যেখানে পাহাড়ের গায়ে কফিনের সারি

ইশতিয়াক হাসান
প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৩, ১১: ১৯
আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৩, ১১: ৪২

ফিলিপাইনের সবচেয়ে বড় ও বেশি জনসংখ্যার দ্বীপ লুজন। এর উত্তরে দুর্গম করডিলেরা সেন্ট্রাল পর্বতমালায় সাগাদা গ্রামের অবস্থান। ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা থেকে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে ঝাঁকি খেতে খেতে সাড়ে আট ঘণ্টায় পৌঁছানো যায় গ্রামটিতে। তবে সেখানে এমন একটি আশ্চর্য বিষয় আছে তা দেখতে অনেক পর্যটকই এই ঝক্কিটা পোহান হাসিমুখে।

সাগাদায় বাস করা ইগোরোট আদিবাসীরা বহু পুরোনো দিন থেকে মেনে চলেছে আশ্চর্য এক রীতি। সেখানে কেউ মারা যাওয়ার পর কফিনে পুরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় পর্বত বা পাহাড়ের গায়ে। আগে থেকে জানা না থাকলে হঠাৎ পর্বতের গায়ে এভাবে শত শত কফিন ঝুলতে দেখে যে কারও শরীরে শিরশিরে একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়বে সন্দেহ নেই।

ইগোরোটরা এই আচার পালন করে আসছে আনুমানিক ২০০০ বছর ধরে। প্রথমে হাতে বানানো কফিনে মৃতদেহ ঢোকানো হয়। তারপর খাড়া পর্বতের গায়ে দড়ি দিয়ে আটকে কিংবা পেরেক মেরে দেওয়া হয়। মাটি থেকে অনেক ওপরে তখন ঝুলতে থাকে কফিনগুলো। ইগোরোটদের বিশ্বাস, এ ধরনের ঝুলন্ত গোরস্থান তৈরি করায় সদ্য মৃতদের আত্মা পূর্বপুরুষদের আত্মার আরও কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে। আরেকটি কারণও আছে, ইগোরোটদের ধারণা আকাশের যত কাছাকাছি থাকবে মৃতরা, পরের জীবনে তাদের আত্মার অবস্থার তত উন্নতি হবে।

বলা হয় এভাবে কফিন ঝোলানোর চল শুরু ২০০০ বছর আগেশুনে অবাক হবেন, বয়স হয়ে গেলে এই গোত্রের মানুষেরা নিজেরাই কাঠ দিয়ে কফিন বানিয়ে একপাশে নিজের নাম লিখে দেন। অবশ্য কেউ মারা যাওয়ার পর কফিনে পুরে ঝুলিয়ে দেওয়ার আগে কিছু আচার পালন করা হয়। প্রথমে মৃতদেহ কাঠের একটি ‘ডেথ চেয়ারে’ বসিয়ে গাছের লতাপাতা দিয়ে বাঁধা হয়। এরপর মৃতদেহটিকে ঢেকে দেওয়া হয় একটি চাদর দিয়ে। পরের কয়েক দিন আত্মীয়-স্বজনেরা শ্রদ্ধা জানান। এ সময়টা মৃতদেহ পচে-গলে যেন দুর্গন্ধ না ছড়ায় সে জন্য একে ধোঁয়া দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আগে এক-একটি কফিন ছিল এক মিটার বা তিন ফুটের মতো লম্বা। এর একটা ব্যাখ্যাও আছে। একজন মানুষ মায়ের গর্ভে যেমন ছিলেন, সেভাবেই তাঁকে সমাধিস্থ করাই ছিল উদ্দেশ্য। তবে পরিবারের সদস্যরা মৃতদেহটিকে চেয়ার থেকে নামিয়ে কফিনে ঢোকানোর সময় ভেতরে ভ্রূণের মতো অবস্থায় স্থাপন করতে হাড়গোড় ভেঙে ফেলতে বাধ্য হতেন। পরবর্তী সময়ে কফিন বড় করে তৈরি করা শুরু হয়। এখন দুই মিটার পর্যন্ত লম্বা কফিনও দেখা যায়। অর্থাৎ এখন স্বাভাবিকভাবেই মৃতদেহ কফিনে পুরে দেওয়া হয়।

‘বিষয়টা অনেকটা মায়ের গর্ভে যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার মতো।’ বলেন স্থানীয় অধিবাসী ও নারী গাইড বানগিয়া।

ঝুলন্ত কফিনের সঙ্গে পর্যটকেরামৃতদেহটিকে রত্তন বা এ ধরনের কোনো গাছের পাতা দিয়ে ঢেকে কফিনে ঢোকানো হয়। তারপর পাহাড়ের গায়ে বড় বড় পেরেক দিয়ে আটকে দেওয়া হয় কফিনটিকে। আর এভাবেই এ ঝুলন্ত গোরস্থানে নতুন একটি সমাধি বা কফিন যুক্ত হয়।

ফিলিপাইনের ইগোরোটদের এভাবে মৃতদের কফিনে পুরে পর্বতের গায়ে ঝুলিয়ে দেওয়ার বিষয়টি আপনাকে চমকে দিলেও এটা কিন্তু পৃথিবীতে একেবারে বিরল নয়। চীন আর ইন্দোনেশিয়ার দুর্গম পাহাড়ি কিছু অঞ্চলেও একসময় এভাবে মৃতদের কফিনে পুরে ঝুলিয়ে রাখা হতো। ওইসব জায়গায় ওই রীতির চল বন্ধ হয়ে গেছে বহু আগেই। তবে সাগাদাতে এটি অব্যাহত আছে। তবে অবশ্যই আগের মতো ব্যাপক হারে নয়। কয়েক বছরের মধ্যেও সেখানে এভাবে মৃত ব্যক্তিকে কফিনে পুরে পর্বতের গায়ে ঝুলিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এখানে যেসব কফিন আছে, সেগুলোর মধ্যে শতবর্ষী কিংবা আরও বেশি বয়সের কফিনও দেখতে পাবেন।

সাগাদায় পর্বতের এক গুহায় স্তূপ করে রাখা কিছু কফিনএকটা সময় নিভৃতেই ইগোরোটরা পালন করে আসছিলেন তাঁদের এই আচার। তবে এখন অনেক পর্যটকই জেনে গেছেন আশ্চর্য এই ঝুলন্ত গোরস্থানের কথা। কফিনগুলো একটিবার দর্শনলাভে লম্বা রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাজির হয়ে যাচ্ছেন পার্বত্য এলাকাটিতে। আর এটা একদিক থেকে ভালোই হয়েছে ইগোরোট জনগোষ্ঠীর জন্য। পর্যটক আসায় আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন তাঁরা।

স্থানীয় বাসিন্দারা এখন গাইড হিসেবে কাজ করছেন। পাহাড়ি পথে পর্যটকদের সঙ্গী হয়ে তাঁদের আরও কাছ থেকে ঝুলন্ত কফিনগুলো দেখার সুযোগ করে দিচ্ছেন। আবার নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নানা বিষয়ের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন।

তবে এটা ঠিক, পুরোনো দিনের তুলনায় এখন সাগাদার পাহাড়ে ঝুলন্ত কফিনের সংখ্যা কমেছে। তবে ঐতিহ্যগত প্রথাটি এখনই বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বোধ হয় কম। কারণ এখানকার প্রজন্মের কোনো কোনো ইগোরোট এখনো এভাবে প্রথা অনুযায়ী মৃত্যুর পরে ঝুলন্ত কফিনে আশ্রয় নিতে আগ্রহী।

সূত্র: বিবিসি, রিপ্লিস ডট কম

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত