Ajker Patrika

এই অনিরাপত্তা ও অস্থিরতার শেষ কোথায়

কাশফিয়া আলম ঝিলিক, ঢাকা 
ছবি: জাহিদুল ইসলাম
ছবি: জাহিদুল ইসলাম

উত্তাল সময়, অস্থির পরিস্থিতি—এই শব্দগুলো যেন পিছু ছাড়ছে না। পথে-ঘাটে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভরে যাচ্ছে আতঙ্কিত মুখ আর উদ্বেগজনক লেখা দিয়ে। নিরাপদে নেই জনপদ। বাসে, ট্রেনে, বাড়িতে—সর্বত্র মানুষ থাকলেও নিরাপত্তা উধাও।

চিরচেনা শহর নাগরিকদের কাছে হয়ে উঠছে আতঙ্কের জগৎ। সহনাগরিকের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে বসে আছেন নারীরা। এর সুষ্ঠু সমাধান যেন নেই কারও কাছে। আলোচনা কিংবা আন্দোলন—কোনোটিই সমাধান আনতে পারেনি; বরং বদল এসেছে শব্দে। শব্দগুলোকেই যেন সুশীল করার চেষ্টা চলছে। আরও চলেছে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা। এই চেষ্টার ফলে দৃশ্যমান কাজ যে খুব হয়েছে, তা কিন্তু বলা যাবে না।

এ বছরের প্রথম দুই মাসে ধর্ষণের শিকার

৯৭ জন। গত বছর একই সময়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ৫১৬ জন কন্যাশিশু ও নারী। শেষ সপ্তাহে ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে শিশুর সংখ্যাই বেশি দেখা গেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ দিনে ধর্ষণের অভিযোগে গড়ে ১২টি মামলা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এ বছরের জানুয়ারি মাসে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৪৪০টি।

৬ মার্চ মাগুরায় আট বছরের একটি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এরপর ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। শিশুটির শারীরিক অবস্থার অবনতি মানুষের ক্ষোভকে আরও উসকে দেয়। বাড়তে থাকে ধর্ষকের শাস্তি ও নারীর নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা। রাতের আঁধারে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী হয়ে উঠতে দেখে দেশ। এর দুই দিন পরে আসে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সেদিনেও গাজীপুরের শ্রীপুরে এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। বনের নির্জন স্থানে আরমান মিয়া নামের এক ব্যক্তি শিশুটিকে ধর্ষণের পর সেই দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করেন। পরে সেই ভিডিও ক্লিপ তিন বন্ধুকে পাঠিয়ে দেন। ওই দিন রাতেই কুমিল্লার লালমাইয়ে কুকুর দিয়ে কামড়ানোর ভয় দেখিয়ে সাত বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধের বিরুদ্ধে। উপজেলার বেলঘর উত্তর ইউনিয়নের ভুশ্চি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এমন বিকৃত মনোভাব কেন, এর উত্তর নেই কারও কাছে।

একদিকে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে উত্তাল দেশ, অন্যদিকে ছড়িয়ে পড়ছে নারী বিদ্বেষ। আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতা নিয়ে মানুষের বেপরোয়া বিভিন্ন আচরণ নারীদের নিরাপত্তা এবং মানসিক অবস্থার অবনতি অবলীলায় ঘটিয়ে যাচ্ছে। চলতি পথে নারীদের পর্দা ও কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হচ্ছে অযাচিতভাবে। আর ধর্ষণের মতো বড় ঘটনায় ভিকটিম ব্লেমিংয়ের চর্চা কোথাও কমতে দেখা যায়নি।

এই অবস্থা নিয়ে আমরা কথা বলেছিলাম মানবাধিকার সংগঠন উই ক্যান নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক জিনাত আরা হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘অপরাধকে সমাজ কীভাবে দেখছে, এটা অনেক বড় বিষয়। ভিকটিমকেই নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। তার পরিবারকে দোষারোপ করা হয়। এই চর্চার কারণে অপরাধীরা এসব বিষয়কে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে। কাউকে অপমান করতে হলে তাঁকে কিংবা তাঁর পরিবারের কোনো নারীকে ধর্ষণ করা যায়—এটাই ভাবে অপরাধীরা।’ ঘটনার পরের ট্রমা কাটানোর ক্ষেত্রেও সমাজ কিছুটা নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে। জিনাত আরা বলেন, ‘এমন অপরাধগুলোর ক্ষেত্রে নারীরা প্রাধান্য পাবে, রাষ্ট্রকে এমন হতে হবে। রাষ্ট্র তার সব সিস্টেম ব্যবহার করে নারীকে প্রোটেকশন দেবে। রাষ্ট্র কঠোর হয়ে উঠলে ধর্ষণের ঘটনা কমে যাবে।’

নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কর্মরত ব্যক্তিদের মতে, নারী ও পুরুষের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও অপরাধকে ছোট করে দেখার কারণে অপরাধীরা অপরাধ করেই যাচ্ছে। অন্যদিকে মামলা হওয়ার পর দীর্ঘ সময় নিয়ে তদন্ত, ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে ডিএনএ প্রতিবেদন দেরিতে দেওয়া, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, বড় অপরাধেও আসামির জামিন হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনায় অপরাধ বাড়ছে। তবে আশার কথা, আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল ধর্ষণের বিচারপ্রক্রিয়ার সময় কমিয়ে ৯০ দিন করার কথা বলেছেন। এর মধ্যে ১৫ দিনে তদন্তকাজ শেষ করার কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব‍্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফিন বলেন, ‘ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো আইনের দুর্বল প্রয়োগ, বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা এবং সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা। অপরাধীরা জানে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শাস্তি এড়ানো সম্ভব, যা অপরাধের প্রবণতা বাড়ায়। প্রমাণ সংগ্রহ ও সাক্ষ্য প্রমাণের জটিলতা ধর্ষণের বিচারকে আরও কঠিন করে তোলে। ভুক্তভোগীদের প্রতি সামাজিক কুসংস্কার এবং ভয় বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। শুধু আইনি ব্যবস্থা নয়, মানুষকেও তাদের নেতিবাচক চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। অবলা ও অনিরাপদ বলে কোণঠাসা করে রাখলে নারী নিজেকে এগিয়ে নিতে পারবে না, যার সরাসরি প্রভাব রাষ্ট্রের ওপরেও পড়বে।’

ভয়ে ভয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়াই যেন একজন নারীর মেয়েবেলা থেকে নারীবেলা হয়ে বুড়িয়ে যাওয়ার গল্প। ১০ মার্চ মোবাইল ফোনে মাগুরার ভুক্তভোগী শিশুটির মা আমাদের বলেন, হাত-পায়ে চাবি দিয়ে আঁচড় দিলে একটু নড়ে। কিন্তু মাথাটা এখনো নাড়াচাড়া করে না।

এই আঁচড়ে সাড়া দেওয়া শিশুটির বাঁচার আকুতি, নাকি সেই ভয়ংকর ঘটনার ভয়াবহতা থেকে আসছে, আমরা সেটা জানি না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চিকিৎসক প্রকাশ্যে জানালেন, ধূমপান করতে চাচ্ছেন তামিম

তামিমের ধূমপানের তথ্য প্রকাশ চিকিৎসকের ‘পেশাগত নৈতিকতা’ লঙ্ঘন

ভাষাশহীদ ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের রাষ্ট্রীয় সালাম দিলেন না ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসপি এহতেশামুল

এআই যে তিন পেশাকে হুমকিতে ফেলবে না, জানালেন বিল গেটস

৪টি জাহাজ কিনতে বাংলাদেশকে ঋণ দেবে চীন: প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত