তিনবারের এমপির চেহারাই দেখেননি ভোটাররা! 

সাইফুল মাসুম ও আনিসুল হক জুয়েল, দিনাজপুর থেকে
প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০: ২৯
আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৯: ০৩

মানুষের ভোটে যারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন, তাঁরা জনগণের দুঃখ দুর্দশায় পাশে থাকবেন—এমনটিই প্রত্যাশা। কিন্তু দিনাজপুর–৪ (চিরিরবন্দর–খানসামা) আসনের এমপি ব্যতিক্রম। 

এখানে ২০০৮ সাল থেকে টানা তিনবারের সংসদ সদস্য সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তিনি এবারও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ভোটে লড়ছেন। 

তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছাড়া এলাকায় যান না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করেন না। মানুষ সুখ দুঃখের কথা সংসদ সদস্যকে বলার সুযোগ পান না। এ ছাড়া চিরিরবন্দর ও খানসামা উপজেলার অনেক ভোটার আছেন, যারা মাহমুদ আলীকে সরাসরি কখনো দেখেননি। 

গত শনিবার (২৩ ডিসেম্বর) চিরিরবন্দর উপজেলার রানীরবন্দরের গ্রামীণ টাওয়ার ভবনে কথা হয় কয়েকজন নারী ভোটারের সঙ্গে। তাঁরা নৌকার প্রার্থীর নির্বাচনী সভায় গেছেন এমপিকে এক নজর দেখতে! নশরতপুর ইউনিয়নের নারী ভোটার কোহিনুর বেগম আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘এমপিকে কুনোদিন দ্যাখোঁ নাই, তাই দেখির আনু।’ 

ওই সভায় নশরতপুরের আরেক ভোটার খাইরুনেচ্ছা বলেন, ‘এমপি থাকেন ঢাকায়। নাগাল পাইলে তো দুঃখের কথা কইবো। সাহায্য সহযোগিতা তো দূরে থাক, কোনো দিন খোঁজ নিতে আসেনি।’ 

যদিও উপজেলা আওয়ামী লীগের কর্মীরা দাবি করছেন, নির্বাচনী সভায় অংশ নেওয়া এই নারীরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে নৌকার পক্ষে ভোট চাইবেন। 

উপজেলার আন্ধারমুহা বাজারে কথা হয় মাংস বিক্রেতা আফজাল হোসেনের সঙ্গে। তাঁর বক্তব্য, কোনো দিন এমপিকে দেখেননি। অভিমান করে বলেন, গরিব মানুষ হওয়ায় তাঁর কাছে যাওয়ার দরকার পড়েনি এমপির! 

খানসামা উপজেলার গোবিন্দপুরের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এক দরকারে এমপিকে কল করেছি। তিনি তাঁর প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে প্রতিনিধি কল করে এমপিকে কেন কল দিয়েছি এর জন্য জবাব চেয়েছেন।’ 

জানা গেছে, করোনা মহামারির সময় দীর্ঘ ২১ মাস নির্বাচনী এলাকায় যাননি মাহমুদ আলী। অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু না হলে এলাকায় যান না, সবকিছু করান প্রতিনিধির মাধ্যমে। প্রতিনিধিরা হচ্ছেন—এমপির পিএ শাহ সালাউদ্দিন, খানসামা উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সফিউল আযম চৌধুরী লায়ন, চিরিরবন্দর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুনীল কুমার সাহা ও সাধারণ সম্পাদক আলিম সরকার। 

এর আগে বছরখানেক চিরিরবন্দরে প্রতিনিধি ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আহসানুল হক মুকুল। তাঁদেরও জনসম্পৃক্ততা তেমন নেই। গত ১৫ বছরে এমপির সঙ্গে থাকা এসব প্রতিনিধিরা বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। 

উপজেলা পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদেরও পাত্তা দেন না এমপি
সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, উপজেলা পর্যায়ের নেতাদেরও পাত্তা দেন না সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী। চিরিরবন্দর উপজেলার এক নারী জনপ্রতিনিধি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘চার বছরের বেশি সময় হয়েছে নির্বাচিত হয়েছি, কোনো দিন এমপির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। ইদানীং ভোটের কারণে কিছুটা যোগাযোগ হয়েছে।’ 

খানসামা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ–সভাপতি আমিনুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা নেতারাই ওনার সঙ্গে দেখা করতে পারি না, আর সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা! তিনি প্রতিনিধি দিয়ে কাজ করেন, দলীয় নেতা–কর্মী ও জনগণের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা নাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা গিয়েও ওনার সঙ্গে দেখা করতে পারি নাই।’ 

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অকপটে স্বীকার করেছেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তিনি চিরিরবন্দরে নির্বাচনী সভার আগে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি নির্বাচনী এলাকার মানুষদের বলেছি, সংসদ বসে ঢাকায়, ওখানে না থাকলে কাজ হবে না। তাই মাঝে মাঝে এলাকায় আসব, কিন্তু রাস্তা দিয়ে যেতে খালি সালাম দেব, খেতে বসে সানকিতে ভাত খাব, এটা আমি পারব না।’ তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের দুঃখের কথা শুনলে তো কাজ হবে না। আমি কিন্তু ওটা পারব না। আপনারা যদি চান কাজ করব, না হলে ছেড়ে দেব। আমি কিন্তু অন্যরকম লোক।’ 

ট্রাকের ধাক্কায় ডুবতে পারে নৌকা
দিনাজপুর–৪ (চিরিরবন্দর–খানসামা) আসনে নৌকার প্রার্থী সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ছাড়াও তিনজন প্রার্থী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে নৌকার শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হতে পারেন সদ্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ট্রাক মার্কার স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য তারিকুল ইসলাম তারিক। আসনটিতে পোস্টার, মাইকিং, সভা–পাল্টা সভায় ভোট অনেকটা জমে উঠেছে। 

ভোটার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বর্তমান সরকারের সময় সারা দেশে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু দিনাজপুর–৪ আসনে সেই উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। দলীয় নেতা–কর্মী, সাধারণ মানুষ, কারও জন্য তেমন কাজে আসেননি তিনবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। এতে দুই উপজেলার আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়েছে। দলের নেতাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে ভোটের মাঠে সরব। এ ছাড়া সরকার বিরোধী বিএনপি–জামায়াতের ভোট ব্যাংকও স্বতন্ত্রের দিকে গড়াতে পারে। 

চিরিরবন্দর উপজেলার আতারবাজারে ট্রাক প্রতীকের একটি নির্বাচনী সভায় কথা হয় স্বতন্ত্র প্রার্থী তারিকুল ইসলাম তারিকের সঙ্গে। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ও জনগণের চাপে আমি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি। আমি নির্বাচনে না আসলে শতকরা পাঁচজন লোকও ভোট কেন্দ্রে যেত না। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো না। মানুষের সঙ্গে আমার যে সম্পৃক্ততা রয়েছে, তাতে বলতে পারি, নির্বাচনে ১২ আনা ভোট আমি পাব।’ তিনি দাবি করেন, বিএনপি–জামায়াতের একটি অংশও তাঁকে ভোট দেবে। 

দিনাজপুর–৪ আসনে ১৯৮৬ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত চারবার আওয়ামী লীগ, তিনবার বিএনপি, একবার ওয়ার্কার্স পার্টির থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলেন। এ আসনে দুটি উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নে ১৩০টি কেন্দ্রে মোট ভোটার রয়েছেন ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৮২২ জন। 

 (প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন চিরিরবন্দর ও খানসামা উপজেলা প্রতিনিধি)

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত