‘পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধ’ একটি উপন্যাসের নাম

মইনুল হাসান 
প্রকাশ : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯: ০০

‘২০৩৪ সালে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভয়াবহ পারমাণবিক যুদ্ধ চলছে। এতে দুটি দেশেরই প্রচুর শক্তি ক্ষয় হবে। মাঝখান থেকে নিরপেক্ষ দেশ ভারত বিশ্বের সেরা শক্তিশালী দেশের শিরোপা লাভ করবে। নৌযুদ্ধের সূচনা ঘটবে তাইওয়ানের সমুদ্র উপকূলে। আর এ যুদ্ধে চীনের মিত্রশক্তি হবে রাশিয়া ও ইরান।’

এভাবেই এগিয়েছে ‘পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধ’ নামের উপন্যাসটির কাহিনি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক চুক্তি চীনকে চাপে রাখার কৌশলগত পন্থা হিসেবে যাঁরা ভাবছেন, এর মধ্যে যাঁরা বিশ্বযুদ্ধের আলামত খুঁজছেন, তাঁরা পড়তে পারেন উপন্যাসটি। এ উপন্যাসের লেখক দুজন। দুজনই সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁদের একজন অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডমিরাল জেমস স্ট্যাভ্রিডিস এবং অন্যজন সাবেক মেরিন ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইলিয়ট একারম্যান। প্রশ্ন হলো, ‘পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধ’ নামে এ উপন্যাস কি শুধুই দুজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার কল্পকাহিনি? নাকি এর মধ্যে সত্যিই পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধের আলামত আছে? নিদেনপক্ষে ব্যাপক কোনো সংঘাতপূর্ণ সময়ের ইঙ্গিত?

দীর্ঘ বিশ বছর আফগানিস্তানে সেনা অভিযানের পর, অনেকটা তড়িঘড়ি করে এ বছর আগস্টে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে দেশ ছেড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন মন দিয়েছে বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে চীনের প্রভাব খর্ব করার দিকে। আর তাই মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায়, ১৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বে, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার করতে ত্রিদেশীয় জোট গঠন করেন। এই চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য মিলে অস্ট্রেলিয়াকে পরমাণু শক্তিচালিত অত্যাধুনিক ডুবোজাহাজ বানাতে প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে বলে চুক্তিবদ্ধ হয়। ইউরোপিয়ান মিত্রদের মধ্য থেকে শুধু যুক্তরাজ্যকে বেছে নিয়ে এমন ত্রিদেশীয় জোটের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অকাস’।

অস্ট্রেলিয়া কোনো রকম দ্বিধা না করে, অর্থাৎ অনেকটা ডুবে ডুবে ফ্রান্সের সঙ্গে পাঁচ বছর আগে করা ডুবোজাহাজ ক্রয়সংক্রান্ত চার হাজার কোটি মার্কিন ডলার আর্থিক মূল্যের মেগা চুক্তিটি একতরফাভাবে বাতিল করে দেয়। এমন আকর্ষণীয় চুক্তিটি হঠাৎ করে বাতিল হওয়ায় স্বাভাবিক কারণে ফ্রান্স তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, অস্ট্রেলিয়ার আচমকা এমন চুক্তি বাতিলে ফ্রান্স একদিকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে এই তিন দেশ মিলে পারমাণবিক প্রযুক্তির অংশীদার করতে ‘ফ্রান্সকে বিশ্বাস করা যায় না’—এমন একটি বার্তা দিয়েছে। ফ্রান্স তাই তার বহুদিনের পরীক্ষিত মিত্রদের এমন আচরণ ‘অপমানজনক’ ও ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে উল্লেখ করেছে। বলেছে যে এ চুক্তিটি তাদের পেছন থেকে ছুরি মেরে ঘায়েল করার শামিল। ফলে অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে।

কেন এমন হলো? যাঁরা ভূরাজনৈতিক বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন, তাঁরা বলেছেন, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ার ভয় থেকে অস্ট্রেলিয়া এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য রক্ষায় এ ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই বলেই অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্রের কাঁধে ভর করেছে।

এই রাজনৈতিক ঘটনাই সাবেক দুই মার্কিন সামরিক কর্মকর্তার লেখা উপন্যাসটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাঁরা আগামী ১৩ বছরের মাথায় যে বিধ্বংসী যুদ্ধের কথা গল্পের ছলে বলেছেন, তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই। কারণ, সম্প্রতি ইরান ও চীন নিজেদের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি এক নিরাপত্তা চুক্তি করেছে। আন্তর্জাতিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে  চীনের যুদ্ধবিমান নিয়মিত তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে এবং সমুদ্রসীমায় বালু উত্তোলন  অব্যাহত রেখেছে।

এদিকে ভ্লাদিমির পুতিন, ২২ বছর যাবৎ রাশিয়ার ক্ষমতার কেন্দ্রে ঘাঁটি গেড়ে বসেছেন। বিরোধীদের হাত-পা বেঁধে রেখে আবারও তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে ইউক্রেন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছেন। ফলে এবার দেখা যাচ্ছে, চীন, ইরান ও রাশিয়া একজোট হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের একটি বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছে—আর ছড়ি ঘোরানো চলবে না।

চীন সামরিক, অর্থনৈতিক শক্তি এবং প্রযুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম করলেও মাইক্রোপ্রসেসরের নকশা ও উৎপাদনে অনেকখানি পিছিয়ে আছে। অথচ বাড়ির পাশে তাইওয়ান, সেখানে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বড় ও অত্যাধুনিক মাইক্রোচিপস তৈরির কারখানা—তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি। এটি পৃথিবীর সেরা তিনটি কারখানার একটি। উন্নত সামরিক সরঞ্জাম তৈরির জন্য এমন একটি প্রতিষ্ঠান একদম হাতের নাগালে। অনেকে মনে করেন, সে কারণেই চীন মরিয়া হয়ে তাইওয়ানকে নিজের কবজায় নিতে চাইছে।
প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিমে ফ্রান্সনিয়ন্ত্রিত নতুন ক্যালিডোনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে ফ্রান্সের প্রতিশ্রুতি অনুসারে এ বছর ডিসেম্বরে সেখানে গণভোট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। চীনের মদদপুষ্ট স্বাধীনতাকামীরা এ নির্বাচনে জয়লাভ করলে চীন সেখানে তার সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করবে। এটি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের জন্য মোটেও স্বস্তিকর হবে না। ফ্রান্স কোনোভাবেই চাইবে না সেখানে তাদের আধিপত্য খর্ব হোক।

শত্রু ও স্বার্থ যেখানে অভিন্ন, সেখানে ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগতে এবং ‘ছুরির আঘাত’ শুকাতে, অর্থাৎ মারাত্মক সংকট কাটিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক শীতল থেকে উষ্ণ হতে সময় লাগবে না বলেই অনেকে মনে করেন।

তারপরও সন্দেহ থেকে যায়। উত্তর কোরিয়ার মসনদের পাকাপাকি দখলদার কিম জং-উন বলেছেন, জনসন, মরিসন ও বাইডেন পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা উসকে দিয়েছেন। যদি তা-ই হয়, তবে ‘পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধ’ উপন্যাসটিতে যা আশঙ্কা করা হয়েছে, তা বাস্তবে ফলে যেতে পারে।

করোনা অতিমারিতে বিশ্ব অনেকটাই বিপর্যস্ত। আফ্রিকার অনেকগুলো দেশে ইতিমধ্যে খরা ও দুর্ভিক্ষ হানা দিতে শুরু করেছে। জলবায়ু অনেক আগে থেকেই লাল কার্ড দেখাচ্ছে। এ সময়ে বিশ্বনেতাদের ভুল পদক্ষেপ নেওয়া মোটেই উচিত হবে না। আমরা বিশ্বাস করি, তাঁরা বিচক্ষণতার পরিচয় দেবেন। কারণ, তাঁরা ভালোই জানেন যে বিশ্বব্যাপী আরেকটি সংঘাত দেখা দিলে তা হতে পারে মানব ইতিহাসের সর্বশেষ সংঘাত।

লেখক: ফ্রান্সপ্রবাসী গবেষক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত