মানুষের ১০ গুণ কাকতাড়ুয়া আছে যে গ্রামে

ইশতিয়াক হাসান
প্রকাশ : ০২ এপ্রিল ২০২৩, ১৪: ৪৮
আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২৩, ১৫: ১৮

স্বাভাবিক দৃষ্টিতে নাগোরোকে দক্ষিণ জাপানের দুর্গম ইয়া উপত্যকার সাধারণ, নিস্তরঙ্গ একটি গ্রামের মতোই মনে হবে। গাড়ি নিয়ে ছোট্ট গ্রামটির মাঝের আঁকাবাঁকা পথ ধরে যাওয়ার সময় চোখে পড়বে বয়স্ক ব্যক্তিরা বাগানের পরিচর্যা করছেন, বাসস্টপে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছে কোনো পরিবারের সদস্যরা। সবকিছু স্বাভাবিকই মনে হবে। তার পরই আপনার হয়তো খেয়াল হবে এসব ‘মানুষ’ আসলে মানুষ নন। এরা আসলে মানবাকৃতির কাকতাড়ুয়া। আরও মজার ব্যাপার, সংখ্যায় তারা গ্রামটির জনসংখ্যার দশ গুণ।

কাপড়ের তৈরি এই আজব কাঠামোগুলো বানানোর মূল কারিগর তসুকিমি আয়ানো। এই শখের হস্তশিল্পী জীবনের বড় একটি সময় ওসাকা শহরে কাটানোর পর ২০০২ সালে ফিরে আসেন গ্রামে। এখন তাঁর তৈরি তিন শতাধিক কাকতাড়ুয়া বা মানুষের আকারের পুতুল আছে গ্রামটিতে। দেশের তো বটেই, বিদেশি পর্যটকদের কাছেও পরিচিতি পেয়েছে আয়ানোর বানানো কাঠামোগুলো।

‘পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ আমাদের এই ছোট্ট গ্রামে আসবে কখনো ভাবিনি।’ বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের আদলে তাঁর কাকতাড়ুয়া তৈরির ওয়ার্কশপে সাংবাদিককে বলেছিলেন আয়ানো।

কাপড়ের তৈরি এই আজব কাঠামোগুলো বানানোর মূল কারিগর তসুকিমি আয়ানোজাপানের শিকোকু দ্বীপের উপত্যকায় মোটামুটি বিচ্ছিন্ন এক গ্রাম নাগোরোতে পৌঁছানো মোটেই সহজ নয়। বাস পাওয়া যায় না নিয়মিত। নিকটতম রেলস্টেশন, তাও এক ঘণ্টার পথ। তবে এটা প্রতি বছর ৩ হাজার কিংবা এর বেশি পর্যটকের এই গ্রামে আসা ঠেকাতে পারিনি। এদের কেউ কেউ প্রতি বছরই একবার নিয়ম করে হাজির হন গ্রামটিতে।

স্বাভাবিক নিয়মেই সময় বদলেছে নাগোরোর। অন্য জাপানি গ্রামগুলোর মতোই বয়স্ক মানুষেরাই যেখানকার মূল বাসিন্দা। আয়ানোর শৈশবে তিন শতাধিক মানুষের বাস ছিল, এদের মধ্যে ছিল বাচ্চাকাচ্চাসহ অনেক পরিবার। বর্তমানে গ্রামটির জনসংখ্যা ২৯, এদের প্রায় সবার বয়স ৫০-এর বেশি। তরুণেরা পাড়ি জমিয়েছেন জাপানের বড় শহরগুলোতে উন্নত জীবনের আশায়।

বেশিরভাগ পুতুল বা কাকতাড়ুয়া বাইরে খোলামেলা জায়গায় থাকে বলে তিন বছর পর নতুন করে বানাতে হয়গ্রামে ফিরে আসার পর আয়ানো আবিষ্কার করলেন, একসময়কার লোকজনে ভরা গ্রামটি এখন অনেকটাই জনশূন্য। আয়ানো প্রথম কাকতাড়ুয়াটি বানালেন নিজের বাবার মতো করে, আর কাকের থেকে ফসল রক্ষায় এটি ব্যবহার করা শুরু করলেন। এ সময়ই একটি বিষয় খেয়াল করলেন, প্রতিবেশীরা কাকতাড়ুয়াটির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একে ‘হাই’ বলছে। তারপর একটির পর একটি আরও কাকতাড়ুয়া বানাতে লাগলেন, একপর্যায়ে গোটা গ্রাম ভরে গেল কাকতাড়ুয়ায়।

অবশ্য এই কাকতাড়ুয়াগুলো তিনি এমনি এমনি বানাননি। এগুলো তিনি তৈরি করেন গ্রামটির একসময়কার বাসিন্দাদের প্রতিকৃতি হিসেবে। এভাবে তাঁদের স্মরণ করার পাশাপাশি  চেয়েছিলেন ক্রমে ক্ষয়প্রাপ্ত গ্রামটিতে কিছুটা হলেও চাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে।

বাসস্টপে গাড়ির অপেক্ষায় কয়েকজন ‘গ্রামবাসী’প্রথম কয়েকটি কাকতাড়ুয়া অবশ্য জমিতে কাকসহ নানা ধরনের পাখি তাড়ানোর কাজে ব্যবহার করেন। তারপর এমন এক প্রতিবেশী নারীর আদলে একটি কাকতাড়ুয়া তৈরি করলেন। গ্রামে থাকার সময় তাঁর সঙ্গে নিয়মিত কথা বলতেন। এটি বানানোর ইচ্ছা ছিল পুরোনো দিনের কথা স্মরণ করে এই কাকতাড়ুয়া বা পুতুলটির সঙ্গে নিজের মতো করে কথা বলা। 

এভাবে আরও নতুন নতুন মানুষ মারা গেলে তাঁদের মতো করে এবং গ্রামটি থেকে একে একে শহরে পাড়ি জমানো মানুষদের আদলে তৈরি করতে লাগলেন একটির পর একটি কাকতাড়ুয়া। ‘এই কাকতাড়ুয়াগুলো বানানোর আগে এটি ছিল একটি সাধারণ গ্রাম। কেউ সেই অর্থে এর কথা ভাবত না।’ বলেছিলেন আয়ানো।

বিদ্যালয়ে চলছে পড়ালেখাঅবশ্য শুরুতে এই কাকতাড়ুয়াগুলোর কথা খুব বেশি মানুষ জানত না। তার পরই ফ্রিটজ শুমান নামের এক জার্মান চলচ্চিত্র নির্মাতা গ্রামটিতে আসেন। আয়ানোর কাকতাড়ুয়াদের নিয়ে ‘ভ্যালি অব ডলস’ নামের একটু শর্ট ডকুমেন্টারি বা তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন তিনি। আর এটাই শুধু জাপান নয়, গোটা পৃথিবীর নজরে নিয়ে এল তকুশিমার ছোট্ট এই গ্রামকে।

মজার ঘটনা, বেশির ভাগ পুতুল বা কাকতাড়ুয়া বাইরে খোলামেলা জায়গায় থাকে বলে এগুলোর মেয়াদ তিন বছর। তারপর আবার নতুন করে তৈরি করতে হয়।

জড়ো করে রাখা কাঠের পাশে কয়েকটি কাকতাড়ুয়াগ্রামটি ভ্রমণে এলে একজন দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজের ভঙ্গিতে দেখবেন কাকতাড়ুয়াগুলোকে। মাথায় শক্ত টুপি পরা নির্মাণশ্রমিকেরা একটি সড়ক নির্দেশক স্থাপন করছে, গাছপালার মাঝখানে দাঁড়িয়ে উদ্দাম নদীর দিকে তাকিয়ে আছে একজোড়া নর-নারী। বুট পরিহিত এক জেলে পাশে মেয়েকে নিয়ে ঘরের রোয়াক বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। এ ধরনের আরও কত দৃশ্য তৈরি হয়েছে, যেগুলো হঠাৎ দেখলে বাস্তব বলেই মনে হবে।

শেষ দুজন শিক্ষার্থী পাশ করে ফেলার পর গ্রামের একমাত্র বিদ্যালয়টি বছর কয়েক আগে বন্ধ হয়ে গেছে। তবে একসময়কার পরিত্যক্ত ওই দালান এখন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও কাল্পনিক চরিত্রের সমন্বয়ে একটি অঘোষিত জাদুঘর। একটি শ্রেণিকক্ষে এক ডজনের মতো ‘শিক্ষার্থী’ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে শিক্ষকের দিকে। অবশ্য কাকতাড়ুয়া তৈরিতে এখন গ্রামের অন্যদেরও সাহায্য নেন আয়োনো।

মাঠে কাজে ‘ব্যস্ত’ কাকতাড়ুয়াদের দেখছেন দুই পর্যটক।এখন গ্রামটিতে হয় বার্ষিক কাকতাড়ুয়া উৎসব।  প্রতি বছরের অক্টোবরের প্রথম রোববার হয় এটি। আয়ানোর বাড়িতেও যেতে পারবেন, সেখানে আয়ানোর মৃত মায়ের কাকতাড়ুয়া প্রতিমূর্তিকে দেখা যায় স্নেহমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মেয়ের দিকে।

চাইলে গ্রামটিতে কাকতাড়ুয়া বানানোর প্রশিক্ষণও নিতে পারবেন। প্রতি মাসের চতুর্থ বুধবার বেলা ১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দেওয়া হয় এই প্রশিক্ষণ। তবে ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বন্ধ থাকে এই কর্মশালা। আয়ানো মাটির নানা ধরনের সুন্দর ভাস্কর্যও তৈরি করেন। এগুলোও দেখতে পাবেন গ্রামটিতে গেলে। 

অতএব জাপান ভ্রমণে কাকতাড়ুয়াদের গ্রামে একটি বার ঘুরে আসতেই পারেন, কী বলেন? তকুশিমার মাউন্ট তসারাগি যাওয়ার পথে বিখ্যাত ডাবল ভাইন ব্রিজের রাস্তা ধরে গেলেই পৌঁছে যাবেন সেখানে। গ্রাম পর্যন্ত বাস যায় সপ্তাহে কেবল একবার। কাজেই একটা গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে যাওয়াই সুবিধাজনক।

সূত্র: সিএনএন, ম্যাড অর নোমাড ডট কম

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি চাকরিজীবীরা সম্পদের হিসাব না দিলে যেসব শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন

শেখ হাসিনাকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে এম সাখাওয়াতের বিস্ফোরক মন্তব্য, কী বলেছেন এই উপদেষ্টা

শিক্ষকের নতুন ২০ হাজার পদ, প্রাথমিকে আসছে বড় পরিবর্তন

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

শ্রীপুরে পিকনিকের বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু, আহত ৩

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত