রাজু নুরুল
নভেম্বরের ১৯ তারিখ ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ, এদিন ভারতের মহাপরাক্রমশালী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তাঁর সরকারের করা তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। সঙ্গে দেশবাসীর কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়েছেন।
এক দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে অবিসংবাদিত মুখ হয়ে ওঠা নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে এমন আচরণ রীতিমতো বিস্ময়ের। টানা দুই মেয়াদ নির্ভেজাল কাটিয়ে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার স্বপ্নে বিভোর মোদি ও তাঁর অনুসারীদের জন্য এটি বিরল এক অভিজ্ঞতা। এর আগে কোভিড সামলাতে ব্যর্থ হয়ে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন তিনি।
গত শুক্রবারের (১৯ নভেম্বর) ভাষণে তিনি বলেছেন, ‘তপস্যায় নিশ্চয় কিঞ্চিৎ ঘাটতি ছিল, তাই সব কৃষককে সন্তুষ্ট করতে পারিনি। স্বচ্ছ হৃদয়ে ক্ষমা চেয়ে কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।’ আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে আন্দোলনকারী কৃষকদের খেত-খামারে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। মোদির এ ঘোষণা রাজনৈতিক মহলে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। কেউ বলছেন, অবশেষে হার মানলেন নরেন্দ্র মোদি। কেউ বলছেন, এ জয় কৃষকের। বিরোধী দল কংগ্রেস বলেছে, ‘বিলম্বিত বোধোদয়। অহংকারের পতন হলো।’ তবে আন্দোলনের শীর্ষ নেতা ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের (বিকেইউ) প্রধান রাকেশ টিকায়েত বলেছেন, বিতর্কিত কৃষি আইন দেশের পার্লামেন্টে বাতিল হলেই শুধু তাঁরা চলমান আন্দোলন প্রত্যাহার করবেন। রাজ্যসভার শীতকালীন অধিবেশন শুরু হচ্ছে ২৯ নভেম্বর।
কী ছিল বিতর্কিত কৃষি আইনে?
সরকার শুরু থেকে বলে আসছিল—তিনটি উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তিনটি কৃষি আইন কার্যকর করা হচ্ছে। প্রথমটি হচ্ছে, কৃষিক্ষেত্রে ফড়িয়া বা দালালদের আধিপত্য কমিয়ে কৃষকের আয় বাড়ানো। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, রাজ্যগুলোয় চুক্তিভিত্তিক চাষের ব্যবস্থা আইনসিদ্ধ করা এবং তৃতীয়টি হচ্ছে, কৃষিপণ্য বিপণন নিয়ে যে আইন রয়েছে, তা দূর করে আন্তঃরাজ্য কৃষিপণ্যের অবাধ বাণিজ্যের রাস্তা খুলে দেওয়া।
এখন দেখা যাক, আইন তিনটিতে কী বলা আছে এবং কেনই-বা এর বিরোধিতা করা হচ্ছিল। প্রথম আইনটি ছিল অত্যাবশ্যক পণ্য সংশোধনী আইন। এ আইনের মাধ্যমে কোনো দালাল বা ফড়িয়া ছাড়া কৃষক সরাসরি বড় ব্যবসায়ীর কাছে তাঁর পণ্য বিক্রি করতে পারবেন। এতে কৃষক প্রকৃত দাম পাবেন ও আয় বাড়বে। কিন্তু কৃষকেরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের কথা হলো, অত্যাবশ্যক পণ্য (সংশোধনী) আইনের মাধ্যমে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সরাসরি কৃষকদের থেকে কৃষিপণ্য কিনে মজুত ও বিক্রির অধিকার দেওয়া হলো। এর মধ্য দিয়ে সরকার কৃষিপণ্যে যে সহায়ক মূল্য দেয়, তা তুলে নিতে চায়। কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য কেনার দায় সরকার নিজেদের ঘাড় থেকে ঝেড়ে বেসরকারি সংস্থা বা ব্যবসায়ীদের কাছে দিতে চায়। ফলে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য মজুতের ঊর্ধ্বসীমা না রাখায় সেসব পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা চলে যাবে বড় ব্যবসায়ীদের হাতে।
দ্বিতীয় আইনটি কৃষিপণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন আইন। সরকার বলছে, এ আইনের ফলে কৃষক তাঁর এলাকার মান্ডির বাইরেও ফসল বিক্রি করতে পারবেন। এখন কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য মান্ডির মাধ্যমে বিভিন্ন হাত ঘুরে বড় ব্যবসায়ীর কাছে পৌঁছায়। নতুন আইনের ফলে বড় ব্যবসায়ী বা বেসরকারি কোনো সংস্থা চাইলে সরাসরি চাষির কাছ থেকে কৃষিপণ্য কিনে নিতে পারবেন। কৃষকদের দাবি, তাঁরা এতে আপাতত লাভবান হবেন সত্য; কিন্তু এতে মান্ডিব্যবস্থার বিলোপ ঘটবে। ফলে কৃষকের সুরক্ষাকবচ থাকবে না এবং সেই সুযোগে বড় সংস্থাগুলো কৃষকদের ক্রমাগত ঠকানোর সুযোগ পাবে।
তৃতীয়টিকে বলা হচ্ছিল কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ এবং কৃষি পরিষেবাসংক্রান্ত কৃষক চুক্তি আইন। এ আইনের মাধ্যমে কৃষক চুক্তিনির্ভর চাষ করতে পারবেন। কৃষক আগে থেকেই বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে শস্যের দাম নির্ধারণ করে নিতে পারবেন। কোনো বেসরকারি বাণিজ্য সংস্থা বা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সংস্থা চাইলে কৃষকদের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে সেই জমিতে কৃষিজ পণ্য ফলাতে পারবেন। জমির চুক্তি অনুযায়ী কৃষক দাম পেয়ে যাবেন। কৃষক নিজের জমিতে কাজ করতে চাইলে তার জন্য দৈনিক পারিশ্রমিকও মিলবে। সরকারের যুক্তি, এতে দেশীয় কৃষিজ পণ্যের চাহিদা বাড়বে। কৃষিপণ্য রপ্তানির পথ প্রশস্ত হবে। কিন্তু কৃষকদের আশঙ্কা ছিল, চুক্তির খেলাপ হলে প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে টেকার সামর্থ্য কৃষকদের নেই। তখন কৃষকেরা নিজ জমি লিজ দিতে বাধ্য হবেন। ফলে নিজের জমিতে ক্রীতদাস হয়ে যাবেন।
মোটকথা, নতুন তিনটি আইন মূলত কৃষকের কাছ থেকে সরকারি সংরক্ষণের সুবিধা কেড়ে নিত, যা কয়েক দশক ধরে ভারতের কৃষকদের মুক্তবাজার থেকে রক্ষা করেছে।
আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল সবখানে
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে তড়িঘড়ি করে সংসদের অধিবেশনে বিনা আলোচনায় বিল তিনটি আইনে রূপান্তরিত হয়। বিলের ওপর আলোচনার দাবি না মেনে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতেও বিলগুলো পাঠাতে অস্বীকার করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ততক্ষণে দেশজুড়ে কৃষকেরা ফুঁসে উঠেছেন। অনির্দিষ্টকালের জন্য লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিয়ে কৃষকেরা দিল্লি অবরোধ শুরু করেন। তত দিনে ৪০টির বেশি সংগঠন এক ছাতার নিচে এসে গেছে। গড়ে তুলেছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। ভারতে সংঘবদ্ধ কৃষক সংগঠনের পালে হাওয়া লাগল। ধারাবাহিক মিছিল, সভা-সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘটের মাধ্যমে প্রায় দেড় বছর পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশসহ ভারতের কৃষিপ্রধান বড় বড় অঞ্চলে রাস্তাঘাট দখল করে রেখেছিলেন তাঁরা। আন্দোলনের মধ্যে শিখ ও জাটরা সংখ্যায় বেশি ছিলেন। গত দেড় বছর বর্ষা, শীত, গরম—কোনো দুর্যোগেই মাঠ ছাড়েননি তাঁরা। আন্দোলনকে অবৈধ ঘোষণা করতে মোদি সরকার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে কৃষি আন্দোলনকে অবৈধ বলে ঘোষণা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, কৃষকদের আন্দোলন আইনানুগ এবং আন্দোলন করার অধিকার সংবিধানেই আছে। উল্টো পুলিশ প্রশাসন ও সরকারকে আন্দোলনে বাধা না দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন আদালত।
গণমানুষের লাগাতার আন্দোলন
প্রথমে পাঞ্জাব-হরিয়ানাসহ বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকেরা দিল্লির সীমান্তে এসে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁরা ট্রাক, ট্রাক্টর আর সঙ্গে গোটা পরিবার নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। রাজধানী অচল করে দিয়েছিলেন। এক বছর ধরে অবরোধস্থানে থেকেছেন কৃষকেরা। সেসব স্থানেই শিশুদের পড়াশোনা করাতে স্কুল গড়ে তোলা হয়েছে। কমিউনিটি কিচেন পরিচালনা করে কৃষকদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে দিনের পর দিন। নারীদের জন্য ভ্রাম্যমাণ টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে। একসময় সেই আন্দোলন সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে। কংগ্রেস ও বাম দল ছাড়াও রাজ্যভিত্তিক দলগুলো আন্দোলনে সমর্থন দেয়। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যোগ দিয়েছেন কৃষকদের এই ক্যাম্পে। শিশুদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁরা। পরিবারের বাধা, সরকারের চোখরাঙানিকে গ্রাহ্য করেননি।
এ বছরের অক্টোবরে ‘রেল রোকা’ কর্মসূচির ডাক দিলে গোটা রেলব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। ‘ভারত বন্ধ’-এ সারা ভারত স্তব্ধ হয়ে যায়। কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করে সুমিত নামে এক বর তাঁর ট্রাক্টরে কৃষকদের ঝান্ডা ঝুলিয়ে বিয়ের আসরে হাজির হন। পাঞ্জাবের ফরিদকোট জেলার কোট কপুরা গ্রামের ২৮ বছর বয়সী মনি গিল তাঁর করপোরেট চাকরি ছেড়ে কৃষকদের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘আমি এখানে আমাদের কৃষকদের প্রতি সমর্থন জানাতে এসেছি। এই আইনগুলো দ্বারা শুধু কৃষকদের ক্ষতি হবে মনে হলেও আসলে এতে লোকসান হবে সব মানুষের। আমি নিশ্চিত যে আমরা জিতব। দিল্লিতে একটা ছোট পাঞ্জাব তৈরি হয়ে গেছে, দেখতে বেশ লাগছে।’ এভাবেই কৃষকদের আন্দোলন হয়ে পড়ে সর্বস্তরের আন্দোলন।
শুধু ভারতে নয়, আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশের বাইরেও। প্রবাসী ভারতীয়দের পাশাপাশি জাতিসংঘ কৃষকদের আন্দোলন বিবেচনা করতে চিঠি দেয়। দেশ হিসেবে ব্রিটেন, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র; ব্যক্তি হিসেবে গায়িকা রিয়ানা, পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের আইনজীবী ও তাঁর বোনঝি মিনা হ্যারিস; মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কৃষক আন্দোলন নিয়ে মোদি সরকারকে সতর্ক করে।
দমন-পীড়ন-নিগ্রহ, তবু অটল
মোদি সরকার এসব আন্দোলন গ্রাহ্য করেনি। ফলে দেড় বছরের আন্দোলনে সাত শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এ বছরের জুন পর্যন্ত শুধু পাঞ্জাবে মারা গেছেন ২২০ জন কৃষক। আন্দোলনকারীদের ওপর নানাভাবে নিপীড়ন চালানো হয়েছে। কৃষকদের ওপর গাড়ি উঠিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। মারা গেছেন কয়েকজন কিষানি। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে হয়েছে ব্যাপক সংঘর্ষ। কৃষকদের মনোবল ও ঐক্য ভাঙতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি শাসক বিজেপি।
একদিকে প্রশাসনিক দমন-পীড়ন, অকথ্য পুলিশি অত্যাচার; অন্যদিকে বিভিন্ন ধারায় মামলা করে কৃষক ঐক্যে ভাঙনের চেষ্টা চলেছে। একদল কৃষককে ভাঙিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। দিল্লির লাগোয়া বলে পাঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষকেরা অবরোধে শামিল হওয়ায় তাঁদের ‘দেশদ্রোহী’ ও ‘খলিস্তানি’ বলে কটাক্ষ করা হয়েছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক: গত বছরের ২০ ডিসেম্বরের ঘটনা। বিমলা দেবী নামের ৬২ বছর বয়সী এক নারী সিংঘু আন্দোলনমঞ্চে এসেছিলেন। সেখানে গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ওই মঞ্চে আন্দোলন করছে তাঁর ছেলে এবং ভাইয়েরা। তাঁরা কেউ সন্ত্রাসী বা বিদ্রোহী নন। হরিয়ানার সোনিপত জেলার সেহরি গ্রামে তাঁর পরিবার দুই একর জমিতে গম, জোয়ার ও আখের চাষ করে। অথচ দূরদর্শনে শোনা গেল, ‘আমাদের ছেলেদের গুন্ডা বলা হচ্ছে। ওরা চাষি, গুন্ডা নয়। এসব শুনে আমি কাঁদছিলাম। কারণ, ওরা জানে না, কৃষকদের চেয়ে বড় মানুষ নেই।’
এত সব দমন-পীড়নের পরেও কৃষকেরা ছিলেন অনড়। অবশেষে দেড় বছর পর এল তাঁদের মধুর জয়।
কৃষি আইন বাতিল কি রাজনৈতিক কারণে?
সাম্প্রতিক উপনির্বাচনগুলোয় বিজেপির ফল হয়েছে হতাশাজনক। হিমাচল প্রদেশের চারটি আসনেই তারা কংগ্রেসের কাছে হেরেছে। হরিয়ানায় উপনির্বাচনে হয়েছে তৃতীয়। রাজস্থানে দুটি আসন হারিয়েছে কংগ্রেসের কাছে। মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও কর্নাটকে একটি করে আসন কেড়ে নিয়েছে কংগ্রেস। দাদরা-নগর হাভেলিতে হেরেছে শিবসেনার কাছে। পশ্চিমবঙ্গের সাত আসনের উপনির্বাচনে সাতটিতেই ধরাশায়ী হয়েছে। উত্তর প্রদেশের ৪০৪টি বিধানসভার মধ্যে ৩১২টি বিজেপির দখলে, সেই রাজ্যে দুই-তৃতীয়াংশ আসন হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কার কথা শুনিয়েছেন দলীয় নেতারা। কৃষক আন্দোলনের ঢেউ সবচেয়ে বেশি উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে। এখানে ১০৪টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে বিজেপির দখলে ৭৫টির মতো আসন। তা সম্ভব হয়েছিল জাট ও মুসলমান কৃষকদের জোটে ভাঙন ধরানোর কারণে। সেই ভাঙন জোড়া লাগিয়েছে কৃষক আন্দোলন।
২০২২ সালে যে রাজ্যগুলোয় বিধানসভা নির্বাচন হবে, তার মধ্যে অন্যতম পাঞ্জাব। ভারতের এ রাজ্য একমাত্র শিখপ্রধান। কৃষি আইন বাতিলে যাঁরা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম এ রাজ্যের শিখ কৃষকেরা। তাঁদের কথা মাথায় রেখে মোদি এমন দিনে কৃষি আইন বাতিলের ঘোষণা দিলেন যে, ১৯ নভেম্বর ছিল শিখ ধর্মাবলম্বীদের গুরু নানক দেবের জন্মবার্ষিকী। ভারতের এই দুই বড় রাজ্য ছাড়াও উত্তরাখণ্ড, মনিপুর, গোয়ায় নির্বাচন হবে আগামী বছরের শুরুর দিকে। আর বছরের শেষ দিকে নির্বাচন হবে হিমাচল ও গুজরাটে। তাই সব মিলিয়ে বিশ্লেষকেরা বলছেন, কৃষকদের স্বার্থ নয়, আইন বাতিলের পেছনে প্রধান প্রভাবক ভোটের হিসাব-নিকাশ।
ভারত-বাংলাদেশের কৃষিতে মিল-অমিল ও ভবিষ্যৎ
ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশেরই জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৬ শতাংশ। বাংলাদেশে এখনো ৪৩ শতাংশ মানুষ কৃষির সঙ্গে যুক্ত, যেখানে ভারতে এ হার আরও বেশি—৫২ শতাংশ। তবে ভারতের কৃষি আমাদের চেয়ে বহুগুণ বড় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। দুগ্ধ, কাজুবাদাম, নারিকেল, চা, পাট, আম, গবাদি পশুসহ নানা কৃষিপণ্য উৎপাদনে ভারত বিশ্বে প্রথম। কফি উৎপাদনে সারা বিশ্বে ষষ্ঠ, তামাকে তৃতীয়, বিশ্বের মোট উৎপাদিত ফলের ১০ শতাংশ ভারত একা উৎপাদন করে। বাংলাদেশও কৃষির নানা শাখায় বিশ্বদরবারে গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। ইলিশে প্রথম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, পাটে দ্বিতীয়, আলু উৎপাদনে ষষ্ঠ, ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন চতুর্থ।
কিন্তু কৃষকদের সুরক্ষায় বাংলাদেশে অবস্থা যে যথেষ্ট নাজুক, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের মতো বাংলাদেশের কৃষকেরা যোজন-যোজন দূরে। কৃষকের মাঠে যখন এক কেজি আলু ৫ টাকা দরে বিক্রি হয়, সেটিই ঢাকার মতো বড় শহরে কখনো ২০ টাকার নিচে নামে না। ২০ টাকা কেজি দরের ধান যখন চাল হয়ে যায়, সেটার দাম গিয়ে দাঁড়ায় ৫০-৬০ টাকায়। এই উদাহরণ প্রায় সব পণ্যের ক্ষেত্রে সত্য।
বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা ধীরে ধীরে করপোরেট মধ্যস্বত্বভোগীদের দখলে চলে গেছে। ওদিকে দফায় দফায় ডিজেলের দাম বৃদ্ধি, বীজের সংকট, সারের অভাব তো নিয়মিত ঘটনা। কৃষকের কাছ থেকে সস্তায় কিনে ব্যক্তিগত সুরক্ষায় মজুত করে মাঝখান থেকে একদল লুটে নিচ্ছে অস্বাভাবিক মুনাফা। কিন্তু ভারতের মতো বাংলাদেশের কৃষক সংঘবদ্ধ নয়, নেই সচেতনতা। তিনটি আইন বাতিলের জন্য ভারতের লাখো কৃষক যেভাবে একটানা দেড় বছর মাঠঘাটে আন্দোলন করে বেড়াল, সংগঠনের সেই শক্তি অনুপস্থিত তো বটেই; বরং বাংলাদেশের কোনো একটা কৃষি আইন প্রণয়নের সময় কি আদৌ কোনো কৃষকের মন্তব্য চাওয়া হয়, নাকি কৃষকেরা জানে যে, আইন দিয়ে আসলে কী হয়? এখানেই ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের কৃষকদের মূল তফাত।
গণতন্ত্রের টালমাটাল সময়ে গর্ব করার মতো যে অহিংস আন্দোলন ভারতের কিষান দেখাল, সেখান থেকে কি আমরা শিখব যে, আন্দোলন কীভাবে করতে হয়? গত বছর তীব্র শীতের গভীর রাতে উন্মুক্ত রাজপথে বৃদ্ধ শিখ কৃষকদের নির্জীব হয়ে বসে থাকার মাহাত্ম্যকে ধারণ করার যোগ্যতা কি অর্জন করতে পারব কখনো? আর যদি না পারি, তবে আমাদের কৃষির ভবিষ্যৎ আর কৃষকের হাতে থাকবে না।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
নভেম্বরের ১৯ তারিখ ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ, এদিন ভারতের মহাপরাক্রমশালী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তাঁর সরকারের করা তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। সঙ্গে দেশবাসীর কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়েছেন।
এক দশক ধরে ভারতের রাজনীতিতে অবিসংবাদিত মুখ হয়ে ওঠা নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে এমন আচরণ রীতিমতো বিস্ময়ের। টানা দুই মেয়াদ নির্ভেজাল কাটিয়ে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার স্বপ্নে বিভোর মোদি ও তাঁর অনুসারীদের জন্য এটি বিরল এক অভিজ্ঞতা। এর আগে কোভিড সামলাতে ব্যর্থ হয়ে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন তিনি।
গত শুক্রবারের (১৯ নভেম্বর) ভাষণে তিনি বলেছেন, ‘তপস্যায় নিশ্চয় কিঞ্চিৎ ঘাটতি ছিল, তাই সব কৃষককে সন্তুষ্ট করতে পারিনি। স্বচ্ছ হৃদয়ে ক্ষমা চেয়ে কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।’ আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে আন্দোলনকারী কৃষকদের খেত-খামারে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। মোদির এ ঘোষণা রাজনৈতিক মহলে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। কেউ বলছেন, অবশেষে হার মানলেন নরেন্দ্র মোদি। কেউ বলছেন, এ জয় কৃষকের। বিরোধী দল কংগ্রেস বলেছে, ‘বিলম্বিত বোধোদয়। অহংকারের পতন হলো।’ তবে আন্দোলনের শীর্ষ নেতা ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের (বিকেইউ) প্রধান রাকেশ টিকায়েত বলেছেন, বিতর্কিত কৃষি আইন দেশের পার্লামেন্টে বাতিল হলেই শুধু তাঁরা চলমান আন্দোলন প্রত্যাহার করবেন। রাজ্যসভার শীতকালীন অধিবেশন শুরু হচ্ছে ২৯ নভেম্বর।
কী ছিল বিতর্কিত কৃষি আইনে?
সরকার শুরু থেকে বলে আসছিল—তিনটি উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তিনটি কৃষি আইন কার্যকর করা হচ্ছে। প্রথমটি হচ্ছে, কৃষিক্ষেত্রে ফড়িয়া বা দালালদের আধিপত্য কমিয়ে কৃষকের আয় বাড়ানো। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, রাজ্যগুলোয় চুক্তিভিত্তিক চাষের ব্যবস্থা আইনসিদ্ধ করা এবং তৃতীয়টি হচ্ছে, কৃষিপণ্য বিপণন নিয়ে যে আইন রয়েছে, তা দূর করে আন্তঃরাজ্য কৃষিপণ্যের অবাধ বাণিজ্যের রাস্তা খুলে দেওয়া।
এখন দেখা যাক, আইন তিনটিতে কী বলা আছে এবং কেনই-বা এর বিরোধিতা করা হচ্ছিল। প্রথম আইনটি ছিল অত্যাবশ্যক পণ্য সংশোধনী আইন। এ আইনের মাধ্যমে কোনো দালাল বা ফড়িয়া ছাড়া কৃষক সরাসরি বড় ব্যবসায়ীর কাছে তাঁর পণ্য বিক্রি করতে পারবেন। এতে কৃষক প্রকৃত দাম পাবেন ও আয় বাড়বে। কিন্তু কৃষকেরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের কথা হলো, অত্যাবশ্যক পণ্য (সংশোধনী) আইনের মাধ্যমে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সরাসরি কৃষকদের থেকে কৃষিপণ্য কিনে মজুত ও বিক্রির অধিকার দেওয়া হলো। এর মধ্য দিয়ে সরকার কৃষিপণ্যে যে সহায়ক মূল্য দেয়, তা তুলে নিতে চায়। কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য কেনার দায় সরকার নিজেদের ঘাড় থেকে ঝেড়ে বেসরকারি সংস্থা বা ব্যবসায়ীদের কাছে দিতে চায়। ফলে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য মজুতের ঊর্ধ্বসীমা না রাখায় সেসব পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা চলে যাবে বড় ব্যবসায়ীদের হাতে।
দ্বিতীয় আইনটি কৃষিপণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন আইন। সরকার বলছে, এ আইনের ফলে কৃষক তাঁর এলাকার মান্ডির বাইরেও ফসল বিক্রি করতে পারবেন। এখন কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য মান্ডির মাধ্যমে বিভিন্ন হাত ঘুরে বড় ব্যবসায়ীর কাছে পৌঁছায়। নতুন আইনের ফলে বড় ব্যবসায়ী বা বেসরকারি কোনো সংস্থা চাইলে সরাসরি চাষির কাছ থেকে কৃষিপণ্য কিনে নিতে পারবেন। কৃষকদের দাবি, তাঁরা এতে আপাতত লাভবান হবেন সত্য; কিন্তু এতে মান্ডিব্যবস্থার বিলোপ ঘটবে। ফলে কৃষকের সুরক্ষাকবচ থাকবে না এবং সেই সুযোগে বড় সংস্থাগুলো কৃষকদের ক্রমাগত ঠকানোর সুযোগ পাবে।
তৃতীয়টিকে বলা হচ্ছিল কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ এবং কৃষি পরিষেবাসংক্রান্ত কৃষক চুক্তি আইন। এ আইনের মাধ্যমে কৃষক চুক্তিনির্ভর চাষ করতে পারবেন। কৃষক আগে থেকেই বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে শস্যের দাম নির্ধারণ করে নিতে পারবেন। কোনো বেসরকারি বাণিজ্য সংস্থা বা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সংস্থা চাইলে কৃষকদের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে সেই জমিতে কৃষিজ পণ্য ফলাতে পারবেন। জমির চুক্তি অনুযায়ী কৃষক দাম পেয়ে যাবেন। কৃষক নিজের জমিতে কাজ করতে চাইলে তার জন্য দৈনিক পারিশ্রমিকও মিলবে। সরকারের যুক্তি, এতে দেশীয় কৃষিজ পণ্যের চাহিদা বাড়বে। কৃষিপণ্য রপ্তানির পথ প্রশস্ত হবে। কিন্তু কৃষকদের আশঙ্কা ছিল, চুক্তির খেলাপ হলে প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে টেকার সামর্থ্য কৃষকদের নেই। তখন কৃষকেরা নিজ জমি লিজ দিতে বাধ্য হবেন। ফলে নিজের জমিতে ক্রীতদাস হয়ে যাবেন।
মোটকথা, নতুন তিনটি আইন মূলত কৃষকের কাছ থেকে সরকারি সংরক্ষণের সুবিধা কেড়ে নিত, যা কয়েক দশক ধরে ভারতের কৃষকদের মুক্তবাজার থেকে রক্ষা করেছে।
আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল সবখানে
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে তড়িঘড়ি করে সংসদের অধিবেশনে বিনা আলোচনায় বিল তিনটি আইনে রূপান্তরিত হয়। বিলের ওপর আলোচনার দাবি না মেনে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতেও বিলগুলো পাঠাতে অস্বীকার করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ততক্ষণে দেশজুড়ে কৃষকেরা ফুঁসে উঠেছেন। অনির্দিষ্টকালের জন্য লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিয়ে কৃষকেরা দিল্লি অবরোধ শুরু করেন। তত দিনে ৪০টির বেশি সংগঠন এক ছাতার নিচে এসে গেছে। গড়ে তুলেছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। ভারতে সংঘবদ্ধ কৃষক সংগঠনের পালে হাওয়া লাগল। ধারাবাহিক মিছিল, সভা-সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘটের মাধ্যমে প্রায় দেড় বছর পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশসহ ভারতের কৃষিপ্রধান বড় বড় অঞ্চলে রাস্তাঘাট দখল করে রেখেছিলেন তাঁরা। আন্দোলনের মধ্যে শিখ ও জাটরা সংখ্যায় বেশি ছিলেন। গত দেড় বছর বর্ষা, শীত, গরম—কোনো দুর্যোগেই মাঠ ছাড়েননি তাঁরা। আন্দোলনকে অবৈধ ঘোষণা করতে মোদি সরকার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে কৃষি আন্দোলনকে অবৈধ বলে ঘোষণা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, কৃষকদের আন্দোলন আইনানুগ এবং আন্দোলন করার অধিকার সংবিধানেই আছে। উল্টো পুলিশ প্রশাসন ও সরকারকে আন্দোলনে বাধা না দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন আদালত।
গণমানুষের লাগাতার আন্দোলন
প্রথমে পাঞ্জাব-হরিয়ানাসহ বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকেরা দিল্লির সীমান্তে এসে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁরা ট্রাক, ট্রাক্টর আর সঙ্গে গোটা পরিবার নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। রাজধানী অচল করে দিয়েছিলেন। এক বছর ধরে অবরোধস্থানে থেকেছেন কৃষকেরা। সেসব স্থানেই শিশুদের পড়াশোনা করাতে স্কুল গড়ে তোলা হয়েছে। কমিউনিটি কিচেন পরিচালনা করে কৃষকদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে দিনের পর দিন। নারীদের জন্য ভ্রাম্যমাণ টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে। একসময় সেই আন্দোলন সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে। কংগ্রেস ও বাম দল ছাড়াও রাজ্যভিত্তিক দলগুলো আন্দোলনে সমর্থন দেয়। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যোগ দিয়েছেন কৃষকদের এই ক্যাম্পে। শিশুদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁরা। পরিবারের বাধা, সরকারের চোখরাঙানিকে গ্রাহ্য করেননি।
এ বছরের অক্টোবরে ‘রেল রোকা’ কর্মসূচির ডাক দিলে গোটা রেলব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। ‘ভারত বন্ধ’-এ সারা ভারত স্তব্ধ হয়ে যায়। কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করে সুমিত নামে এক বর তাঁর ট্রাক্টরে কৃষকদের ঝান্ডা ঝুলিয়ে বিয়ের আসরে হাজির হন। পাঞ্জাবের ফরিদকোট জেলার কোট কপুরা গ্রামের ২৮ বছর বয়সী মনি গিল তাঁর করপোরেট চাকরি ছেড়ে কৃষকদের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘আমি এখানে আমাদের কৃষকদের প্রতি সমর্থন জানাতে এসেছি। এই আইনগুলো দ্বারা শুধু কৃষকদের ক্ষতি হবে মনে হলেও আসলে এতে লোকসান হবে সব মানুষের। আমি নিশ্চিত যে আমরা জিতব। দিল্লিতে একটা ছোট পাঞ্জাব তৈরি হয়ে গেছে, দেখতে বেশ লাগছে।’ এভাবেই কৃষকদের আন্দোলন হয়ে পড়ে সর্বস্তরের আন্দোলন।
শুধু ভারতে নয়, আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশের বাইরেও। প্রবাসী ভারতীয়দের পাশাপাশি জাতিসংঘ কৃষকদের আন্দোলন বিবেচনা করতে চিঠি দেয়। দেশ হিসেবে ব্রিটেন, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র; ব্যক্তি হিসেবে গায়িকা রিয়ানা, পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের আইনজীবী ও তাঁর বোনঝি মিনা হ্যারিস; মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কৃষক আন্দোলন নিয়ে মোদি সরকারকে সতর্ক করে।
দমন-পীড়ন-নিগ্রহ, তবু অটল
মোদি সরকার এসব আন্দোলন গ্রাহ্য করেনি। ফলে দেড় বছরের আন্দোলনে সাত শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এ বছরের জুন পর্যন্ত শুধু পাঞ্জাবে মারা গেছেন ২২০ জন কৃষক। আন্দোলনকারীদের ওপর নানাভাবে নিপীড়ন চালানো হয়েছে। কৃষকদের ওপর গাড়ি উঠিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। মারা গেছেন কয়েকজন কিষানি। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে হয়েছে ব্যাপক সংঘর্ষ। কৃষকদের মনোবল ও ঐক্য ভাঙতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি শাসক বিজেপি।
একদিকে প্রশাসনিক দমন-পীড়ন, অকথ্য পুলিশি অত্যাচার; অন্যদিকে বিভিন্ন ধারায় মামলা করে কৃষক ঐক্যে ভাঙনের চেষ্টা চলেছে। একদল কৃষককে ভাঙিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। দিল্লির লাগোয়া বলে পাঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষকেরা অবরোধে শামিল হওয়ায় তাঁদের ‘দেশদ্রোহী’ ও ‘খলিস্তানি’ বলে কটাক্ষ করা হয়েছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক: গত বছরের ২০ ডিসেম্বরের ঘটনা। বিমলা দেবী নামের ৬২ বছর বয়সী এক নারী সিংঘু আন্দোলনমঞ্চে এসেছিলেন। সেখানে গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ওই মঞ্চে আন্দোলন করছে তাঁর ছেলে এবং ভাইয়েরা। তাঁরা কেউ সন্ত্রাসী বা বিদ্রোহী নন। হরিয়ানার সোনিপত জেলার সেহরি গ্রামে তাঁর পরিবার দুই একর জমিতে গম, জোয়ার ও আখের চাষ করে। অথচ দূরদর্শনে শোনা গেল, ‘আমাদের ছেলেদের গুন্ডা বলা হচ্ছে। ওরা চাষি, গুন্ডা নয়। এসব শুনে আমি কাঁদছিলাম। কারণ, ওরা জানে না, কৃষকদের চেয়ে বড় মানুষ নেই।’
এত সব দমন-পীড়নের পরেও কৃষকেরা ছিলেন অনড়। অবশেষে দেড় বছর পর এল তাঁদের মধুর জয়।
কৃষি আইন বাতিল কি রাজনৈতিক কারণে?
সাম্প্রতিক উপনির্বাচনগুলোয় বিজেপির ফল হয়েছে হতাশাজনক। হিমাচল প্রদেশের চারটি আসনেই তারা কংগ্রেসের কাছে হেরেছে। হরিয়ানায় উপনির্বাচনে হয়েছে তৃতীয়। রাজস্থানে দুটি আসন হারিয়েছে কংগ্রেসের কাছে। মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও কর্নাটকে একটি করে আসন কেড়ে নিয়েছে কংগ্রেস। দাদরা-নগর হাভেলিতে হেরেছে শিবসেনার কাছে। পশ্চিমবঙ্গের সাত আসনের উপনির্বাচনে সাতটিতেই ধরাশায়ী হয়েছে। উত্তর প্রদেশের ৪০৪টি বিধানসভার মধ্যে ৩১২টি বিজেপির দখলে, সেই রাজ্যে দুই-তৃতীয়াংশ আসন হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কার কথা শুনিয়েছেন দলীয় নেতারা। কৃষক আন্দোলনের ঢেউ সবচেয়ে বেশি উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে। এখানে ১০৪টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে বিজেপির দখলে ৭৫টির মতো আসন। তা সম্ভব হয়েছিল জাট ও মুসলমান কৃষকদের জোটে ভাঙন ধরানোর কারণে। সেই ভাঙন জোড়া লাগিয়েছে কৃষক আন্দোলন।
২০২২ সালে যে রাজ্যগুলোয় বিধানসভা নির্বাচন হবে, তার মধ্যে অন্যতম পাঞ্জাব। ভারতের এ রাজ্য একমাত্র শিখপ্রধান। কৃষি আইন বাতিলে যাঁরা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম এ রাজ্যের শিখ কৃষকেরা। তাঁদের কথা মাথায় রেখে মোদি এমন দিনে কৃষি আইন বাতিলের ঘোষণা দিলেন যে, ১৯ নভেম্বর ছিল শিখ ধর্মাবলম্বীদের গুরু নানক দেবের জন্মবার্ষিকী। ভারতের এই দুই বড় রাজ্য ছাড়াও উত্তরাখণ্ড, মনিপুর, গোয়ায় নির্বাচন হবে আগামী বছরের শুরুর দিকে। আর বছরের শেষ দিকে নির্বাচন হবে হিমাচল ও গুজরাটে। তাই সব মিলিয়ে বিশ্লেষকেরা বলছেন, কৃষকদের স্বার্থ নয়, আইন বাতিলের পেছনে প্রধান প্রভাবক ভোটের হিসাব-নিকাশ।
ভারত-বাংলাদেশের কৃষিতে মিল-অমিল ও ভবিষ্যৎ
ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশেরই জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৬ শতাংশ। বাংলাদেশে এখনো ৪৩ শতাংশ মানুষ কৃষির সঙ্গে যুক্ত, যেখানে ভারতে এ হার আরও বেশি—৫২ শতাংশ। তবে ভারতের কৃষি আমাদের চেয়ে বহুগুণ বড় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। দুগ্ধ, কাজুবাদাম, নারিকেল, চা, পাট, আম, গবাদি পশুসহ নানা কৃষিপণ্য উৎপাদনে ভারত বিশ্বে প্রথম। কফি উৎপাদনে সারা বিশ্বে ষষ্ঠ, তামাকে তৃতীয়, বিশ্বের মোট উৎপাদিত ফলের ১০ শতাংশ ভারত একা উৎপাদন করে। বাংলাদেশও কৃষির নানা শাখায় বিশ্বদরবারে গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। ইলিশে প্রথম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, পাটে দ্বিতীয়, আলু উৎপাদনে ষষ্ঠ, ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন চতুর্থ।
কিন্তু কৃষকদের সুরক্ষায় বাংলাদেশে অবস্থা যে যথেষ্ট নাজুক, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের মতো বাংলাদেশের কৃষকেরা যোজন-যোজন দূরে। কৃষকের মাঠে যখন এক কেজি আলু ৫ টাকা দরে বিক্রি হয়, সেটিই ঢাকার মতো বড় শহরে কখনো ২০ টাকার নিচে নামে না। ২০ টাকা কেজি দরের ধান যখন চাল হয়ে যায়, সেটার দাম গিয়ে দাঁড়ায় ৫০-৬০ টাকায়। এই উদাহরণ প্রায় সব পণ্যের ক্ষেত্রে সত্য।
বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা ধীরে ধীরে করপোরেট মধ্যস্বত্বভোগীদের দখলে চলে গেছে। ওদিকে দফায় দফায় ডিজেলের দাম বৃদ্ধি, বীজের সংকট, সারের অভাব তো নিয়মিত ঘটনা। কৃষকের কাছ থেকে সস্তায় কিনে ব্যক্তিগত সুরক্ষায় মজুত করে মাঝখান থেকে একদল লুটে নিচ্ছে অস্বাভাবিক মুনাফা। কিন্তু ভারতের মতো বাংলাদেশের কৃষক সংঘবদ্ধ নয়, নেই সচেতনতা। তিনটি আইন বাতিলের জন্য ভারতের লাখো কৃষক যেভাবে একটানা দেড় বছর মাঠঘাটে আন্দোলন করে বেড়াল, সংগঠনের সেই শক্তি অনুপস্থিত তো বটেই; বরং বাংলাদেশের কোনো একটা কৃষি আইন প্রণয়নের সময় কি আদৌ কোনো কৃষকের মন্তব্য চাওয়া হয়, নাকি কৃষকেরা জানে যে, আইন দিয়ে আসলে কী হয়? এখানেই ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের কৃষকদের মূল তফাত।
গণতন্ত্রের টালমাটাল সময়ে গর্ব করার মতো যে অহিংস আন্দোলন ভারতের কিষান দেখাল, সেখান থেকে কি আমরা শিখব যে, আন্দোলন কীভাবে করতে হয়? গত বছর তীব্র শীতের গভীর রাতে উন্মুক্ত রাজপথে বৃদ্ধ শিখ কৃষকদের নির্জীব হয়ে বসে থাকার মাহাত্ম্যকে ধারণ করার যোগ্যতা কি অর্জন করতে পারব কখনো? আর যদি না পারি, তবে আমাদের কৃষির ভবিষ্যৎ আর কৃষকের হাতে থাকবে না।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে নীতিনির্ধারণী একটি বিষয় অগ্রাধিকার বিবেচনার জন্য অপেক্ষমাণ আছে, আর তা হলো, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তন করা, নাকি যথাশিগগির নির্বাচন আয়োজন করা? অনেক ধরনের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তনের জন্য জাতীয় সংসদের বিকল্প কিছু আছে বলে মনে হয় না।
৬ ঘণ্টা আগেকিছু কিছু বিতর্ক তৈরি করা হয় সমসাময়িক বিষয় থেকে দৃষ্টি দূরে সরিয়ে রাখার জন্য। পুরো পাকিস্তান আমলেই রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে বিতর্ক জারি রাখা হয়েছিল। আমলাতন্ত্র আর সামরিক আমলাতন্ত্র মিলে পাকিস্তান নামক দেশটায় যে স্বৈরশাসন কায়েম করে রেখেছিল, সেদিকে যেন সচেতন মানুষের চোখ না যায়, সে অভিসন্ধি থেকেই রবীন্দ্রনাথ
৬ ঘণ্টা আগেএকটি কলা। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। একটি সাধারণ কলা, যা নিলামে বিক্রি হলো ৭৪ কোটি টাকায়। এটি শিল্প, না কৌতুক, না সামাজিক শ্লেষ—নাকি তিনটির মিশেল? ইতালীয় শিল্পী মরিজিও ক্যাটালানের এই ‘কমেডিয়ান’ আমাদের শিল্পের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আর বাজারজাত সৃজনশীলতার প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।
৬ ঘণ্টা আগে‘গণতন্ত্র মঞ্চ’র অন্যতম নেতা সাইফুল হক বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্র ঐক্য ফোরামের নেতা ছিলেন। তিনি পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন। এখন পর্যন্ত ২০টি বই লিখেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার এবং দেশের রাজনীতি নিয়ে...
১ দিন আগে