জিম্বাবুয়েতে আট বছর আগের মুশফিকুর রহিমের ঘটনারই যেন পুনরাবৃত্তি করলেন মাহমুদউল্লাহ! ২০১৩ সালের মে মাসে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ হারের পরই মুশফিক অধিনায়কত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) অনুরোধে পরে অবশ্য তিনি অধিনায়কত্বে আবার ফিরে আসেন। তবে সফরের শেষ দিকে মুশফিকের এই আকস্মিক সিদ্ধান্তে তোলপাড় হয়েছিল দেশের ক্রিকেট।

সেই জিম্বাবুয়েতেই পরশু সফরের মাঝপথে মাহমুদউল্লাহ গুরুত্বপূর্ণ এক সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন দলকে। তৃতীয় দিনের খেলা শেষে ড্রেসিংরুমে টিম মিটিংয়ে অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান সতীর্থদের জানিয়েছেন, হারারে টেস্টই তাঁর শেষ টেস্ট! পরশু রাতে হারারে থেকে দলের একাধিক খেলোয়াড় আজকের পত্রিকাকে বিষয়টি নিশ্চিতও করেছেন।

মাহমুদউল্লাহর এই সিদ্ধান্তে গুমোট এক পরিবেশই তৈরি হয়েছে দলে। অথচ তৃতীয় দিনেই বাংলাদেশ হারারে টেস্টে খুব ভালো অবস্থানে চলে গেছে। মাহমুদউল্লাহর সিদ্ধান্ত চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই টিম ম্যানেজমেন্টের সদস্যরা মুখে তালা মেরে আছেন। খেলোয়াড়েরাও বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। অস্বস্তিতে আছেন ঢাকায় বিসিবির শীর্ষ কর্তারাও। বিসিবির একাধিক পরিচালকের সঙ্গে কাল কথা বলে জানা গেল, মাহমুদউল্লাহর সিদ্ধান্তটা তাঁদের পছন্দ হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পরিচালক বললেন, ‘সে তো আমাদের লিখিতভাবে জানিয়েছে টেস্ট খেলতে চায়। আর অবসরের সিদ্ধান্ত কেন একটা টেস্ট চলার মাঝপথে জানাতে হবে? টেস্ট ম্যাচটা শেষ হওয়ার পর জানাতে পারত।’

প্রশ্ন সেটাই, মাহমুদউল্লাহ কেন টেস্টের মাঝপথেই টেস্ট না খেলার সিদ্ধান্ত জানালেন? তাঁর সতীর্থ ও ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁকে নিয়ে বাংলাদেশ কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর ভাবনা ও মন্তব্য নিয়ে ভীষণ অসন্তুষ্ট ছিলেন তিনি। মাহমুদউল্লাহকে রাসেল ডমিঙ্গো বলেছিলেন, ‘সাদা বলের ক্রিকেট নিয়েই চিন্তা করো।’ এর পরই ফেব্রুয়ারিতে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দল থেকে বাদ দেওয়া হয় তাঁকে। যে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাদ পড়েছিলেন, ১৬ মাস পর সেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট দলে ফিরলেন। অবশ্য জিম্বাবুয়ে সফরে বাংলাদেশ টেস্ট দলে তাঁর নামই ছিল না। সফর শুরুর দুই দিন আগে আকস্মিক দলে জায়গা পান মাহমুদউল্লাহ। এর পরও টেস্ট শুরুর আগের দিনও নিশ্চিত ছিল না তাঁর খেলা। কোনোভাবে সুযোগ পেয়েই খেলেছেন অপরাজিত ১৫০ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। সেটিও কখন? দল যখন চরম ব্যাটিং বিপর্যয়ে, ১৩২ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ যখন ধুঁকছে!

কঠিন পরিস্থিতিতে আটে নেমে ‘লাইফ টাইম ইনিংস’ খেলে সব উপেক্ষার জবাব দেওয়া মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে চারদিকে এখন প্রশংসার বন্যা। তিনি ঠিক এই মুহূর্তটার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিলেন টেস্টকে বিদায় জানাতে। খেলোয়াড়দের বিদায় নিয়ে প্রচলিত একটা কথা আছে, ‘তখনই বিদায় নাও, যখন সবাই বলবে কেন যাচ্ছ?’ মাহমুদউল্লাহ এ কথাটাই যেন সত্যি করলেন। ঘনিষ্ঠ সূত্রেই জানা গেল, টেস্টে তাঁকে নিয়ে কোচের দৃষ্টিভঙ্গি একাধিক আড্ডায় বলেছেন, ‘কেন ডমিঙ্গো এভাবে বলবেন!’ দক্ষিণ আফ্রিকান কোচ যখন এই মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশে তাঁর আসাটা তখন চার মাসও হয়নি। মাহমুদউল্লাহর প্রশ্ন ছিল, ‘তিনি আমাকে কতটা জানেন?’

দেশের এক অভিজ্ঞ মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যান, যিনি এক যুগের বেশি সময় দলকে উপহার দিয়েছেন অসংখ্য স্মরণীয় মুহূর্ত। আর মাহমুদউল্লাহ ‘লাল বলে চলে না’ বলে যে রায় দেওয়া হয়েছে, পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। গত তিন বছরে টেস্টে বাংলাদেশের তিন সফল ব্যাটসম্যানের তিনি একজন। ১৩ টেস্টে ৪ সেঞ্চুরি একটি ফিফটিতে ৪০ দশমিক ৪২ গড়ে করেছেন ৮৪৯ রান। তাঁর আগে থাকা মুমিনুল হক ১৮ টেস্টে করেছেন ১১৯৫ রান আর ১৫ টেস্টে মুশফিকুর রহিমের রান ১০৬০।

গত তিন বছরে মাহমুদউল্লাহ টেস্টে তাঁর সেরা সময়টাই কাটিয়েছেন। ১০ টেস্টে ১৮ ইনিংসে ৫৪ দশমিক ২৬ গড়ে করেছেন ৮১৪ রান। ১২ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে যে পাঁচটি সেঞ্চুরি পেয়েছেন, তার চারটিই এসেছে এই ১৮ ইনিংসে। গত তিন বছরে যে ব্যাটসম্যান প্রতি ৪ দশমিক ৫ ইনিংসে একটি সেঞ্চুরি পেয়েছেন (বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে যেটি সেরা), তিনি একটি ইনিংসে শূন্য রানে ফেরার ‘অপরাধে’ লাল বলে ‘অচল’ হয়ে যাবেন—এটা মানতেই পারেননি মাহমুদউল্লাহ!

অবশ্য মাহমুদউল্লাহর ক্যারিয়ারে এটিই প্রথম নয়; ২০১৭ সালের মার্চেও তাঁকে টেস্ট থেকে বাদ দিয়েছিলেন তখনকার কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। বাদ পড়ার জবাব দিয়েছিলেন দুই মাস পর চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে কার্ডিফে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি করে। মাহমুদউল্লাহ গত ১৬ মাসে হয়তো এমনই আরেকটি সুযোগ খুঁজছিলেন। কাছের মানুষদের ৩৫ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যান জানিয়েছেন, ক্যারিয়ারকে তিনি আরও লম্বা করতে একটি সংস্করণের খেলা ছাড়তে চান। আর সেটি যে টেস্ট, না বললেও চলছে।

বিসিবির কর্তারা অবশ্য যুক্তি দিচ্ছেন, মাহমুদউল্লাহ এবার কেন্দ্রীয় চুক্তিতে টেস্ট খেলার কথা জানিয়েছেন। এ যুক্তির বিপরীতে তাঁর কাছের একজন বললেন, ‘চুক্তিতে টেস্ট খেলার কথা জানালেও এটা তো আর লিখিত দেননি যে তিনি অবসর নিতে পারবেন না!’