বঙ্গদেশে ভাব ও মূর্তি রক্ষার প্রোপাগান্ডা এত দুর্বল! 

গোলাম ওয়াদুদ, ঢাকা
আপডেট : ২০ জুন ২০২৩, ০৯: ০১
Thumbnail image

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই দেখা যায় অনেকে কিছু একটা লিখে বলছে, এটা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এটা আইনস্টাইন বলেছেন বা কাজী নজরুল বলেছেন। অধিকাংশ সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী পাঠক তা বিশ্বাস করেন। কারণ, এ বিষয়ে তাঁদের পড়ালেখা কম অথবা জানাশোনাই নেই। এমনটা যে হবে, সেটা নিয়ে আগেই ভেবেছিলেন আইনস্টাইন। 

নিজের মৃত্যুর পরে কী হবে তা নিয়ে চিন্তিত আইনস্টাইন বলেন, ‘আমার মৃত্যু পর সেদিনের কথা ভেবে খুব ভয় হয়, যেদিন লোকজন আমার ভুয়া উক্তি দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট বানাবে। আসলে আইনস্টাইনের যে উক্তি এখানে লেখা হয়েছে, সেটাও তিনি বলেননি। তাঁর নামে এত এত মিথ্যা প্রচারণা! তাই তাঁর পক্ষে কেউ একজন প্রচারণাটি করেছেন।’ 

আইনস্টাইনের নামে যেমন সত্য-মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়, তেমনি অন্য বিষয়গুলো নিয়েও নিয়মিত ছড়ানো হচ্ছে। এমন তথ্য ছড়ানোকে আপনি দুভাবে দেখতে পারেন। প্রথমত, গুজব, দ্বিতীয়ত, প্রোপাগান্ডা। 

প্রথমেই জেনে নেই গুজব কী। গুজব হলো কোনো ঘটনা সম্পর্কে লোকমুখে প্রচারিত সত্যতা যাচাই বিহীন কিছু কথা বা ব্যাখ্যা। যার কোনো সত্যতা নেই। রাজনৈতিক গুজব এখন বেশি দেখা যায়। গুজব বরাবর রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়ে এসেছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ সম্পর্কে ইতিবাচক গুজবের পরিবর্তে নেতিবাচক গুজব অধিক কার্যকর হতে দেখা গেছে। 

আর প্রোপাগান্ডা হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা। এমন ধরনের পক্ষপাতমূলক ও ভ্রান্ত তথ্য, যা একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বা উদ্দেশের প্রচারণায় ব্যবহৃত হয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা সাধারণত আংশিক সত্য বা আংশিক মিথ্যা প্রচার করে। জনগণের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয় এবং সব ধরনের প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করা হয়। 

২০১৩ সালের কথা নিশ্চয় মনে আছে। কিছু সুযোগ সন্ধানী মানুষ হঠাৎ রাতের বেলা ছড়িয়ে দিল যে চাঁদে জামায়াত নেতা মাওলানা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীকে দেখা যাচ্ছে বা গেছে। এর পর থেকে শুরু হলো এর প্রচারণা। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল এ তথ্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে বিদ্যুতের গতিতে এদিক থেকে সেদিক ছুটল তথ্যটি। এ ঘটনাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা। যেটা থেকে অনেকে ফায়দা নিতে চেয়েছে। আর এই প্রোপাগান্ডাটি একশ্রেণির মানুষ গ্রহণ করেছিল, যার কারণে ৩৪ জেলায় ব্যাপক সহিংসতায় নিহত হয় ৭৮ জন মানুষ।

দেশে আরও অনেক সমস্যা তৈরি হয়েছে গুজব ছড়ানোর কারণে। মতিন সাহেবের মনে প্রশ্ন, গুজব কারা ছড়ায়, কেন এত গুজব ছড়ায়? হুট করে এই প্রশ্নের উত্তর মতিন সাহেবের মাথায়ই চলে এল। নিজেই নিজেকে বলছেন, ওহ সামনে তো জাতীয় নির্বাচন, তাই তো এত প্রোপাগান্ডা-গুজব। এতে করে আখেরে লাভ তো রাজনৈতিক দলগুলোর। 

মতিন সাহেবের হঠাৎ মনে হলো এসব তো বহুকাল ধরে চলে আসছে। হিটলারের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাকারী জোসেফ গোয়েবলসের কথা মনে পড়ল তাঁর। এরপর ব্রিটিশদের পলিটিক্যাল ওয়ারফেয়ার এক্সিকিউটিভ এবং যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব ওয়ার ইনফরমেশনের কথা ভাবছেন, আর মনে মনে বলছেন কেউই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা ব্যবহারে কারও থেকে কম ছিল না। 

ভিনদেশের কথা ভাবতে ভাবতে আবার দেশের চিন্তায় বুদ মতিন সাহেব। বেশ কিছুদিন হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন সত্য-মিথ্যা তথ্য ঘুরপাক খাচ্ছে। আবার এসব যে মিথ্যা বা গুজব বা প্রোপাগান্ডা সেটা সবাই বুঝে যাচ্ছে। মতিন সাহেব নিজ মনে হাসছেন আর ভাবছেন, এরা এত মেধাশূন্য কেন? একটা প্রোপাগান্ডা অল্প সময়ের মধ্য সবাই বুঝে যায় যে এটা আসলে প্রোপাগান্ডা। গোয়েবলসকে দেখে, পড়ে শেখা উচিত বঙ্গদেশের প্রোপাগান্ডা সেলের সদস্যদের। 

সম্প্রতি বঙ্গদেশের কিছু প্রোপাগান্ডার কথা মনে পরে গেল মতিন সাহেবের। কয়েক দিন আগের একটি প্রোপাগান্ডার কথা ভেবেই হতাশ তিনি। এ দেশের প্রোপাগান্ডা বাহিনী এত মূর্খ যে ঠিকঠাক মতো মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে না। কয়েক দিন আগে লোডশেডিংয়ের সময় বলা হচ্ছিল ওমান থেকে ৭৭ জাহাজ কয়লা আসছে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। কিন্তু গুজব বা প্রোপাগান্ডা সেলের লোকজন জানেই না কোন দেশ কী আমদানি বা রপ্তানি করে। গুজব বা প্রোপাগান্ডা ছড়াতে হলেও পড়ালেখার প্রয়োজন সেটা তারা বোঝে না। 

এরপর গত রাতে দেশের প্রথম সারির একটি গণমাধ্যমের কার্ড ব্যবহার করে একটি প্রোপাগান্ডা ছড়ায়। যেখানে বল হয়, জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ হিরো আলমকে ঢাকা-১৭ নির্বাচনের জন্য ২০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় সে টাকা ফেরত চাইছেন পার্থ বলেন হিরো আলম। কিন্তু এ-সংক্রান্ত কোনো সংবাদ ওই গণমাধ্যম প্রচার করেনি এবং তারা সঙ্গে সঙ্গে এটার প্রতিবাদ জানিয়েছে। এটা যে প্রোপাগান্ডা, সেটা অল্প সময়ের মধ্য মানুষ জেনে গেছে। এ ছাড়া আরও অনেক ঘটনা আছে, যেগুলো মানুষ অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারছে যে এটা সত্য নয়। যার কারণে যারা বা যে পক্ষ ছড়াচ্ছে, তাদের ভাব ও মূর্তি উজ্জ্বল না হয়ে আরও ক্ষুণ্ন হচ্ছে। 

মতিন সাহেব মনে মনে ভাবছেন, এরা কি এটা জানে না যে প্রোপাগান্ডা এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন আমজনতা বুঝতে না পারে এটা মিথ্যা। এটাই সত্য এবং শতভাগ সত্য তা যেন মনে করে জনতা, তাহলেই তো উদ্দেশ্য হাসিল হবে, অন্যথায় তাদের ভাব ও মূর্তির অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হবে। দলের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য নেমে ক্ষুণ্ন করে ফেলছে তারা। 

এখন আবার মতিন সাহেবের আইনস্টাইনের একটি কৌতুক বা হাস্যরসের কথা মনে পড়ে গেল। একবার এক অনুষ্ঠানে আইনস্টাইনকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি একটু সহজ করে আপনার তত্ত্বটা আমাদের বোঝাবেন? আইনস্টাইন তখন একটি গল্পটা শোনালেন। আমি একবার বন্ধুর সঙ্গে হাঁটছিলাম। বন্ধুটি ছিল অন্ধ। আমি বললাম, ‘দুধ পান করতে ইচ্ছা করছে।’ বন্ধুটি বলল, ‘পান করা বুঝি, কিন্তু দুধ কী জিনিস?’ 

আমি বললাম, ‘একটা সাদা তরল পদার্থ।’ বন্ধুটি বলল, ‘তরল আমি বুঝি, কিন্তু সাদা জিনিসটা কী?’ বললাম ‘বকের পালকের রং।’ বন্ধুটি বলল, ‘পালক আমি বুঝি, কিন্তু বক কী?’ আমি বললাম, ‘ঘাড় কুঁজো বা বাঁকানো ঘাড়ের এক পাখি।’ সে বলল, ‘ঘাড় সে তো বুঝি। কিন্তু এই কুঁজো কথাটার মানে কী?’ এরপর আর ধৈর্য থাকে, বলুন! আমি তার হাতটা ধরে এক ঝটকায় টান টান করলাম। বললাম, ‘এটা এখন একদম সোজা, তাই না। তারপর ধরো, কনুই বরাবর এটা ভেঙে দিলাম। এবার তোমার হাতটা যেমন আছে সেটাকেই কুঁজো বা বাঁকানো বলে, বুঝলে?’ ‘আহ্!’ অন্ধ বন্ধু বলল, ‘এবার বুঝেছি, দুধ বলতে তুমি কী বুঝিয়েছ।’

লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত