Ajker Patrika

বিশ্বের প্রথম কবিতার বই, কবিতা দিয়ে সাম্রাজ্য চালিয়েছেন এক নারী

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২৮ অক্টোবর ২০২২, ১৬: ৫৪
বিশ্বের প্রথম কবিতার বই, কবিতা দিয়ে সাম্রাজ্য চালিয়েছেন এক নারী

নথিভুক্ত ইতিহাসের তিনিই প্রথম লেখক। তিনি একাধারে মেসোপটেমিয়ার রাজকন্যা, ধর্মযাজিকা এবং কবি—এনহেদুয়ানা। বিষয়টি বিস্ময়কর নয় কি? সাধারণত মানুষ মনে করে, প্রাচীন কোনো লেখক নিশ্চয়ই একজন পুরুষ। তিনি যে গ্রিসের না হয়ে মেসোপেটিমিয়া সভ্যতার কেউ হবেন, আবার নারী— এটা কারও ধারণাতেই ছিল না।

আগের প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদদের ধারণা ছিল, এমন কোনো লেখক নিঃসন্দেহে প্রাচীন গ্রিসের কেউ। আর যদি হোন নারী তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে সাফো–এর নাম চলে আসবে। অথচ গ্রিসের এই নারী কবি এনহেদুয়ানার সময়ের অন্তত এক হাজার বছর পরে জন্মেছিলেন। তাছাড়া সাফোর যতোটুকু কাজ টিকে আছে তার চেয়ে এনহেদুয়ানার অনেক বেশি কাজ আবিষ্কার করা গেছে।

প্রত্নতত্ত্ববিদেরা দেখেছেন, ৩ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বেঁচে ছিলেন এই মহিলা কবি। কাদা মাটি বা পাথরের ফলকে লেখা রয়েছে তাঁর কবিতা। সেখানে লেখক হিসেবে তাঁর নামটিও এখনো স্পষ্ট।

মেসোপটেমিয়ার স্বল্প পরিচিত এই মহিলা কবিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। প্রদর্শনীটি সেই কালে মেসোপটেমিয়া সাম্রাজ্যে এই মহিলা কবির প্রভাব অন্বেষণ করা হয়েছে। কীভাবে তিনি প্রাচীন সেই সাম্রাজ্যজুড়ে বিশ্বাসের একটি সাধারণ ব্যবস্থা তৈরি করতে সাহায্য করেছিলেন সেটিও খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে।

এই মহিলা কবির নাম খুব কম মানুষই শুনেছে। কারণ ১৯২৭ সাল পর্যন্ত এনহেদুয়ানা সম্পূর্ণ অজানা ছিলেন। প্রত্নতাত্ত্বিক স্যার লিওনার্ড উললি তাঁর নামাঙ্কিত কিছু জিনিসপত্র আবিষ্কার করেন। এখন আমরা জানি, সুমেরীয় ভাষায় তাঁর নামের অর্থ ‘স্বর্গের অলঙ্কার’। চন্দ্রদেবী নান্না-সুয়েনের মহাযাজিকা হিসেবে তিনি ৪২টি মন্দিরের জন্য স্তব এবং তিনটি স্বতন্ত্র কবিতা রচনা করেছেন। গিলগামেশ মহাকাব্যের মতোই মেসোপটেমীয় সাহিত্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয় এটিকে। অবশ্য গিলগামেশ মহাকাব্যের জন্য কোনো নামধারী লেখককে কৃতিত্ব দেওয়া হয় না।

এনহেদুয়ানা ছিলেন সারগন দ্য গ্রেটের কন্যা। একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং যাজক হিসেবে বাড়তি মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। এই সব মিলিয়ে তিনি একচ্ছত্র রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হন। এই নারীই বিশ্বের প্রথম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন বলে মনে করেন ইতিহাসবিদেরা। বিশেষ করে আক্কাদের উত্তর মেসোপটেমিয়া অঞ্চলকে একীভূত করতে অপরিহার্য ভূমিকা রেখেছিলেন। এখানে সারগন প্রথম ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। পরবর্তীতে দক্ষিণে সুমেরীয় নগর-রাজ্যগুলো দখল করেন।

এনহেদুয়ানা সুমেরীয় দেবী ইনানা সম্পর্কিত বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আক্কাদিয়ান দেবী ইশতারের সংশ্লিষ্ট আচারের সংমিশ্রণ ঘটান। তাঁর সাহিত্যিক ও ধর্মীয় স্তব এবং কবিতাগুলোতে দুই দেবীর মধ্যকার মিল ও যোগসূত্রগুলোর ওপর জোর দেন। ফলে সমগ্র সাম্রাজ্যে একটি সাধারণ বিশ্বাসের (ধর্ম) ব্যবস্থা তৈরি হয়। মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের অর্ধাংশের ৪২টি মন্দিরের জন্য এনহেদুয়ানা তাঁর প্রতিটি স্তবেই সেই শহরগুলোর উপাসকদের কাছে স্থানীয় দেবীর অনন্য চরিত্র তুলে ধরেন। এনহেদুয়ানার মৃত্যুর পর শত শত বছর ধরে মন্দিরে মন্দিরে এসব স্তবের অনুলিপি করা হয়।

এনহেদুয়ানার ভাস্কর্যের ধ্বংসাবশেষ। ছবি: সংগৃহীতএনহেদুয়ানার লেখাগুলো নিউইয়র্কের প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। সাধারণ পাণ্ডুলিপির বদলে রাখা হয়েছে কীলক আকৃতির ছাপযুক্ত মাটির ট্যাবলেট (ফলক)। এই ধরনের লেখাকে বলে কিউনিফর্ম। এই প্রদর্শনীর একটি কবিতার নাম ‘ইনান্নার প্রশংসাগীত’। এতে রয়েছে আশ্চর্য সৃজনশীল বর্ণনা প্রক্রিয়া! কবিতার প্রথম কয়েক ছত্র এমন—

“আমি সৃজন করেছি, 
ও, মহিমান্বিত নারী, (এই গান) তোমার জন্য। 
যা আমি (মধ্য) রাতে তোমাতে নিবেদন করেছিলাম
গাতক দুপুরে আবার তোমার সামনে নৈবেদ্য দেবে!”

মন্দিরের স্তবটির উপসংহারে এনহেদুয়ানা দাবি করেছেন, এর লেখক তিনি নিজেই। সেটি স্পষ্ট করেই লেখা রয়েছে—

 ‘এই ট্যাবলেটের রচয়িতা এনহেদুয়ানা। আমার প্রভু, যা এখানে সৃষ্টি করা হয়েছে, তা এর আগে কেউ কখনো সৃষ্টি করেনি।’ 

 ২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘প্রিন্সেস, প্রিস্টেস, পোয়েট’ বইতে মনোবিশ্লেষক ও এনহেদুয়ানার কবিতার অনুবাদক বেটি ডি শং মেডোর লিখেছেন, ‘গানে আমরা যে কণ্ঠটি শুনতে পাচ্ছি তা একজন প্রতিভাধর কবির। তিনি প্রাত্যহিক জীবন, প্রয়োজন এবং দেব–দেবী ও তাদের মন্দিরগুলোর অন্তর্নিহিত প্রকৃতির কথা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি প্রাণবন্ত, চিত্তাকর্ষক এবং নিয়ন্ত্রণ অযোগ্য ঐশ্বরিক বিষয়াদির সঙ্গে তাঁর আশেপাশের মহাজগতকে তুলে এনেছেন তাঁর কবিতায়।

এনহেদুয়ানার কবিতার মধ্যে এমন কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়—যাতে বোঝা যায় গণিতে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। এটা অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু নয়, কারণ ইতিহাসবিদেরা দেখিয়েছেন, গণিতের জন্মস্থানই মেসোপটেমিয়া সভ্যতা। কিউনিফর্ম এবং অন্যান্য প্রাথমিক লিখন পদ্ধতির বিকাশের পাশাপাশি এই সভ্যতায় লেখা এবং গণনা উভয়ই কৃষি ও বস্ত্র অর্থনীতির ভিত্তি তৈরি করেছিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত