রহস্যময় আগুনে জ্বলত ইতালির যে গ্রাম

ইশতিয়াক হাসান
আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২৩, ১১: ৫৩
Thumbnail image

কেনেতো দি কেরোনিয়া ইতালির সিসিলির মেসিনা প্রদেশের ছোট্ট এক গ্রাম। খুব বেশি মানুষের বসবাসও নেই এখানে। সিসিলি ভ্রমণে আসা পর্যটকেরা জায়গাটি কোনো কারণে অতিক্রম করলেও একবারের বেশি দুবার তাকাতেন না। তবে ২০০৩ সালের শেষ দিকে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটতে শুরু করে কেনেতো দি কেরোনিয়া গ্রামে। স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখের সামনে কোনো কারণ ছাড়া হঠাৎই বিভিন্ন জিনিসপত্র ও বাড়ি-ঘরে আগুন ধরে যেতে থাকে। বলা চলে, রহস্যময় এই আগুন ইতালি তো বটেই, গোটা পৃথিবীর মানুষের কাছেই পরিচিত করে তোলে ছোট্ট এই গ্রামকে। 

চোখের সামনে এভাবে কারণ ছাড়া একটার পর একটা অগ্নিকাণ্ড দেখে স্থানীয় বাসিন্দারা বেশ ভড়কে গেলেন। নানা কুসংস্কারের জন্ম দিল এটি। যাঁরা ঘটনাগুলো সরাসরি দেখেছেন তাঁদের কেউ একে শয়তানের কেরামতি বলে দাবি করলেন। কেউ কেউ আবার এর জন্য দায়ী করলেন ইউএফও, অর্থাৎ ভিনগ্রহ থেকে আসা যানকে। 

রহস্যময় আগুনে পুড়ে যাওয়া একটি ঘররহস্যময় আগুনের শুরু
কেনেতো দি কেরোনিয়ায় প্রথম এই সমস্যার শুরু ২০০৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর। নিউইয়র্ক টাইমস রিপোর্ট করে, রহস্যময় আগুন ও ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে বেশ কয়েকটি জায়গায়। এতে পুড়ে যায় গ্রামটির ৯টি বাড়ি। ১৭টি পরিবারকে ঘরছাড়া হতে হয়। প্রথম আগুনের সূত্রপাত স্থানীয় বাসিন্দা অ্যান্টোনিও নিনো পেজিনোর একটি টেলিভিশন বিস্ফোরণ এবং এতে আগুন জ্বলে ওঠার মাধ্যমে। 

বড়দিনের ঠিক আগে ঘটনার শুরু। গ্রামবাসী তখন উৎসবের আমেজে ছিল। এর মধ্যেই ঘটতে থাকে একটির পর একটি ঘটনা। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি রীতিমতো ভুতুড়ে। বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়া নেই এমন শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রে হঠাৎই আগুনের শিখা দেখা যায়। অপ্রত্যাশিতভাবে গলে যায় গ্রামের ফিউজ বাক্সগুলো। আশ্চর্যজনকভাবে দরজায় লাগানো তালাগুলো হঠাৎ ঝনঝন শব্দে কাঁপতে শুরু করে। যেন দরজা থেকে আলাদা হয়ে যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

এ ধরনের একটার পর একটা ঘটনার জন্ম হতে থাকে ২০০৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এ সময় ভয়াবহ এক আগুনে গ্রামের ৩৯ জন বাসিন্দা ঘরছাড়া হয়। গ্রামবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, আর ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা না থাকায় আরও বেশি হতভম্ব হয়ে পড়ে তারা। ঘরে ফিরতেই সাহস পাচ্ছিল না। মানুষ এতটাই আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল যে মেয়র পেদরো স্পিনাতো ইতালির ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সির সঙ্গে মিলে গ্রামবাসীদের পাশের এক গ্রামের হোটেলে সরিয়ে নিতে বাধ্য হন। পরে জুনের দিকে কিছুটা সাহস ফিরে পান তাঁরা, ঘর-বাড়ি মেরামত করে ফিরতে শুরু করেন।

কেনেতো দি কেরোনিয়া গ্রামশয়তান প্রবেশের গুজব
গ্রামবাসীদের নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানোর পর মেয়র আগুনের ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দেন। ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ শুরু হয় তদন্ত। এক মাস পর আবার শুরু হলো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। কর্তৃপক্ষ সব ধরনের বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেন গ্রামের। বিদ্যুৎ বিভাগ ইতালির ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলও তদন্ত শুরু করে রহস্যময় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে। কিন্তু এর গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধান বের করায় ব্যর্থ হলো তারা। আর এই ব্যর্থতায় গুজবের ডালপালা ছড়াল। কেউ দেখলেন এতে শয়তানের হাত, কেউ আবার এর সঙ্গে জড়ালেন ইউএফওকে।

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব এক্সরসিস্টস ফাদার গ্যাব্রিয়েল অ্যামোর্থ গার্ডিয়ানের কাছে দাবি করেন এই অগ্নিকাণ্ডের একটিই ব্যাখ্যা আছে, ‘এ ধরনের ঘটনা তখনই ঘটে, যখন শয়তান কোনো এলাকার মানুষের জীবনযাত্রায় ঢুকে পড়ে, অর্থাৎ যারা তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয় তাদের।’ 

অনেক গ্রামবাসী রহস্যময় আগুনের সঙ্গে অতিপ্রাকৃত কিছুর সম্পর্ক আছে বলে দাবি করেনসাময়িকভাবে বন্ধ হলো আগুন
তবে কিছু মানুষ কেনেতো দি কেরোনিয়ার অগ্নিকাণ্ডে অতিপ্রাকৃত কিছুর প্রভাব আছে, এটা মেনে নিতে পারলেন না। সার্জিও কন্তে নামের এক টেলিকম বিশেষজ্ঞ সাংবাদিকদের কাছে মত প্রকাশ করলেন, গ্রামের বৈদ্যুতিক তারগুলোর বাইরের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে পরীক্ষা করে দেখেছেন তিনি। তাঁর ধারণা, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এ কাজ করেছে। তবে কন্তে এই প্রশ্ন তুললেও এ ব্যাপারে কোনো প্রমাণ না থাকায় গুরুত্ব পায়নি বিষয়টি। প্রথম অগ্নিকাণ্ডের চার বছর পর ২০০৮ সালের দিকে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড কমতে কমতে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। গ্রামবাসীও ভয় ও রহস্যকে পেছনে রেখে আবার স্বাভাবিক জীবন শুরু করলেন। একে ‘অমীমাংসিত রহস্য’ হিসেবেই বিবেচনা করল মেয়রসহ তদন্তের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো। 

আবার আগুন...
কয়েকটি বছর শান্তই কাটল। তারপর ২০১৪ সালে আবারও রহস্যময় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে শুরু করল গ্রামে। এবার গ্রামবাসী জানাল, আসবাবপত্র, কাপড়ের গাদা এমনকি গাড়িতেও অপ্রত্যাশিতভাবে জ্বলে উঠছে আগুন। আবারও ইউএফওর উপস্থিতিসহ নানা কানাঘুষা শুরু হলো গ্রামবাসীর মধ্যে।

আগুনে পুড়ছে গাড়িএকজন গ্রেপ্তার, কিন্তু রহস্যের সমাধান হলো না
নতুন করে অগ্নিকাণ্ড শুরুর পর গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় সিসি ক্যামেরা বসানো হলো, এতে হয়তো অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানা যাবে এই আশায়। কিছু প্রমাণও মিলল সিসিটিভি ফুটেজে। আর এভাবেই ২০১৫ সালের ৫ মার্চ নতুন অগ্নিকাণ্ডগুলোর জন্য দায়ী করে একজনকে গ্রেপ্তার করা হলো। গ্রেপ্তার হলেন ২৬ বছরের তরুণ গিওসেপ্পে পেজিনো, অ্যান্টোনিও নিনো পেজিনোর ছেলে। তাঁর বাবাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। ইতালির সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী পেজিনোরা আগুন লাগানো শুরু করেন সরকারি সহায়তা পাওয়ার জন্য। তবে নতুন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোর বেশ কিছুর সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিললেও ২০০৩-০৪ সালের মূল অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়ানো সম্ভব হয়নি গিওসেপ্পে পেজিনোকে। এটি অমীমাংসিতই রয়ে গেল।

আগুনে পোড়া ঘরের ভেতরে হতভম্ব এক ব্যক্তিঘটনাটা আসলে কী
এখন গ্রামটিকে এক হিসাবে ‘ঘোস্ট টাউন’ বলা যায়। মূল সড়কের দুপাশে তেমন বসতি নেই। ১৫০-এর নিচে শহরের জনসংখ্যা। তাদের বেশির ভাগ আবার বাস করে চারপাশের পাহাড়ের পাদদেশে। পেজিনো কি তবে সবগুলো অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী? যদি হয়, তাহলে কীভাবে? আচমকা, কোনো কারণ ছাড়াই চোখের সামনে অগ্নিকাণ্ডগুলো ঘটতে দেখেছে গ্রামবাসী। ওই সময় এখানে বাস করা যেসব মানুষ এখনো গ্রামেই আছেন, তাঁরা আজও ভাবেন কীভাবে লেগেছে আগুনগুলো? অতিপ্রাকৃত কোনো শক্তির গ্রামে উপস্থিতির তত্ত্বটা এখনো ঘুরপাক খায় তাদের মাথায়।

শুধু স্থানীয় গ্রামবাসীর নয়, কেনেতো দি কেরোনিয়ার আগুনের রহস্য অবাক করে গোটা বিশ্ববাসীকেই। এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা উঠে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টিভি প্রোগ্রাম দ্য আনএক্সপ্লেইনড ফাইলসে। ২০১৯ সালে কেরোনিয়ার আগুন উঠে আসে টিভি শো আনআইডেন্টিফাইড: ইনসাইড আমেরিকা’জ ইউএফও ইনভেস্টিগেশনে। কী, একটিবার সিসিলি ঘুরে আসবেন নাকি? সেখানকার অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার পাশাপাশি অমীমাংসিত এক রহস্য সমাধানেও নেমে পড়তে পারবেন। 

সূত্র: অল দেট ইন্টারেস্টিং ডট কম, উইকিপিডিয়া

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কারা পরিদর্শক হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক

ট্রাম্পের অভিষেক: সি আমন্ত্রণ পেলেও পাননি মোদি, থাকছেন আরও যাঁরা

ট্রাম্পের শপথের আগেই বার্নিকাটসহ তিন কূটনীতিককে পদত্যাগের নির্দেশ

কিশোরগঞ্জে বিএনপি নেতা হত্যা: সাবেক চেয়ারম্যানসহ গ্রেপ্তার ৪

সংস্কারের কিছু প্রস্তাবে মনঃক্ষুণ্ন বিএনপি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত