যে ‘সাগরে’ ডোবার ভয় নেই

ইশতিয়াক হাসান
প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৩, ১৩: ৪৫
আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২৩, ১৫: ২৫

বিশাল কোনো সাগর বা লেকে আপনাকে নামিয়ে দেওয়া হলো। এদিকে সাঁতারও জানেন না, সঙ্গে দেওয়া হয়নি লাইফ জ্যাকেটও। ভাবছেন নিশ্চয়, এমন পরিস্থিতে বাঁচার আশা ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। তবে জায়গাটি যদি হয় ডেড সি বা মৃত সাগর, তাহলে অবশ্য আপনার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। কারণ সাঁতার না জানাতে সেখানে কিছুই আসে যায় না। যে কেউ ভেসে থাকতে পারবেন সেখানে। কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে বরং ডেড সি সম্পর্কে আরও কিছু মজার বিষয় জেনে নেওয়া যাক।

জর্ডান আর ইসরায়েলের সীমানায় অবস্থান মৃত সাগরের। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু জায়গা বা লোয়েস্ট পয়েন্ট। সাগর সমতল থেকে প্রায় ১ হাজার ৩০০ ফুট নিচে এর অবস্থান। এখন নিশ্চয় আপনার মনে প্রশ্ন জাগছে, একটি সাগর কীভাবে সাগর সমতল থেকে নিচে অবস্থিত হতে পারে! আসলে নামে ডেড সি হলেও এটি মোটেই সাগর নয়, বরং এটি একটি হ্রদ। এর সঙ্গে যদি তুলনা করেন উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে নিচু জায়গা ডেথ ভ্যালি সাগর সমতল থেকে কেবল ২৮২ ফুট নিচে অবস্থিত।

পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু রাস্তা ইসরায়েলের হাইওয়ে ৯০ চলে গেছে ডেড সির পশ্চিম তীর ঘেঁষে। সাগর সমতল থেকে রাস্তাটি ১ হাজার ২৮৯ ফুট নিচে অবস্থিত। 

মৃত সাগরের কালিয়া সৈকতডেড সির আয়তন ৬০৫ বর্গকিলোমিটার। এটি কিন্তু বেশ গভীরও। সর্বোচ্চ গভীরতা কত শুনলে চমকে উঠবেন, ১ হাজার ৩০০ ফুটের কাছাকাছি। 

পৃথিবীর সবচেয়ে লবণাক্ত জায়গাগুলোর একটি ডেড সি। সাধারণ সাগরের পানি থেকে দশ গুণ বেশি লবণ আছে এখানে। এখানকার প্রচণ্ড গরম ও শুকনো আবহাওয়ার কারণে প্রচুর পানি বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। এ কারণে লবণসহ অন্য খনিজ আরও বেশি ঘনীভূত হওয়ার সুযোগ পায়। অনুমান করা হয়, গোটা মৃত সাগরে ৩ হাজার ৭০০ কোটি টন লবণ আছে। 

পৃথিবীর নিম্নতম জায়গাএবার তাহলে শুরুর ওই প্রসঙ্গে আসা যাক, মানে সাঁতার না জানলেও ডেড সিতে নামলে আপনাকে কেন দুশ্চিন্তায় ভুগতে হবে না, সে বিষয় আরকি! এখানকার উচ্চমাত্রার লবণের কারণে পানির ঘনত্ব অনেক বেশি। এতে প্রাকৃতিকভাবেই প্লবতা বেড়ে যাওয়ায় সহজেই ভেসে থাকবে আপনার শরীরটা। 

তবে এখানে সহজে ভেসে থাকা গেলেও সাঁতার কাটা কিন্তু মোটেই সহজ নয়। বিষয়টি অনেকটা এ রকম, আপনি ভেসে থাকতে পারছেন কিন্তু শরীরের ওজন আবার অনুভব করছেন। সবকিছু মিলিয়ে তখন আপনার জন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো নাড়াচাড়া করা কঠিন হবে। তাহলে পানিতে আরাম করে শুয়ে শুয়ে পত্রিকা পড়ার যে ছবিগুলো আমরা দেখি সেগুলোর কী হলো। এগুলো অবশ্যই বাস্তব। তবে শুরুতে এভাবে অবস্থান নিতে একজন মানুষকে কেমন বেগ পোহাতে হয় তা অবশ্য ছবি দেখে বোঝা যায় না। 

জর্ডানের তীরে পানি নিচে নামায় সাদা লবণের উপস্থিতি পাহাড়ের গায়ে।মৃত সাগরে লবণ ও খনিজের পরিমাণ অনেক বেশি থাকার মানে এখানকার পানির রোগ নিরাময়ের ভালো ক্ষমতা আছে। ত্বকের নানা ধরনের সমস্যা দূর করতে মানুষ এই জলে নামে। এক হিসাবে নিখরচায় স্পার জন্য স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকদের কাছে খুব জনপ্রিয় এটি। তেমনি এর তীরে গড়ে উঠেছে অনেক স্পা সেন্টার। অবশ্য এখানকার জলের এই বিশেষ ক্ষমতার কথা মানুষের জানা ছিল বহু আগ থেকে। বলা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ৪ থেকে ৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করা সম্রাট হরোড দ্য গ্রেট পৃথিবীর প্রথম হেলথ স্পাগুলোর একটি গড়ে তোলেন এর তীরে। কিংবদন্তি অনুসারে ক্লিওপেট্রার ভারি প্রিয় জায়গা ছিল মৃত সাগর, নিজের রূপচর্চায় এখানকার বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করতেন। 

মৃত সাগরে ভেসে আছেন এক দম্পতিতবে শরীরে কোনো ক্ষত নিয়ে মৃত সাগরে না নামাই ভালো। কেন? লবণের কারণে তখন ক্ষতস্থান জ্বলবে আপনার। তার মানে, ডেড সিতে নামার আগে শেভ বা দাড়ি-গোঁফ না কাটাই উত্তম। 

ডেড সিতে এক দেশে থেকে আপনি আরেক দেশ দেখতে পারবেন। অর্থাৎ মৃত সাগরের জর্ডানের অংশের তীরে দাঁড়িয়ে আপনি ইসরায়েলের পশ্চিম তীর দেখতে পারবেন। আবার ইসরায়েলের সীমানায় দাঁড়িয়ে দূরে দেখতে পারবেন জর্ডানের ভূভাগ। 

ডেড সির তীরে নুড়ি পাথরউচ্চমাত্রার লবণের উপস্থিতির কারণে এখানে কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদের বেঁচে থাকা মুশকিল। ব্যাকটেরিয়াসহ আণুবীক্ষনিক কিছু জীবাণু আর জলজ দু-চারটি উদ্ভিদ ছাড়া এখানে আর কোনো উদ্ভিদ বা প্রাণের উপস্থিতি পাবেন না। 

ডেড সিতে সূর্যস্নানে অন্য জায়গার তুলনায় সানবার্ন বা ত্বক সূর্যতাপে পোড়ার আশঙ্কা কম। এর কারণ, ডেড সির অবস্থান সাগর সমতল থেকে বেশ নিচে হওয়ায় প্রাকৃতিক তিনটি স্তরের ছাঁকনি পেরিয়ে তবেই আসতে হয় ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মিকে। 

মহানন্দে আছেন দুই পর্যটকআধুনিক প্রত্নতত্ত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর একটির জায়গা এটি। ১৯৪৭ সালে এর উত্তর-পশ্চিম তীরে গুহার মধ্যে পাওয়া যায় বিখ্যাত ডেড সি স্ক্রল। প্রাচীন ওই পান্ডুলিপি খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০ সাল থেকে ৬৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যকার কোনো এক সময়ের। 

ডেড সির আরেকটি আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, ছোট ছোট নুড়ি আর অ্যাসফাল্ট এর গভীর থেকে সমতলে উঠে আসে কোনো প্রক্রিয়ায়। প্রাচীন মিসরীয়রা এগুলো আমদানি করতেন মমি তৈরির কাজে ব্যবহারের জন্য। 

ডেড সিতে ভেসে বই পড়ছেন এক নারীপর্যটকদের খুব প্রিয় এক গন্তব্য ডেড সি। তবে প্রতিবছর এক মিটারের বেশি কমছে এর গভীরতা, আর ১০০ বছর আগে আয়তন যা ছিল, এখন নেমে এসেছে এর অর্ধেকে। তবে এমন দুই-একটা শঙ্কা বাদ দিলে ভ্রমণের জন্য মৃত সাগরের মতো আশ্চর্য জায়গা পাবেন কমই! 

সূত্র: অন দ্য গো ট্যুরস, ইনসাইড দ্য ট্র্যাভেল লেব

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত