জাপানের যে শহরে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায় হরিণেরা

ইশতিয়াক হাসান
প্রকাশ : ২৪ এপ্রিল ২০২৩, ১৪: ০৭
আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৩, ১৪: ২৮

জাপানের রাজধানী টোকিও থেকে ট্রেনে দুই ঘণ্টার কম সময়ে পৌঁছে যেতে পারবেন নারা শহরে। নারা প্রশাসনিক অঞ্চলের রাজধানী এটি। মন্দির, প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, পৃথিবীর সবচেয়ে কাঠের দালানগুলোর একটি এবং বুদ্ধের বিশাল এক ভাস্কর্যের জন্য শহরটি বিখ্যাত। তবে নারার আরেকটি আশ্চর্য বিষয় আছে, শহরময় মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায় হাজারের বেশি হরিণ। বলা চলে নারাতে যেসব পর্যটক আসেন, তাঁদের একটি বড় অংশই আসেন স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানো এই হরিণদের দেখতে। 

মজার ঘটনা নারা একসময় জাপানের রাজধানীও ছিল। সেটি অবশ্য প্রায় দেড় হাজার বছর আগের ঘটনা। ৭১০ সাল থেকে ৭৮৪ সাল পর্যন্ত প্রাচীন শহরটি জাপানের রাজধানী ছিল। বর্তমানে শহরটিতে মুক্তভাবে বিচরণ করা হরিণের সংখ্যা ১২০০। এগুলোর মূল বাসস্থান অবশ্য নারা পার্ক। 

হরিণদের খাওয়াচ্ছেন এক নারী। ছবি: ফেসবুকস্থানীয় কিংবদন্তি ও গল্পগাথা অনুসারে তাকেমিকাজুচি নামের এক দেবতা পুরোনো শহরের রক্ষাকর্তা হিসেবে হাজির হয়েছিলেন, এক সাদা হরিণের পিঠে সওয়ার হয়ে। আর এ কারণেই পবিত্র প্রাণী হিসেবে নারায় বিবেচিত হয় হরিণ। তেমনি স্থানীয় শিন্তো ধর্মাবলম্বীদের কাছেও এই হরিণেরা পরিচিত দেবতার দূত হিসেবে। একটা সময় পর্যন্ত নারার এই হরিণদের হত্যার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। পরে এ নিয়ম বাতিল করা হয়। যতদূর জানা যায়, এ ধরনের মৃত্যুদণ্ডের ঘটনা সর্বশেষ ঘটে ১৬৩৭ সালে। এখন অবশ্য জাতীয় সম্পদ হিসেবে সংরক্ষণ করা হয় এই হরিণদের। ২০১০ সালে ৪০ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তিকে ১০ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয় তীর-ধনুক দিয়ে একটি হরিণ হত্যার করার অপরাধে। 

সময় এখন বিশ্রামের। ছবি: টুইটারঅবশ্য হরিণদের এখানে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ প্রাণী হিসেবে জায়গা করে নেওয়া নিয়ে আরও নানা গল্পগাথা বা ঘটনা প্রচলিত আছে। ১১৭৭ সালে কুজো কানিজানে নামের এক স্থানীয় গোত্র প্রধান পরিবার-পরিজন নিয়ে জায়গাটি ভ্রমণে আসেন। এ সময় হরিণদের একটি পালের মুখোমুখি হন তাঁরা। এ সময় একটি শিশু ঘোড়ার গাড়ি থেকে বের হয়ে হরিণদের বো করে অভিবাদন জানায়। এর এক যুগ পর ১১৮৯ সালে একটি মন্দিরের পুনর্নির্মাণ কাজ পরিদর্শন করছিলেন কানিজান। এ সময় একটি হরিণ মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করে। অভিভূত কানিজান দুই হাত জড়ো এবং মাথা নিচু করে অভিবাদন জানান হরিণটিকে। তার পর থেকে হরিণেরা আরও বেশি করে শুভ ঘটনার বার্তাবাহী হিসেবে পরিচিতি পায়। 

এক পর্যটকের সঙ্গে খুনসুটিতে ব্যস্ত একটি হরিণ। ছবি: ফেসবুকনারা পার্কের মধ্যেই বেশি দেখা মেলে এই হরিণদের। বলতে পারেন এদের মূল বাসস্থান নারা পার্ক। সেখানে পর্যটক আসেন প্রচুর, খাবারও থাকে অনেক। তবে কিছু কিছু হরিণকে আবার দেখা যায় রাস্তা ধরে ঘুরে বেড়াতে, রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়তে কিংবা খাবার বিক্রি করার জায়গার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। কখনো কখনো খাবারের খোঁজে কোনো পর্যটকের জামার হাতা কামড়াতেও দেখা যায় এদের। গোটা শহরময় স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানো হরিণদের দেখা পাবেন পার্কিং লট, অফিসের সামনে, বাসস্টপ এমনকি স্থানীয়দের বাড়ির সামনেও। এদের কোনো কোনোটিকে শহরের মানুষেরা আদর করে নামও দিয়েছে। 

পর্যটকের পাশে শান্ত হয়ে বসে আছে এক হরিণ। ছবি: ফেসবুকশত শত বছর ধরে মানুষের কাছ থেকে খুব দয়ালু আচরণ পেয়ে এ হরিণেরা বেশ সাহসী হয়ে উঠেছে। কখনো কখনো এদের দু-একটির আচরণ কিছুটা বেপরোয়াও হয়ে ওঠে। যেমন পর্যটকেরা যেখান থেকে হরিণদের জন্য ক্র্যাকার বা বিস্কুট কেনেন, সেখানে হরিণেরা কখনো কখনো কোনো পর্যটককে কোণঠাসা করে ফেলে। এমনকি চাবি কিংবা ক্যামেরা কামড়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। তবে এদের এ সময় বিরক্তিসূচক শব্দ করে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন, তাতেও সমস্যা আছে। কারণ এদের প্রতি একটি অসন্তোষ প্রকাশও অপছন্দ স্থানীয় বাসিন্দাদের। 

তবে তাই বলে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। হরিণেরা মোটেই অকৃতজ্ঞ নয়। এদের বেশির ভাগই খাবার পাওয়ার পর স্থানীয় প্রথা অনুসারে আপনাকে বো করবে অর্থাৎ মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানাবে। 

রাস্তায় বসে থাকতে নেই মানা। ছবি: ফেসবুকএই হরিণেরা অবশ্য অনেক কিছুই এখন বুঝে গেছে। এদের অনেক সময়ই দেখা যায় পার্কের মধ্যে কিংবা বাইরের রাস্তায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সিগন্যাল বাতি পরিবর্তনের অপেক্ষা করছে। এদের অনেককেই মন্দিরের সামনে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। অনেক সময়ই পর্যটকদের সামনে খুব শান্তশিষ্টভাবে পোজ নিয়ে দাঁড়াতেও দেখা যায় তাদের। কোনোভাবে এরা বুঝে গেছে চমৎকার একটি ইনস্টাগ্রাম পিকচারের জন্য ভালোভাবে দাঁড়াতে পারলে প্রচুর পরিমাণে মুখরোচক খাবার মিলবে। 

নারার ট্রেন থেকে নেমে পর্যটকেরা স্টেশনের চারপাশে হরিণদের নিয়ে নানা ধরনের শিল্পকর্মের দেখা পাবেন। এর মধ্যে আছে শিকামারো-কান নামের একটি সুন্দর হরিণের কার্টুন আর শেন্তো-কান নামের শিংসহ একটি শিশু হরিণের মাসকট। এমনকি স্থানীয় ভেন্ডিং মেশিনগুলোতেও দেখবেন হরিণদের নানা ধরনের কার্টুন, ছবি। 

অনেক সময় হরিণদের দেখা যায় ট্র্যাফিক বাতি জ্বলা-নেভার অপেক্ষা করছে। ছবি: ফেসবুক১৮৮০ সালে স্থাপন করা নারা পার্ক জাপানের সবচেয়ে পুরোনো পার্কগুলোর একটি। হরিণদের জন্য বিখ্যাত হলেও সেখানে পাবেন কফোকুজি মন্দির। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কাঠের কাঠামোগুলোর একটি ও ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট তোদাইজি মন্দিরের অবস্থানও পার্কের সীমানায়। শহরেই পাবেন ন্যাশনাল ট্রেজার মিউজিয়াম, যেখানে বৌদ্ধ ধর্মের অনেক নিদর্শন ও শিল্পকর্ম আছে। 

সূত্র: সিএনএন, অ্যামিউজিং প্ল্যানেট

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত