যদি তাকাই, আমি রোমের কথা, গ্রিসের কথাই বলব। তারা এতদূর এগোতে পেরেছিল একটা কারণে—তারা তাদের নায়কদের সম্মান করত। তাই আপনার জন্য যাঁরা অবদান রেখেছেন, বলিদান দিয়েছেন, আপনি যদি তাঁদের সম্মান না দেন তাহলে আপনার কোনো ভবিষ্যৎ হবে না। এটা ইতিহাসই বলে দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে আপনি কেন দলটির তেমন সমালোচনা করেননি, এখন যেমন করছেন?
আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমার এক ভাগনেকেও কিন্তু গুম করা হয়েছিল। তাকে ১১ দিন আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল। আমি যখন পদত্যাগ নাটকের শিকার হই—পদত্যাগ করতেও কিন্তু আমাকে প্রায় যুদ্ধ করতে হয়েছিল। পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হচ্ছিল না, বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছিল, অনেক যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত আমি সংসদ সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছি। এখানেও আবার নাটক—আমি স্পিকার হামিদ সাহেবের কাছে পাঠিয়েছিলাম পদত্যাগপত্র। তিনি বললেন, এটা কে না কে পাঠিয়েছে! অথচ আমি তাঁকে ফোন করে বললাম, ‘হামিদ কাকু (তাঁকে কাকু ডাকতাম), আমি কিন্তু পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছি। পরে আমি নিজে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিলাম। এটা শুনে প্রধানমন্ত্রী খুব আশ্চর্য হলেন, ‘তুমি পদত্যাগ করে আসছো?’ তার আগে অনেক ঘটনা ছিল। অনেকভাবে চেষ্টা করা হয়েছিল আমাকে রাখার জন্য।
যাই হোক, এখানে বুঝতে হবে, বিডিআর বিদ্রোহ, ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা ঘটনা পরম্পরায় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়েছে। রীতিমতো একনায়কতন্ত্রের পথে যাত্রা। ডিজিএফআই, এনএসআইয়ের প্রভাব চারদিকে ছিল। ২০১১, ২০১২, ২০১৩ সালের দিকে কিন্তু গুম হওয়া শুরু করল। খোঁজ করে দেখেন, এই সংস্কৃতিটা শুরু হয়েছে তখন। এই অবস্থায় আমার আরেক ভাগনেকে পুলিশ বেধড়ক মারধর করল। এগুলো সব আমার জন্য ইশারা ছিল।
আমরা দেখেছি, সরকার যে-ই হোক না কেন, একটা পর্যায়ে গিয়ে ‘ফ্যাসিস্ট’ আচরণ প্রকাশ পেতে থাকে। জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ বইটি নিশ্চয়ই পড়েছেন, অনেকটা সে রকম। যেখানে শাসক বদলালেও স্বৈরশাসন বারবার ফিরে আসে। উপন্যাসটির সঙ্গে বাস্তবতার মিল পান কি?
‘অল অ্যানিমেলস আর ইক্যুয়াল বাট সাম অ্যানিমেলস আর মোর ইক্যুয়াল।’ পড়েছি অ্যানিমেল ফার্ম। যাই হোক, ফ্যাসিস্ট আচরণ আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট সরকার ছিল না। কারণ, এখানে ফ্যাসিস্ট সংজ্ঞার একটা বিষয় আছে। ফ্যাসিজম একটা মতাদর্শকে প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু এখানে তো কোনো মতাদর্শ ছিল না। এটা তো একটা দুর্নীতি, হত্যাযজ্ঞ, গুম, খুনের উৎসব ছিল। আমি বলব এটা একটা ক্লেপ্টোক্রেসি, মাফিয়া এবং পরিবারতন্ত্রের সম্মিলন—তিনটার সংমিশ্রণে এটা একটা হাইব্রিড ফিউশন সিস্টেম। এটার নাম এখনো কেউ দিতে পারেনি। এ জন্যই আমরা বলি ফ্যাসিস্ট।
কেন যেন এই উপমহাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা পরিবারকেন্দ্রিক। আমরা শ্রীলঙ্কায় সেটা দেখেছি। পাকিস্তানে দেখেছি। বাংলাদেশে দেখেছি। একমাত্র ভারত কিছুটা বেরিয়ে এসেছে, কারণ ওরা গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। যদিও কংগ্রেস আছে কিন্তু ওদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এত মজবুত যে ওই সুবিধা ওরা পাচ্ছে না আমাদের তুলনায়। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও মজবুত করতে হবে, যাতে এ রকম ক্লেপ্টোক্রেসি, মাফিওক্রেসি পরিবারতন্ত্র আর মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে। আমাদের সবার এক থাকতে হবে এই জায়গাটায়। সব রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য যেন হয় জনসেবা। রাজনীতির মূলে আমাদের চলে যেতে হবে। এ জন্য জনগণেরই চাপ সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু জনগণ তো খুব অসহায়।
শেখ হাসিনার ১৫-১৬ বছরের সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে আচরণ, সেটা কি তাঁর নিজের গড়া, নাকি আশপাশের কারও মাধ্যমে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন? আপনার কী মনে হয়?
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমি তাঁর খুব কাছাকাছি থেকে বিরোধীদলীয় রাজনীতি করেছিলাম। পরে ২০০৮-০৯ সালে যখন মন্ত্রিসভায় ছিলাম, তাঁকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তাঁর ভাবভঙ্গি, আচার পুরোপুরি ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। তিনি আগে যেমন ছিলেন, তা থেকে রাতারাতি পরিবর্তিত হয়ে গেলেন। আমি যতটুকু দেখেছি, তাঁকে পরামর্শ দেওয়ার মতো কেউ নেই বাংলাদেশে। যা কিছু হতো, তাঁর ইচ্ছায় হতো। দলীয় ফোরামে এবং ইনফরমাল মিটিংয়ে কোনো বিষয়ে কথা হলে সবাই ভেবেছি তাঁকে এই ব্যাপারে বলতে হবে, কিন্তু তিনি আসার পর সবাই চুপ থাকতেন এবং তিনি কী শুনতে চান, সেটা আঁচ করে অন্যরা সুর পাল্টে ফেলতেন।
আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
আপাতত আমার কোনো নির্ধারিত পরিকল্পনা নেই। আমি যে কাজটা করছি সেটা করেই আমি তৃপ্তি পাই, খুব সন্তুষ্ট আছি। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা তো আমাদের কারোরই জানা নেই। এটা মহান আল্লাহ তাআলাই জানেন।
কিন্তু অনেকের বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে একটা আশা ছিল যে সোহেল তাজ একটা দল গঠন করবেন, দিশা দেখাবেন।
আমি বিশ্বাস করি যে তরুণদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা প্রত্যেকে একটা করে দুর্গ হতে পারি বাংলাদেশের জন্য। প্রত্যেককেই নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নীতি-আদর্শ থাকতে হবে এবং দৃঢ়তা থাকতে হবে। আমরা যদি এই অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে পারি, তাহলে আরও অনেকেই চলে আসবে। সবাইকে নিজ উদ্যোগে বেরিয়ে আসতে হবে, কারও জন্য অপেক্ষা করলে হবে না। তাহলে আপনা-আপনি একটা নেতৃত্ব চলে আসবে।
বর্তমান তরুণদের ওপর আপনার আস্থা কতটুকু?
আসলে আমরা সবাই আশ্চর্য হয়েছি এবারের এই আন্দোলনটা দেখে। আমরা ভেবেছিলাম জেন-জি হচ্ছে মোবাইল ডিভাইস নিয়ে বসে থাকে। কিন্তু তারা প্রমাণ করল যে তারাও আন্দোলন করতে পারে, অধিকারের জন্য লড়াই করতে পারে। জীবন দিতে পারে। এটা আমাদের আশান্বিত করে যে তারা পারবে।
এই অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু সফল বা ব্যর্থ বলে আপনি মনে করেন?
আমাদের বাংলাদেশ কিন্তু একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখনো আমরা এটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কারণ, ১৫-১৬ বছরে যে একনায়কতন্ত্র কায়েম করা হয়েছিল, তাতে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছে। দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা—সব ক্ষেত্রে ‘ইয়েস ম্যান’ বসিয়ে তাদের মতলব হাসিল করা হয়েছে। এখন এই অন্তর্বর্তী সরকার এসে এ রকম একটা পরিস্থিতির ভেতরে পড়েছে। তাদের কোনো দল নেই। তাদের বসিয়েছে ছাত্ররা। অন্যদিকে বড় বড় রাজনৈতিক দল আছে, যাদের সমর্থক গোষ্ঠী সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে। আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় আওয়ামী লীগে এখনো ন্যূনতম সমর্থক আছে ৩০ শতাংশ। বিএনপির আছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। ২০-২৫ শতাংশ আছে স্বতন্ত্র। বাকিরা জামায়াতের সমর্থক। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আপনি যখন সংস্কার করতে যাবেন, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল কিন্তু তাদের সুবিধাগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য নানাভাবে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করবে।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা। গণ-অভ্যুত্থান যখন ঘটে, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা কিন্তু আকাশচুম্বী হয়। জনগণ খুশি থাকে কখন? তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কাজ যখন সুন্দরভাবে করতে পারে। এর মধ্যে আছে দ্রব্যমূল্য, নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা। দুর্ভাগ্যবশত এই ক্ষেত্রগুলো কিন্তু এখনো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি এই সরকার। আমি আগে যে প্রতিকূলতার কথা বললাম, তাদের ওই বাধাগুলো অতিক্রম করতে একটু সময় লাগছে। আমি মনে করি, এদিকে নজর দেওয়া উচিত। সিন্ডিকেটগুলো ভাঙতে পারেনি। এখন উল্টো দাম বেড়ে যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। আমার বিনীত পরামর্শ থাকবে যে এদিকে একটু বেশি মনোনিবেশ করার। কারণ, জনগণ যদি আবার তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো না পায় তাহলে কথা বলা শুরু করবে। তাই আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নাগালের মধ্যে আনতে হবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ। ধন্যবাদ আজকের পত্রিকার পাঠকদেরও।

বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না।
৮ ঘণ্টা আগে
ভারতের মালয়ালমভাষী উপকূলীয় রাজ্য কেরালা জনসংখ্যার বিচারে দেশটির ১৪তম বৃহৎ রাজ্য। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে এই রাজ্যের একটি বড় পার্থক্য হলো, এখানে বাম মতাদর্শের প্রভাব বেশি। কংগ্রেসেরও আধিপত্য রয়েছে। সে তুলনায় দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রভাব কিছুদিন...
৮ ঘণ্টা আগে
ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের সাম্প্রতিক মন্তব্য কেবল মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির জন্য নয়, বরং পুরো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকাঠামোর জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, যদি জাতিসংঘ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে এগোতে থাকে...
৮ ঘণ্টা আগে
একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় জলবায়ু পরিবর্তন আর শুধুই পরিবেশ সংরক্ষণ বা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার সীমিত পরিসরে আবদ্ধ কোনো ইস্যু নয়; বরং এটি ক্রমেই একটি কাঠামোগত বৈশ্বিক সংকটে রূপান্তরিত হয়েছে, যার প্রভাব রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, সীমান্ত নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির...
৮ ঘণ্টা আগেসম্পাদকীয়

বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখন পর্যন্ত এতটাই সজীব যে, ইচ্ছে করলেই এই ইতিহাসকে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যাবে না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলে, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অতি সুকৌশলে এমন সব প্রশ্নের জন্ম দেওয়া হয়, যার উত্তর তারা নিজেরা জানলেও সে উত্তরকে আড়ালে রেখে নতুন বয়ান তৈরির ধূর্ততাও পরিলক্ষিত হয়। সম্প্রতি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায় পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদর, আলশামসের কাঁধ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা গেছে। এই কাজটি মূলত তারাই করতে চাইছে, যারা একাত্তরের পরাজয়ের গ্লানি এখনো হজম করে উঠতে পারেনি। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে বাংলাদেশের সূত্রের কাছে না গেলেও চলবে। আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষরকারী পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি এবং সে সময়ের ভয়ংকর দানব হয়ে ওঠা রাও ফরমান আলী তাদের বইগুলোয় একে অপরকে দোষারোপ করতে গিয়ে নিজেদের ষড়যন্ত্রের গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। নিয়াজির অফিসের সামনে রাও ফরমান আলী দেখেছেন কাদালেপা মাইক্রোবাস, রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে দেখা গেছে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। কেউ কেউ রাও ফরমান আলীকে অনুরোধ করে সেই তালিকা থেকে বুদ্ধিজীবীদের নাম কাটিয়েছেন বলেও প্রমাণ আছে। এই যখন অবস্থা, তখন বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশেরই শিক্ষিত কোনো মানুষ একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে না বলে মত প্রকাশ করলে তা সত্যের অপলাপই হয়। এ ধরনের বক্তব্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার ন্যক্কারজনক প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।
বাংলা ও বাঙালির বীরত্বগাথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা জরুরি। দেশের ক্ষমতা যার হাতে থাকে, সে-ই নিজের ইচ্ছেমতো ইতিহাস রচনা করতে চায়। কিন্তু তারা ভুলে যায়, ইতিহাসের সত্যগুলো প্রকাশিত হবেই। স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে আসা স্বাধীনতার সময়টিতে কার নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালিত হয়, কার ওপর দেশবাসী রেখেছিল আস্থা, পাকিস্তানিদের চালানো অপারেশন সার্চলাইট, সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয় এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার বর্ণনা পাওয়া কঠিন কোনো কাজ নয়। বাঙালির এই জনযুদ্ধকে খাটো করে দেখানো কিংবা পাকিস্তানি বাহিনীর মহিমাকীর্তন কোনো ইতিবাচক স্বপ্ন দেখাতে পারবে না। সব পক্ষের উচিত, ইতিহাসের সত্যকে আড়াল না করে নতুন করে জীবন গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা।
আমাদের দেশ একটা অস্থির সময় পার করছে। এই সময়টিতে পুরো জাতির ঐক্য প্রয়োজন। কিন্তু গণ-আন্দোলনে বিজয়ী পক্ষ এত বেশি বিভক্ত হয়ে রয়েছে যে তাদের সম্মিলিত উদ্যোগে জাতীয় সব অঙ্গনে স্থিতিশীলতা আসবে—এমন আশা এখন পায়ের নিচে শক্ত মাটি পাচ্ছে না। ন্যূনতম কিছু বিষয়ে একমত হতে হলে জাতিকে সামগ্রিকভাবেই দেখতে হবে। সেদিকেই হতে হবে দেশের যাত্রা।

বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখন পর্যন্ত এতটাই সজীব যে, ইচ্ছে করলেই এই ইতিহাসকে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যাবে না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলে, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অতি সুকৌশলে এমন সব প্রশ্নের জন্ম দেওয়া হয়, যার উত্তর তারা নিজেরা জানলেও সে উত্তরকে আড়ালে রেখে নতুন বয়ান তৈরির ধূর্ততাও পরিলক্ষিত হয়। সম্প্রতি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায় পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদর, আলশামসের কাঁধ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা গেছে। এই কাজটি মূলত তারাই করতে চাইছে, যারা একাত্তরের পরাজয়ের গ্লানি এখনো হজম করে উঠতে পারেনি। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে বাংলাদেশের সূত্রের কাছে না গেলেও চলবে। আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষরকারী পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি এবং সে সময়ের ভয়ংকর দানব হয়ে ওঠা রাও ফরমান আলী তাদের বইগুলোয় একে অপরকে দোষারোপ করতে গিয়ে নিজেদের ষড়যন্ত্রের গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। নিয়াজির অফিসের সামনে রাও ফরমান আলী দেখেছেন কাদালেপা মাইক্রোবাস, রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে দেখা গেছে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। কেউ কেউ রাও ফরমান আলীকে অনুরোধ করে সেই তালিকা থেকে বুদ্ধিজীবীদের নাম কাটিয়েছেন বলেও প্রমাণ আছে। এই যখন অবস্থা, তখন বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশেরই শিক্ষিত কোনো মানুষ একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে না বলে মত প্রকাশ করলে তা সত্যের অপলাপই হয়। এ ধরনের বক্তব্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার ন্যক্কারজনক প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।
বাংলা ও বাঙালির বীরত্বগাথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা জরুরি। দেশের ক্ষমতা যার হাতে থাকে, সে-ই নিজের ইচ্ছেমতো ইতিহাস রচনা করতে চায়। কিন্তু তারা ভুলে যায়, ইতিহাসের সত্যগুলো প্রকাশিত হবেই। স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে আসা স্বাধীনতার সময়টিতে কার নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালিত হয়, কার ওপর দেশবাসী রেখেছিল আস্থা, পাকিস্তানিদের চালানো অপারেশন সার্চলাইট, সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয় এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার বর্ণনা পাওয়া কঠিন কোনো কাজ নয়। বাঙালির এই জনযুদ্ধকে খাটো করে দেখানো কিংবা পাকিস্তানি বাহিনীর মহিমাকীর্তন কোনো ইতিবাচক স্বপ্ন দেখাতে পারবে না। সব পক্ষের উচিত, ইতিহাসের সত্যকে আড়াল না করে নতুন করে জীবন গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা।
আমাদের দেশ একটা অস্থির সময় পার করছে। এই সময়টিতে পুরো জাতির ঐক্য প্রয়োজন। কিন্তু গণ-আন্দোলনে বিজয়ী পক্ষ এত বেশি বিভক্ত হয়ে রয়েছে যে তাদের সম্মিলিত উদ্যোগে জাতীয় সব অঙ্গনে স্থিতিশীলতা আসবে—এমন আশা এখন পায়ের নিচে শক্ত মাটি পাচ্ছে না। ন্যূনতম কিছু বিষয়ে একমত হতে হলে জাতিকে সামগ্রিকভাবেই দেখতে হবে। সেদিকেই হতে হবে দেশের যাত্রা।

আমি খুবই সম্মানিত হয়েছি। কারণ, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা একজন নোবেল লরিয়েট, বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য ব্যক্তি। তিনি যে এত অমায়িকভাবে আমাকে ফোন দেবেন, আমি এতে খুবই আশ্চর্য হয়েছি, খুবই মুগ্ধ হয়েছি।
১০ নভেম্বর ২০২৪
ভারতের মালয়ালমভাষী উপকূলীয় রাজ্য কেরালা জনসংখ্যার বিচারে দেশটির ১৪তম বৃহৎ রাজ্য। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে এই রাজ্যের একটি বড় পার্থক্য হলো, এখানে বাম মতাদর্শের প্রভাব বেশি। কংগ্রেসেরও আধিপত্য রয়েছে। সে তুলনায় দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রভাব কিছুদিন...
৮ ঘণ্টা আগে
ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের সাম্প্রতিক মন্তব্য কেবল মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির জন্য নয়, বরং পুরো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকাঠামোর জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, যদি জাতিসংঘ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে এগোতে থাকে...
৮ ঘণ্টা আগে
একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় জলবায়ু পরিবর্তন আর শুধুই পরিবেশ সংরক্ষণ বা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার সীমিত পরিসরে আবদ্ধ কোনো ইস্যু নয়; বরং এটি ক্রমেই একটি কাঠামোগত বৈশ্বিক সংকটে রূপান্তরিত হয়েছে, যার প্রভাব রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, সীমান্ত নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির...
৮ ঘণ্টা আগেরাজিউল হাসান

ভারতের মালয়ালমভাষী উপকূলীয় রাজ্য কেরালা জনসংখ্যার বিচারে দেশটির ১৪তম বৃহৎ রাজ্য। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে এই রাজ্যের একটি বড় পার্থক্য হলো, এখানে বাম মতাদর্শের প্রভাব বেশি। কংগ্রেসেরও আধিপত্য রয়েছে। সে তুলনায় দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রভাব কিছুদিন আগেও বেশ কম ছিল।
বহু বছর ধরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই-মার্ক্সবাদী) নেতৃত্বে বাম মতাদর্শের জোট লেফট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এলডিএফ) আর কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউডিএফ) ভাগাভাগি করে কেরালা শাসন করছে। কিন্তু সে দুর্ভেদ্য রাজ্যে এবার বিজেপি চমক দেখিয়েছে। ৯ ডিসেম্বর কেরালার তিরুবনন্তপুরাম পৌরসভায় ভোট হয়েছে। এখানকার ১০১টি আসনের মধ্যে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট জিতেছে ৫০টিতে। আগের পর্ষদের চেয়ে এবার এই জোট ১৫টি বেশি আসন দখলে নিয়েছে। এলডিএফ বিজয়ী হয়েছে ২৯টি আসনে। আগেরবারের তুলনায় এবার তাদের আসন কমেছে ২৩টি। ইউডিএফ জিতেছে ১৯টি আসনে। আগেরবারের চেয়ে এবার তাদের ঝুলিতে আসন বেড়েছে ৯টি। দুটি আসনে বিজয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
ভূখণ্ডের আয়তনের বিচারে ভারত বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম দেশ। আর জনসংখ্যার বিচারে দেশটি এখন বিশ্বের শীর্ষে। ২৮টি রাজ্য আর ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের এমন বড় একটি দেশের একটি রাজ্যের একটি পৌরসভায় বিজেপির এমন বিজয় হয়তো সাদা চোখে খুব বড় কোনো সাফল্য নয়। তবে এ কথা একেবারে অনস্বীকার্য যে বামদের দুর্গে এবার খুব ছোট করে হলেও বিজেপির পদ্মফুল ফুটেছে। এ বিজয় বিজেপির জন্য যেমন উদ্যাপনের একটি মুহূর্ত নিয়ে এসেছে, একই সঙ্গে দেশটির অন্যান্য রাজনৈতিক দলের জন্যও নতুন করে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের উপলক্ষ তৈরি করেছে।
ভারতের ২৮টি রাজ্য ও ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে এখন ২৪টিই বিজেপি ও তার জোটের দখলে। এগুলো হলো অন্ধ্র প্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, বিহার, ছত্তিশগড়, দিল্লি, গোয়া, গুজরাট, হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মণিপুর, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, ওডিশা, পদুচেরি, রাজস্থান, সিকিম, ত্রিপুরা, উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখন্ড। কংগ্রেস, তার মিত্র ও কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের শাসন চলছে সাতটি রাজ্য ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে। পাঞ্জাবে চলছে আম আদমি পার্টির এবং মিজোরামে চলছে জোরাম পিপলস মুভমেন্ট (জেডপিএম) পার্টির শাসন। পশ্চিমবঙ্গ অনেক বছর ধরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস শাসন করছে।
অথচ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি জোট যখন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় আসে, তখনো দলটির এতটা বিস্তার ছিল না। দিনে দিনে দেশজুড়ে তাদের প্রভাব বেড়েছে, নিয়ন্ত্রণে এসেছে নতুন নতুন এলাকা। সে হিসাবে হয়তো বামদের দুর্গে বিজেপির ছোট্ট হানা স্বাভাবিক মনে হবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গসহ আরও যেসব রাজ্য বিজেপির নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে, সেসব রাজ্যের শাসক দলের জন্য এটি একটি অশনিসংকেত। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য কেরালার তিরুবনন্তপুরাম পৌর নির্বাচন আশু দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। কারণ, আর কয়েক মাস পরই এই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন।
যে কেরালা নিয়ে আজকের আলোচনা, সেখানেও আগামী এপ্রিলে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। সে হিসাবে তিরুবনন্তপুরামের নির্বাচনের ফলাফল বড় একটি বার্তা দিয়েছে বামদের। এ নির্বাচনে এলডিএফ বড় মার খেয়েছে। ১০১ আসনের এই পৌর কাউন্সিলে ৫১ আসনে জিতলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হয়। বিজেপি মাত্র এক আসন কম পেয়েছে। এলডিএফ হারিয়েছে ২৩ আসন। অবশ্য কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ পৌরসভা ও পঞ্চায়েতগুলোয় বেশ ভালো করেছে।
কেরালায় হয়তো আজও এলডিএফ এবং ইউডিএফ জোটই বড় রাজনৈতিক খেলোয়াড়। তবে বিজেপিও যে আর তুচ্ছ নয়, তা তিরুবনন্তপুরামের ফলাফল বুঝিয়ে দিয়েছে। রাজ্যটি এলডিএফ এবং ইউডিএফ ভাগাভাগি করে শাসন করলেও তিরুবনন্তপুরাম ৪৫ বছর ধরে রেখেছিল বামেরাই। সেই দুর্গ এবার ছিনিয়ে নিয়েছে বিজেপি। শুধু তিরুবনন্তপুরামই নয়, কেরালার পালাক্কাড় পৌরসভা এবং ত্রিপুনিথুরা পৌরসভাও এখন বিজেপির দখলে।
কেরালায় আগের বিধানসভা নির্বাচনে ১৪০ আসনের মধ্যে ৯৯টিই দখলে নিয়েছিল এলডিএফ। বাকি ৪১টি আসন পেয়েছিল ইউডিএফ। তিরুবনন্তপুরামের নির্বাচন বলে দিচ্ছে, এবার ফলাফলটা এমন হবে না। এলডিএফ জোট ২০১৬ সাল থেকে টানা এ রাজ্যের ক্ষমতায়।
রাজ্যের নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, কেরালার পঞ্চায়েতগুলোর মধ্যে দেড় হাজারের মতো ওয়ার্ড এখন বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের দখলে। তিরুবনন্তপুরামে জয়ের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মন্তব্য ছিল, ‘চোখে জল আনার মতো মুহূর্ত এটি।’
বিজেপির নেতাদের দাবি, কেরালায় ভবিষ্যতে বিজেপির অবস্থান আরও পোক্ত হবে এবং একসময় এখানে ইউডিএফ ও কংগ্রেসের ভোটাররা বিজেপিকেই সমর্থন করবেন। তাঁরা এ জন্য আগেভাগেই বিজেপির কর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে রেখেছেন।
কংগ্রেস নেতা শশী থারুরও তিরুবনন্তপুরামের নির্বাচনের ফলাফলের পর স্বীকার করেছেন, কেরালায় ভোটারদের পছন্দে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছে।
অবশ্য তিরুবনন্তপুরামে কিন্তু রাতারাতি বিজেপি এমন বিজয় অর্জন করেনি। বরং ১৫ বছর ধরে রাজনৈতিক ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা ধীরে ধীরে অগ্রগতি অর্জন করেছে। শুধু কেরালায়ই নয়, অন্যান্য রাজ্যেও বিজেপির পদ্মফুল ফুটেছে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায়। আমরা শুধু জানি, বিজেপি ধর্মকে সামনে রেখে রাজনীতি করে চলেছে। সেটা হয়তো ঠিক। কিন্তু এই ইস্যুটি ছাড়াও বিজেপির রাজনৈতিক কৌশলের ঝুলিতে আরও অনেক কিছু আছে। বিজেপির সবচেয়ে বড় সুবিধাটা হলো, তারা যে রাজ্যের জন্য যে কৌশল প্রয়োজন, ঠিক সেটাই প্রয়োগ করছে। যেমন কেরালায় বামদের হটাতে তারা যে কৌশল প্রয়োগ করছে, আসাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিন্তু সেই একই কৌশলে তারা হাঁটছে না। সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোয় বিজেপিতে আস্থা বাড়াতে যে পথে হাঁটছে তারা, দেশের মধ্যাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় সে পথে তারা নেই। কাশ্মীরে তাদের যে কৌশল, তামিলনাড়ুতে গিয়ে দেখা যাবে, ঠিক তার বিপরীত কৌশল বিজেপির। এবং এই যে রাজ্যভেদে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল, সেটা নির্ধারণ করা হচ্ছে একেবারে শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে। এই শীর্ষ নেতৃত্ব কিন্তু একজনের হাতে কুক্ষিগত নয়, বরং একদল বর্ষীয়ান-অভিজ্ঞ রাজনীতিক একসঙ্গে গড়ে তুলেছেন সে নেতৃত্ব।
ঠিক এই জায়গায় কংগ্রেস কিংবা অন্য দলগুলোর সঙ্গে বিজেপির ফারাক। কংগ্রেসের কথাই ধরা যাক। দলটি এখনো গান্ধী পরিবারের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। পারিবারিক নেতৃত্ব থেকে দলটি বের হতে না পারার খেসারত দিচ্ছে এক দশকের বেশি সময় ধরে। এ ছাড়া ভারতের বেশির ভাগ দলেও পরিবারতন্ত্র বেশ বহাল তবিয়তে রাজত্ব করছে। আর ঠিক এ সুযোগেই বিজেপি ভারতজুড়ে ধীরে ধীরে পদ্মফুল ফুটিয়ে চলেছে।

ভারতের মালয়ালমভাষী উপকূলীয় রাজ্য কেরালা জনসংখ্যার বিচারে দেশটির ১৪তম বৃহৎ রাজ্য। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে এই রাজ্যের একটি বড় পার্থক্য হলো, এখানে বাম মতাদর্শের প্রভাব বেশি। কংগ্রেসেরও আধিপত্য রয়েছে। সে তুলনায় দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রভাব কিছুদিন আগেও বেশ কম ছিল।
বহু বছর ধরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই-মার্ক্সবাদী) নেতৃত্বে বাম মতাদর্শের জোট লেফট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এলডিএফ) আর কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউডিএফ) ভাগাভাগি করে কেরালা শাসন করছে। কিন্তু সে দুর্ভেদ্য রাজ্যে এবার বিজেপি চমক দেখিয়েছে। ৯ ডিসেম্বর কেরালার তিরুবনন্তপুরাম পৌরসভায় ভোট হয়েছে। এখানকার ১০১টি আসনের মধ্যে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট জিতেছে ৫০টিতে। আগের পর্ষদের চেয়ে এবার এই জোট ১৫টি বেশি আসন দখলে নিয়েছে। এলডিএফ বিজয়ী হয়েছে ২৯টি আসনে। আগেরবারের তুলনায় এবার তাদের আসন কমেছে ২৩টি। ইউডিএফ জিতেছে ১৯টি আসনে। আগেরবারের চেয়ে এবার তাদের ঝুলিতে আসন বেড়েছে ৯টি। দুটি আসনে বিজয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
ভূখণ্ডের আয়তনের বিচারে ভারত বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম দেশ। আর জনসংখ্যার বিচারে দেশটি এখন বিশ্বের শীর্ষে। ২৮টি রাজ্য আর ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের এমন বড় একটি দেশের একটি রাজ্যের একটি পৌরসভায় বিজেপির এমন বিজয় হয়তো সাদা চোখে খুব বড় কোনো সাফল্য নয়। তবে এ কথা একেবারে অনস্বীকার্য যে বামদের দুর্গে এবার খুব ছোট করে হলেও বিজেপির পদ্মফুল ফুটেছে। এ বিজয় বিজেপির জন্য যেমন উদ্যাপনের একটি মুহূর্ত নিয়ে এসেছে, একই সঙ্গে দেশটির অন্যান্য রাজনৈতিক দলের জন্যও নতুন করে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের উপলক্ষ তৈরি করেছে।
ভারতের ২৮টি রাজ্য ও ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে এখন ২৪টিই বিজেপি ও তার জোটের দখলে। এগুলো হলো অন্ধ্র প্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, বিহার, ছত্তিশগড়, দিল্লি, গোয়া, গুজরাট, হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মণিপুর, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, ওডিশা, পদুচেরি, রাজস্থান, সিকিম, ত্রিপুরা, উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখন্ড। কংগ্রেস, তার মিত্র ও কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের শাসন চলছে সাতটি রাজ্য ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে। পাঞ্জাবে চলছে আম আদমি পার্টির এবং মিজোরামে চলছে জোরাম পিপলস মুভমেন্ট (জেডপিএম) পার্টির শাসন। পশ্চিমবঙ্গ অনেক বছর ধরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস শাসন করছে।
অথচ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি জোট যখন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় আসে, তখনো দলটির এতটা বিস্তার ছিল না। দিনে দিনে দেশজুড়ে তাদের প্রভাব বেড়েছে, নিয়ন্ত্রণে এসেছে নতুন নতুন এলাকা। সে হিসাবে হয়তো বামদের দুর্গে বিজেপির ছোট্ট হানা স্বাভাবিক মনে হবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গসহ আরও যেসব রাজ্য বিজেপির নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে, সেসব রাজ্যের শাসক দলের জন্য এটি একটি অশনিসংকেত। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য কেরালার তিরুবনন্তপুরাম পৌর নির্বাচন আশু দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। কারণ, আর কয়েক মাস পরই এই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন।
যে কেরালা নিয়ে আজকের আলোচনা, সেখানেও আগামী এপ্রিলে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। সে হিসাবে তিরুবনন্তপুরামের নির্বাচনের ফলাফল বড় একটি বার্তা দিয়েছে বামদের। এ নির্বাচনে এলডিএফ বড় মার খেয়েছে। ১০১ আসনের এই পৌর কাউন্সিলে ৫১ আসনে জিতলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হয়। বিজেপি মাত্র এক আসন কম পেয়েছে। এলডিএফ হারিয়েছে ২৩ আসন। অবশ্য কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ পৌরসভা ও পঞ্চায়েতগুলোয় বেশ ভালো করেছে।
কেরালায় হয়তো আজও এলডিএফ এবং ইউডিএফ জোটই বড় রাজনৈতিক খেলোয়াড়। তবে বিজেপিও যে আর তুচ্ছ নয়, তা তিরুবনন্তপুরামের ফলাফল বুঝিয়ে দিয়েছে। রাজ্যটি এলডিএফ এবং ইউডিএফ ভাগাভাগি করে শাসন করলেও তিরুবনন্তপুরাম ৪৫ বছর ধরে রেখেছিল বামেরাই। সেই দুর্গ এবার ছিনিয়ে নিয়েছে বিজেপি। শুধু তিরুবনন্তপুরামই নয়, কেরালার পালাক্কাড় পৌরসভা এবং ত্রিপুনিথুরা পৌরসভাও এখন বিজেপির দখলে।
কেরালায় আগের বিধানসভা নির্বাচনে ১৪০ আসনের মধ্যে ৯৯টিই দখলে নিয়েছিল এলডিএফ। বাকি ৪১টি আসন পেয়েছিল ইউডিএফ। তিরুবনন্তপুরামের নির্বাচন বলে দিচ্ছে, এবার ফলাফলটা এমন হবে না। এলডিএফ জোট ২০১৬ সাল থেকে টানা এ রাজ্যের ক্ষমতায়।
রাজ্যের নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, কেরালার পঞ্চায়েতগুলোর মধ্যে দেড় হাজারের মতো ওয়ার্ড এখন বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের দখলে। তিরুবনন্তপুরামে জয়ের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মন্তব্য ছিল, ‘চোখে জল আনার মতো মুহূর্ত এটি।’
বিজেপির নেতাদের দাবি, কেরালায় ভবিষ্যতে বিজেপির অবস্থান আরও পোক্ত হবে এবং একসময় এখানে ইউডিএফ ও কংগ্রেসের ভোটাররা বিজেপিকেই সমর্থন করবেন। তাঁরা এ জন্য আগেভাগেই বিজেপির কর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে রেখেছেন।
কংগ্রেস নেতা শশী থারুরও তিরুবনন্তপুরামের নির্বাচনের ফলাফলের পর স্বীকার করেছেন, কেরালায় ভোটারদের পছন্দে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছে।
অবশ্য তিরুবনন্তপুরামে কিন্তু রাতারাতি বিজেপি এমন বিজয় অর্জন করেনি। বরং ১৫ বছর ধরে রাজনৈতিক ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা ধীরে ধীরে অগ্রগতি অর্জন করেছে। শুধু কেরালায়ই নয়, অন্যান্য রাজ্যেও বিজেপির পদ্মফুল ফুটেছে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায়। আমরা শুধু জানি, বিজেপি ধর্মকে সামনে রেখে রাজনীতি করে চলেছে। সেটা হয়তো ঠিক। কিন্তু এই ইস্যুটি ছাড়াও বিজেপির রাজনৈতিক কৌশলের ঝুলিতে আরও অনেক কিছু আছে। বিজেপির সবচেয়ে বড় সুবিধাটা হলো, তারা যে রাজ্যের জন্য যে কৌশল প্রয়োজন, ঠিক সেটাই প্রয়োগ করছে। যেমন কেরালায় বামদের হটাতে তারা যে কৌশল প্রয়োগ করছে, আসাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিন্তু সেই একই কৌশলে তারা হাঁটছে না। সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোয় বিজেপিতে আস্থা বাড়াতে যে পথে হাঁটছে তারা, দেশের মধ্যাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় সে পথে তারা নেই। কাশ্মীরে তাদের যে কৌশল, তামিলনাড়ুতে গিয়ে দেখা যাবে, ঠিক তার বিপরীত কৌশল বিজেপির। এবং এই যে রাজ্যভেদে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল, সেটা নির্ধারণ করা হচ্ছে একেবারে শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে। এই শীর্ষ নেতৃত্ব কিন্তু একজনের হাতে কুক্ষিগত নয়, বরং একদল বর্ষীয়ান-অভিজ্ঞ রাজনীতিক একসঙ্গে গড়ে তুলেছেন সে নেতৃত্ব।
ঠিক এই জায়গায় কংগ্রেস কিংবা অন্য দলগুলোর সঙ্গে বিজেপির ফারাক। কংগ্রেসের কথাই ধরা যাক। দলটি এখনো গান্ধী পরিবারের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। পারিবারিক নেতৃত্ব থেকে দলটি বের হতে না পারার খেসারত দিচ্ছে এক দশকের বেশি সময় ধরে। এ ছাড়া ভারতের বেশির ভাগ দলেও পরিবারতন্ত্র বেশ বহাল তবিয়তে রাজত্ব করছে। আর ঠিক এ সুযোগেই বিজেপি ভারতজুড়ে ধীরে ধীরে পদ্মফুল ফুটিয়ে চলেছে।

আমি খুবই সম্মানিত হয়েছি। কারণ, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা একজন নোবেল লরিয়েট, বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য ব্যক্তি। তিনি যে এত অমায়িকভাবে আমাকে ফোন দেবেন, আমি এতে খুবই আশ্চর্য হয়েছি, খুবই মুগ্ধ হয়েছি।
১০ নভেম্বর ২০২৪
বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না।
৮ ঘণ্টা আগে
ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের সাম্প্রতিক মন্তব্য কেবল মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির জন্য নয়, বরং পুরো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকাঠামোর জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, যদি জাতিসংঘ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে এগোতে থাকে...
৮ ঘণ্টা আগে
একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় জলবায়ু পরিবর্তন আর শুধুই পরিবেশ সংরক্ষণ বা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার সীমিত পরিসরে আবদ্ধ কোনো ইস্যু নয়; বরং এটি ক্রমেই একটি কাঠামোগত বৈশ্বিক সংকটে রূপান্তরিত হয়েছে, যার প্রভাব রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, সীমান্ত নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির...
৮ ঘণ্টা আগেরাফায়েল আহমেদ শামীম

ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের সাম্প্রতিক মন্তব্য কেবল মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির জন্য নয়, বরং পুরো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকাঠামোর জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, যদি জাতিসংঘ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে এগোতে থাকে; তবে ফিলিস্তিনি নেতাদের বেছে বেছে হত্যা করা উচিত। এটি কোনো উগ্রমনা ব্যক্তির অযৌক্তিক মন্তব্য নয়, এটি একজন রাষ্ট্রীয় মন্ত্রীর মুখ থেকে আসা রাজনৈতিক নির্দেশ, যা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের জন্য এক চরম হুমকি।
এই মন্তব্যের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে রুখে দেওয়ার জন্য সুগঠিত নীতি অনুসরণ করছে, যেখানে রাজনৈতিক নেতাদের দমন, ভূখণ্ড দখল, বসতি সম্প্রসারণ এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অবজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ভোটে গাজা উপত্যকার স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার জন্য আন্তর্জাতিক শান্তিবাহিনী গঠনের প্রস্তাব, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সংস্কার কার্যক্রম এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গঠনের সহায়তা ইসরায়েলকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। ফিলিস্তিনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মানে তাদের রাষ্ট্র হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা, যা পশ্চিম তীরের দখলনীতি ও বসতি সম্প্রসারণকে আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এই ভীতিই বেন-গভিরের মতো উগ্র নেতাদের প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিতে প্রলুব্ধ করছে।
বেন-গভিরের বক্তব্যে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে অস্তিত্বহীন বলা, তাদের অন্য আরব দেশ থেকে আগত অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা এবং সন্ত্রাসমূলক আখ্যায়িত করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও জাতিগত স্বীকৃতির নীতির পরিপন্থী। ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে কোনো জাতিকে অবৈধ বা অস্তিত্বহীন হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে তার ওপর সহিংসতা প্রয়োগ করা হয়েছে। যেমন রুয়ান্ডার তুতসিদের ক্ষেত্রে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর এবং নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের বিরুদ্ধে। তাই এই ধরনের বক্তব্য কেবল হুমকি নয়, বরং বাস্তবায়নের প্রস্তুতি হিসেবে রাষ্ট্রীয় নির্দেশনার অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। তবে এই সহযোগিতাও ইসরায়েলের কাছে রাষ্ট্র স্বীকৃতির জন্য যথেষ্ট নয়। নেতানিয়াহু সরকারের ডানপন্থী জোটের নেতারা একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অর্থমন্ত্রী বেনজালেল স্মোট্রিচ পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের ভূখণ্ডের সঙ্গে একত্র করার চেষ্টা করছেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন, যাতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি না দেওয়া হয়। এই কৌশল দেখাচ্ছে, ইসরায়েলের নীতি কেবল নিরাপত্তার কারণে নয়, বরং রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অংশ। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি নীরব থাকে, তবে এটি আন্তর্জাতিক আইনের জন্য একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করবে। যে রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে হত্যার হুমকি দিতে পারে, তাকে আইনি ও নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ করার কোনো কার্যকর ক্ষমতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নেই, এটাই সবচেয়ে বড় উদ্বেগ।
ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের জন্য আলাদা কারাগারের কক্ষ প্রস্তুত রাখার কথাও ইসরায়েলি সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এটি শুধু হুমকি নয়, বরং সম্ভাব্য বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনার ইঙ্গিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি এটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে ইসরায়েল তার কৌশলগত লক্ষ্য পূরণের জন্য চরম হুমকি ও সহিংসতা ব্যবহারে প্রস্তুত।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির প্রক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গাজা পুনর্গঠন, পিএর সংস্কার কার্যক্রম এবং আন্তর্জাতিক শান্তিবাহিনী—সবই ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্র গঠনের পথকে সহায়তা করছে। এই প্রক্রিয়ায় ইসরায়েল উদ্বিগ্ন, কারণ এটি তাদের একতরফা দখল নীতি ও বসতি সম্প্রসারণকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। বেন-গভিরের মন্তব্য কেবল হুমকি নয়, বরং এই প্রক্রিয়ার প্রতি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
ইসরায়েলি নেতাদের উগ্র প্রতিক্রিয়ার কারণ হলো, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তাদের দীর্ঘমেয়াদি নীতি ও নিরাপত্তাকাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা এটিকে ‘রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের হুমকি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। একবার জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলে, পশ্চিম তীরের দখল, জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ এবং গাজার ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এই পরিস্থিতিই বেন-গভিরকে হত্যার হুমকি দিতে প্রলুব্ধ করেছে।
আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বেন-গভিরের বক্তব্য স্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক আদালতের কার্যকর পদক্ষেপ থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা কার্যকর হচ্ছে না। ইসরায়েলের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্র যখন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মিত্র শক্তির আশ্রয়ে থাকে, তখন আন্তর্জাতিক আইনের কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে জাতিসংঘের মতো সংস্থা কার্যকর হুমকি প্রতিরোধ করতে পারছে না। ফিলিস্তিনের জনগণ এই হুমকির প্রভাবে ভয় ও অনিশ্চয়তায় দগ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না, তাতে ইসরায়েল আরও বেপরোয়া হচ্ছে। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, রাষ্ট্রীয় হুমকি এবং নীরব আন্তর্জাতিক সমাজ মিলিত হলে অত্যাচারী নীতি বাস্তবায়িত হয়। রুয়ান্ডা, মিয়ানমার, ইউক্রেন—সবই এই প্যাটার্নের উদাহরণ। তাই ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো সুরক্ষিত রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় হস্তক্ষেপ অপরিহার্য।
ইসরায়েলি রাজনীতির উগ্রতা, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক চাপ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সীমিত প্রতিক্রিয়া মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন এক সংকট তৈরি করেছে, যেখানে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা ধ্বংসের মুখে। এই অবস্থা শুধু ফিলিস্তিনের জন্য বিপজ্জনক নয়; এটি পুরো মধ্যপ্রাচ্য, কূটনীতি এবং আন্তর্জাতিক আইনকে চ্যালেঞ্জ করছে। রাষ্ট্রীয় হত্যার হুমকি, ফিলিস্তিনের জনগণের অস্তিত্ব অস্বীকৃতি এবং জাতিসংঘকে হুমকি—সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব পরীক্ষা করছে। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নীরব থাকে, জাতিসংঘ কার্যকর পদক্ষেপ না নিক, তবে ইসরায়েলের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্ররা জানবে যে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য কোনো দায়বদ্ধতা নেই। এতে ফিলিস্তিনিরা রাষ্ট্রহীন হবে, তাদের নেতৃত্ব দুর্বল হবে এবং আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের ধারণা অন্ধকারে ঢাকা পড়বে। এই সংকট কেবল মধ্যপ্রাচ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি বৈশ্বিক নৈতিকতা, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের কাঠামোর জন্য বড় পরীক্ষা।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি কেবল ভূরাজনৈতিক নয়; এটি নৈতিক, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ না করে, পরিস্থিতি আরও সংকীর্ণ ও বিপজ্জনক হবে। রাষ্ট্রীয় হত্যার হুমকি, জাতিসংঘের ওপর চাপ, ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব অস্বীকার—সব মিলিয়ে বিশ্বকে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি করছে। এই বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখনই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। নইলে শুধু ফিলিস্তিন নয়, বৈশ্বিক নৈতিকতা, আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকারের ভিত্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সর্বোপরি ইসরায়েলের এই হুমকি শুধু একটি উগ্রমনা নেতার বক্তৃতা নয়; এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শক্তির অমোঘ প্রভাবের উদাহরণ। এটি রাষ্ট্রীয় নীতি, মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের কার্যকারিতা পুনর্মূল্যায়নের তাগিদ দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রাধান্য কি তারা নিশ্চিত করবে, নাকি শক্তিশালী রাষ্ট্রের উসকানি ও হত্যার হুমকি নিয়ে নীরব থাকবে?

ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের সাম্প্রতিক মন্তব্য কেবল মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির জন্য নয়, বরং পুরো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকাঠামোর জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, যদি জাতিসংঘ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে এগোতে থাকে; তবে ফিলিস্তিনি নেতাদের বেছে বেছে হত্যা করা উচিত। এটি কোনো উগ্রমনা ব্যক্তির অযৌক্তিক মন্তব্য নয়, এটি একজন রাষ্ট্রীয় মন্ত্রীর মুখ থেকে আসা রাজনৈতিক নির্দেশ, যা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের জন্য এক চরম হুমকি।
এই মন্তব্যের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে রুখে দেওয়ার জন্য সুগঠিত নীতি অনুসরণ করছে, যেখানে রাজনৈতিক নেতাদের দমন, ভূখণ্ড দখল, বসতি সম্প্রসারণ এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অবজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ভোটে গাজা উপত্যকার স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার জন্য আন্তর্জাতিক শান্তিবাহিনী গঠনের প্রস্তাব, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সংস্কার কার্যক্রম এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গঠনের সহায়তা ইসরায়েলকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। ফিলিস্তিনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মানে তাদের রাষ্ট্র হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা, যা পশ্চিম তীরের দখলনীতি ও বসতি সম্প্রসারণকে আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এই ভীতিই বেন-গভিরের মতো উগ্র নেতাদের প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিতে প্রলুব্ধ করছে।
বেন-গভিরের বক্তব্যে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে অস্তিত্বহীন বলা, তাদের অন্য আরব দেশ থেকে আগত অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা এবং সন্ত্রাসমূলক আখ্যায়িত করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও জাতিগত স্বীকৃতির নীতির পরিপন্থী। ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে কোনো জাতিকে অবৈধ বা অস্তিত্বহীন হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে তার ওপর সহিংসতা প্রয়োগ করা হয়েছে। যেমন রুয়ান্ডার তুতসিদের ক্ষেত্রে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর এবং নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের বিরুদ্ধে। তাই এই ধরনের বক্তব্য কেবল হুমকি নয়, বরং বাস্তবায়নের প্রস্তুতি হিসেবে রাষ্ট্রীয় নির্দেশনার অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। তবে এই সহযোগিতাও ইসরায়েলের কাছে রাষ্ট্র স্বীকৃতির জন্য যথেষ্ট নয়। নেতানিয়াহু সরকারের ডানপন্থী জোটের নেতারা একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অর্থমন্ত্রী বেনজালেল স্মোট্রিচ পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের ভূখণ্ডের সঙ্গে একত্র করার চেষ্টা করছেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন, যাতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি না দেওয়া হয়। এই কৌশল দেখাচ্ছে, ইসরায়েলের নীতি কেবল নিরাপত্তার কারণে নয়, বরং রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অংশ। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি নীরব থাকে, তবে এটি আন্তর্জাতিক আইনের জন্য একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করবে। যে রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে হত্যার হুমকি দিতে পারে, তাকে আইনি ও নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ করার কোনো কার্যকর ক্ষমতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নেই, এটাই সবচেয়ে বড় উদ্বেগ।
ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের জন্য আলাদা কারাগারের কক্ষ প্রস্তুত রাখার কথাও ইসরায়েলি সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এটি শুধু হুমকি নয়, বরং সম্ভাব্য বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনার ইঙ্গিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি এটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে ইসরায়েল তার কৌশলগত লক্ষ্য পূরণের জন্য চরম হুমকি ও সহিংসতা ব্যবহারে প্রস্তুত।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির প্রক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গাজা পুনর্গঠন, পিএর সংস্কার কার্যক্রম এবং আন্তর্জাতিক শান্তিবাহিনী—সবই ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্র গঠনের পথকে সহায়তা করছে। এই প্রক্রিয়ায় ইসরায়েল উদ্বিগ্ন, কারণ এটি তাদের একতরফা দখল নীতি ও বসতি সম্প্রসারণকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। বেন-গভিরের মন্তব্য কেবল হুমকি নয়, বরং এই প্রক্রিয়ার প্রতি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
ইসরায়েলি নেতাদের উগ্র প্রতিক্রিয়ার কারণ হলো, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তাদের দীর্ঘমেয়াদি নীতি ও নিরাপত্তাকাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা এটিকে ‘রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের হুমকি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। একবার জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলে, পশ্চিম তীরের দখল, জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ এবং গাজার ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এই পরিস্থিতিই বেন-গভিরকে হত্যার হুমকি দিতে প্রলুব্ধ করেছে।
আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বেন-গভিরের বক্তব্য স্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক আদালতের কার্যকর পদক্ষেপ থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা কার্যকর হচ্ছে না। ইসরায়েলের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্র যখন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মিত্র শক্তির আশ্রয়ে থাকে, তখন আন্তর্জাতিক আইনের কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে জাতিসংঘের মতো সংস্থা কার্যকর হুমকি প্রতিরোধ করতে পারছে না। ফিলিস্তিনের জনগণ এই হুমকির প্রভাবে ভয় ও অনিশ্চয়তায় দগ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না, তাতে ইসরায়েল আরও বেপরোয়া হচ্ছে। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, রাষ্ট্রীয় হুমকি এবং নীরব আন্তর্জাতিক সমাজ মিলিত হলে অত্যাচারী নীতি বাস্তবায়িত হয়। রুয়ান্ডা, মিয়ানমার, ইউক্রেন—সবই এই প্যাটার্নের উদাহরণ। তাই ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো সুরক্ষিত রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় হস্তক্ষেপ অপরিহার্য।
ইসরায়েলি রাজনীতির উগ্রতা, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক চাপ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সীমিত প্রতিক্রিয়া মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন এক সংকট তৈরি করেছে, যেখানে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা ধ্বংসের মুখে। এই অবস্থা শুধু ফিলিস্তিনের জন্য বিপজ্জনক নয়; এটি পুরো মধ্যপ্রাচ্য, কূটনীতি এবং আন্তর্জাতিক আইনকে চ্যালেঞ্জ করছে। রাষ্ট্রীয় হত্যার হুমকি, ফিলিস্তিনের জনগণের অস্তিত্ব অস্বীকৃতি এবং জাতিসংঘকে হুমকি—সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব পরীক্ষা করছে। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নীরব থাকে, জাতিসংঘ কার্যকর পদক্ষেপ না নিক, তবে ইসরায়েলের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্ররা জানবে যে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য কোনো দায়বদ্ধতা নেই। এতে ফিলিস্তিনিরা রাষ্ট্রহীন হবে, তাদের নেতৃত্ব দুর্বল হবে এবং আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের ধারণা অন্ধকারে ঢাকা পড়বে। এই সংকট কেবল মধ্যপ্রাচ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি বৈশ্বিক নৈতিকতা, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের কাঠামোর জন্য বড় পরীক্ষা।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি কেবল ভূরাজনৈতিক নয়; এটি নৈতিক, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ না করে, পরিস্থিতি আরও সংকীর্ণ ও বিপজ্জনক হবে। রাষ্ট্রীয় হত্যার হুমকি, জাতিসংঘের ওপর চাপ, ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব অস্বীকার—সব মিলিয়ে বিশ্বকে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি করছে। এই বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখনই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। নইলে শুধু ফিলিস্তিন নয়, বৈশ্বিক নৈতিকতা, আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকারের ভিত্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সর্বোপরি ইসরায়েলের এই হুমকি শুধু একটি উগ্রমনা নেতার বক্তৃতা নয়; এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শক্তির অমোঘ প্রভাবের উদাহরণ। এটি রাষ্ট্রীয় নীতি, মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের কার্যকারিতা পুনর্মূল্যায়নের তাগিদ দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রাধান্য কি তারা নিশ্চিত করবে, নাকি শক্তিশালী রাষ্ট্রের উসকানি ও হত্যার হুমকি নিয়ে নীরব থাকবে?

আমি খুবই সম্মানিত হয়েছি। কারণ, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা একজন নোবেল লরিয়েট, বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য ব্যক্তি। তিনি যে এত অমায়িকভাবে আমাকে ফোন দেবেন, আমি এতে খুবই আশ্চর্য হয়েছি, খুবই মুগ্ধ হয়েছি।
১০ নভেম্বর ২০২৪
বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না।
৮ ঘণ্টা আগে
ভারতের মালয়ালমভাষী উপকূলীয় রাজ্য কেরালা জনসংখ্যার বিচারে দেশটির ১৪তম বৃহৎ রাজ্য। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে এই রাজ্যের একটি বড় পার্থক্য হলো, এখানে বাম মতাদর্শের প্রভাব বেশি। কংগ্রেসেরও আধিপত্য রয়েছে। সে তুলনায় দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রভাব কিছুদিন...
৮ ঘণ্টা আগে
একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় জলবায়ু পরিবর্তন আর শুধুই পরিবেশ সংরক্ষণ বা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার সীমিত পরিসরে আবদ্ধ কোনো ইস্যু নয়; বরং এটি ক্রমেই একটি কাঠামোগত বৈশ্বিক সংকটে রূপান্তরিত হয়েছে, যার প্রভাব রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, সীমান্ত নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির...
৮ ঘণ্টা আগেড. জাহাঙ্গীর আলম সরকার

একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় জলবায়ু পরিবর্তন আর শুধুই পরিবেশ সংরক্ষণ বা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার সীমিত পরিসরে আবদ্ধ কোনো ইস্যু নয়; বরং এটি ক্রমেই একটি কাঠামোগত বৈশ্বিক সংকটে রূপান্তরিত হয়েছে, যার প্রভাব রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, সীমান্ত নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রচলিত নীতিমালার ওপর সরাসরি প্রতিফলিত হচ্ছে। শিল্পায়ন-উত্তর বিশ্বব্যবস্থায় অনিয়ন্ত্রিত কার্বন নিঃসরণ ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন আজ এমন এক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে, যা আধুনিক রাষ্ট্রের অস্তিত্বগত ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
বিশেষত, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে সমুদ্রস্তরের ক্রমবর্ধমান উত্থান বিশ্বের বহু নিম্নভূমি ও দ্বীপরাষ্ট্রের জন্য এক গভীর অস্তিত্ববাদী সংকটের জন্ম দিয়েছে। উপকূলীয় ক্ষয়, লবণাক্ততার বিস্তার, পানযোগ্য পানির ঘাটতি এবং ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস—এই সম্মিলিত প্রভাব দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জনবসতি, কৃষি উৎপাদনব্যবস্থা ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোকে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করছে। এর ফলে নিরাপত্তা-ধারণা আর শুধু সামরিক সক্ষমতা বা প্রতিরক্ষা কৌশলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না; বরং খাদ্যনিরাপত্তা, মানবনিরাপত্তা এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অবিচ্ছেদ্য উপাদানে পরিণত হচ্ছে।
মালদ্বীপ, কিরিবাতি, টুভালু, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ কিংবা বঙ্গোপসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলের মতো অঞ্চলগুলোতে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে ভূমি হারানোর আশঙ্কা নিছক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে বিবেচ্য নয়; বরং এটি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানা, নাগরিকত্বের ধারাবাহিকতা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মতো মৌলিক রাষ্ট্রীয় প্রশ্ন উত্থাপন করছে। কোনো রাষ্ট্রের ভূখণ্ড যদি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়, তবে সেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, তার সমুদ্রসীমা, এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন (ইইজেড) এবং সামুদ্রিক সম্পদের ওপর অধিকার কীভাবে সংরক্ষিত থাকবে—এই প্রশ্নগুলোর সুস্পষ্ট উত্তর আন্তর্জাতিক আইনের বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে এখনো অনুপস্থিত।
পরিবেশগত সংকট থেকে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা
আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত প্যানেলের বিভিন্ন মূল্যায়ন প্রতিবেদনে প্রতীয়মান হয়েছে যে গত এক শতাব্দীতে বৈশ্বিক সমুদ্রস্তর উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ভবিষ্যতে এই প্রবণতা আরও ত্বরান্বিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বরফগলন, তাপীয় সম্প্রসারণ এবং চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনাবলির ফলে উপকূলীয় ক্ষয় ও লবণাক্ততার বিস্তার দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর কৃষি, পানীয় জল এবং মানববসতির ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর পরিণতিতে কিছু রাষ্ট্র কার্যত ‘ডুবে যাওয়া রাষ্ট্র’তে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।
দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব সংকট
রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদান—ভূখণ্ড, জনসংখ্যা, সরকার ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি—এর মধ্যে ভূখণ্ড যদি স্থায়ীভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তবে রাষ্ট্রের আইনগত অস্তিত্ব ও মর্যাদা কীভাবে নির্ধারিত হবে—এই প্রশ্ন আন্তর্জাতিক আইনের জন্য এক গুরুতর চ্যালেঞ্জ। সমুদ্রস্তরের উত্থানের ফলে দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর স্থায়ী ভূখণ্ড সংকুচিত হলে তাদের সামুদ্রিক সীমানা, বিশেষত ইইজেড ও সামুদ্রিক সম্পদের অধিকার নিয়ে নতুন ধরনের আইনি ও ভূরাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি হয়। এর ফলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সীমান্ত ও সম্পদকেন্দ্রিক বিরোধ এবং শক্তির পুনর্বিন্যাস অনিবার্য হয়ে ওঠে।
জলবায়ু শরণার্থী
সমুদ্রস্তরের উচ্চতার অন্যতম গভীর মানবিক পরিণতি হলো জলবায়ু শরণার্থী সংকটের উদ্ভব। দ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠী যখন নিজ ভূমিতে বসবাসের সক্ষমতা হারায়, তখন তারা অভ্যন্তরীণ অথবা আন্তর্জাতিক অভিবাসনে বাধ্য হয়। তবে আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইনে ‘জলবায়ু শরণার্থী’ নামে কোনো স্বীকৃত শ্রেণি না থাকায় এসব বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী আইনি সুরক্ষা, নাগরিক অধিকার ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে একধরনের আইনগত শূন্যতার মুখোমুখি হয়।
এই বাস্তুচ্যুতি শুধু মানবিক সংকটেই সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং এটি গন্তব্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য সামাজিক চাপ, অর্থনৈতিক বোঝা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাঝুঁকিরও সৃষ্টি করে। দক্ষিণ এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও আফ্রিকার উপকূলীয় দেশগুলোতে এর ভূরাজনৈতিক অভিঘাত ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক সীমাবদ্ধতা
জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় জোট জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নীতিকাঠামো ও অর্থনৈতিক তহবিল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও, দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্ব সংকট মোকাবিলায় এখনো কোনো বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক আইনগত ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর ঐতিহাসিক কার্বন নিঃসরণের দায় স্বীকার এবং ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোর ন্যায্য ক্ষতিপূরণের দাবির মধ্যে দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে প্রায়ই অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে কিছু দ্বীপরাষ্ট্র বিকল্প কূটনৈতিক কৌশল অনুসরণ করছে—যেমন ডিজিটাল সার্বভৌমত্বের ধারণা, বিদেশে ভূমি ক্রয়, কিংবা ‘রাষ্ট্র নির্বাসনে’ থাকার তাত্ত্বিক প্রস্তাব। এসব উদ্যোগ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণাকে নতুনভাবে পুনর্বিবেচনার সুযোগ সৃষ্টি করছে।
ভবিষ্যৎ ভূরাজনৈতিক অভিঘাত
সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি বিশ্বরাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্য পুনর্গঠনের সম্ভাবনা বহন করে। সামুদ্রিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ, নৌপথের নিরাপত্তা, সামরিক ঘাঁটির কৌশলগত অবস্থান এবং মানবিক হস্তক্ষেপ—সব ক্ষেত্রেই জলবায়ু পরিবর্তন এক নীরব কিন্তু গভীর ভূরাজনৈতিক চালিকাশক্তিতে পরিণত হচ্ছে। এর ফলে বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধ ও কূটনীতির প্রচলিত ধারণার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ‘জলবায়ু নিরাপত্তা’ নামক নতুন এক কৌশলগত বাস্তবতা।
কাজেই, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জন্য নিছক পরিবেশগত দুর্যোগ নয়; এটি তাদের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব, নিরাপত্তাকাঠামো এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মৌলিক ভিত্তিকে গভীরভাবে চ্যালেঞ্জ করছে। জলবায়ু শরণার্থী সংকট এবং সমুদ্রসীমা ঘিরে উদ্ভূত বিরোধ ভবিষ্যৎ ভূরাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ও অনিবার্য অধ্যায়ে পরিণত হবে। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব সহানুভূতিশীল ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে কার্যকর ও বাধ্যতামূলক আইনগত কাঠামো, ন্যায্য কূটনৈতিক উদ্যোগ এবং দায়বদ্ধ বৈশ্বিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা, যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার দ্বীপরাষ্ট্রগুলো ইতিহাসের মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে না গিয়ে আন্তর্জাতিক সমাজের পূর্ণ মর্যাদাসম্পন্ন অংশ হিসেবে টিকে থাকতে পারে।

একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় জলবায়ু পরিবর্তন আর শুধুই পরিবেশ সংরক্ষণ বা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার সীমিত পরিসরে আবদ্ধ কোনো ইস্যু নয়; বরং এটি ক্রমেই একটি কাঠামোগত বৈশ্বিক সংকটে রূপান্তরিত হয়েছে, যার প্রভাব রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, সীমান্ত নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রচলিত নীতিমালার ওপর সরাসরি প্রতিফলিত হচ্ছে। শিল্পায়ন-উত্তর বিশ্বব্যবস্থায় অনিয়ন্ত্রিত কার্বন নিঃসরণ ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন আজ এমন এক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে, যা আধুনিক রাষ্ট্রের অস্তিত্বগত ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
বিশেষত, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে সমুদ্রস্তরের ক্রমবর্ধমান উত্থান বিশ্বের বহু নিম্নভূমি ও দ্বীপরাষ্ট্রের জন্য এক গভীর অস্তিত্ববাদী সংকটের জন্ম দিয়েছে। উপকূলীয় ক্ষয়, লবণাক্ততার বিস্তার, পানযোগ্য পানির ঘাটতি এবং ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস—এই সম্মিলিত প্রভাব দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জনবসতি, কৃষি উৎপাদনব্যবস্থা ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোকে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করছে। এর ফলে নিরাপত্তা-ধারণা আর শুধু সামরিক সক্ষমতা বা প্রতিরক্ষা কৌশলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না; বরং খাদ্যনিরাপত্তা, মানবনিরাপত্তা এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অবিচ্ছেদ্য উপাদানে পরিণত হচ্ছে।
মালদ্বীপ, কিরিবাতি, টুভালু, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ কিংবা বঙ্গোপসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলের মতো অঞ্চলগুলোতে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে ভূমি হারানোর আশঙ্কা নিছক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে বিবেচ্য নয়; বরং এটি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানা, নাগরিকত্বের ধারাবাহিকতা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মতো মৌলিক রাষ্ট্রীয় প্রশ্ন উত্থাপন করছে। কোনো রাষ্ট্রের ভূখণ্ড যদি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়, তবে সেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, তার সমুদ্রসীমা, এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন (ইইজেড) এবং সামুদ্রিক সম্পদের ওপর অধিকার কীভাবে সংরক্ষিত থাকবে—এই প্রশ্নগুলোর সুস্পষ্ট উত্তর আন্তর্জাতিক আইনের বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে এখনো অনুপস্থিত।
পরিবেশগত সংকট থেকে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা
আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত প্যানেলের বিভিন্ন মূল্যায়ন প্রতিবেদনে প্রতীয়মান হয়েছে যে গত এক শতাব্দীতে বৈশ্বিক সমুদ্রস্তর উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ভবিষ্যতে এই প্রবণতা আরও ত্বরান্বিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বরফগলন, তাপীয় সম্প্রসারণ এবং চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনাবলির ফলে উপকূলীয় ক্ষয় ও লবণাক্ততার বিস্তার দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর কৃষি, পানীয় জল এবং মানববসতির ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর পরিণতিতে কিছু রাষ্ট্র কার্যত ‘ডুবে যাওয়া রাষ্ট্র’তে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।
দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব সংকট
রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদান—ভূখণ্ড, জনসংখ্যা, সরকার ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি—এর মধ্যে ভূখণ্ড যদি স্থায়ীভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তবে রাষ্ট্রের আইনগত অস্তিত্ব ও মর্যাদা কীভাবে নির্ধারিত হবে—এই প্রশ্ন আন্তর্জাতিক আইনের জন্য এক গুরুতর চ্যালেঞ্জ। সমুদ্রস্তরের উত্থানের ফলে দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর স্থায়ী ভূখণ্ড সংকুচিত হলে তাদের সামুদ্রিক সীমানা, বিশেষত ইইজেড ও সামুদ্রিক সম্পদের অধিকার নিয়ে নতুন ধরনের আইনি ও ভূরাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি হয়। এর ফলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সীমান্ত ও সম্পদকেন্দ্রিক বিরোধ এবং শক্তির পুনর্বিন্যাস অনিবার্য হয়ে ওঠে।
জলবায়ু শরণার্থী
সমুদ্রস্তরের উচ্চতার অন্যতম গভীর মানবিক পরিণতি হলো জলবায়ু শরণার্থী সংকটের উদ্ভব। দ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠী যখন নিজ ভূমিতে বসবাসের সক্ষমতা হারায়, তখন তারা অভ্যন্তরীণ অথবা আন্তর্জাতিক অভিবাসনে বাধ্য হয়। তবে আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইনে ‘জলবায়ু শরণার্থী’ নামে কোনো স্বীকৃত শ্রেণি না থাকায় এসব বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী আইনি সুরক্ষা, নাগরিক অধিকার ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে একধরনের আইনগত শূন্যতার মুখোমুখি হয়।
এই বাস্তুচ্যুতি শুধু মানবিক সংকটেই সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং এটি গন্তব্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য সামাজিক চাপ, অর্থনৈতিক বোঝা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাঝুঁকিরও সৃষ্টি করে। দক্ষিণ এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও আফ্রিকার উপকূলীয় দেশগুলোতে এর ভূরাজনৈতিক অভিঘাত ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক সীমাবদ্ধতা
জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় জোট জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নীতিকাঠামো ও অর্থনৈতিক তহবিল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও, দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্ব সংকট মোকাবিলায় এখনো কোনো বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক আইনগত ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর ঐতিহাসিক কার্বন নিঃসরণের দায় স্বীকার এবং ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোর ন্যায্য ক্ষতিপূরণের দাবির মধ্যে দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে প্রায়ই অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে কিছু দ্বীপরাষ্ট্র বিকল্প কূটনৈতিক কৌশল অনুসরণ করছে—যেমন ডিজিটাল সার্বভৌমত্বের ধারণা, বিদেশে ভূমি ক্রয়, কিংবা ‘রাষ্ট্র নির্বাসনে’ থাকার তাত্ত্বিক প্রস্তাব। এসব উদ্যোগ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণাকে নতুনভাবে পুনর্বিবেচনার সুযোগ সৃষ্টি করছে।
ভবিষ্যৎ ভূরাজনৈতিক অভিঘাত
সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি বিশ্বরাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্য পুনর্গঠনের সম্ভাবনা বহন করে। সামুদ্রিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ, নৌপথের নিরাপত্তা, সামরিক ঘাঁটির কৌশলগত অবস্থান এবং মানবিক হস্তক্ষেপ—সব ক্ষেত্রেই জলবায়ু পরিবর্তন এক নীরব কিন্তু গভীর ভূরাজনৈতিক চালিকাশক্তিতে পরিণত হচ্ছে। এর ফলে বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধ ও কূটনীতির প্রচলিত ধারণার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ‘জলবায়ু নিরাপত্তা’ নামক নতুন এক কৌশলগত বাস্তবতা।
কাজেই, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জন্য নিছক পরিবেশগত দুর্যোগ নয়; এটি তাদের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব, নিরাপত্তাকাঠামো এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মৌলিক ভিত্তিকে গভীরভাবে চ্যালেঞ্জ করছে। জলবায়ু শরণার্থী সংকট এবং সমুদ্রসীমা ঘিরে উদ্ভূত বিরোধ ভবিষ্যৎ ভূরাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ও অনিবার্য অধ্যায়ে পরিণত হবে। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব সহানুভূতিশীল ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে কার্যকর ও বাধ্যতামূলক আইনগত কাঠামো, ন্যায্য কূটনৈতিক উদ্যোগ এবং দায়বদ্ধ বৈশ্বিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা, যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার দ্বীপরাষ্ট্রগুলো ইতিহাসের মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে না গিয়ে আন্তর্জাতিক সমাজের পূর্ণ মর্যাদাসম্পন্ন অংশ হিসেবে টিকে থাকতে পারে।

আমি খুবই সম্মানিত হয়েছি। কারণ, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা একজন নোবেল লরিয়েট, বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য ব্যক্তি। তিনি যে এত অমায়িকভাবে আমাকে ফোন দেবেন, আমি এতে খুবই আশ্চর্য হয়েছি, খুবই মুগ্ধ হয়েছি।
১০ নভেম্বর ২০২৪
বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না।
৮ ঘণ্টা আগে
ভারতের মালয়ালমভাষী উপকূলীয় রাজ্য কেরালা জনসংখ্যার বিচারে দেশটির ১৪তম বৃহৎ রাজ্য। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে এই রাজ্যের একটি বড় পার্থক্য হলো, এখানে বাম মতাদর্শের প্রভাব বেশি। কংগ্রেসেরও আধিপত্য রয়েছে। সে তুলনায় দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রভাব কিছুদিন...
৮ ঘণ্টা আগে
ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের সাম্প্রতিক মন্তব্য কেবল মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির জন্য নয়, বরং পুরো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকাঠামোর জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, যদি জাতিসংঘ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে এগোতে থাকে...
৮ ঘণ্টা আগে