Ajker Patrika

উদ্বেগভরা সময় পেরিয়ে তামিমের ফেরা

আহমেদ রিয়াদ, সাভার থেকে
তামিম ইকবাল। ফাইল ছবি
তামিম ইকবাল। ফাইল ছবি

দুই বছর আগে দেশের একটি মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে এক দরিদ্র বাবার হার্টে রিং পরানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তামিম ইকবাল। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস—দুই বছর পর তিনি নিজেই হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত। ৩৬ বছর বয়সে জীবন-মৃত্যুর সীমানায় পৌঁছে গিয়েছিলেন তামিম। তবে সময়মতো সঠিক চিকিৎসায় কাল বড় বিপদ কেটেছে তামিমের।

বিকেএসপি থেকে যখন নিকটবর্তী কেপিজে হাসপাতালে নেওয়া হয়, তখন সেখানে যেন মানুষের ঢল নেমেছিল। কেউ উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে এসেছেন খবর নিতে, কেউবা নিশ্চিত হতে চেয়েছেন, প্রিয় তারকার চিকিৎসা সেরা মানের হচ্ছে কি না। কাল রাতে তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল হওয়ার খবরই মিলেছে। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন তামিম।

গতকালের ম্যাচটা দেবব্রত পালের জন্য শুরু হয়েছিল অন্য সব ম্যাচের মতোই। বিকেএসপিতে সকালে প্রিমিয়ার লিগের মোহামেডান-শাইনপুকুর ম্যাচে তিনি ম্যাচ রেফারির দায়িত্বে ছিলেন। দুই দলের অধিনায়ক তামিম ইকবাল ও রায়ান রাফসানকে নিয়ে সকাল ৯টায় টস করেন। তামিম কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিলেন টসের আগে, ওয়ার্মআপের সময়েই। টস করে ড্রেসিংরুমে ফেরার পর সেটা আরও বাড়ে। মোহামেডান কর্মকর্তা তরিকুল ইসলামকে এ সময় তিনি বলেন, তাঁর সম্ভবত গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হচ্ছে। তারিকুল তখন তাঁকে বলেন, ‘তোমার মাঠে যাওয়ার দরকার নেই। বিশ্রাম নাও।’ কিছুক্ষণ পর তামিম আরও অসুস্থ বোধ করেন। তারিকুলকে তিনি জানান, তাঁর খারাপ লাগছে, মুখের দিকে ব্যথা হচ্ছে।

তারিকুল ও টিম ম্যানেজার সাজ্জাদ হোসেনসহ মোহামেডান দলের সংশ্লিষ্টরা দ্রুত তামিমকে বিকেএসপির কাছের কেপিজে বিশেষায়িত হাসপাতালে নিয়ে যান। এ সময় বিকেএসপির চিকিৎসকও তাঁদের সহায়তা করেন। মোহামেডান কর্মকর্তাদের তিনিই পরামর্শ দেন তামিমকে বিকেএসপির কাছের এই হাসপাতালে নিয়ে যেতে। তামিম নিজের গাড়িতে চড়েই হাসপাতালে যান। সকাল সাড়ে ৯টায় তামিমকে ছাড়াই খেলতে নামে মোহামেডান।

হাসপাতালে নেওয়ার পরই তামিমের ইসিজি ও কয়েকটি প্রাথমিক পরীক্ষা করা হয়। তবে তখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি, তাঁর প্রকৃত অবস্থা কী। দ্রুত ঢাকায় যোগাযোগ করে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হয়, সেটা বিকেএসপির মাঠেও সময়মতো পৌঁছায়। কেপিজে হাসপাতালে প্রাথমিক পরীক্ষায় কিছু ধরা না পড়ায় তামিমও ভেবেছিলেন, ঢাকায় গিয়েই আরও বিস্তারিত পরীক্ষা করাবেন। মোহামেডান কর্মকর্তাদেরও সেই পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।

তবে কেপিজে হাসপাতাল থেকে বিকেএসপিতে ফিরে হেলিকপ্টারে ওঠার আগেই হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তামিম। ম্যাচ রেফারি দেবব্রত জানান, তখন তাঁর মুখ থেকে ফেনা বের হচ্ছিল, পালস পাওয়া যাচ্ছিল না। আকস্মিক এই অবস্থায় উপস্থিত সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। বিকেএসপির চিকিৎসক তখন জানান, পরিস্থিতি সংকটজনক। হেলিকপ্টারে ঢাকায় নেওয়ার পথে সমস্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। দ্রুত কাছের হাসপাতালেই চিকিৎসা শুরু করাই সঠিক উপায়। তামিমের শারীরিক অবস্থার কথা শুনে হেলিকপ্টারের পাইলটও ওড়ার ঝুঁকি নিতে চাননি।

বেলা ১১টা ২০ মিনিটে আবারও কেপিজে হাসপাতালে নেওয়া হয় তামিমকে। অ্যাম্বুলেন্সে যাওয়ার পুরোটা সময় মোহামেডানের ট্রেনার ইয়াকুব চৌধুরী কার্ডিও-পালমোনারি রিসাসিটেশন (সিপিআর) শুরু করেন। বুকে পাঞ্চ করা এই প্রক্রিয়ায় নিঃসাড় হৃৎপিণ্ড আবার সক্রিয় হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তামিমের সঙ্গে থাকা ম্যাচ রেফারি দেবব্রত জানান, তামিম তখন সম্পূর্ণ অচেতন, কারও ডাকেই সাড়া দিচ্ছিলেন না। যখন ট্রেইনার ইয়াকুব তামিমের মুখ খুলে সিপিআর করছিলেন, তখন মুখ দিয়ে লালা ও ফেনা বেরিয়ে এসেছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে উপস্থিত বিকেএসপির চিকিৎসকসহ সবাই সিদ্ধান্ত নেন, কাছের কেপিজে হাসপাতালেই তামিমকে নিতে হবে। হাসপাতালে পৌঁছানোর পরই তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। এ সময় তাঁর পরিবারের সদস্যরাও হাসপাতালে এসে পৌঁছান। কেপিজে হাসপাতালের কার্ডিওলজিস্ট ডা. মনিরুজ্জামান মারুফের তত্ত্বাবধানে জরুরি ভিত্তিতে তামিমের এনজিওগ্রাম, এনজিওপ্লাস্টি ও স্টেন্টিং করা হয়। পরীক্ষায় তাঁর হৃদ্‌যন্ত্রে একটি ব্লক ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে স্টেন্ট বসানো হয়।

তামিমকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় মোহামেডানের ট্রেনার ইয়াকুবের সিপিআর কতটা কাজে দিয়েছে, সেটা পরে দেখাই গেল। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, তামিম কেপিজে হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। তামিমের পাশে ছিলেনে স্ত্রী আয়েশা ইকবাল। বিকেলে জ্ঞান ফেরার পর পরিবারের সদস্য ও চিকিৎসকদের সঙ্গে তামিম কথা বলছেন বলে জানিয়েছেন বিসিবির প্রধান চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী। আগামী ৪৮ ঘণ্টা তামিম পর্যবেক্ষণে থাকবেন, এর মধ্যে প্রথম ২৪ ঘণ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজ সকাল ১০টায় হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তামিমের শারীরিক অগ্রগতির খবর জানাবেন।

বিকেলে এক বিজ্ঞপ্তিতে বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ তামিমের দ্রুত চিকিৎসায় বিকেএসপি ও কেপিজে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তামিমের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিয়েছেন স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তামিমের ভক্ত-সমর্থকদের বিসিবির পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে, অযথা হাসপাতালে ভিড় না করতে। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে তামিমের জন্য দোয়া চাওয়া হয়েছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হার্টে স্টেন্ট বসানোর পর একজন সুস্থ মানুষের জন্যও বিশেষ কিছু গাইডলাইন অনুসরণ করতে হয়। যেখানে ক্রিকেটের মতো খেলায় শারীরিক ফিটনেস সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়। স্টেন্ট মূলত হৃদ্‌যন্ত্রের রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে ব্যবহার করা হয়, যা অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা তৈরি করে। সংকট কাটিয়ে উঠলেও তামিমের মতো একজন পেশাদার ক্রিকেটারের জন্য নিয়মিত অনুশীলন ও ম্যাচ খেলা কতটা নিরাপদ হবে, সেটি নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনার পর অনেক ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের ক্যারিয়ারের পাশে যতিচিহ্ন বসে যায়। তামিমেরও কি তা-ই হতে যাচ্ছে? এখানে তামিমকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে নিজের সুস্থতা ও জীবনমূল্যের হিসাব কষে। প্রিমিয়ার লিগ শুরুর আগের দিনই সংবাদমাধ্যমে বিকেএসপির মতো ঢাকার বাইরে লিগ খেলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন তামিম। সেই শঙ্কা তাঁর ক্ষেত্রেই সত্যি হবে, সেটা কে ভেবেছিল?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত