Ajker Patrika

তামিমদের এই কাণ্ডে বিসিবি কি শুধুই দর্শক

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৪, ১৭: ৪৭
তামিমদের এই কাণ্ডে বিসিবি কি শুধুই দর্শক

৩৫তম জন্মদিন কাল তামিম ইকবালের একটু অন্য রকম গেল। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে (ডিপিএল) রূপগঞ্জ টাইগার্সের বিপক্ষে প্রাইম ব্যাংকের হয়ে ৬৭ রান করে ম্যাচসেরা হয়েছেন। ক্রিকেটীয় দিক বিবেচনা করলে জন্মদিন রঙিন করে রাখতে ভালো উপাদানই পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁকে নিয়ে এদিন যে আলোচনা-সমালোচনার ঢেউ, তাতে তামিমের জন্মদিনটা খুব ভালো কাটার কথা নয়। 

বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতিতে একটা দৃশ্য প্রায় দেখা যায়। যে খেলোয়াড় জাতীয় দলের বাইরে থাকেন বা নানা কারণে বাইরে চলে যান—সমর্থকদের কাছে তাঁর একটা ‘হিরো’র ভাবমূর্তি দাঁড়িয়ে যায়। তাঁর অনুপস্থিতি তখন প্রবল অনুভব হয় সমর্থকদের মনে। যেন তিনি থাকলেই দলের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। গত জুলাই থেকে নানা ঘটনাপ্রবাহে জাতীয় দলের বাইরে থাকা তামিমেরও এমন একটা ‘হিরো’র ইমেজ দাঁড়িয়েছে। যেটি তিনি তাঁর ক্যারিয়ারে খুব কমই পেয়েছেন। তাঁর চাচা আকরাম খান যখন বিসিবির প্রধান নির্বাচক ছিলেন, তখন তাঁকে নানা নেতিবাচক কথা শুনতে হয়েছে। ২০১৫ বিশ্বকাপের সময় তাঁকে নিয়ে যে বিষাক্ত সমালোচনা হয়েছে, তখন ক্যারিয়ারের শেষই প্রায় দেখে ফেলেছিলেন তামিম। নানা বাঁক পেরিয়ে নিজেকে তিনি দেশের সেরা ওপেনার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশের খেলার কথা ছিল ২০২৩ বিশ্বকাপ। কিন্তু গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর—যে ঘটনা ঘটে গেছে, তাতে তাঁর প্রতি বাংলাদেশের বড় একটা ক্রিকেট সমর্থকগোষ্ঠীর বিশেষ সহানুভূতি তৈরি হয়েছে। 

সবশেষ বিপিএলে তামিমের প্রতি সেই সহানুভূতি, সমর্থনের বড় ঢেউ দেখা গেল। যদি টুর্নামেন্টে একটা সমর্থক-জরিপ চালানো হতো, নিশ্চিত তামিমের ফরচুন বরিশালের সমর্থকই বেশি দেখা যেত। তামিমের দলে ছিলেন মাহমুদউল্লাহর মতো পোড় খাওয়া ক্রিকেটার। যিনি বন্ধুর পথে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। সেই তামিম ইকবালের ‘নেতৃত্বে’ গত দুই দিনে এমন এক ঘটনা ঘটেছে, যেটিতে দেশের বেশির ভাগ ক্রিকেটপ্রেমী বিরক্ত, হতাশ, ক্ষুব্ধ। সামাজিক মাধ্যম ছেয়ে গেছে তামিমসহ তারকা ক্রিকেটারদের নিয়ে নেতিবাচক সব পোস্টে। গত কিছুদিনে তামিমের যে ‘হিরো ইমেজ’ তৈরি হয়েছিল, সেটিও নিদারুণ ধাক্কা খেয়েছে। ‘টাকার জন্য ক্রিকেটাররা কত নিচে নামতে পারেন, টাকার জন্য তাঁরা কত সস্তা হতে পারেন’—এ ধরনের মন্তব্য ওয়ালে ওয়ালে ঘুরছে। প্রশ্ন উঠছে সংবাদ সম্প্রচার ও পণ্যের বিপণন নীতি নিয়েও। 

দুই দিন আগে একটি বেসরকারি চ্যানেল ও একটি ওয়েবসাইটের ফেসবুক পেজে একেবারে খবরের আদলে তামিম আর মেহেদী হাসান মিরাজের একটি ফোন কল রেকর্ড ‘ফাঁস’ হয়। এটি যে কোনো খবর নয়, সেদিনই নেটিজেনরা আঁচ করতে পারেন। সমর্থকদের সরল বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞাপনী প্রচারণায় নিজেদের নিকৃষ্ট ব্যবহারের উদাহরণ আগেও দেখা গেছে। সাকিব আল হাসান যেমন—২০২৩ এশিয়া কাপের দল ঘোষণার রাতে নিজের পেজে স্ট্যাটাস দিলেন, ‘আমি আর খেলব না, খেলবে কে জানাচ্ছি।’ পরে জানা গেল এটা একটা মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনী প্রচারণার অংশ। 

ক্রিকেটের প্রতি দেশের মানুষের আবেগ কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞাপনী প্রচারণা দোষের কিছু নয়। উপমহাদেশে এটি হরহামেশাই ব্যবহার হয়। কিন্তু এটি শিল্পিত রূপে ব্যবহার হলে প্রশ্ন তোলার অবকাশ কমই থাকে। বাংলাদেশে বোধ হয় আবেগকে পুঁজি করে বিজ্ঞাপন তৈরির সবচেয়ে কদর্য রূপটাই বেশি দেখা যায়। তামিম-মিরাজের ঘটনাটা এর সবশেষ উদাহরণ। সেই ফোন কল রেকর্ডে মিরাজের উদ্দেশে তামিমকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘যদি অধিনায়ক থাকতাম (জাতীয় দলে) তাহলে তো তোরা এটা করতে পারতি না। এখন আমার দাম নাই, তাই তোরা এসব করছ। অসুবিধা নাই মিরাজ, সময় আমারও তো আসবে। একটা কথা শোন, পৃথিবীটা গোল। তুই ওই সাইডে, আমি এই সাইডে। কালকে আমি ওই সাইডে বসব তুই এই সাইডে আসবি। বিষয়টা ভুলে যাইস না, তোর বড় ভাইকেও বলে দিস।...সময় আমারও তো আসবে। এখন তো ন্যাশনাল টিমে খেলি না, তাতে অনেকের ভাব বেড়ে গেছে।’ 

গতকাল সন্ধ্যায় নিজেরাই একটি ফেসবুক লাইভে এসে তাঁরা বোঝালেন, তামিম-মিরাজের এই সংলাপ ছিল পুরোই সাজানো। এটি একটি মোবাইল ব্যাংক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনী প্রচারণার অংশ। এতে শুধু সমালোচনার ঢেউ ওঠেনি, দর্শক-সমর্থকেরা এতে ভীষণ প্রতারিত বোধও করেছেন। 

যতই বিজ্ঞাপনী প্রচারণার অংশ হোক, দুজন তারকা ক্রিকেটারের এই কথোপকথন শুধুই আপত্তিকর নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) গঠনতন্ত্র ও আচরণবিধি ভঙ্গের শামিল। তামিম কেন্দ্রীয় চুক্তিতে না থাকতে পারেন, কিন্তু তিনি তো বিসিবির বিভিন্ন ঘরোয়া টুর্নামেন্ট খেলছেন। এই বিজ্ঞাপনে তামিমের সঙ্গী মিরাজ বিসিবির চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়। ক্রিকেট বোর্ডের দুর্বল প্লেয়ার ম্যানেজমেন্টও এখানে সামনে আসছে। আচরণবিধির ক্ষেত্রে তারকা ক্রিকেটারদের প্রতি তাদের নমনীয় আচরণের কারণে খেলোয়াড়েরা আরও সুযোগ পাচ্ছেন প্রশ্নবিদ্ধ সব কর্মকাণ্ড ঘটাতে। 

বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে যে উন্মাদনা আর ক্রিকেটারদের যে জনপ্রিয়তা, তার বিপরীতে তাঁদের সাফল্যের প্রসঙ্গও এখন সামনে আসছে। প্রথম ১০টি টেস্ট খেলুড়ে দলগুলোর মধ্যে ৮টিরই কোনো না কোনো আইসিসির টুর্নামেন্ট জেতার রেকর্ড আছে। শুধু বাংলাদেশ আর জিম্বাবুয়ের শোকেস গড়ের মাঠ! গত দুই দশকে জিম্বাবুয়ের যে ভঙ্গুর ক্রিকেট প্রশাসন, তাতে তাদের বড় কিছু জেতা কঠিনও। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের আর্থিক কাঠামো অনেক শক্তিশালী। ক্রিকেট অবকাঠামোও শক্তিশালী হয়েছে আগের চেয়ে অনেক। জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের বেতন, বোনাস, ম্যাচ ফি, সুযোগ-সুবিধা হয়েছে আকর্ষণীয়। নিজেদের তারকাখ্যাতি পুঁজি করে ক্রিকেটাররাও যে যাঁর মতো বিত্তবান হয়েছেন, ব্যবসা করছেন। রাজনীতিতে পর্যন্ত নাম লেখাচ্ছেন। কিন্তু ক্রিকেটে বাংলাদেশের বড় সাফল্য কোথায়?

বাংলাদেশ পুরুষ জাতীয় ক্রিকেট দলের সর্বোচ্চ সাফল্য ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ জয়। যেখানে প্রতিপক্ষ ছিল তুলনামূলক দুর্বল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আয়ারল্যান্ড। যে দল এখনো একটা এশিয়া কাপ জিততে পারেনি, (ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি) বিশ্বকাপের সেমিফাইনালেও উঠতে পারেনি কখনো—তাদের নিয়ে যে উন্মাদনা, আগ্রহ, তাতে বাংলাদেশ দলকে পৃথিবীর সবচেয়ে ‘হাইলি রেটেড ক্রিকেট টিম’ বললে অত্যুক্তি হবে না। সেই দলের তারকা ক্রিকেটাররা যখন মানুষের আবেগ-বিশ্বাসকে পুঁজি করে খুব সস্তা বিজ্ঞাপনী প্রচারণায় অংশ নেয়, মানুষ তাতে হতাশ, ক্ষুব্ধ আর বিরক্ত না হয়ে কি পারে? আর তামিমদের এই কাণ্ডে বিসিবি যেন শুধুই দর্শক!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতের বিপক্ষে সেমির আগেই ধাক্কা খেল অস্ট্রেলিয়া

পরমাণু শক্তিধর হতে চেয়েছিল তাইওয়ান, সিআইএ এজেন্টের বিশ্বাসঘাতকতায় স্বপ্নভঙ্গ

এলপি গ্যাস, তেল, আটাসহ বেশ কিছু পণ্যে ভ্যাট তুলে দিল এনবিআর

চ্যাম্পিয়নস ট্রফি: রিজার্ভ-ডেতেও সেমিফাইনাল না হলে হৃদয়বিদারক সমীকরণ

অমর্ত্য সেনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় যা বললেন জামায়াতের আমির

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত