ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশে-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর গবেষণামূলক বই ‘নারী সত্তার অন্বেষণে’। দেশে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির কারণ এবং প্রতিরোধের উপায় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা
সাম্প্রতিক সময়ে শিশু ধর্ষণের ঘটনা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার কারণ কী?
সাম্প্রতিক সময়ে শুধু ধর্ষণ নয়, চুরি, ছিনতাই, হেনস্তা বেড়েছে আগের তুলনায়। যখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে, তখন ভিকটিমের জায়গায় শুধু নারী ও কন্যাশিশুকে দেখা যায়। আবার যখন কোনো ত্রাসের অবস্থা সৃষ্টি করার ইচ্ছা কোনো টার্গেট গ্রুপের থাকে, তখন তারা নারী ও কন্যাশিশুকে প্রধান টার্গেট করে থাকে। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন তো সাম্প্রতিক সময়ের বিষয় না। আবার এই ঘটনাগুলো কোনো সরকারকেন্দ্রিকও না। এ ঘটনাগুলো হলো একটা ক্ষমতা চর্চার ব্যাপার। মনস্তাত্ত্বিকভাবে মানুষ ক্ষমতায় কে আছে, সেটাও খেয়াল রাখে। যে রকমভাবে একাত্তর সালে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমাদের সমাজে নারী ও কন্যাশিশুকে সামাজিক কাঠামো ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে আপাতত ক্ষমতাহীন ভাবা হয়। এ কারণে তাঁরা টার্গেট গ্রুপ দ্বারা আক্রান্ত হন।
কাউকে আঘাত করার জন্য টার্গেট গ্রুপরা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বল অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করছে। এ সময়ে শুধু নারী নয়, যেকোনো মানুষকে এখন মব ভায়োলেন্সের মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এই সংস্কৃতি চালু হওয়ার কারণ হলো, থানা, পুলিশ, কোর্ট এগুলোর কোনো কিছুই এ মুহূর্তে নাগরিককে নিরাপত্তা দিতে পারছে না। আবার আক্রান্ত ব্যক্তিরা কোনো মাধ্যমে অভিযোগ দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না।
কিছু দিন আগে ঢাবির এক নারী শিক্ষার্থীকে উত্ত্যক্তের ঘটনার পর তিনি মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
‘সামাজিক নিরাপত্তা’র ধারণাটাই আমাদের কাছে পরিষ্কার না। ব্যক্তির চলাফেরা, ব্যক্তির সিদ্ধান্ত, ব্যক্তির চর্চা, ব্যক্তির পোশাক—এই বিষয়গুলো তো ব্যক্তির ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখানে কোনো ব্যক্তির কোনো কিছু যখন অন্যের কাছে হানিকর না হয়, অন্যের জন্য ক্ষতিকর না হয়, সে ক্ষেত্রে অন্য কেউ নাক গলাতে পারে না—এই ধারণাটা সামাজিকভাবে তো তৈরি হয়নি। এমনকি আপনি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বললেন, সেটাসহ দেশের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও একটা নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারত। যেখানে নারী শিক্ষার্থীদের স্বাধীন চলাফেরার স্বীকৃতি থাকত। কারণ, নারী শিক্ষার্থীদের পোশাক পরা এবং স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা তো তাঁদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। সে জন্য ব্যক্তির চলাফেরায় অন্য কারও নাক গলানো যে একটা অপরাধ—সেটার আইনগত স্বীকৃতি এখন একটা সময়ের দাবি। এটা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের পক্ষ থেকে নীতিমালা আকারে থাকা দরকার।
সামাজিক নিরাপত্তা কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে?
কেউ চাইলে একজনের চলাফেরা ও পোশাক পরা নিয়ে বাজে মন্তব্য, ইভ টিজিং, বুলিং করতে পারে না। সেটা তো একটা অপরাধ। সেটার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে জরিমানা নির্ধারণ করা দরকার। আমি তো বিদেশ থেকে পিএইচডি করেছি। সেই দেশে দেখেছি, সেখানে কেউ যদি অন্য কারও দিকে তাকিয়ে থাকেন এবং সেই ব্যক্তির তাকানো যদি তাঁর কাছে অস্বস্তির কারণ হয়, সঙ্গে সঙ্গে তিনি পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে পারবেন। এমনকি স্থানীয় যৌন নিপীড়ন সেল এবং সোশ্যাল সার্ভিসের কাছে অভিযোগ দিতে পারবেন। আমরা তো সেই প্রক্রিয়ার মধ্যেই ঢুকতে পারিনি। বিপরীতে আমরা এমন কিছু নরমেটিভ নর্মস এবং বয়ান তৈরি করেছি, যেটার মাধ্যমে আমরা অন্যের দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকার অধিকার যেন পেয়ে গেছি।
এ ধরনের নরমালাইজেশন প্রক্রিয়ায় আমাদের এখানে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করতে বাধাগ্রস্ত করছে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করার ক্ষেত্রে সমাজের মানুষকে আগে সচেতন করতে হবে। এর জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মিডিয়া, পত্রপত্রিকা, তথ্য মন্ত্রণালয়কে সমাজসচেতনামূলক প্রচারণা এবং গণসচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করতে হবে।
আমরা কী উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি?
এসব ঘটনা তো শুধু এখনকার গল্প না। এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা প্রতি মুহূর্তের কাজ। প্রতিটি পত্রিকার তো এ ধরনের প্রচার চালানোর জন্য একটা পাতা থাকা দরকার। শুধু পত্রিকা নয়, টিভি চ্যানেলগুলো এগুলো নিয়ে একটা অনুষ্ঠান করতে পারে। এগুলো করার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয় কেন বাধ্য করে না মিডিয়াগুলোকে? সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাজ কি শুধু কিছু প্রান্তিক মানুষের জন্য কতগুলো পলিসি করা আর ভাতা দেওয়া?
বিশ্বের উন্নত দেশে সোশ্যাল সার্ভিস দেওয়ার জন্য একটা গ্রুপ থাকে, যারা কারও ওপর এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আমাদের দেশে ঘরের মধ্যে কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হলে পুলিশের কাছে যায়। কিন্তু এটা ভুল চর্চা। এসব ক্ষেত্রে পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে মামলা করার বিধান আছে। কিন্তু বিষয়টা শুধু মামলার না। ধরেন, আপনার পাশের বাসায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। আপনি সেই মুহূর্তে দায়িত্বের জায়গা থেকে পুলিশকে কল না করে সোশ্যাল সার্ভিসে কল করবেন। তখন তারাই পুলিশকে নিয়ে সেই বাসায় হাজির হবে। আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো ব্যাপারই নেই। এখানে সোশ্যাল সার্ভিস বলে কিছুই নেই। অথচ প্রতিবছর সমাজকল্যাণ, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী পাস করে বের হচ্ছেন। এ ধরনের একটা দক্ষ গ্রুপকে যে আমরা কাজে লাগাব, তা নিয়ে রাষ্ট্রের কোনো ভাবনা ও পরিকল্পনা নেই।
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করার জন্য সমাজের মুরব্বিদেরও ভূমিকা আছে। সমাজে আগে দেখা যেত, ছোটরা অন্যায় কাজ করলে পাড়ার মুরব্বিরা ধমক দিয়ে বা বুঝিয়ে শিক্ষা দিতেন। এখন তো যুগের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখনকার যুগ কিন্তু ধমক বা শাসনের না।
কিছুদিন আগে দেখা গেছে, একজন বেত দিয়ে আরেকজনকে ওঠবস করাচ্ছেন রমজানে দিনের বেলা খাওয়ার অপরাধে। এটা কীভাবে সম্ভব হতে পারে? কারণ, আমাদের সমাজ এটাকেই গ্রহণ করছে। সামাজিক নিরাপত্তা এসবকেই বলা হচ্ছে। তাহলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাজ কী? জনগণের ভ্যাট ও ট্যাক্সের টাকা দিয়ে তারা কী করে? ৫৪ বছর ধরে এ মন্ত্রণালয় কোনো কাজ করেনি? তার জবাব তাদের অবশ্যই দিতে হবে। কেন তারা সোশ্যাল সার্ভিস গ্রুপ এখন পর্যন্ত গঠন করতে পারল না?
কেউ কেউ বলে থাকেন, ধর্ষণের ঘটনাগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণেও ঘটে থাকে। আপনি কী মনে করেন?
যুগ পরিবর্তনশীল। একসময় আমরা শিল্প যুগে বাস করেছি। এখন কিন্তু আমরা প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করেছি। পুরো বিশ্ব এখন গ্লোবাল ভিলেজের অন্তর্ভুক্ত। অনেক মানুষ কনটেন্ট বানিয়ে বাছবিচার ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দিচ্ছে। আবার ওয়াজ মাহফিলের অনেক কনটেন্টে নারীবিদ্বেষী বক্তব্য পাওয়া যায়। সেগুলো একধরনের সামাজিক মন তৈরি করে। মানুষ এক দিনে তো অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে না।
গবেষণা বলে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্যাতন করে থাকে পরিবারের লোক, তারপর আত্মীয়স্বজন, এরপর পরিচিত বন্ধুবান্ধব এবং স্থানীয় লোকজন। সবশেষ অপরিচিত লোক। এই সামাজিক মনটা কোথা থেকে তৈরি হচ্ছে? এই মনটা তৈরি হচ্ছে ওয়াজ, নাটক, সিনেমা ও কনটেন্ট থেকে। সেখান থেকে নিপীড়কেরা শিখছেন—তিনি ইচ্ছে করলেই একজন নারী সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করতে, জামা ধরে টান দিতে পারবেন! আমরা গবেষণা করে দেখেছি, পাবলিক বাসে যে মেয়ে ও নারীরা চলাফেরা করেন, সেখানে একটা গ্রুপ ব্লেড দিয়ে তাঁদের জামা কেটে দেয়। তারা এটা করে নারীরা কেন পর্দা করে না। কোন ধর্মে আছে এভাবে কোনো নারীর জামা কেটে দেওয়া যায়? নারীরা পর্দা না করলে তাঁদের স্পর্শ, হেনস্তা, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি করা যায়? এভাবে ধর্মের অপব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে ওয়াজের কনটেন্টের মাধ্যমে। আমাদের তো কোনো নীতিনৈতিকতা নেই। শুধু অর্থের জন্য তারা এসব কনটেন্ট তৈরি করছে, ভিউ পাওয়ার জন্য।
উন্মুক্ত বিশ্বে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভালো-মন্দ বিষয়গুলো কীভাবে প্রতিরোধ করা যাবে?
এসব সমাধানের দায়িত্ব হলো তথ্য মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রণালয়ের কাজ সরকারকে সার্ভ করা না। তাদের কাজ হলো জনগণকে সেবা দেওয়া। তথ্য মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসে কোন কনটেন্টে কী ধরনের কথা থাকলে সামাজিক অসংগতি, অস্থিরতা তৈরি হয়, সেগুলো ব্লক করে দিতে হবে। সামাজিক অসংগতি, অস্থিরতা ও ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা কোনো কনটেন্টে প্রমোট করা যাবে না। কোনো কনটেন্টে ব্যক্তি চরিত্রের হনন, অশালীন বিষয় থাকতে পারে না। এসব তো আর রাজনীতির বিষয় নয়। এগুলো কেন প্রমোট করা হবে?
বাংলাদেশে প্রচলিত আইন ও বিচারব্যবস্থা এ ধরনের অপরাধ রোধে কতটা কার্যকর?
আমাদের দেশে অনেক আইন আছে, কিন্তু সেগুলোর কোনো বাস্তবায়ন নেই। যেমন ২০০৯ সালে হাইকোর্ট ‘যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল’ নামে একটা আইন করেছিল। যেটা প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সরকারি-বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, গার্মেন্টসসহ সব জায়গায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই আইনের আজও কোনো বাস্তবায়ন বা কার্যকারিতা দেখা যাচ্ছে না।
মাগুরায় শিশু ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনায় আমরা নড়েচড়ে বসেছি। এসব তো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সম্পর্কিত না। আইন পাস করার সময় তাড়াহুড়ো করা ঠিক না। আগে ধর্ষণের মামলায় আইন ছিল যাবজ্জীবন। সুবর্ণচরের ঘটনার পর প্রতিবাদের মুখে তৎকালীন সরকার সেটাকে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করেছিল। বিশ্বের কোনো সভ্য দেশে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় না। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষণের ঘটনা তো ওয়ান টু ওয়ানের ব্যাপার (যদি দলবদ্ধ ধর্ষণ না হয়ে থাকে)। ওয়ান টু ওয়ানের ক্ষেত্রে ভিকটিমের জবানবন্দি হলো আসল। তারপর তার মেডিকেল টেস্টের রিপোর্টও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে করতে হবে। এই দুটি যদি যথাযথভাবে পাওয়া না যায়, তাহলে ধর্ষককে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। সে জন্য আইন তৈরি করার সময় অভিজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
সাম্প্রতিক সময়ে শিশু ধর্ষণের ঘটনা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার কারণ কী?
সাম্প্রতিক সময়ে শুধু ধর্ষণ নয়, চুরি, ছিনতাই, হেনস্তা বেড়েছে আগের তুলনায়। যখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে, তখন ভিকটিমের জায়গায় শুধু নারী ও কন্যাশিশুকে দেখা যায়। আবার যখন কোনো ত্রাসের অবস্থা সৃষ্টি করার ইচ্ছা কোনো টার্গেট গ্রুপের থাকে, তখন তারা নারী ও কন্যাশিশুকে প্রধান টার্গেট করে থাকে। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন তো সাম্প্রতিক সময়ের বিষয় না। আবার এই ঘটনাগুলো কোনো সরকারকেন্দ্রিকও না। এ ঘটনাগুলো হলো একটা ক্ষমতা চর্চার ব্যাপার। মনস্তাত্ত্বিকভাবে মানুষ ক্ষমতায় কে আছে, সেটাও খেয়াল রাখে। যে রকমভাবে একাত্তর সালে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমাদের সমাজে নারী ও কন্যাশিশুকে সামাজিক কাঠামো ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে আপাতত ক্ষমতাহীন ভাবা হয়। এ কারণে তাঁরা টার্গেট গ্রুপ দ্বারা আক্রান্ত হন।
কাউকে আঘাত করার জন্য টার্গেট গ্রুপরা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বল অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করছে। এ সময়ে শুধু নারী নয়, যেকোনো মানুষকে এখন মব ভায়োলেন্সের মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এই সংস্কৃতি চালু হওয়ার কারণ হলো, থানা, পুলিশ, কোর্ট এগুলোর কোনো কিছুই এ মুহূর্তে নাগরিককে নিরাপত্তা দিতে পারছে না। আবার আক্রান্ত ব্যক্তিরা কোনো মাধ্যমে অভিযোগ দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না।
কিছু দিন আগে ঢাবির এক নারী শিক্ষার্থীকে উত্ত্যক্তের ঘটনার পর তিনি মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
‘সামাজিক নিরাপত্তা’র ধারণাটাই আমাদের কাছে পরিষ্কার না। ব্যক্তির চলাফেরা, ব্যক্তির সিদ্ধান্ত, ব্যক্তির চর্চা, ব্যক্তির পোশাক—এই বিষয়গুলো তো ব্যক্তির ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখানে কোনো ব্যক্তির কোনো কিছু যখন অন্যের কাছে হানিকর না হয়, অন্যের জন্য ক্ষতিকর না হয়, সে ক্ষেত্রে অন্য কেউ নাক গলাতে পারে না—এই ধারণাটা সামাজিকভাবে তো তৈরি হয়নি। এমনকি আপনি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বললেন, সেটাসহ দেশের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও একটা নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারত। যেখানে নারী শিক্ষার্থীদের স্বাধীন চলাফেরার স্বীকৃতি থাকত। কারণ, নারী শিক্ষার্থীদের পোশাক পরা এবং স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা তো তাঁদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। সে জন্য ব্যক্তির চলাফেরায় অন্য কারও নাক গলানো যে একটা অপরাধ—সেটার আইনগত স্বীকৃতি এখন একটা সময়ের দাবি। এটা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের পক্ষ থেকে নীতিমালা আকারে থাকা দরকার।
সামাজিক নিরাপত্তা কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে?
কেউ চাইলে একজনের চলাফেরা ও পোশাক পরা নিয়ে বাজে মন্তব্য, ইভ টিজিং, বুলিং করতে পারে না। সেটা তো একটা অপরাধ। সেটার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে জরিমানা নির্ধারণ করা দরকার। আমি তো বিদেশ থেকে পিএইচডি করেছি। সেই দেশে দেখেছি, সেখানে কেউ যদি অন্য কারও দিকে তাকিয়ে থাকেন এবং সেই ব্যক্তির তাকানো যদি তাঁর কাছে অস্বস্তির কারণ হয়, সঙ্গে সঙ্গে তিনি পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে পারবেন। এমনকি স্থানীয় যৌন নিপীড়ন সেল এবং সোশ্যাল সার্ভিসের কাছে অভিযোগ দিতে পারবেন। আমরা তো সেই প্রক্রিয়ার মধ্যেই ঢুকতে পারিনি। বিপরীতে আমরা এমন কিছু নরমেটিভ নর্মস এবং বয়ান তৈরি করেছি, যেটার মাধ্যমে আমরা অন্যের দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকার অধিকার যেন পেয়ে গেছি।
এ ধরনের নরমালাইজেশন প্রক্রিয়ায় আমাদের এখানে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করতে বাধাগ্রস্ত করছে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করার ক্ষেত্রে সমাজের মানুষকে আগে সচেতন করতে হবে। এর জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মিডিয়া, পত্রপত্রিকা, তথ্য মন্ত্রণালয়কে সমাজসচেতনামূলক প্রচারণা এবং গণসচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করতে হবে।
আমরা কী উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি?
এসব ঘটনা তো শুধু এখনকার গল্প না। এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা প্রতি মুহূর্তের কাজ। প্রতিটি পত্রিকার তো এ ধরনের প্রচার চালানোর জন্য একটা পাতা থাকা দরকার। শুধু পত্রিকা নয়, টিভি চ্যানেলগুলো এগুলো নিয়ে একটা অনুষ্ঠান করতে পারে। এগুলো করার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয় কেন বাধ্য করে না মিডিয়াগুলোকে? সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাজ কি শুধু কিছু প্রান্তিক মানুষের জন্য কতগুলো পলিসি করা আর ভাতা দেওয়া?
বিশ্বের উন্নত দেশে সোশ্যাল সার্ভিস দেওয়ার জন্য একটা গ্রুপ থাকে, যারা কারও ওপর এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আমাদের দেশে ঘরের মধ্যে কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হলে পুলিশের কাছে যায়। কিন্তু এটা ভুল চর্চা। এসব ক্ষেত্রে পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে মামলা করার বিধান আছে। কিন্তু বিষয়টা শুধু মামলার না। ধরেন, আপনার পাশের বাসায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। আপনি সেই মুহূর্তে দায়িত্বের জায়গা থেকে পুলিশকে কল না করে সোশ্যাল সার্ভিসে কল করবেন। তখন তারাই পুলিশকে নিয়ে সেই বাসায় হাজির হবে। আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো ব্যাপারই নেই। এখানে সোশ্যাল সার্ভিস বলে কিছুই নেই। অথচ প্রতিবছর সমাজকল্যাণ, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী পাস করে বের হচ্ছেন। এ ধরনের একটা দক্ষ গ্রুপকে যে আমরা কাজে লাগাব, তা নিয়ে রাষ্ট্রের কোনো ভাবনা ও পরিকল্পনা নেই।
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করার জন্য সমাজের মুরব্বিদেরও ভূমিকা আছে। সমাজে আগে দেখা যেত, ছোটরা অন্যায় কাজ করলে পাড়ার মুরব্বিরা ধমক দিয়ে বা বুঝিয়ে শিক্ষা দিতেন। এখন তো যুগের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখনকার যুগ কিন্তু ধমক বা শাসনের না।
কিছুদিন আগে দেখা গেছে, একজন বেত দিয়ে আরেকজনকে ওঠবস করাচ্ছেন রমজানে দিনের বেলা খাওয়ার অপরাধে। এটা কীভাবে সম্ভব হতে পারে? কারণ, আমাদের সমাজ এটাকেই গ্রহণ করছে। সামাজিক নিরাপত্তা এসবকেই বলা হচ্ছে। তাহলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাজ কী? জনগণের ভ্যাট ও ট্যাক্সের টাকা দিয়ে তারা কী করে? ৫৪ বছর ধরে এ মন্ত্রণালয় কোনো কাজ করেনি? তার জবাব তাদের অবশ্যই দিতে হবে। কেন তারা সোশ্যাল সার্ভিস গ্রুপ এখন পর্যন্ত গঠন করতে পারল না?
কেউ কেউ বলে থাকেন, ধর্ষণের ঘটনাগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণেও ঘটে থাকে। আপনি কী মনে করেন?
যুগ পরিবর্তনশীল। একসময় আমরা শিল্প যুগে বাস করেছি। এখন কিন্তু আমরা প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করেছি। পুরো বিশ্ব এখন গ্লোবাল ভিলেজের অন্তর্ভুক্ত। অনেক মানুষ কনটেন্ট বানিয়ে বাছবিচার ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দিচ্ছে। আবার ওয়াজ মাহফিলের অনেক কনটেন্টে নারীবিদ্বেষী বক্তব্য পাওয়া যায়। সেগুলো একধরনের সামাজিক মন তৈরি করে। মানুষ এক দিনে তো অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে না।
গবেষণা বলে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্যাতন করে থাকে পরিবারের লোক, তারপর আত্মীয়স্বজন, এরপর পরিচিত বন্ধুবান্ধব এবং স্থানীয় লোকজন। সবশেষ অপরিচিত লোক। এই সামাজিক মনটা কোথা থেকে তৈরি হচ্ছে? এই মনটা তৈরি হচ্ছে ওয়াজ, নাটক, সিনেমা ও কনটেন্ট থেকে। সেখান থেকে নিপীড়কেরা শিখছেন—তিনি ইচ্ছে করলেই একজন নারী সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করতে, জামা ধরে টান দিতে পারবেন! আমরা গবেষণা করে দেখেছি, পাবলিক বাসে যে মেয়ে ও নারীরা চলাফেরা করেন, সেখানে একটা গ্রুপ ব্লেড দিয়ে তাঁদের জামা কেটে দেয়। তারা এটা করে নারীরা কেন পর্দা করে না। কোন ধর্মে আছে এভাবে কোনো নারীর জামা কেটে দেওয়া যায়? নারীরা পর্দা না করলে তাঁদের স্পর্শ, হেনস্তা, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি করা যায়? এভাবে ধর্মের অপব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে ওয়াজের কনটেন্টের মাধ্যমে। আমাদের তো কোনো নীতিনৈতিকতা নেই। শুধু অর্থের জন্য তারা এসব কনটেন্ট তৈরি করছে, ভিউ পাওয়ার জন্য।
উন্মুক্ত বিশ্বে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভালো-মন্দ বিষয়গুলো কীভাবে প্রতিরোধ করা যাবে?
এসব সমাধানের দায়িত্ব হলো তথ্য মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রণালয়ের কাজ সরকারকে সার্ভ করা না। তাদের কাজ হলো জনগণকে সেবা দেওয়া। তথ্য মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসে কোন কনটেন্টে কী ধরনের কথা থাকলে সামাজিক অসংগতি, অস্থিরতা তৈরি হয়, সেগুলো ব্লক করে দিতে হবে। সামাজিক অসংগতি, অস্থিরতা ও ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা কোনো কনটেন্টে প্রমোট করা যাবে না। কোনো কনটেন্টে ব্যক্তি চরিত্রের হনন, অশালীন বিষয় থাকতে পারে না। এসব তো আর রাজনীতির বিষয় নয়। এগুলো কেন প্রমোট করা হবে?
বাংলাদেশে প্রচলিত আইন ও বিচারব্যবস্থা এ ধরনের অপরাধ রোধে কতটা কার্যকর?
আমাদের দেশে অনেক আইন আছে, কিন্তু সেগুলোর কোনো বাস্তবায়ন নেই। যেমন ২০০৯ সালে হাইকোর্ট ‘যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল’ নামে একটা আইন করেছিল। যেটা প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সরকারি-বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, গার্মেন্টসসহ সব জায়গায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই আইনের আজও কোনো বাস্তবায়ন বা কার্যকারিতা দেখা যাচ্ছে না।
মাগুরায় শিশু ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনায় আমরা নড়েচড়ে বসেছি। এসব তো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সম্পর্কিত না। আইন পাস করার সময় তাড়াহুড়ো করা ঠিক না। আগে ধর্ষণের মামলায় আইন ছিল যাবজ্জীবন। সুবর্ণচরের ঘটনার পর প্রতিবাদের মুখে তৎকালীন সরকার সেটাকে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করেছিল। বিশ্বের কোনো সভ্য দেশে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় না। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষণের ঘটনা তো ওয়ান টু ওয়ানের ব্যাপার (যদি দলবদ্ধ ধর্ষণ না হয়ে থাকে)। ওয়ান টু ওয়ানের ক্ষেত্রে ভিকটিমের জবানবন্দি হলো আসল। তারপর তার মেডিকেল টেস্টের রিপোর্টও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে করতে হবে। এই দুটি যদি যথাযথভাবে পাওয়া না যায়, তাহলে ধর্ষককে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। সে জন্য আইন তৈরি করার সময় অভিজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ইতিমধ্যে ৩৭টি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঁচটি সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সারসংক্ষেপ পাঠিয়েছে এবং দলগুলোকে মতামত জমা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। মতপার্থক্য দূর করার লক্ষ্যে সংলাপ শুরু হবে এবং বেশ কয়েক দিন পর্যন্ত তা চলবে।
১৮ ঘণ্টা আগেরাজধানীর মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালটি যেন দখলবাজদের জন্য এক স্বর্গরাজ্য! চিকিৎসাসেবার চেয়ে এখানে দখলদারিতেই বেশি গতি। সাততলা বস্তি, দোকানপাট, কাঁচাবাজার, এমনকি মাদক ও জুয়ার আড্ডার জন্য হাসপাতালের চেয়ে ভালো জায়গা আর কী-ইবা হতে পারে...
১৯ ঘণ্টা আগে৭ মার্চ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়ালের একটি বক্তব্যে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দুমুখো নীতির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংকালে ভারতীয় এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেন, ‘এখন বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক...
২ দিন আগেআগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সংশয় যেন কাটছেই না। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল বিএনপি বড় ধরনের সংশয়ের মধ্যে আছে। বিভিন্ন সময় এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে যে আভাস পাওয়া যায়, তাকে অবিশ্বাসও বলা যেতে পারে। অথচ অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ...
২ দিন আগে