তোমার–আমার জুটি, উন্নয়নের খুঁটি

অর্ণব সান্যাল
প্রকাশ : ১৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১১: ০০
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১২: ৫১

চারপাশে পানি, মাঝখানে তারা দাঁড়িয়ে আছে স্বমহিমায়। তারা খুঁটি। তবে খুঁটির ওপর যার থাকার কথা, সেই স্ল্যাব নেই। বেরিয়ে আছে চোখা চোখা রড। তবে কি সেতু চাইলে এখন থেকে বাঁশের বদলে রড দেওয়া হচ্ছে জনগণকে? 

কর্তারা বলতেই পারেন, বাঁশ দেওয়া গেলে রড কী দোষ করল? আর দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাঁশের বদলে আপগ্রেড হিসেবে রড আসতেই পারে। আর যেকোনো ধরনের ‘উন্নয়ন’ মেনে নেওয়াই উন্নত নাগরিকের লক্ষণ। উন্নতি চাইবেন, কিন্তু রড নেবেন না—তা হবে না, তা হবে না!

এ তো গেল এক জায়গার কথা। দূরে ঠেলার (বিস্তারিত বলছি, সবুর প্লিজ) এই গল্পে নায়ক-নায়িকা আরও আছে। আরেক জায়গায় প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যকার দূরত্ব ঘোচানোই যাচ্ছে না। প্রেমিক মূলত সাধারণ জনগণ আর প্রেমিকা একটি সেতু। তার সঙ্গে জনতা মিলতে চায়, কিন্তু সেতু হাত বাড়াতে পারছে না মোটেই। কারণ, কোনো সংযোগ সড়ক নেই। একদম ‘সে যে বসে আছে একা একা’ অবস্থা। আমি নিশ্চিত, পছন্দের গায়ক শায়ান চৌধুরী অর্ণব এই ছবির সঙ্গে নিজের গাওয়া গানের এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পাবেন! 

এবার ওপরের দুই ঘটনার একটু বিস্তারিত বিবরণে যাওয়া যাক। আজকের পত্রিকার খবরে প্রকাশ, সদম্ভে দাঁড়িয়ে থাকা খুঁটিগুলো পাওয়া যাবে রংপুরের কাউনিয়ার মরা তিস্তা নদীর ওপর। সেতু নির্মাণ নিয়ে সেখানে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। খুঁটি নির্মাণের পর দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও বাকি কাজে হাত দেওয়া হয়নি।

জানা গেছে, মেসার্স মামুন কনস্ট্রাকশন ২০১৯ সালে প্রথম দরপত্রে প্রায় ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ৭৬ মিটার দীর্ঘ সেতুটির একাংশ নির্মাণের জন্য কার্যাদেশ পায়। প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে নির্মাণকাজ শুরু করে আর শেষ করেনি। চুক্তিমূল্যের কার্যাদেশে কাজ শেষের মেয়াদ ছিল ওই বছরের জুনে। এরপর ২০২০ সালের নভেম্বরে দ্বিতীয় দরপত্রে প্রায় ২৯ লাখ টাকা ব্যয়ে সেতুর স্ল্যাব, বিম ও রেলিং নির্মাণের কাজ পায় নুর ইসলাম এন্টারপ্রাইজ। কাজ শেষের মেয়াদ ছিল চলতি বছরের জুনে। কিন্তু কার্যাদেশ পাওয়ার প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো কাজ শুরু করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। স্থানীয় লোকজন জানাচ্ছেন, গত বছরের মাঝামাঝি থেকে কাজ বন্ধ রয়েছে। 

খালের মাঝে সংযোগ সড়কের অভাবে দাঁড়িয়ে আছে ব্রিজআর একা একা বসে থাকা সেতুটি আছে কুড়িগ্রামে। সদর উপজেলার মোঘলবাসা ইউনিয়নের চরসিতাইঝাড়-নয়ারহাট সড়কে দেখা গেছে এমন দৃশ্য। সেতু অবশ্য ঘটনাস্থলে দুটি। একটি বসে আছে, আরেকটি ভেঙে গেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দাবি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সেতু/কালভার্ট প্রকল্পের আওতায় এই সড়কে দুটি সেতু নির্মাণের পর স্থানীয় লোকজন এক সপ্তাহও ব্যবহার করতে পারেনি। সংস্কারের জন্য বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও তা আমলে নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এমনকি স্থানীয় কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি মন্ত্রণালয় থেকে পরিদর্শন করা হলেও পাঁচ বছরেও জনভোগান্তি দূর হয়নি। 

আর এভাবেই জনগণ ও সেতুর মন দেওয়া-নেওয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে খলনায়কেরা। তৈরি হচ্ছে দূরে ঠেলার গল্প। কারণ সেতুর কাছে তো আর মানুষ যেতে পারছে না, দূরত্ব বরং বাড়ছে। সেই দূরত্ব বাড়তে বাড়তে হয়তো একসময় রূপ নেবে সাত সমুদ্র তেরো নদীতে! সেই সব সমুদ্র ও নদীতে শুধু খুঁটি থাকলে কী মনোলোভা দৃশ্যই না হবে! 

নিন্দুকেরা অনুযোগ করে বলতেই পারেন, ধু ধু মরুভূমি থুক্কু শূন্য নদীতে খুঁটি বসাটা কি উন্নয়ন নয়? এগিয়ে যাওয়া নয়? আগে কি এসব ছিল? 

এসব প্রশ্ন শুনলে নিঃশব্দে মেনে নেওয়া নিরাপদ। কে না জানে, বোবার শত্রু নেই! আর উন্নয়নের খুঁটিতে কোন জুটির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, সেটিও মাথায় রাখতে হবে। ওই জুটিতে যে নরম নরম গদি ও গরম-গরম নেতা আছে। নরমে-গরমে চরম মাখামাখি। আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে মিশে থাকে টাকা-পয়সার সুমধুর ঝনঝনানি। একেবারে মণিকাঞ্চন যোগ যাকে বলে! 

মণি ও কাঞ্চনের এই মিলে আর নাক না গলাই। তার চেয়ে বরং খুঁটিগুলোর একটা ব্যবস্থা করা যাক। এভাবে একা একা বসে থাকা সেতু বা খুঁটিগুলোকে কি ভাস্কর্যের মর্যাদা দেওয়া যায় না? তাতে কিন্তু ঢের সুবিধা। পত্রিকার পাতায় খবরও হলো না, আবার মানুষের মনের দুঃখও কমে এল। তখন তো অন্তত সেতু না থাকার কষ্টে দিল পুড়বে না। কেউ কথা শোনাতে এলে মুখে ঝামা ঘষে বলা যাবে, ‘নদীর ওপর সেতু না থাকলেই কী, ভাস্কর্য তো আছে! পাবে পাবে? এমন পাবে?’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত