‘রাষ্ট্রের দায়িত্ব বীরাঙ্গনাদের কাছে যাওয়া’

শাকেরা তাসনীম ইরা
প্রকাশ : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৮: ২০

মুক্তিযুদ্ধ ও জেনোসাইডবিষয়ক গবেষক হাসান মোরশেদ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নারীদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তিনি লিখেছেন ‘নারী সাক্ষ্যে জেনোসাইড’ নামে এক প্রামাণ্য বই। বীরাঙ্গনাদের সংখ্যা, তালিকাভুক্তি এবং এসব প্রশ্নে নারী অধিকারকর্মীদের করণীয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে শাকেরা তাসনীম ইরা কথা বলেছেন তাঁর সঙ্গে।

প্রশ্ন: ইতিহাস থেকে আমরা জানি, ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। সেই হিসাবে বীরাঙ্গনার সংখ্যা ৪৫৬। এই সংখ্যা খুবই নগণ্য। বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

উত্তর: আমাদের এই ধারণা ভুল। নারীদের যৌন সহিংসতার শিকার হওয়ার সঙ্গে তাঁর সম্ভ্রম বা ইজ্জত চলে যাওয়ার কোনোভাবেই কোনো সম্পর্ক নেই। যৌন সহিংসতা একটি অপরাধ। অপরাধকে অপরাধের মতো করেই দেখা উচিত।

তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের ভাষ্যমতে সংখ্যাটা কিন্তু প্রায় ৪ লাখ। ৪৫৬ জন বীরাঙ্গনাকে বাংলাদেশ সরকার গেজেটের অন্তর্ভুক্ত করেছে, এ বিষয়টা প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু ২ লাখ হোক বা ৪ লাখ, স্বাধীনতার ৫২ বছর পার করে গেজেটভুক্ত ৪৫৬ জনের সংখ্যাটা আসলেই খুব কম। আমি বিষয়টাকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক—দুভাবেই দেখছি। ইতিবাচক জায়গাটা হলো, দেরিতে হলেও বীরাঙ্গনাদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। তাঁদের সমান অধিকার ও মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তালিকাভুক্তির সংখ্যাটা খুবই কম। তালিকাভুক্তির কাজ আরও ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন।

প্রশ্ন: তালিকা তৈরির ধীরগতির কারণ কী হতে পারে বা কী কী প্রতিবন্ধকতা বা সীমাবদ্ধতা আছে বলে মনে করেন?

উত্তর: আমলাতান্ত্রিক জায়গা থেকে হয়তো এ কাজকে গতানুগতিক কাজ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে এখানে কিছু প্রতিবন্ধকতা বাস্তবিকভাবেও সত্য। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর পুরো প্রেক্ষাপটই বদলে গিয়েছিল। আমি অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী যে দুঃসময় গিয়েছিল, সে সময়ে তাঁরা অনেকেই রাজনৈতিক বাস্তবতায় নিজেদের পরিচয় গোপন করেছিলেন। একই ঘটনা বীরাঙ্গনাদের ক্ষেত্রেও ঘটেছে।

প্রশ্ন: এই সীমাবদ্ধতা আমরা কীভাবে দূর করতে পারি?

উত্তর: সেই জায়গা থেকে বীরাঙ্গনাদের তালিকা তৈরির কাজটিকে গতানুগতিক কাজ হিসেবে না দেখে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিতে হবে সরকারকে। গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ঊর্ধ্বে গিয়ে গবেষকসহ অন্য যাঁরা এ কাজে সাহায্য করতে পারবেন, তাঁদের নিয়ে এগোতে হবে।

হাসান মোরশেদ।প্রশ্ন: এখন পর্যন্ত সংবেদনশীলতা রক্ষার স্বার্থে বীরাঙ্গনাদের তালিকা রাষ্ট্র নিজ থেকে করছে না। এর পরিবর্তে আহ্বান জানানো হয়েছে যেন বীরাঙ্গনারা নিজ থেকে এসে নাম তালিকাভুক্ত করেন। এই প্রক্রিয়া ঠিক কতটুকু ফলপ্রসূ বলে মনে করেন?

উত্তর: বাহাত্তরের সামাজিক বাস্তবতা আর বর্তমান সামাজিক বাস্তবতা এক নয়। নিজস্ব অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে আমি বলতে পারি, বীরাঙ্গনারা বিচারের দাবি থেকে সরে আসেননি। তাঁদের নির্যাতনের বর্ণনায় কিংবা নির্যাতকের নাম বলায় তাঁরা কখনোই পিছপা হননি। সেই জায়গা থেকে বীরাঙ্গনাদের তালিকাকরণে যে সংবেদনশীলতার কথা বলা হচ্ছে, সেটাকে আমার যৌক্তিক বলে মনে হয় না। আমার মনে হয় বীরাঙ্গনারা এখন নিজেদের কথা বলতে আগ্রহী। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাঁদের কাছে যাওয়া, তাঁদের খুঁজে বের করা।

প্রশ্ন: ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর যুদ্ধাপরাধের আওতাধীন ১১ হাজার অপরাধীর বিচার থেমে যায়। এমনকি দালাল আইনও বাতিল করে দেওয়া হয়। বীরাঙ্গনাদের অধিকার রক্ষায় মামলাগুলোর বিচারপ্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করা উচিত বলে মনে করেন কি না?

উত্তর: দালাল আইন বাতিল হয় ১৯৭৬ সালে। তখনো ১১ হাজার অপরাধী বিচারাধীন অবস্থায় জেলে বন্দী ছিলেন। সামরিক সরকার সেই ১১ হাজার অপরাধীকে মুক্তি দিয়ে দেয়। কেবল যে মুক্তি দেয় তা-ই না, তাঁদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পঞ্চদশ সংশোধনীতে বলা হয়, সামরিক সরকার অবৈধ এবং সামরিক সরকার যেসব অধ্যাদেশ জারি করেছিল, তার সবগুলোই বাতিলযোগ্য। সেই জায়গা থেকে আমরা একটা যুক্তি দাঁড় করাতে পারি, যেহেতু দালাল আইন বাতিল করা হয়েছিল সামরিক অধ্যাদেশে, সেহেতু দালাল আইন পুনর্বহালের আইনগত একটা যৌক্তিক জায়গা আছে।

এ ছাড়া ২০১০ থেকে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) আমরা বহাল রেখেছি। সেখানে এখন পর্যন্ত ৭০টির ওপর রায় হয়েছে। সেখানে নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয় আমলে নিয়ে রায় হয়েছে। এর মধ্যে ময়মনসিংহের রাজাকার কমান্ডার রিয়াজুদ্দীন ফকির এবং হবিগঞ্জের সৈয়দ কায়সারের মৃত্যুদণ্ডের রায়ে নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতার বিষয় আমলে নেওয়া হয়েছিল। কাদের মোল্লার রায়ের ক্ষেত্রেও কবি মেহেরুন্নিসা হত্যার বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়েছে। তার মানে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নারীর প্রতি সহিংসতাকে আলাদাভাবে বিবেচনার সুযোগ রয়েছে বলে আমি মনে করি।

প্রশ্ন: এখনো মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যাকে জেনোসাইডের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সেখানে মুক্তিযুদ্ধকালে ধর্ষণের মতো অপরাধকে জেনোসাইডের আওতাভুক্ত করার ক্ষেত্রে নারী অধিকারকর্মীরা কী ভূমিকা রেখেছেন বা রাখতে পারেন?

উত্তর: ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘ জেনোসাইড কনভেনশন গ্রহণ করে। সেই কনভেনশনের সংজ্ঞা অনুযায়ী, জেনোসাইড একটি সমন্বিত অপরাধ, যা কোনো জাতিকে নিঃশেষ করার উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়। এসব অপরাধের মধ্যে অন্যতম হলো নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা এবং একই সঙ্গে জেনোসাইডের যে মূল উদ্দেশ্য তা হলো, একটি জাতি-গোষ্ঠীর পরিচয় বদলে ফেলা। এর অন্যতম হাতিয়ার ধর্ষণ। সুতরাং জেনোসাইডের স্বীকৃতি পেলে আলাদা করে আর ধর্ষণকে জেনোসাইডের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতাকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছে রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনাল। কাছাকাছি সময়ে বসনিয়া ট্রাইব্যুনাল এটিকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের নারী অধিকারকর্মীদের কাছে একটা সুবর্ণ সুযোগ ছিল বসনিয়া ও রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালের উদাহরণ সামনে রেখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়ানোর। ট্রাইব্যুনাল যাতে বিষয়টিকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দেয়, সে জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারতেন তাঁরা। তবে আমি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেছি, আমাদের এখানে যাঁরা নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁরা ট্রাইব্যুনালের শুরু থেকেই বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। আমি যদি ভুল না করি, রুয়ান্ডা ও বসনিয়া ট্রাইব্যুনালে সেখানকার নারী অধিকারকর্মীরা নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার ব্যাপারে যতটা সরব ছিলেন, আমাদের এখানে তেমনটা এখন পর্যন্ত নেই।

প্রশ্ন: এই মুহূর্তে নারী অধিকারকর্মীদের আসলে কী করা উচিত?

উত্তর: তাঁদের উচিত জীবিত বীরাঙ্গনারা, যাঁরা এখনো বিচারের আশায় লড়ছেন, তাঁদের সাহস দেওয়া। তাঁদের সাক্ষী হিসেবে যেসব প্রান্তিক নারী আছেন, তাঁদের পাশে দাঁড়ানো, তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কাজ করা এবং রাষ্ট্র যাতে তাঁদের ভুলে না যায়, সে ব্যাপারে ভূমিকা রাখা। 

প্রশ্ন: বীরাঙ্গনাদের তালিকাভুক্তি ও সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় তরুণ প্রজন্ম কী ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন?

উত্তর: আমার মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধকে যে আমরা নাটক, সিনেমা বা সাহিত্যে শুধু বীরত্বের মাপকাঠিতে দেখি, সেই চিন্তায় একটা পরিবর্তন আনা উচিত। মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যই বীরত্বগাথা। কিন্তু এর পাশাপাশি সে সময়ে জেনোসাইডের আওতাভুক্ত যে অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে, সেসব বিষয়েও নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। আমি মনে করি, প্রতিটি এলাকার এই নির্যাতনের ঘটনাগুলো পাঠ্যপুস্তকে আসা উচিত। জাতীয় দিবসগুলোতে স্কুল-কলেজে যেসব অনুষ্ঠান হয়, সেখানে বীরত্বগাথার পাশাপাশি নির্যাতনের ঘটনাগুলোও বিশদভাবে আলোচনা করা উচিত। আমাদের নতুন প্রজন্ম যখন এসব জানবে, তখন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি বীরাঙ্গনাদের আলাদাভাবে সম্মান করবে। তারা বুঝতে শিখবে, এই সব নারী একটি স্বাধীন দেশ দেওয়ার জন্য কী অমানবিক ও অসহনীয় নির্যাতন সহ্য করেছেন।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত